ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার স্বার্থে by আলী রীয়াজ
গত
২৯ জানুয়ারি মন্ত্রিভায় প্রস্তাবিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ অনুমোদিত
হওয়ার পর দেশ-বিদেশে এই আইনের ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। এটা স্পষ্ট যে ২০১৬
সালে এই আইন প্রস্তাব হিসেবে উপস্থাপনের পর যেসব সমালোচনা হয়েছিল, বিভিন্ন
বৈঠকে যেসব নেতিবাচক দিক চিহ্নিত করা হয়েছিল, সরকার কার্যত সেগুলো আমলে
নেয়নি।
যৎকিঞ্চিৎ যে সংশোধন বা পরিবর্তন হয়েছে, তাতে এই আইনের উদ্দেশ্য বা
মর্মবস্তুর কোনো বদল ঘটেনি। এই আইনের বিরুদ্ধে গত কয়েক দিনের আলোচনায় যে
বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে তা হচ্ছে কী করে এই আইন দেশে সাংবাদিকতার জন্য এক
বিরাট প্রতিবন্ধকতায় পরিণত হবে। এ প্রসঙ্গে কুখ্যাত আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার
বিভিন্ন বিষয়কে ৪টি ভাগে ভাগ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন ধারায়
(ধারা ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১) সংযুক্ত হওয়ার বিষয় বিস্তারিতভাবেই আলোচিত হচ্ছে।
নতুন আইনের ৩২ ধারা এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়; এই ধারার একটি ব্যাখ্যা
অনুযায়ী অনুমোদন ব্যতিরেকে সরকারি তথ্য সংগ্রহ করলে তাকে গুপ্তচরবৃত্তি বলে
বিবেচনা করা যেতে পারে। ফলে এই আইনের ভেতরে এমন ব্যবস্থা রেখে দেওয়া
হয়েছে, যা কেবল শাসনব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিরুদ্ধেই নয়, কার্যত
দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের পথকেই প্রশস্ত করেছে। অনুমোদিত খসড়ায় এই
আইনের আওতায় সরকারি তথ্য সুরক্ষার যে ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাতে যে
জনস্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়নি, সেটা সহজেই বোধগম্য। যে দেশে তথ্য
অধিকার আইন প্রণয়ন করার পর সবাই উৎফুল্ল হয়েছিল, সেই দেশে তথ্য প্রকাশের
ক্ষেত্রে এত দিন ধরে যে আইসিটির ৫৭ ধারা বজায় ছিল, সেটাই ছিল মর্মান্তিক,
দুর্ভাগ্যজনক। এখন তার বদলে এর চেয়েও ভয়াবহ বিষয় যুক্ত হচ্ছে; যুক্ত হতে
চলেছে সেই সব ধারা ও শাস্তি, যা আসলে ১৯২৩ সালের দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইনের ৩
ধারায় গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধের শাস্তির বিধানাত্র (টিআইবির নির্বাহী
পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের বিবৃতি, যুগান্তর, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮)।
ঔপনিবেশিক শাসনের ভূত এখন স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকদের মাথায় ভর করেছে;
পার্থক্য কেবল অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল। কয়েক দিন ধরে আলোচনা–সমালোচনায় এই
আইনের প্রত্যক্ষ এবং আশু যেসব প্রতিক্রিয়া পড়বে বলে বলা হচ্ছে, এর অধিকাংশই
সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপরে। কিন্তু এই আইনের ভার কেবল যে সাংবাদিকদেরই
বইতে হবে, তা নয়।
বাংলাদেশ বিষয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, বিশেষত যাঁরা ইতিহাস ও
রাজনীতি বিষয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসে স্বাধীনভাবে গবেষণা করতে চান,
তাঁদের জন্য এই আইনে এমন অনেক কিছুই আছে, যা তাঁদের উদ্বিগ্ন করার কথা।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসব নিয়ে সমাজবিজ্ঞানের গবেষক বা শিক্ষকদের মধ্য
থেকে এমন কোনো শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এটুকু যদিও বলা হচ্ছে যে
এই আইনের বিভিন্ন বিধান ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করবে’। কিন্তু এই
বক্তব্য যথেষ্ট নয়, সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা দরকার কী কী বিধান
