ঢাকা থেকেই আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে
শিশুদের
জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন নোবেল বিজয়ী শিশু অধিকার কর্মী
কৈলাশ সত্যার্থী। তিনি বলেন, আজই সময়, এ ঢাকা থেকেই আমাদের শিশুদের জন্য
কিছু করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সহানুভূতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার এখনই
সময়। তিনি বলেন, বিশ্বের সব শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার জন্য মাত্র ২২ বিলিয়ন
ডলার প্রয়োজন। যা বিশ্বের সাড়ে তিনদিনের প্রতিরক্ষা বাজেটের সমান। তিনি
প্রশ্ন রেখে বলেন, আমাদের এ বিশ্ব কি এতই গরিব যে, এ পরিমাণ অর্থ প্রাথমিক
শিক্ষার জন্য ব্যয় করতে পারবো না? ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন
(আইপিইউ)-এর ১৩৬তম সম্মেলনের প্রথম দিনে আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উত্থাপনকালে
শান্তিতে নোবেলজয়ী মানবাধিকার কর্মী কৈলাশ সত্যার্থী এ কথা বলেন। তিনি
সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ‘সমাজের বৈষম্য নিরসনের মাধ্যমে সবার মর্যাদা ও মঙ্গল
সাধন’-এর ওপর মূল প্রবন্ধ উত্থাপন করেন। পরে বিষয়টির ওপর বিভিন্ন দেশের
প্রতিনিধিরা সাধারণ আলোচনায় অংশ নেন। ওই আলোচনায় বৈষম্যের কারণগুলো চিহ্নিত
করে তা নিরসনে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। আইপিইউ
সম্মেলনের সাধারণ অধিবেশন গতকাল সকাল ৯টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন
কেন্দ্রে শুরু হয়। বেলা ১১টায় মূল প্রতিপাদ্যের ওপর সাধারণ আলোচনা শুরু হয়।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুরু হওয়া এই আলোচনায় চলাকালে
আইপিইউ প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরী ও সেক্রেটারি জেনারেল মটিন চুংগং
উপস্থিত ছিলেন। বিশ্বব্যাপী আয় বৈষম্যকে অর্থনৈতিক সহিংসতার বড় কারণ উল্লেখ
করে কৈলাশ সত্যার্থী বলেছেন, অর্থনৈতিক বৈষ্ণম্যের কারণে সৃষ্ট এ সহিংসতা
মানবজাতির নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য বড় ধরনের হুমকি। বিশ্বে ধনী-দরিদ্রের
ব্যবধান ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বিশ্বের একশ’ কোটি মানুষ এখনো দিনে দুই ডলার আয়
করতে পারে না। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অবস্থা দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে। ভারতের
শিশু অধিকার কর্মী কৈলাশ বলেন, আমরা যখন এ সম্মেলন করছি তখন ২৭০ মিলিয়ন
শিশু স্কুলে যেতে পারছে না। ২১ মিলিয়ন মানুষ বিক্রি হয়ে শ্রমদাসে পরিণত
হয়েছে। এটা মেনে নেয়া যায় না, সহ্য করা যায় না। তিনি বলেন, একদিকে একশ
মিলিয়ন শিশু দাসত্ব, পাচার ও শিক্ষাবঞ্চনাসহ বিভিন্ন সহিংসতার শিকার হচ্ছে,
অন্যদিকে একশ’ মিলিয়ন তরুণ রয়েছে, যারা চাচ্ছে পৃথিবীকে বদলে দিতে। তাদের
পৃথিবী বদলে দেয়ার শক্তি, ক্ষমতা ও আদর্শ আছে। এই তরুণদের পাশে দাঁড়াতে হবে
আমাদের। তিনি আরো বলেন, পৃথিবীকে সুন্দর করতে তরুণদের শক্তি আছে, আদর্শ
আছে, সম্ভাবনা আছে। আমরা যদি এই শক্তিকে কাজে লাগাতে না পারি, তবে তারা
হতাশাগ্রস্ত, অসহিষ্ণু এবং সহিংস হয়ে পড়বে। তরুণদের যদি ক্ষমতা কাজে লাগানো
যায় এই পৃথিবী আরো আনন্দময় ও শক্তিশালী হবে বলে তিনি আশা করেন।
বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের দিকে ইঙ্গিত করে শান্তিতে নোবেল জয়ী
কৈলাশ সত্যার্থী বলেন, দক্ষিণ এশিয়াসহ পৃথিবীর কিছু অংশে তরুণরা ভুল পথে
পরিচালিত হচ্ছে। উগ্রবাদের পথ বেছে নিচ্ছে। বিশ্বের ২৩০ মিলিয়ন শিশু
সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বসবাস করছে। তাদের জীবন ও শিক্ষা বিপদগ্রস্থ। তিনি বলেন,
প্রতিদিন গড়ে ৯ হাজার শিশু ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কারণে মারা যাচ্ছে।
প্রকৃত অর্থে তারা মারা যাচ্ছে না, তাদের হত্যা করা হচ্ছে। আড়াই লাখ শিশু
পাচারের শিকার হচ্ছে। যৌথভাবে এর সমাধান আমাদের দায়িত্ব। বিপদগ্রস্ত
শিশুদের বাঁচানোর জন্য বিশ্বের সব দেশের সংসদ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান
তিনি। এ সময় একটি উদ্যোগের কথা তুলে ধরে কৈলাশ সত্যার্থী বলেন, বিশ্ব
নাগরিকদের জন্য একটি নতুন সভ্যতা গড়তে হবে। তাই আমি আপনাদের সবাইকে আহ্বান
