এ লেখা প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে by তৈমূর আলম খন্দকার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গত ৬ জানুয়ারি থেকে পর্যাক্রমে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত চার দফায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট নির্বাচন’ ২০১৮ এবং ২০১৫ সালের ৯ জানুয়ারি বিএনপি আহূত অবরোধ কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে মিছিলে ভাঙচুর, বিস্ফোরণ ও নাশকতার মিথ্যা অভিযোগে নারায়ণগঞ্জ থানার দু’টি মামলায় পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করায় বিগত দুই সপ্তাহ নয়া দিগন্তে আমার লেখা পাঠাতে পারিনি। দেশের ব্যাংক ও শিক্ষা খাতে যে নৈরাজ্য চলছে, তার তথ্যবহুল চিত্র পাঠকদের সামনে তুলে ধরাই ছিল ওই লেখাগুলোর উদ্দেশ্য। নোভেল বিজয়ী ড. ইউনূস বলেছেন, দেশের সম্পদ ও রাজনীতি উভয়ই ধনীক শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি) বলেছে, ২০১৭ সাল ছিল ব্যাংকিং খাতে লুটপাটের বছর। ব্যাংক চলে জনগণের টাকায়। এক ব্যাংকের ঋণখেলাপি, অন্য ব্যাংকের মালিক। জনগণের টাকা লুট করেই ব্যাংকের মালিক বনে যাওয়ার সুযোগ সরকারই করে দিয়েছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, ব্যাংকগুলোর আর্থিক নিয়মশৃঙ্খলার প্রতি আরো সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে। নানা বিতর্কে বিতর্কিত বর্তমান বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ এ মর্মে আইন পাস করেছে, একই পরিবারের সদস্যরা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ৯ বছর পর্যন্ত থাকতে পারবেন। ফলে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ব্যাংক লুটের যাবতীয় ব্যবস্থার আইনগত আর কোনো বাধা রইল না। শিক্ষকেরা প্রচণ্ড শীতে খোলা আকাশের নিচে তাদের দাবি নিয়ে লড়াই করছেন, অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। শিক্ষামন্ত্রীর ওপর তারা আস্থা রাখতে পারছেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সাতটি কলেজের অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর পুলিশের সরাসরি টিয়ার শেল ক্ষেপণে ছাত্র সিদ্দিকুর রহমান চক্ষু হারিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্তিকে বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের ছাত্রলীগ পিটিয়েছে। বেসরকারি একটি মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করায় কলেজের মালিক আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত সাবেক এমপি মকবুল হোসেন ছাত্রছাত্রীদের মাথার খুলি উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন। মিডিয়াতে ধারণ করা এ ছবি দেশে ও বহির্বিশ্ব দেখেছে। দৃশ্যটি হয়তো প্রধানমন্ত্রী দেখেননি অথবা তার গোয়েন্দা সংস্থা ঘটনার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেননি অথবা প্রধানমন্ত্রী নিজেই একচোখা নীতি অবলম্বন করেছেন। তাই যদি না হয়, তবে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের মাথার খুলি উড়িয়ে দেয়ার হুমকি কি আইন ভঙ্গের কারণ হতে পারে না? প্রধানমন্ত্রীর প্লাটফর্মের বিরোধী কেউ যদি এভাবে অস্ত্র প্রদর্শন করত, তবে ‘আইন’ নিশ্চয় নিজ অগ্নিমূর্তি নিয়ে আবর্তন হতো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ‘আইন’ নীরব নিশ্চুপ এ জন্য যে, বাংলাদেশে একই আইন দু’ভাবে প্রয়োগ করতে সরকার সদা সক্রিয়। সরকারি দলের জন্য মধু ও বিপরীত চিন্তার জনগোষ্ঠীর জন্য বিষ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। চিরকাল শুনেছি, আইনের হাত অনেক লম্বা। আর এখন দেখছি, আইনের হাত দিন দিন খাটো হয়ে আইন প্রয়োগকারীর হাত লম্বা হয়ে যাচ্ছে, যারা এখন জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে তো বটেই, ধরাছোঁয়ার বাইরে। ড. ইউনূস বলেছেন, রাজনীতি এখন টাকাওয়ালাদের দখলে চলে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পে দেশকে সম্পৃদ্ধশালী করার জন্য ধনীক শ্রেণীর একটি ভূমিকা সবাই প্রত্যাশা করে। সে শ্রেণী তাদের ব্যবসায়িক খাতকে পরিবর্তন করে ব্যাংক লুটের পর ভূমিদস্যুতা, মিডিয়া, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিভাগে ঢুকে পড়েছে।
