চড়ুই, বিড়াল, বস্তি ও ফায়ার সার্ভিস by সৈয়দ আবুল মকসুদ
ফায়ার
সার্ভিস সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা, এর কর্মীরা অগ্নিকাণ্ডে উদ্ধারকাজ
করেন। পানির ভেতরে দুর্ঘটনা ঘটলে সেখানেও তাঁরা উদ্ধার তৎপরতা চালান।
কিন্তু এর বাইরেও যে তাঁদের কাজের ক্ষেত্র কতটা বিস্তৃত, তা মাঝে মাঝে
সংবাদমাধ্যমে আসে। গত দুই মাসে সে রকম কিছু খবর থেকে বোঝা যায় তাঁদের
কর্মপরিধি কতটা বহুমাত্রিক। গত মঙ্গলবার রাজশাহী নগরের আলুপট্টি মোড়ে
রাস্তার বিদ্যুতের তারে একটি ঘুড়ি আটকে যায়। ঘুড়ির সুতায় ঝুলছিল একটি চড়ুই
পাখি। সহৃদয় একজন ফায়ার সার্ভিসে ফোন করলে তারা দ্রুত এসে চড়ুই পাখিটি
উদ্ধার করে। ‘সঙ্গে সঙ্গে আকাশে উড়াল দেয় ছোট্ট পাখিটি।’ ফায়ার সার্ভিসের
কর্মকর্তা জানান, পাখির একটি পায়ে সুতা আটকে ছিল। তাঁদের দুটি ইউনিট পাখিটি
মুক্ত করার অভিযানে নেমেছিল। তিনি বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস এখন দ্য লাইভ
সেভিং ফোর্স। প্রতিটি প্রাণ রক্ষা আমাদের কর্তব্যের ভেতরেই পড়ে।’ এর কয়েক
দিন আগে কুমিল্লায় একটি বিড়াল কীভাবে যেন এক উঁচু গাছের মগডালে গিয়ে আর
নামতে পারছিল না। দুই দিন ওভাবে থাকার পর লোকজন ফায়ার সার্ভিসকে জানালে
তারা এসে বিড়ালটিকে উদ্ধার করে। তারা উদ্ধার না করলে অনাহারে দুর্বল হয়ে অত
উঁচু থেকে পড়ে হতভাগ্য বিড়ালটি হয়তো মারাই যেত। তার কয়েক দিন আগে
আন্তর্জাতিক মাধ্যমের একটি খবর ছিল তাজ্জব হওয়ার মতো শুধু নয়, বড়ই বেদনার।
ঘটনাটির অকুস্থল লন্ডনের একটি হাসপাতাল হলেও তাতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। প্রতিবেদনে তেমনটিই বলা হয়েছে। এক লোকের লিঙ্গে
একটি আংটি ঢুকে গিয়েছিল। সাত-আটজন বিশিষ্ট সার্জন এবং পুরুষ ও নারী নার্স
ওই আংটি খুলতে যখন গলদঘর্ম, তখন ডাক পড়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। তাঁদের
অক্লান্ত পরিশ্রমে আট ঘণ্টা পর আংটিটি বের করা সম্ভব হয়। কীভাবে আংটিটি ওই
প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের বিশেষ দেহযন্ত্রে ঢুকল এবং আটকে গেল, সে ব্যাপারে
বিপন্ন ব্যক্তিটি কিছু জানাননি। যাহোক, লিঙ্গ থেকে আংটি উদ্ধারে চিকিৎসকেরা
নন, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাই প্রধান ভূমিকা পালন করেন। খবরের
গুরুত্বপূর্ণ অংশ দুটি: পুরুষের বিশেষ অঙ্গে আংটি গিয়ে আটকে যাওয়া এবং
ফায়ার সার্ভিস কর্তৃক তা উদ্ধার। ফায়ার সার্ভিসের মূল কাজ অবশ্য চড়ুই পাখি,
বিড়াল বা কারও দেহযন্ত্রে আটকে যাওয়া আংটি উদ্ধার নয়। ওগুলো কখনো-সখনো
করতে হয়। প্রধান কাজ আগুন নেভানো এবং কোথাও কোনো ভবনে বা পানিতে অথবা অন্য
কোথাও মানুষ বা গবাদিপশু আটকা পড়লে তাদের উদ্ধার করা।
যেমন বাংলাদেশে
পোশাকশিল্প কারখানায় আগুন লাগলে বা রানা প্লাজার মতো কোনো ভবন হাজার হাজার
কর্মী নিয়ে ধসে পড়লে তাঁদের উদ্ধারকাজ চালানো। আমরা দেখেছি ফায়ার সার্ভিসের
কর্মীদের জীবন বাজি রেখে রানা প্লাজা বা তাজরীনে উদ্ধারকাজ চালাতে।
প্রশাসনের অবহেলার কারণে অন্ধ কূপে পড়ে যাওয়া জিহাদের মৃতদেহ উদ্ধার।
পৃথিবীর কোনো কোনো দেশের বনভূমিতে যেমন দাবানল হয়, তার আগুন নেভাতে হয়
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের; বাংলাদেশের বনভূমিতে দাবানলের প্রকোপ না থাকলেও
