ব্যর্থ জাতিসঙ্ঘের কাজটা কী? by মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ
জাতিসঙ্ঘ
গঠন করা হয়েছিল একটি মানবিক বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে
সঙ্ঘাত, যুদ্ধ, আন্তঃরাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও দুর্যোগ মোকাবেলা করে বাসযোগ্য
বিশ্ব গড়ে তোলাই ছিল মূল উদ্দেশ্য; কিন্তু বাস্তবে কার্যকর কোনো সিদ্ধান্ত
গ্রহণ বা বাস্তবায়ন কোনোটাই করতে সক্ষম নয় জাতিসঙ্ঘ। ফলে এর প্রতিষ্ঠার
উদ্দেশ্য ব্যর্থ। হিরোশিমার ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা জাতিসঙ্ঘের
চোখের সামনেই ঘটল ভিয়েৎনামে নাপামের বোমাযজ্ঞ। জাতিসঙ্ঘ গঠিত হলো; কিন্তু
বোমা, যুদ্ধ, অবিচার বন্ধ হলো না। তবে কি আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে
জাতিসঙ্ঘ ব্যর্থ; অকার্যকর হয়ে গেছে বা যাবে? জাতিসঙ্ঘ মূলত বিশ্বের
ক্ষমতাধর শক্তিগুলোর ভাগ-বাঁটোয়ারার বিজনেস ক্লাবে পরিণত হয়েছে। সেই ক্লাবে
বসে ক্ষমতাধরেরা কে কোন অংশের নিয়ন্ত্রণ নেবে, কার তেল দরকার, কে অস্ত্র
বেচবে সেসব হিসাব করা হয়। বর্তমান বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে বলা যায়,
জাতিসঙ্ঘ একটি ব্যর্থ সংগঠন। জাতিসঙ্ঘ নিজেকে সঙ্কুচিত করে এতই ছোট করে
ফেলেছে যে, তাদের কার্যক্রম এখন নিন্দা, আহ্বান ও শোকবার্তা প্রদান,
শান্তিরক্ষী মোতায়েন ও ত্রাণ বিতরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিশ্ব মাত্র পাঁচটি
রাষ্ট্রের কাছে জিম্মি হয়ে আছে ওদের ভেটো পাওয়ার সংরক্ষণের মাধ্যমে।
পৃথিবীর ১৯৫টি রাষ্ট্র চাইলেও কিছু হবে না, যে পর্যন্ত এই পাঁচ রাষ্ট্র
একমত না হবে। শুধু এক রাষ্ট্রের ভেটোই যথেষ্ট যেকোনো শুভ উদ্যোগ ভেস্তে
দেয়ার জন্য। জাতিসঙ্ঘকে ঢাল বানিয়ে পরাশক্তির একেকজন একেকটি রাষ্ট্রে
বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী গড়ে তোলে, আরেক পরাশক্তি গিয়ে তাদের নিধন করে।
তেল-গ্যাস লুট এবং অস্ত্র বিক্রি ও পরীক্ষার বহুবিধ সুবিধা ভোগের বাজারে
পরিণত হয়েছে জাতিসঙ্ঘ, যার ভোক্তা মাত্র পাঁচজন। রাতকে দিন, দিনকে রাত
বানানো যায় মোড়লদের ইশারায়। জাতিসঙ্ঘ যুদ্ধবাজ দখলদারদের দায়মুক্তি দেয়ার
কাজটি করে নিপুণ হাতে। জাতিসঙ্ঘের চোখের সামনে স্বাধীন রাষ্ট্র ফিলিস্তিন
মানবিক কারণে রাষ্ট্রহীন কিছু মানুষকে ঠাঁই দিলো।
আশ্রয় পাওয়া ইহুদিরা
ফিলিস্তিনের দুই-তৃতীয়াংশ দখল করে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করল। এ ক্ষেত্রে
জাতিসঙ্ঘ ব্যর্থ বৈঠক আর বিবৃতি দেয়া ছাড়া কিছুই করেনি। উল্টো ফিলিস্তিনের
স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য লড়াইরত পিএলও এবং হামাসকে সন্ত্রাসী
সংগঠনের তকমাও দিয়েছে জাতিসঙ্ঘ। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ও তার জনগণের সাথে কী
নির্মম পরিহাস। এখনো প্রতিদিন ইঞ্চি ইঞ্চি করে দখল হয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিন।