জানাবো, আমরা সব নোবেল জয়ীরা একটা ক্যাম্পেইন শুরু করেছি। ২০শে সেপ্টেম্বর
এমপিরা নিজ নিজ স্কুলে যান। আপনাদের স্কুলে শিশুদের সঙ্গে সময় কাটান। আমরাও
এই কাজটি করবো। তিনি বলেন, আজই সময়, এই ঢাকাই স্থান, এখান থেকেই আমাদের
শিশুদের জন্য কিছু করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সহানুভূতি নিয়ে সারা
বিশ্বের শিশুর পাশে দাঁড়াতে হবে। প্রবন্ধে নারীর ক্ষমতায়নের ওপর
গুরুত্বারোপ করেন এই নোবেল বিজয়ী। তিনি বলেন, যদি নারীকে আমরা সমভাবে
ক্ষমতায়িত করতে পারতাম, তাহলে গত ৫ হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাসে অনেক
সমস্যা আমাদের মোকাবিলা করতে হতো না; যা এখন আমোদের এখনো করতে হচ্ছে। তিনি
আরো বলেন, করপোরেট নেতৃত্বের ক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে এই
ক্ষমতা মেলালে চলবে না। আপনারা কেবল জনগণ, ভোটার ও এলাকার জনপ্রতিনিধি নন,
আপনারা লাখো প্রত্যাশা ও স্বপ্নের প্রতিনিধিত্ব করেন। আপনারা তাদের বিবেক
এবং বিশ্বাসের রক্ষক। এটা বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বশান্তির জন্য আপনাদের ভূমিকা
রাখতে হবে। এ আলোচনায় অংশ নিয়ে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, সমাজে বৈষম্য
নতুন বিষয় নয়। পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে এই বৈষম্য চলে আসছে। এই বৈষম্য নিরসনে
সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি। তার আগে বৈষম্যের কারণগুলো চিহ্নিত করা দরকার। তিনি
বলেন, সমাজে যেমন অর্থনৈতিক বৈষম্য রয়েছে, তেমনি নারী পুরুষের বৈষম্য। এ
বৈষম্যের কারণে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী পিছিয়ে পড়ছে; যা আমাদের উন্নয়ন ও
অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। স্পিকার আরো বলেন, আমাদের বাংলাদেশের সংবিধানের
২৮ অনুচ্ছেদে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে।
আমাদের সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে। বিশ্বের অন্য দেশগুলোও সেই পদক্ষেপ
নিতে পারে। তবে কী পদক্ষেপ নেয়া হবে, সেটা সবার আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করতে
হবে। আইপিইউ সম্মেলন আমাদের আলোচনার পথ তৈরি করে দিয়েছে। বৈষম্য নিরসনে
আইপিইউ সম্মেলনের সুপারিশ বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান
তিনি। এ আলোচনায় নামিবিয়ার স্পিকার মার্গারেট মেনসা উইলিয়াম বলেন, বিশ্বে
নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য রয়েছে। আমাদের সংসদ এসব বৈষম্য নিরসনে কাজ করছে।
এছাড়া বর্তমান বিশ্বের ১৭টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও স্পিকার রয়েছে।
পাশাপাশি ১৮ দশমিক ৩ ভাগ মন্ত্রী-এমপি নারী। অথচ বিশ্বায়নের এই যুগে
নারীদের প্রতিনিধিত্ব যে জায়গায় থাকার কথা ছিল, তার থেকে এখনো অনেক পিছিয়ে
রয়েছি। তিনি আরো বলেন, যেসব দেশে সংসদের স্পিকার নারী তাদেও, এই ক্ষেত্রে
কাজ করার অবারিত সুযোগ রয়েছে। তারা সংসদে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে পিছিয়ে
পড়া শিশু ও নারীদের উৎসাহিত করতে পারেন। নামিবিয়ার স্পিকার বলেন, নারীরা
অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান হয়ে উঠলেও এখনো আর্থিকভাবে তত বেশি শক্তশালী হয়ে
ওঠেনি। কারণ, এখনো সাধারণ নারীরা পুরুষের তুলনায় অনেক কম আয় করে থাকেন।
তবে, গৃহস্থালির কাজে অনেক বেশি এগিয়ে রয়েছেন নারীরা। এতো কিছুর পরও
নারীদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে আসতে হলে অবশ্যই শক্তভাবে পদক্ষেপ নিতে
হবে। এসব পদক্ষেপ জেন্ডার বৈষম্য কমাতে সহায়ক হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ
করেন। অস্ট্রেলিয়ার তরুণ পার্লামেন্টারিয়ান আর ব মিথি বলেন, সমাজের সব
ধরনের অসমতা কমাতে হলে শিক্ষার মাধ্যমে আমরা এই কাজে যুব-সমাজকে
অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। যেখানে তারা বিশ্বের মানবাধিকার উন্নয়নে কাজ করতে
পারে। পাশাপাশি নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য কমাতে চাকরির ক্ষেত্রে সমান
সুযোগ রাখতে হবে। এ বিষয়ে উদ্যোগী হওয়ার জন্য সম্মেলনে অংশ নেয়া
প্রতিনিধিদের প্রতি আহ্বান জানান।
No comments