এ খাতগুলো অত্যন্ত নিরাপদ। কারণ, একদিকে শ্রম নিয়োগের খাত যেমন গার্মেন্ট শিল্পের মতো শ্রমিক অসন্তোষ্টির কোনো কারণই নেই। অন্য দিকে মিডিয়া, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে সমাজসেবার একটি গন্ধ আছে বলে আর্থিক মুনাফার পাশাপাশি সম্মান রয়েছে প্রচুর। কিন্তু রাজনীতিবিদের সম্মান ও সাংবিধানিক অধিকার পুলিশের বুটের তলায়, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে, যা ছিল এখন তার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। স্বাধীন দেশের পুলিশ প্রশাসন ঔপনিবেশিক কায়দায় চলছে, যাদের ট্রেনিং দেয়া হয় প্রতিপক্ষকে নিপীড়ন-নির্যাতনের। প্রতি বছরের মতো এবারো গত ২৩ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে গণসংযোগ চলার সময় দুপুর সাড়ে ১২টায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে প্রায় ১৫০ জন পুলিশ গ্রেফতারের জন্য উদ্যত হয়। একজন স্বাধীন দেশের নাগরিককে গ্রেফতারে (বিরোধী দলের হলে) পুলিশ কতটুকু মারমুখী হতে পারে, মিডিয়াতে ধারণ করা চিত্র দেখলেই জনগণের সামনে তা পরিস্ফুটিত হয়। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কর্মকর্তারা বলে বেড়ায়, ছাত্রজীবনে ‘অমুক’ হলের (বিশ্ববিদ্যালয়ের) ছাত্রলীগের ‘অমুক’ বিষয়ক সম্পাদক ছিলাম। অন্য দিকে, সে একই লোক বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন বলত বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অমুক’ হলের ছাত্রদলের ‘অমুক’ বিষয়ক সম্পাদক ছিলাম। এসব কথা বলে নিজেদের অযাচিত ক্ষমতা জাহির ও ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য পাওয়ার জন্য। নিজেদের ত্বরিৎকর্মা প্রমাণের জন্য সরকারবিরোধীদের ওপর নির্যাতন করে প্রমোশন পায়। অন্য দিকে, বড় বড় রাজনৈতিক দলে জবাবদিহিতা নেই বলে খোলস বদলাতে বেগ পেতে হয় না। সাফারি ছেড়ে মুজিব কোট, সময় পাল্টে গেলে মুজিব কোট ছেড়ে সাফারি- এ দেশে একটি রুটিন ওয়ার্ক। কিন্তু এতে যাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হয় তাদের আর্তনাদ কেউ শুনতে পায় না। সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার জন্য প্রণীত আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা বাতিলের দাবিতে সরকার তা রদের আশ্বাস দিলেও অধিকতর কঠিন আইন পাস করেছে যাতে সরকারের টিকিটি নিয়েও কোনো সমালোচনা করতে না পারে। এ জন্য আরো কঠিন আইন পাস করার পাশাপাশি পুলিশপ্রধান বলে দিয়েছেন, আইসিটি অ্যাক্টের যেসব মামলা হয়েছে, তাও চলবে। যদি তাই হয়, তবে ওই আইনটি রদ ও রহিত করে লাভ কী? সরকার এখন কোনো যুক্তি মানে না।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাই তাদের একমাত্র যুক্তি। চলতি ২০১৮ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর। এ নির্বাচন সামনে রেখেই সরকারের যত আত্মঘাতী খেলা এবং এ খেলায় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আইন আদালত। সরকারপ্রধান যিনি ‘রাষ্ট্রনায়ক’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, তিনি নিজেই বলেছিলেন, তিনি আর কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন দেখতে চান না। এখন নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করাসহ একতরফা নির্বাচন তথা বিএনপি ছাড়া নির্বাচন করতে যতটুকু করা দরকার, সংবিধান ও নৈতিকতাবিরোধী হলেও, তিনি সবই করে যাচ্ছেন। এক-এগারোর অবৈধ সরকারের আমলে দুই প্রধানমন্ত্রীই (সাবেক ও বর্তমান) কারাবন্দী ছিলেন। যেসব রাজনীতিবিদ এক-এগারোর সরকারের সাথে হাত মেলাননি তারাও জেলে ছিলেন। আমিও সে সময় ২৬ মাস জেল খেটেছি। কিন্তু কোন জাদুর সম্পর্কে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী-এমপিরা খালাস পেয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছেন, আর বিরোধীরা কোর্ট আর কারাগারবাসী হয়ে রইলেন- এ প্রশ্নও কিন্তু একদিন না একদিন জাতির সামনে উঠে আসবে। এ মর্মে স্বাভাবিক ন্যায়বিচার কি ব্যাহত