চট্টগ্রাম বন্দরের দুর্দশা
দেশের
প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরের দুর্দশা অবর্ণনীয় মাত্রায়
পৌঁছেছে—এটা কোনো নতুন খবর নয়। এ বন্দরের দক্ষতা বছর বছর কমে যাচ্ছে এবং এর
ফলে পণ্য খালাস করতে ক্রমেই আরও বেশি সময় লাগছে। কিছুদিন পরপরই এসব বিষয়ে
বিস্তারিত প্রতিবেদন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে, সম্পাদকীয় নিবন্ধে
সমস্যাটির গুরুত্ব তুলে ধরে তা সমাধানের জন্য তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু
বন্দরের এই দুর্দশা দূর হওয়া দূরে থাক, তা ক্রমেই প্রকট থেকে প্রকটতর
হচ্ছে। গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে চট্টগ্রাম
বন্দরের যে সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানা গেল, তা হলো এই বন্দরে পণ্য
খালাসে বিলম্ব গত দুই দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মাত্রায় উঠেছে। সেখানে এখন
প্রতিটি কনটেইনার থেকে পণ্য খালাস করে আমদানিকারকদের হাতে পৌঁছাতে সময়
লাগছে গড়ে ১০৩ ঘণ্টা বা চার দিনের বেশি। চট্টগ্রাম বন্দর রুটে ফিডার
জাহাজগুলো অতিরিক্ত সময় ভেসে থাকার ফলে এসব জাহাজের পরিচালনাকারীদের খরচ
মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে। ২০১৫ সালে ফিডার জাহাজ পরিচালনাকারীদের খরচ হয়েছে
৯৩ কোটি টাকা, অথচ ২০১৭ সালে এই খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩৩ কোটি টাকা। আমদানি
পণ্য খালাস ও ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছাতে অতিরিক্ত সময় ব্যয় হওয়ার ফলে শুধু
যে ব্যবসায়ীদেরই ক্ষতি হচ্ছে তা নয়, জাতীয় অর্থনীতিও ক্ষতির মুখে পড়ছে।
কারণ, অনেক আমদানি পণ্য বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল; সেসব কাঁচামাল বন্দর
থেকে কারখানা পর্যন্ত পৌঁছাতে অতিরিক্ত সময় নষ্ট হচ্ছে বলে উৎপাদন ব্যাহত
হচ্ছে।
শুধু তা–ই নয়, আমদানিকারকদের এ জন্য বিরাট আর্থিক ক্ষতিরও মুখোমুখি
হতে হচ্ছে। পণ্য খালাসে বিলম্বের কারণে আমদানিকারকদের গত এক বছরেই ক্ষতি
হয়েছে ১ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। এই ক্ষতি হয়েছে এই কারণে যে বিলম্বের জন্য
জাহাজ কোম্পানিগুলো তাদের ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে। আমদানিকারকদের এই বাড়তি ভাড়া
পরিশোধ করতে হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রায়। এই সবকিছুর ফলে দেশের বাজারে
আমদানীকৃত পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে এবং তার অর্থনৈতিক চাপ গিয়ে পড়ছে
ভোক্তাসাধারণের ওপর। চট্টগ্রাম বন্দরের এই দুর্দশা কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে
বন্দর কর্তৃপক্ষ বলে, বছর বছর কনটেইনারে পণ্য পরিবহন বেড়েছে, কিন্তু সেই
অনুপাতে অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়েনি। গত ১০ বছর নতুন কোনো নতুন জেটি তৈরি
হয়নি, প্রয়োজন অনুযায়ী লাইটার জাহাজের সংখ্যাও বাড়েনি। এসব কথা সত্য,
অবকাঠামোগত ঘাটতি অবশ্যই আছে। কিন্তু শুধু এই কারণেই বন্দরের সামর্থ্য ও
দক্ষতা এতটা কমে গিয়েছে—এটা মোটেও ঠিক নয়। বন্দর ব্যবস্থাপনায়ও বিরাট ঘাটতি
রয়েছে। অতীতের দৃষ্টান্ত থেকে ব্যবস্থাপনার ঘাটতির প্রমাণ পাওয়া যাবে।
২০০৬ সালে এই বন্দরে পণ্য খালাস করতে গড়ে ব্যয় হতো ৭৮ ঘণ্টা। কিন্তু ২০০৮
সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তা কমে মাত্র ১১ ঘণ্টায় নেমে
আসে। তখনো জেটির ঘাটতি ছিল, লাইটার জাহাজ পর্যাপ্ত ছিল না। তাহলে পণ্য
খালাসের সময় কীভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল? ২০০৯ পর্যন্ত বন্দরের অবস্থা এ
রকম ছিল। কিন্তু তারপর থেকে আবার খারাপ হতে থাকে। তবু ২০১৫ সালেও ৩১
ঘণ্টার বেশি লাগত না। কিন্তু ২০১৬ সালে তা বেড়ে হয় ৭৫ ঘণ্টা এবং তারপরের
বছর ১০৩ ঘণ্টা। এখানে দায়িত্ব পালনে অবহেলাসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনার
দুর্বলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান দুর্দশার
দ্রুত অবসান ঘটানো একান্ত জরুরি। সে জন্য নতুন জেটি নির্মাণ ও লাইটার
জাহাজের সংখ্যা অবশ্যই বাড়াতে হবে। কিন্তু এ জন্য সময় প্রয়োজন। চলমান
দুর্দশা কমানোর জন্য প্রয়োজন বন্দর ব্যবস্থাপনা ব্যাপকভাবে উন্নত করা এবং
বন্দর কর্তৃপক্ষের জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
No comments