বাংলাদেশকে অবশ্যই সুষ্ঠু নির্বাচনে যেতে হবে
বাংলাদেশের
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো যে নাজুক অবস্থায়—এমন ধারণায় বিস্ময়ের কিছু
নেই। উপরন্তু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে আপাতত বাংলাদেশের যে একটি
পশ্চাৎ–মুখী যাত্রা চলমান, সে বিষয় নিয়েও বিতর্কের সুযোগ কম। এই অবস্থায়
ক্ষমতাসীন দল আবারও তৃতীয় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে জয়লাভের লক্ষ্য নিয়ে
নির্বাচনী প্রচারাভিযানে নেমেছে। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দলের নেতার
বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলার আসন্ন রায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে অনিশ্চয়তায়
ফেলবে কি না, সেই প্রশ্ন আলোচিত। এমনই একটি প্রেক্ষাপটে লন্ডনভিত্তিক
সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট-এর ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সদ্য প্রকাশিত গণতন্ত্রের
সূচকে বলা হয়েছে, ১৬৫টি দেশের মধ্যে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ছিল ৮৪তম স্থানে,
কিন্তু এর পরের বছরটিতেই সেটা ৮ ধাপ নিচে নেমেছে। এশীয় দেশগুলোর মধ্যে
বাংলাদেশের অবস্থান অবশ্য দশম। ওই সাময়িকীর বিবেচনায় বাংলাদেশে ‘হাইব্রিড
শাসন’ব্যবস্থা চলছে। এটা তাদের মতে এমন একটি শাসনব্যবস্থা, যেখানে প্রায়ই
অবাধ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত, বিরোধী দল ও গণমাধ্যম চাপে থাকে, আইনের শাসন ও
নাগরিক সমাজ দুর্বল, দুর্নীতির বিস্তার ব্যাপক। যেটা লক্ষণীয় তা হলো,
বাংলাদেশের গণতন্ত্র ধারাবাহিকভাবে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে ব্যর্থ হচ্ছে।
যখন অবাধ নির্বাচনে সংসদ হয়েছে, তখনো আমরা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে
ভঙ্গুর থাকতে দেখেছি। কিন্তু ১৯৯১ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ে প্রতিটি
সংসদ (স্বল্পস্থায়ী ষষ্ঠ ব্যতিক্রম) সরকারি ও বিরোধী দলের অংশগ্রহণে
চলেছে। বিরোধী দল সংসদ লাগাতার বর্জন করা সত্ত্বেও সংসদীয় গণতন্ত্রের একটা
অনুশীলন কমবেশি গতিশীল থেকেছে। ইকোনমিস্ট-এর সূচক নিচে নেমে আসার বিষয়টি
শুধু সরকারি দল নয়,
প্রধান বিরোধী দলের জন্যও একটি প্রশ্ন নিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র দুর্বল রাখার জন্য কোনো একটি শাসনামলকে চিহ্নিত করা
চলে না। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি গণতন্ত্রের মান নিচে নামার ক্ষেত্রে
তাদের বাদ দিয়ে ২০১৪ সালে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকে দেখাতে চাইবে। তাদের
এমন অবস্থান সহজে বোধগম্য এবং অংশত গ্রহণযোগ্য। কিন্তু একটি দেশের
গণতন্ত্রের সূচক কেবল প্রধানত সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদে থাকা না-থাকার
ওপর নির্ভর করে না। বিএনপিকে তার গত এক যুগের বিরোধীদলীয় ভূমিকায়
অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চা ও তার অনুশীলনের মান বাড়াতে কোনোভাবেই
উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায়নি। একই কথা সরকারি দলের জন্যও প্রাসঙ্গিক। তারা এখন
এমন একটি ‘বিরোধী দল’ নিয়ে সংসদ চালাচ্ছে, যারা সব সময় তাদের অনুগতই থেকে
যাচ্ছে। তারা এই বাস্তবতাকে বিবেচনায় নেয়নি যে সংসদ থেকে বিরোধী রাজনৈতিক
শক্তিকে কৌশলে দূরে রাখতে পারলেই সংসদীয় রাজনীতিকে শক্তিশালী করা যায় না।
আগে বিরোধী দল সংসদ বর্জন ও নানা অগণতান্ত্রিক আচরণের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে
কলুষিত করেছিল কিন্তু এখন আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি যে অনুগত বিরোধী দল
সংসদীয় গণতন্ত্রকে আরও দূষিত করতেই ভূমিকা রাখছে। পরিহাস হলো সংসদ বর্জন,
যা আগে বিরোধী দল করেছে, সেটা এখন সরকারি দল পূরণ করছে। লাগাতার কোরাম
সংকট কার্যত সরকারি দল দ্বারা সংসদ বয়কটের নামান্তর। কোনো দেশের সংসদ
দুর্বল থাকলে সেই ঘাটতি স্বাধীন বিচার বিভাগ ও গণমাধ্যম পূরণ করে থাকে।
কিন্তু বিচার বিভাগ পৃথক্করণে জোরালো অস্বীকৃতি, নানা ধরনের চাপ এবং
স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য হুমকিমূলক আইন কার্যকরের উদ্যোগ ইঙ্গিত দেয় যে
বাংলাদেশের গণতন্ত্র অসহনশীল হয়ে উঠছে। গণতন্ত্রের সূচককে ঊর্ধ্বমুখী করতে
চাইলে আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও অবাধ করতেই হবে। তবে সমাজের অন্য
কুশীলবদেরও গণতন্ত্রের চর্চা বাড়াতে হবে।
No comments