বস্তিতে দাবানল খুব ঘন ঘনই ঘটে। ১২ মার্চ বাংলাদেশে দুটি বড় দুর্ঘটনার খবর
ছিল। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয় কাঠমান্ডুতে।
প্রাণহানি ঘটে ৫১ যাত্রীর। ঢাকার মিরপুর মোল্লাহপুরী বস্তিতে আগুনে পুড়ে
ছাই হয় পাঁচ হাজারের মতো ঘর। সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে ২৫ হাজার মানুষ।
উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার মর্মান্তিক ঘটনায় বস্তি ভস্মের ঘটনাটি আড়াল পড়ে যায়।
পৃথিবীর বহু আধুনিক শহরের বাসিন্দার সংখ্যাও ২৫ হাজার নয়। আমাদের
বস্তিগুলোতে যাঁরা বাস করেন, তাঁরা সবাই শ্রমজীবী ও উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত।
কেউ পোশাকশ্রমিক, কেউ কারখানার শ্রমিক, কেউ যানবাহনের চালক ও শ্রমিক, কেউ
গৃহকর্মী, কেউবা ছোট দোকানদার-ব্যবসায়ী। এই রিপাবলিকে তাঁদের প্রয়োজন
রয়েছে। এখন বস্তিবাসী কারও ঘরে রয়েছে একটি পুরোনো টেলিভিশন সেট বা ফ্রিজ।
সব হারিয়ে আজ ২৫ হাজার মানুষ নিঃস্ব। এক সপ্তাহেও তাঁরা সরকারি-বেসরকারি
ত্রাণ বিশেষ পাননি, পুনর্বাসনের ব্যবস্থার তো প্রশ্নই আসে না। এক বাসিন্দা
নার্গিস আক্তার বলেছেন, ‘সরকার নাই, এনজিও নাই। থালা নাই, বাটি নাই।
পলিথিনে ভাত আইন্যা পলিথিনে কইরাই খাইতে হয়। এক কাপড়ে জানডা হাতে নিয়া বাইর
হইছিলাম। সেই কাপড়েই আছি।’ (প্রথম আলো, ১৮ মার্চ, ঘটনার পাঁচ দিন পরে।)
সাধারণত আমাদের দেশে বস্তিতে আগুন লাগে মধ্যরাতে, যখন ছেলেমেয়ে নিয়ে মানুষ
ঘুমিয়ে থাকে। আকস্মিক কারণে হোক, রহস্যজনক কারণে হোক বা বোধগম্য কারণে হোক,
আগুনে যখন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে শত শত ঝুপড়িঘর, তখন ফায়ার সার্ভিস ছাড়া
আর গতি নাই। তবে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের কাজ আগুন নেভানো এবং আটকে পড়া
মানুষদের উদ্ধার করা; লুটপাটকারীদের তাড়ানো নয়। বাংলার মাটিতে বস্তিতে বা
বাজারে আগুন লাগলে আগুনে পুড়ে যত জিনিস ছাই হয়, লুটপাটে খোয়া যায় তার চেয়ে
বহু গুণ বেশি। মোল্লাহপুরীতেও তাই ঘটেছে। বস্তিতে আগুন লাগলে শুধু ফায়ার
সার্ভিসের ওপর সব দায়িত্ব চাপিয়ে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা নাকে তেল দিয়ে
ঘুমাতে পারেন না। আগের দিনে তাঁদের দায়িত্বই দেখা যেত সবচেয়ে বেশি। বড় বড়
অগ্নিকাণ্ডে প্রশাসনের লোক, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী,
সমাজসেবী-সবাই ঝাঁপিয়ে পড়তেন। এখন দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখার লোকের সংখ্যা
বেড়েছে, সাহায্যের হাত বাড়ানো মানুষ বিলুপ্তপ্রায়। অথচ বস্তিগুলোর
‘খালা’দের ব্যবহার করছেন সমাজের কেউকেটারা, যাঁরা পাজেরো চালান। তাঁরা
বস্তিতে ‘বাবা’র (ইয়াবার সংক্ষিপ্ত ও কথ্য রূপ) ছোটখাটো আড়ত গড়ে তুলেছেন।
পোড়া বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসা তাঁদের ‘নৈতিক’ কর্তব্য। ফায়ার
ব্রিগেড আগুন নেভায় বস্তির, কিন্তু বস্তিবাসীর বুকের ভেতরের আগুন দাউ দাউ
করে জ্বলে সারা জীবন। মানুষের বুকের আগুন নেভানোর মতো অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র
আজও উদ্ভাবন করেননি কোনো বিজ্ঞানী।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক
No comments