জনতুষ্টিবাদ সেখানে কতটা ভিন্ন? by স্লাভোমির সিয়েরাকোভস্কি
গণভোটের
মধ্য দিয়ে ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়া এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট
হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়া-২০১৬ সালের এই দুটি ঘটনা জনমনে এই
ধারণা সৃষ্টি করেছিল যে পূর্ব ইউরোপীয় ঘরানার জনতুষ্টিবাদ গোটা পশ্চিম
সমাজকে গ্রাস করতে চলেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পশ্চিম ইউরোপ ও
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। ‘টনি ব্লেয়ার ইনস্টিটিউট ফর
গ্লোবাল চেঞ্জ’-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মার্টিন ইয়ারম্যান,
ইয়াসা মুঙ্ক ও লিমুর গুলচিন যেমনটা দেখিয়েছেন: একমাত্র ইউরোপের
কমিউনিস্ট-পরবর্তী পূর্বাঞ্চলের দেশগুলোতেই জনতুষ্টিবাদ নিয়মিত ভিত্তিতে
প্রসারিত হচ্ছে।
প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোকে এই মতাদর্শ পরাজিত করে আসছে।
পূর্ব ইউরোপের ১৫টি দেশের সাতটিতেই এখন জনতুষ্টিবাদী ধারার দল ক্ষমতায়, আরও
দুটি দেশে ক্ষমতাসীন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ শরিক হিসেবে তারা আছে; আর
তিনটিতে তারা প্রধান বিরোধী শক্তির ভূমিকায়। মার্টিন ইয়ারম্যান, ইয়াসা
মুঙ্ক ও লিমুর গুলচিন আরও দেখিয়েছেন, ২০০০ সালে পূর্ব ইউরোপের মাত্র দুটি
দেশে জনতুষ্টিবাদী দলগুলো মাত্র ২০ শতাংশ বা তার সামান্য কিছু ভোট পেয়েছিল।
ওই অঞ্চলের অন্তত ১০টি দেশে সেই পরিমাণ ভোট এখন তারা পাচ্ছে। পূর্ব ইউরোপে
জনতুষ্টিবাদ প্রবল শক্তিশালী হয়ে ওঠার নেপথ্যে যে সামাজিক ও রাজনৈতিক
ঘটনাপ্রবাহ কাজ করেছে, কাগুজে তথ্য-উপাত্তের বাইরে সেগুলোকেও আমাদের আমলে
নিতে হবে। প্রথমেই বুঝতে হবে, পশ্চিমা গণতন্ত্রে ‘চেক অ্যান্ড
ব্যালান্স’ধর্মী যে ভারসাম্যের রেওয়াজ আছে, পূর্ব ইউরোপে স্পষ্টতই তার
ঘাটতি আছে। পোল্যান্ডের ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির চেয়ারম্যান ও দেশটির
কার্যত প্রধান শাসক জারোস্লাভ কাসজিনস্কির মতো ট্রাম্প চাইলেই বিচারিক
সিদ্ধান্তকে উড়িয়ে দিতে পারেন না অথবা নিরাপত্তা বাহিনীকে বিরোধী শক্তির
ভূমিকায় ঠেলে দিতে পারেন না। ট্রাম্প ও তাঁর নির্বাচনী প্রচার দলের
সদস্যদের সঙ্গে রাশিয়ার যোগসাজশ থাকার বিষয়টি তদন্ত করছেন যে স্পেশাল
কাউন্সেল রবার্ট মুয়েলার, তাঁর দিকটি দেখলেও জিনিসটা বোঝা যাবে। মুয়েলারকে
নিয়োগ দিয়েছেন মার্কিন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল রড রোজেনস্টেইন।
রোজেনস্টেইন সরাসরি ট্রাম্পের অধীনে সরকারি চাকুরে। মুয়েলার ও