উদ্বেগের জন্ম দেয়। উদাহরণ হিসেবে আইনে উল্লিখিত ‘রাষ্ট্রের সুনাম’
‘ভাবমূর্তি’, ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’–এর প্রসঙ্গ স্মরণ
করতে চাই। এসব শব্দ সাধারণ আলোচনায় যতটা সহজে ব্যবহারযোগ্য, আইনের মধ্যে
প্রবেশ করলে তা আর সহজ বিষয় থাকে না। কেননা সেগুলো সুনির্দিষ্টভাবে
সংজ্ঞায়িত হওয়ার দরকার হয়ে পড়ে। এসব ধারণার কি অভিন্ন এবং সবার কাছে
গ্রহণযোগ্য কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণের উপায় আছে? আইনের ২১ ধারার প্রস্তাব
অনুযায়ী, ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির
পিতার নামে প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা চালালে বা মদদ দিলে অনধিক ১৪ বছরের
কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে (বিবিসি বাংলা, ২৯
জানুয়ারি ২০১৮)। একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আমি মনে
করি যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত হয়েছে সাম্য, মানবিক
মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। কিন্তু স্বাধীনতার চেতনার ভিন্ন ব্যাখ্যা
অন্যরা দেন এবং তাঁদের সেই ব্যাখ্যাকে কোনো অবস্থাতেই আমি একেবারে
অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করি না। আমি তাঁদের ওপরে আমার ব্যাখ্যাকে আরোপ করতে
চাই না যেমন, এটা আশা করি যে তাঁরা আমার ওপরে তাঁদের ব্যাখ্যাকে চাপিয়ে
দেবেন না। এখন এই আইনের পরে একজন গবেষক কি এই বিষয়ে গবেষণা এবং প্রকাশনা
করতে পারবেন, এই বিতর্কে নির্ভয়ে অংশ নিতে পারবেন? এই আলোচনা, বিতর্ক কি
‘প্রোপাগান্ডা’ বলে বিবেচিত হবে? মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে
বিভিন্ন ধরনের লেখালেখি হয়েছে এবং আগামী দিনগুলোতে আরও হবে, এটা নিশ্চিত।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং এর পটভূমি বিষয়ে
পশ্চিমা একাডেমিক জগতে যে কটি বই সবচেয়ে আলোচিত হয়, তার একটিও বাংলাদেশের
কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা ইতিহাসবিদের লেখা নয়; শুধু তা–ই নয়,
এসব রাজনৈতিক
ইতিহাসের বর্ণনায় বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর অনুপস্থিত। এই আইন ভবিষ্যতে
বাংলাদেশের রাজনীতি ও ইতিহাস নিয়ে আলোচনায় অনুৎসাহিতই করবে। আমি মনে করি,
প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনবিষয়ক বিতর্কে এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখনো
অনালোচিত। সেই আলোচনা করার দায়িত্ব গবেষকদের, যাঁদের কণ্ঠস্বর এখনো শুনতে
পাইনি। আমি যেসব ধারার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, সেগুলো জামিন অযোগ্য
অপরাধের তালিকাভুক্ত হয়েছে, যা আরও বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ। প্রস্তাবিত
আইনে তদন্ত কর্মকর্তাকে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া
হয়েছে, এমনকি ‘অপরাধ সংঘটনের সম্ভাবনা রয়েছে’—এমন ক্ষেত্রেও এই ক্ষমতা
প্রয়োগের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তার অর্থ কি এই দাঁড়ায় যে একজন গবেষক এতক্ষণ
আলোচিত বিষয়গুলোতে ভবিষ্যতে ‘আপত্তিকর’ গবেষণা করতে পারেন, এই অভিযোগে আটক
হতে পারেন? এই প্রশ্নকে অনেকেই অতিশয়োক্তি বলে মনে করতে পারেন, কিন্তু গত
কয়েক বছরে আইসিটি আইনের ব্যাপক অপপ্রয়োগ দেখে কি এই আশঙ্কাকে একেবারে অমূলক
মনে হয়? বিস্মৃত হওয়ার উপায় নেই, ২০১২ থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত আইসিটি
আইনে ১ হাজার ৪১৭টি মামলা হয়েছিল; এর ৬৫ শতাংশ হয়েছিল ৫৭ ধারায়। অনুমোদিত
আইনে মামলার সংখ্যা কত বাড়বে, তা কি আমরা অনুমান করতে পারছি?
আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক
আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক
No comments