হয়নি? আইন ও আদালতকে কি কোনোদিন এ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে না? তারেক রহমানকে যে আদালত (বিচারক মোতাহার হোসেন) খালাস দিয়েছিলেন, তার পেছনে দুদকের হামলা শুরু হলে তিনি মালয়েশিয়া পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সরকারি ঘরানার প্রধান বিচারপতি (এস কে সিনহা) পদত্যাগ করার পরপরই দুদকে জমা হওয়া ১২৬টি দুর্নীতির অভিযোগ এবং রাষ্ট্রপতির কাছে জমা করা ১১টি অভিযোগ কর্পূরের মতো আকাশে-বাতাসে বিলীন হয়ে যাবে এ প্রশ্নও জাতির সামনে উঠে আসবে, যার জবাব কাউকে না কাউকে অবশ্যই দিতে হবে। খালেদা জিয়া গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে এলেও রাজপথ থেকেই ক্ষমতায় এসেছেন। বহু ঝড়-তুফান তার পরিবারের ওপর দিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর ওপর দিয়েও ঝড় কম যায়নি। তার পরও কি প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদের নির্যাতনের মাধ্যমে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণের দৃঢ়প্রত্যয়ী থেকে যাবেন? সময়ের চাকা ঘুরে যখন ইতিহাস রচিত হবে, তখন বিষয়টি ইতিহাসের নাটক কোন আঙ্গিকে মঞ্চস্থ হবে?বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল মামলা ছাড়াও গেটকো, নাইকো দুর্নীতি মামলা ছাড়াও ১৪টি বিস্ফোরক মামলা আলিয়া মাদরাসা নামে খ্যাত বিশেষ আদালতে বিচারের জন্য পাঠানো হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে তিন দিনই খালেদা জিয়াকে মাদরাসা আদালতে হাজির থাকতে হয়। অনুরূপ মামলা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধেও ছিল; কিন্তু একই ধারায় দায়ের করা মামলায় শেখ হাসিনা খালাস হয়ে বর্তমানে তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী, অন্য দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এখনো মামলার ঘানি টানছেন। বাকপটু মন্ত্রীরা দীপ্তকণ্ঠে দৃঢ়তার সাথে বলছেন, খালেদা জিয়াকে জেলে যেতে হবে,
একদিনের জন্য হলেও জেলের ঘোষণা দিয়েছেন। এ ঘোষণা কারা দিচ্ছেন, যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেও অশালীন ভাষায় মন্তব্য করেছিলেন। খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার জন্য তাকে সাজা দেয়াটাই সরকার যথাযথ পন্থা মনে করছে বিধায় সর্বক্ষেত্রে এই প্রতিবন্ধকতা। প্রতি সপ্তাহে তিন দিন ম্যাডাম জিয়াকে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। আদালতে যাওয়া-আসার পথে পুলিশের রাস্তার দুই পাশে দাঁড়ানো নেতাকর্মীদের পেটানো, হয়রানি ও গ্রেফতার চলছে তো চলছেই। গত ৩০ জানুয়ারি বিশেষ আদালত থেকে গ্রেফতারের একপর্যায়ে নেতাকর্মীরা পুলিশকে পিটিয়ে প্রিজন ভ্যান থেকে আটকদের মুক্ত করেছে। এ সব কারণে সরকারের বোধোদয় হওয়া দরকার এ জন্য যে, মানুষের যখন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় তখনই তারা মারমুখী হয়। জনগণকে মারমুখী হওয়ার জন্য সরকারই তাদের উসকে দিচ্ছে। সবাই বলছেন, সর্বজন গ্রহণযোগ্য অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন হওয়া দরকার এবং এটাই বর্তমানে সব সমস্যা সমাধানের একমাত্র উৎস। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, খালেদা জিয়া ছাড়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব হবে না। সরকার ও সরকারি দল মনে করে, নির্যাতিত নিপীড়িত বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাদের নেতাকর্মীদের এ দেশে থাকা হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। যেমন মন্ত্রীরাই বিভিন্ন সভায় বলছেন, আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় না গেলে রোহিঙ্গা হয়ে যেতে হবে। এ ধরনের অনেক কথা সরকারি ঘরানার লোকেরা বলছেন। এ সবকিছু মিলিয়ে সরকারের স্বস্তির নিঃশ্বাসের জন্যই কি খালেদা জিয়াকে জেলে নেয়া অত্যন্ত জরুরি? জাতির বিবেকের কাছে এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া যাবে কি?
লেখক : বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা
taimuralamkhandaker@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.