আশ্রয় দেয়া রোহিঙ্গারা বাংলাদেশকে নিজেদের বলে দাবি করাটা যেমন হাস্যকর,
ইসরাইলের বেলায়ও তাই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও জাতিসঙ্ঘের ভূমিকা মূল্যহীন।
মিয়ানমারে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হলো, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হলো।
১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলো। গ্রামের পর গ্রাম
বুলডোজার দিয়ে মাঠে পরিণত করা হচ্ছে। বাধা দেয়ার কেউ নেই। জাতিসঙ্ঘেরও যেন
কোনো ক্ষমতা নেই বাধা দেয়ার। কারণ চীন ও ভারত মিয়ানমারের পক্ষে। এত বড়
গণহত্যা এবং একটি জাতিকে বাস্তুচ্যুত করার মতো জঘন্য অপরাধের পরও একবার
অবরোধ পর্যন্ত দেয়া গেল না মিয়ানমারকে; কিন্তু রাশিয়া ও আমেরিকা চাইলে
যেকোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সব অবরোধ করা সম্ভব হতো। অবরোধ তো দূরের কথা,
মিয়ানমার জাতিসঙ্ঘের ওয়্যার ক্রাইম ফাইন্ডিং কমিটির কোনো প্রতিনিধিকে তার
দেশ পরিদর্শনের অনুমতি না দেয়ায় এখনো তারা ঘটনাস্থলে যেতে পারেননি।
বাংলাদেশ কতদিন এই ১০ লাখ মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থা করবে?
সিরিয়ার যুদ্ধ, রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ বন্ধ করতে না পারলেও লিবিয়া বা ইরাকে
সিভিলিয়ানদের রক্ষা ও গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র ধ্বংসের নামে রক্তক্ষয়ী
যুদ্ধের আয়োজন করে দিয়েছে জাতিসঙ্ঘ। ন্যাটো জোটকে বিশ্বের যত্রতত্র যুদ্ধের
বৈধতাও দিয়েছে। জাতিসঙ্ঘের ‘প্রোটেকশন অব সিভিলিয়ান’ ও বিভিন্ন প্রস্তাবের
সুবিধা নিয়ে যুদ্ধবাজরা ‘নরক; করে তুলেছে মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, আফ্রিকাসহ
সারা বিশ্বকে। জাতিসঙ্ঘ আমেরিকার পরামর্শে লিবিয়া ও ইরাকে জনগণ ও তাদের
মানবাধিকার, গণতন্ত্র নিয়ে যতটা আগ্রহী, মিয়ানমার, কাশ্মির, ফিলিস্তিন ও
মিসরের ক্ষেত্রে ততটা নয়। কারণ মিয়ানমার, কাশ্মির, ফিলিস্তিন ও মিসরের
সরকারপ্রধানেরা পশ্চিমাদের আপন লোক। সাদ্দাম, গাদ্দাফিদের বিচার হলেও
নেতানিয়াহু, সিসি, অং সান সু চি একই অপরাধ করেও পুরো নিরাপদ। সমতা সৃষ্টির
কথা থাকলেও জাতিসঙ্ঘ বিশ্বকে অসম যুদ্ধের বাজারে পরিণত করেছে। ইরাক,
লিবিয়া, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, আফগানিস্তান, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, কাশ্মিরে
প্রতি মুহূর্তে মানবাধিকার লুণ্ঠিত হলেও নির্বিকার জাতিসঙ্ঘ।
মিয়ানমারের
পাশাপাশি সিরিয়ায় চলছে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। বাশার আল আসাদ সিরিয়ার
বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য রাশিয়াকে ডেকে নিয়েছেন। আট বছরের যুদ্ধে বাশার ও
তার মিত্রবাহিনী বিদ্রোহীদের গৌতা নামে ১০৪ বর্গকিলোমিটারের ভূখণ্ডে চার
লাখ মানুষের একটি জনবসতির মধ্যে ঘিরে রেখেছে। এই বাসিন্দাদের অর্ধেকের
