বাংলাদেশে নারী জাগরণ by এবনে গোলাম সামাদ
কিছু
দিন আগে বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা মহিলা নেত্রীকে বলতে শোনা গেল,
বাংলাদেশে নারী নির্যাতন বাড়ছে। এর কারণ হলো, নারী জাগরণকে ঠেকানো
(বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২০ জানুয়ারি ২০১৮)। তিনি ঢাকায় মহিলা ঐক্য পরিষদ নামের
একটি প্রতিষ্ঠানের আহূত সভায় বক্তৃতা করার সময় এ কথা বলেন। কিন্তু এর পরেই
আরেক দৈনিক পত্রিকার খবরে দেখলাম (যুগান্তর, ২০ জানুয়ারি ২০১৮), জাতিসঙ্ঘে
কর্মরত নারী কর্মচারীদের যৌন হয়রানি করছেন ওই সংস্থার ঊর্ধ্বতন পুরুষ
কর্মকর্তারা। কিন্তু চাকরি হারাবার ভয়ে নিম্নপদস্থ মহিলা কর্মচারীরা এর
প্রতিবাদ করছেন না।
জাতিসঙ্ঘ বাংলাদেশে অবস্থিত নয়। জাতিসঙ্ঘের মতো
প্রতিষ্ঠানে কেন নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, সেটা ব্যাখ্যা হওয়া
প্রয়োজন। নিশ্চিয় জাতিসঙ্ঘের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের অধীন নারী
কর্মচারীদের যৌন নির্যাতন করছেন নারী জাগরণ বন্ধ করার লক্ষে নয়। নারী
নির্যাতন কেবল যে বাংলাদেশেই বেড়েছে এমনও নয়। নারী নির্যাতনের সাথে নারী
জাগরণ রোধ করার কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে
যেসব মহিলা কেবলই গৃহবধূ অর্থাৎ বাইরে চাকরি করেন না, তারা যখন জীবন বীমা
করেন, তখন তাদের প্রিমিয়াম কম দিতে হয়। কেননা, রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়ে মরার
সম্ভাবনা তাদের ক্ষেত্রে থাকে তুলনামূলকভাবে কম। অন্য দিকে, যেসব মহিলা
বাইরে চাকরি করেন তাদের জীবন বীমা করতে গেলে প্রিমিয়াম দিতে হয় বেশি।
কেননা, তাদের ক্ষেত্রে গাড়িচাপা পড়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি। আগে মহিলারা যে
পরিমাণ বাইরে কাজ করতেন, এখন তার চেয়ে বেশি সংখ্যায় কাজ করছেন। আসছেন
পুরুষের সান্নিধ্যে। যেটা তারা আগে আসতেন না। নারীদের যৌন হয়রানি ও ধর্ষণ
বেড়ে যাওয়ার এটা একটা বড় কারণ বলে আমার মনে হয়। নারী জাগরণের অর্থ
দাঁড়িয়েছে বাইরে চাকরি করার ইচ্ছা; অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন। তাই বাড়ছে
মেয়েদের ক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও বলাৎকারের মাত্রা। পুরুষ ও নারীর মধ্যে
কায়িক শক্তির পার্থক্য আছে। গড়পরতা একজন পুরুষ একজন নারীর থেকে কায়িক
শক্তিতে শক্তিমান। একজন পুরুষ যত সহজে একজন নারীর ওপর বল প্রয়োগ করতে
পারেন, একজন নারী তা পারেন না। পুরুষ ও নারীর কায়িক শক্তির পার্থক্য তর্কের
বিষয় নয়। তাই আমরা দেখি ছেলে ও মেয়ের অলিম্পিক পৃথকভাবে হতে; একসাথে
অর্থাৎ একত্রে অনুষ্ঠিত হতে নয়। অন্তত এখন পর্যন্ত তা করা হচ্ছে না। ছেলেরা
যখন জন্মায়, তখন তাদের ওজন সব সময়ই মেয়ে শিশুর চেয়ে কিছু বেশি হতে দেখা
যায়। যদিও মেয়ে শিশুর কঙ্কাল হতে দেখা যায় অধিক পরিপুষ্ট। মেয়েরা সাধারণত
১৮ বছরের পর দৈহিকভাবে আর বৃদ্ধি পায় না। কিন্তু ছেলেরা বৃদ্ধি পায় প্রায়
২১ বছর পর্যন্ত। মেয়েরা কম আহার্য গ্রহণ করে ছেলেদের চেয়ে বেশি কাজ করতে
