অমর একুশের মাস
গতকাল
শুরু হয়েছে অমর একুশের ভাষা শহীদদের স্মৃতিবিজড়িত ফেব্রুয়ারি মাস। এ
মাসজুড়ে দেশব্যাপী চলবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত নানা
আয়োজন। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল অমর একুশে বইমেলা। গতকাল
প্রধানমন্ত্রী বইমেলার উদ্বোধন করেছেন। বাংলা একাডেমি এবারের বইমেলার আয়োজন
করেছে গতবারের চেয়েও বৃহৎ পরিসরে। মেলার সময়ও বাড়ানো হয়েছে।
মেলার স্থল ও
আশপাশ এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এসব উদ্যোগ প্রশংসনীয়।
এর পাশাপাশি আমরা আশা করব বইমেলার ভাবগাম্ভীর্য রক্ষায় সংশ্লিষ্ট সবাই সজাগ
থাকবেন। লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের সম্মিলিত অংশগ্রহণে সার্থক হয়ে উঠুক এই
প্রাণের মেলা। একুশের অন্যতম চেতনা ছিল- রাষ্ট্রীয় জীবনে অসাম্য, বৈষম্য,
দুর্বলের ওপর সবলের আধিপত্য ইত্যাদির অবসান ঘটানো। প্রশ্ন হল, এই মহৎ
আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন ঘটেছে কি? বাঙালির ঐতিহ্য, কৃষ্টি, আবহমানকালের
সংস্কৃতি ইত্যাদি সমুন্নত রাখার সমন্বিত প্রচেষ্টা কি লক্ষ করা যাচ্ছে
সমাজে? চিন্তার দিক থেকে আমরা হব আন্তর্জাতিক, কিন্তু পরিচয়ে থাকব বাঙালি-
এই ধারায় কি যাপন করছি জীবন? এসব প্রশ্নের উত্তর সন্তোষজনক নয়। বিতর্ক
রয়েছে, বিশ্বায়নের যুগে ভিন্ন সভ্যতা, ভিন্ন সংস্কৃতির যে অবাধ প্রবাহ,
তাতে আমরা কতটা অবগাহন করব অথবা আদৌ অবগাহন করব কিনা, আকাশ সংস্কৃতির যেসব
বিষয় আমাদের বিনোদিত করে, সেগুলো আমরা গ্রহণ করব কিনা- এসব বিতর্কের
মীমাংসা হতে পারে বিষয়টিকে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচারের মাধ্যমে। প্রথমত,
আমরা যেহেতু বাঙালি সেহেতু বাঙালিত্বকে সমুন্নত রাখতে হবে। পাশাপাশি
স্বতন্ত্র একটি জাতি হিসেবে নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য সমুন্নত রেখেই
ভিন্ন সংস্কৃতি-কৃষ্টির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া ঘটাতে হবে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা
হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে সত্য, কিন্তু তা কি চালু করা সম্ভব হয়েছে
সর্বস্তরে?
ভাষার প্রশ্নে বলতে হয়- আমাদের জীবন চলবে মাতৃভাষার মাধ্যমে।
তবে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য শিখতে হবে সাধ্যমতো অন্য ভাষাও। কিন্তু
দুঃখজনক, সর্বস্তরে আজও বাংলা ভাষার প্রচলন সম্ভব হয়নি। সাইনবোর্ড,
বিলবোর্ড, নামফলক, গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধে
পদক্ষেপ গ্রহণে হাইকোর্টের আদেশের পর ৪ বছর পার হতে যাচ্ছে। কিন্তু ওই
আদেশের কোনো বাস্তবায়ন লক্ষ করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান,
এমনকি অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলছে ইংরেজি নামে। বস্তুত বাংলা
ভাষার প্রতি মানুষের আবেগ ও ভালোবাসা দেখা যায় কেবল ফেব্রুয়ারিতে। বাকি ১১
মাস তা থাকে অবহেলিত। কোনো জাতি তার নিজ ভাষা ও সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করে
সামনে এগোতে পারে না। এটা অনুধাবন করতে হবে সর্বস্তরের মানুষকে। প্রাণের
তাগিদেই বাংলাকে ছড়িয়ে দিতে হবে সর্বস্তরে। একুশে ফেব্রুয়ারি আজ
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এর অর্থ পৃথিবীর সব
মাতৃভাষাই স্ব স্ব জাতির নিজস্ব ও অপরিবর্তনযোগ্য ভাষা। সব মাতৃ ও আঞ্চলিক
ভাষাকেই সমান মর্যাদা দিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। আমাদের পূর্বপুরুষরা রক্তের
বিনিময়ে সে পথ দেখিয়ে গেছেন। বাঙালি হয়ে যদি বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষায়
সচেতন না হই, তাহলে চলবে কেন?
No comments