বেশির বয়স ১৮ বছরের নিচে অর্থাৎ শিশু-কিশোর। রাজধানী দামেস্ক থেকে মাত্র ১০
কিলোমিটারের মধ্যে এই এলাকাটি সিরিয়ার বিদ্রোহীদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত।
লড়াইয়ের নামে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে নিরপরাধ বেসামরিক লোকদের। গত ১৫
দিনে নিহত হয়েছে হাজারেরও বেশি লোক। অনেক লাশ ধ্বংস হওয়া বাড়িগুলোর নিচে
চাপা পড়ে আছে। কিংবা ভূগর্ভস্থ বাংকারে আশ্রয় নেয়া অনেক মানুষ বিষাক্ত
গ্যাস হামলায় নীরবে সেখানেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। কেউ তাদের খোঁজ
পায়নি। নিজ দেশের জনগণকে মারার জন্য ভিন দেশী বাহিনী ডেকে আনেÑ এমন নজির
বিশ্বে সম্ভবত নিষ্ঠুর বাশার সরকারই প্রথম স্থাপন করেছে। রাশিয়া তাদের নতুন
নতুন সব মারণাস্ত্রের কার্যকারিতা প্রয়োগের জন্য বেছে নিয়েছে সিরিয়ার
যুদ্ধক্ষেত্র। ফাঁকা মরুভূমিতে যুদ্ধাস্ত্র পরীক্ষার পরিবর্তে সরাসরি
যুদ্ধক্ষেত্রে তা ব্যবহার করছে রাশিয়া। সর্বাধুনিক স্টিলথ প্রযুক্তির
ফাইটার প্লেন সু-৫৭ রাশিয়ার সর্বাধুনিক যুদ্ধপ্রযুক্তির একটি মারণাস্ত্র
হিসেবে গৌতার যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর আগে তারা কয়েক ধরনের
অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে সিরিয়ার নিরীহ জনগণের ওপর। জনগণের
মৃত্যুর হিসাবের চেয়েও তাদের কাছে অস্ত্র পরীক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সেখানেও ব্যর্থ জাতিসঙ্ঘ। নিরাপত্তা পরিষদে ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি পাস হলেও
মানেনি সিরিয়া। এরপরও জাতিসঙ্ঘ সিরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ফলে
সিরিয়ায় মৃত্যুর মিছিল আর মিয়ানমার ও ফিলিস্তিনে উদ্বাস্তুর মিছিল ক্রমেই
বড় হচ্ছে। সিরিয়ার গৌতায় মানবিক সাহায্য পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে বাশার
বাহিনী। সেখানে গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণের খবর বেরিয়েছে বিশ্ব মিডিয়ায়।
ক্ষমতাবানদের ভাগভাটোয়ারা বিশ্বরাজনীতিকে অস্থির করে তুলেছে। ব্যক্তির
ইচ্ছা বা লাভ-ক্ষতির মাশুল গুনতে হচ্ছে বিশ্বের প্রায় ১০০ কোটি মানুষকে
যুদ্ধাবস্থায় বসবাস করে। মানবাধিকার চরমভাবে করা হচ্ছে। বিশ্বে শান্তি
প্রতিষ্ঠায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে জাতিসঙ্ঘ। তাই বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার
জন্য দরকার নতুন কোনো রাষ্ট্রপুঞ্জ, যেখানে মোড়লগিরি বা ভেটো পাওয়ারের
থাকবে না। সমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে এখনই জাতিসঙ্ঘের ভবিষ্যৎ
নিয়ে ভাবা দরকার। নতুবা এভাবে চলতে থাকলে জাতিসঙ্ঘের দায়িত্বহীনতা ও এক
পেশে আচরণের কারণেই আরেক বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হতে পারে।
লেখক : রাজনৈতিক কর্মী
লেখক : রাজনৈতিক কর্মী
No comments