পারে। কিন্তু ছেলেদের গ্রহণ করতে হয় অধিক আহার্য। কেননা তাদের শরীর থেকে
শক্তি তাপের আকারে অনেক সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
খেলাধুলার ক্ষেত্রে দেখা যায়
ছেলেরা যে পরিমাণ ভারোত্তোলন করতে পারছে, মেয়েরা তা পারছে না। ছেলারা যে
পরিমাণ ভারী বস্তু যতদূরে নিক্ষেপ করতে পারছে, মেয়েরা তা পারছে না। কিন্তু
মেয়েরা অনেক অল্প বয়সে ছেলেদের চেয়ে সুন্দর করে সাজ-পোশাক পরতে পারে।
ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা অনেক কম বয়সে গুছিয়ে কথা কলতে পারে। ছেলেরা জীবাণুজনিত
অসুখে যে হারে মারা মারা যায়, মেয়েরা তা যায় না। কিন্তু ছেলেরা যে পরিমাণ
অঙ্ক কষতে পারে, মেয়েরা তা পারে না। ছেলেদের অঙ্কের মেধা সাধারণত গড়পরতা
মেয়েদের চেয়ে বেশি। সাধারণত মনে করা হয় মেয়েদের দেহের বেড়ে চলা যেমন
ছেলেদের আগে থেমে যায়, তেমনি বুদ্ধির বিকাশও ছেলেদের আগেই থেমে যায়। গড়পরতা
মেয়েদের মাথায় মগজের পরিমাণ হতে দেখা যায় ছেলেদের চেয়ে কম। এই যে বিভেদ,
এর কারণ নিহিত আছে সৃষ্টির বিভিন্নতার মধ্যে। এটা নারীর প্রতি পুরুষের কোনো
ষড়যন্ত্রের ফলে যে উদ্ভূত হয়, তা নয়। পাখিদের মধ্যে দেখা যায়, অনেক সময়
একটি নারী পাখি পুরুষ পাখিতে পরিণত হতে। যেমন একটি মুরগি মোরগে পরিণত হতে
পারে। কোনো কারণে যদি একটি মুরগির ডিম্বাশয় নষ্ট হয়ে যায়, তখন তার দেহের
সুপ্ত শুক্রাশয় সক্রিয় হয়ে ওঠে। উৎপন্ন হতে থাকে শুক্রকীট। মুরগিটা তখন
মোরগে পরিণত হয়। তার ঝুঁটি হয়ে ওঠে মোরগেরই মতো। কিন্তু মোরগ তার শারীরিক
গঠনের জন্য কখনোই মুরগিতে পরিণত হয় না। মোরগ-মুরিগর ক্ষেত্রে যখন শুক্রাশয়
এবং ডিম্বাশয় বাচ্চাকালে সরিয়ে ফেলা হয়, তখন তারা প্রাপ্ত বয়সে দেখতে হয়
একই রকম। মুরগিকে দেখে মনে হয় প্রায় মোরগেরই মতো। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে
ঘটে এর উল্টো। আগে অনেক পুরুষকে বাচ্চাকালে খোজা করা হতো। এক সময় খোজাদের
নিয়োগ করা হতো বাদশাহদের হেরেমে মেয়েদের পাহারা দেয়ার জন্য। খোজারা কিন্তু
দেখতে হতো প্রায় মেয়েদেরই মতো। অর্থাৎ মোরগ-মুরগির থেকে এ ক্ষেত্রে চেহারার
পার্থক্য ঘটত উল্টোদিকে। খোজা করা ছেলেরা কেবলা চেহারায় নয়, আচার আচরণেও
হয়ে উঠত অনেক মেয়েলি। গির্জায় একসময় খোজা করা ছেলেদের গান করার জন্য নিয়োগ
করা হতো। কারণ, তাদের কণ্ঠস্বর হতো অনেক পরিমাণে মেয়েলি। এখন খোজা করার মতো
অত্যাচার বন্ধ হয়েছে। কিন্তু একসময় পুরুষকে খোজা করে বিক্রি করা হয়েছে
হাটে বজারে। খুব অল্প বয়সের ছেলেদের খোজা করা হতো। ভাবা হতো না তাদের
জীবনের কথা। অত্যাচার যে কেবল নারীর ওপরই হয়েছে, পুরুষের ওপর হয়নি, তা
কিন্তু নয়। অনেক প্রথা যা এখন আমরা মনে করি অমানবিক, সমাজে তা প্রচলিত ছিল।
সভ্যতার অগ্রগতির একটা মানদণ্ড হলো মানুষের প্রতি মানুষের অমানবিক আচরণ
কমে আসা। আমাদের দেশের মেয়েদের ওপর এখন যৌন নির্যাতন বাড়ছে। এরকমই বলছেন
অনেকে। কিন্তু মেয়েদের প্রতি যৌন নির্যাতন আগেও যে ছিল না, তা নয়। আমার
ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। আমাদের পাড়ায় ইটের ইমারতের চেয়ে খড়ের দোতলা বাড়ির