রোজেনস্টেইন-দুজনকেই যখন-তখন বরখাস্ত করার ক্ষমতা ট্রাম্পের হাতে আছে।
তারপরও তিনি তাঁদের বরখাস্ত করার সাহস দেখাচ্ছেন না। কিন্তু কাসজিনস্কির
ক্ষেত্রে একই কথা বলা যাবে না। পূর্ব ইউরোপীয়দের সঙ্গে পশ্চিমাদের আরেকটি
বড় পার্থক্য হলো, পূর্ব ইউরোপীয়রা পশ্চিমাদের চেয়ে বেশি বস্তুবাদী চেতনা
ধারণ করে। দৃশ্যমান নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিতে পূর্ব ইউরোপীয়রা
পশ্চিমাদের চেয়ে অনেক বেশি জোর দিয়ে থাকে। সমাজবিজ্ঞানী রোনাল্ড
ইঙ্গলেহার্ট এটিকে বলেছেন, ‘বস্তুবাদোত্তর চেতনা’। এই পার্থক্যের একটি
লক্ষণীয় দিক হলো, পূর্ব ইউরোপীয় সমাজগুলোতে বাক্স্বাধীনতা ও বিচার বিভাগের
স্বাধীনতার মতো বিমূর্ত উদারপন্থী প্রতিষ্ঠানগুলো আক্রমণের শিকার হয় বেশি।
এতে খুব অবাক হওয়ার কিছু নেই। আসলে পূর্ব ইউরোপে উদারনৈতিকতাবাদ পশ্চিম
থেকে আমদানি হয়ে এসেছে।
ট্রাম্প ও ব্রেক্সিট ইস্যু দিয়ে বিচার না করলেও
চলবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য রাজনৈতিক ও সামাজিক
উদারনৈতিকতাবাদের দিক থেকে বহু আগে থেকেই যূথবদ্ধ। পূর্ব ইউরোপের দলগুলোর
মধ্যে বর্তমানে ডানপন্থী বনাম বামপন্থী অবস্থা নয়, বরং ‘ঠিক’ বনাম ‘বেঠিক’
অবস্থা চলছে। জার্মানির উদারনীতি বিরোধী কট্টর তাত্ত্বিক কার্ল স্মিথের ‘হয়
মিত্র, নয় শত্রু’ মতবাদ তাঁরা ভালোভাবেই গ্রহণ করেছেন। সেখানকার প্রতিটি
দল নিজেদের প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী মনে করে। প্রতিপক্ষকে তারা
অবৈধ মনে করে। পরস্পরকে তারা শুধু পরাজিত করতে চায় না, একেবারে নিশ্চিহ্ন
করে ফেলতে চায়। পশ্চিম ইউরোপে এমনটা নয়। পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপীয়
জনতুষ্টিবাদের আরেকটি বড় পার্থক্য হলো, পূর্ব ইউরোপে শুধু শ্রমিকশ্রেণির
সমর্থনই নয়, মধ্যবিত্তের সমর্থনও তারা পায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে,
কমিউনিস্ট-পরবর্তী সময়ে পোল্যান্ডের মানুষ, তাদের তখনকার ও এখনকার
জীবন-জীবিকার মান নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় না। সেখানকার ক্ষমতাসীন দলের নেতারা
মনে করেন, সে দেশের আর্থিক অবস্থা সন্তোষজনক। আর ভোটাররা তাঁদের বিচার
বিভাগ, শরণার্থী অথবা অন্য কোনো বিষয়ে নিজেদের মতামত খুব একটা প্রকাশ করেন
না। এর বদলে তাঁরা তাঁদের নেতাদের বক্তব্যকেই বেদবাক্য বলে মেনে নেন।
স্লাভোমির সিয়েরাকোভস্কি ওয়ারশতে অবস্থিত ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডির পরিচালক
স্লাভোমির সিয়েরাকোভস্কি ওয়ারশতে অবস্থিত ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডির পরিচালক
No comments