সংখ্যা ছিল বেশি। আমার বাড়ির খুব কাছে একটা খড়ের বড় দোচালা ঘরের চাল কেটে
এক ব্যক্তি ঢুকে একজন হিন্দু মহিলাকে ধর্ষণ করে চলে যেতে পেরেছিল।
সেই
ব্যক্তি ধরা পড়েনি। সম্ভবত এ ঘটনার কথা কোনো পত্রপত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়নি।
কিন্তু আমাদের দেশের পত্রপত্রিকায় ধর্ষণের খবর খুব ফলাও করে ছাপা হচ্ছে।
যাকে বলা চলে ধর্ষণ সাংবাদিকতা। আমার মনে হয় এই ধর্ষণ-সাংবাাদিকতাও ধর্ষণ
বৃদ্ধিতে সহায়ক হচ্ছে। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখি, একসময়
হিন্দুদের চেয়ে বৌদ্ধদের সংখ্যা ছিল বেশি। অনেক বৌদ্ধ নারী বাস করতেন বৌদ্ধ
মঠে। মঠ থেকে বাইরে আসার সময় তারা সাধারণত চারজন করে একত্রে বাইরে আসতেন।
যাতে তাদের ওপর কেউ যৌন নির্যাতন অথবা অন্য ধরনের নির্যাতন না করতে পারে।
আমার মনে হয়, মেয়েরা যদি এখন এভাবে দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করেন, তবে তাদের ওপর
অত্যাচারের বিশেষ করে যৌন হয়রানির ও ধর্ষণের মাত্রা হবে কম। অর্থাৎ আমি
মনে করি, মেয়েদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে মেয়েদের। কেবলই পুলিশের ওপর
নির্ভর করা ঠিক হবে না। পুলিশ আছে কিন্তু তবু আমরা দরজায় তালা লাগিয়ে
ঘুমাই। প্রচলিত বাংলা প্রবাদেও বলে সাবধানের ঘরে চুরি কম হয়। একেবারে
অপরাধমুক্ত সমাজ কখনো হবে কি না, সেটা একটা দার্শনিক বিতর্কের বিষয়। কিন্তু
মানুষের মধ্যে দুষ্কৃতকারী আছে। তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সাবধান
হতে হবে। আমাদের দেশে এখন কিছু সংখ্যক এনজিও প্রচার করছে, মেয়েরা হলো
গৃহবন্দী। আর এই গৃহবন্দিতার কারণ হলো, এ সমাজ পুরুষ শাসিত। কিন্তু মানুষ
স্তন্যপায়ী প্রাণী। মানব শিশু মাতৃদুদ্ধ পান করে বড় হয়ে ওঠে। মায়েরা
সন্তানের প্রতি বিশেষ মায়া মমতা অনুভব করেন। তাদের গৃহে থাকতে হয় এই
কারণেও। এটা পুরুষের কোনো ষড়যন্ত্র নয়। অন্যান্য স্তন্যপ্রাণীর ক্ষেত্রে
সাধারণত মায়েরা এককভাবে করে সন্তান পালন। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে জনক
জননীকে সাহায্য করেন সন্তান প্রতিপালনে। যে পিতা এটা করেন না, তিনি সমাজে
হন নিন্দিত। আমাদের দেশে এখনো ভাইয়ের বিপদে বোন আসেন সাহায্য করতে। বোনের
বিপদেও ভাই করেন সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত। কিন্তু অনেক নারী জাগরণবাদী
নারী জাগরণের ব্যাখ্যা করছেন পুরুষ ও নারীর মধ্যে শ্রেণী সংগ্রাম হিসেবে।
যেটা সমাজের জন্য শুভকর নয়। নারীর ক্ষমতায়ন কথাটাও খুব বেশি করে বলা হচ্ছে।
যা থেকে মনে হয়, আমাদের দেশে নারীরা ছিলেন এবং এখনো বহুল পরিমাণে আছেন
ক্ষমতাহীন। আমি একজন বয়োজীর্ণ ব্যক্তি। আমার বয়স ৮৯ বছর। আমার মনে পড়ে,
আমার মাতা-পিতার কথা। আমার পিতার কোনো গুরুতর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হলে,
সে বিষয়ে আমার মাতার সাথে আলোচনা করতেন। আমার মনে হয় গড়পরতা পরিবারে
মাতা-পিতার সম্পর্ক এ ক্ষেত্রে একই রকমই ছিল। সংসারে নারীর কোনো কথা বলার
অধিকার ছিল না। এই ধারণা যথার্থ নয়।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
No comments