তিস্তা ছাড়া অন্য চুক্তি মানবে না জনগণ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরে প্রতিরক্ষাসহ আরও অন্তত ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এর মধ্যে তিস্তার পানি চুক্তির বিষয়ে চূড়ান্ত কিছু নেই। এ দফায়ও পানি চুক্তি হচ্ছে না তা অনেকটাই নিশ্চিত। বিএনপি, সিপিবিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করেন তিস্তা চুক্তি না হলে এ সফরের তেমন কোনো মূল্যই থাকবে না। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তিস্তা চুক্তিই জনগণের প্রধান দাবি। কাজেই তিস্তার পানি ছাড়া অন্য কোনো চুক্তি জনগণ মানবে না বলে তারা মনে করেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে কোনো চুক্তি নানা কারণে স্পর্শকাতর। কাজেই যে কোনো বিষয়ে চুক্তি হলেও সে সম্পর্কে জনগণ বিস্তারিত জানতে চায়। জনগণকে না জানিয়ে যখন অন্ধকারে রাখা হয়, তখনই নানা ধরনের সন্দেহ-গুজবের ডালপালা ছড়াতে থাকে। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরে যে চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে সেগুলো সম্পর্কে মানুষ তেমন কিছুই জানে না। তিস্তার পানি চুক্তি হবে কিনা সে সম্পর্কে মানুষ এখনও অন্ধকারে। এসব কারণে সফরের সময় সম্ভাব্য চুক্তি নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তির কথা হচ্ছে। এ চুক্তিতে কি আছে সে বিষয়ে মানুষ জানতে চায়। দেশের মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিকভাবে সচেতন। এটা সরকারকে বুঝতে হবে। কাজেই জনগণকে আড়ালে রেখে কোনো ধরনের চুক্তি এখন আর করা যাবে না। যদি করা হয় তবে তা কেউ মানবে না। আগামী জাতীয় নির্বাচনে এর বিরূপ প্রভাব পড়বেই।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ এ প্রসঙ্গে রোববার যুগান্তরকে বলেন, তিস্তা বাদ দিয়ে অন্য কোনো চুক্তি দেশের জনগণ মানবে না। ভারত প্রথম থেকেই এমন মনোভাব দেখাচ্ছে যে তারা বাংলাদেশকে তিস্তার পানি দেবে না। এর আগে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গঙ্গা চুক্তির সময় তিস্তা, ধরলাসহ ৭টি নদীর পানি নিয়ে চুক্তির সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু তিস্তাতেই তা আটকে যায়। তিনি বলেন, পানি হচ্ছে দেশের জীবন-মরণ সমস্যা। অথচ সরকার তিস্তা চুক্তি বাদ দিয়ে প্রতিরক্ষা চুক্তি করছে। বাংলাদেশের তিন দিকে ভারত রয়েছে তারপরও তাদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি হচ্ছে। আমরা কি কখনও ভারতকে আক্রমণ করতে যাব? এ চুক্তির কারণে ভারত কোনো প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যুদ্ধে গেলে বাংলাদেশকেও জড়াতে হবে। তা কখনোই আমাদের জন্য শুভ হবে না। প্রতিরক্ষা চুক্তির ভেতরে কি আছে তা জনগণ জানতে চায়। জনগণ এখন অনেক সচেতন। দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে জনগণ এর জবাব দেবে। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারতে সফরে প্রতিরক্ষার পাশাপাশি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র সংক্রান্ত চুক্তি নিয়েও জোর আলোচনা চলছে। এ আলোচনায় উঠে এসেছে, তিস্তার পানির চেয়ে প্রতিরক্ষা বা পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র সংক্রান্ত চুক্তি কি বেশি জরুরি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, পশ্চিমবঙ্গের দোহাই দিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তা চুক্তির বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে রেখেছে। অথচ ভারত অনেক দ্বিপাক্ষিক বিষয় এগিয়ে নিচ্ছে যাতে অন্য কোনো রাজ্যকে প্রকাশ্যে টেনে আনছে না। তিস্তা চুক্তির ক্ষেত্রে শুধু ব্যতিক্রম। উজানের দেশ হিসেবে তারা বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে চাচ্ছে না। এজন্য তারা কৌশলে পশ্চিমবঙ্গের নাম ব্যবহার করছে।
দেশটিতে এ বিষয়ে রাজনৈতিক সমঝোতা হলেই শুধু বাংলাদেশ তিস্তার পানি পাবে। এর আগে সম্ভাবনা খুবই কম। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ও এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রকাশ না করায় বিশেষজ্ঞরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, সরকারের মন্ত্রী-সচিবরা একটি নির্দিষ্ট ফরমেটে কথা বলেন। তিস্তা নিয়ে তাদের প্রশ্ন করা হলে এক উত্তর, তা হল ভারত বাংলাদেশকে আশ্বাস দিয়েছে চুক্তি হবে। সে অনুযায়ী একটি খসড়াও প্রস্তুত। চুক্তি হবেই এ ব্যাপারে মন্ত্রী-সচিবরা আশাবাদী। তবে কবে নাগাদ হবে তা কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারেন না। তারা বলেন, জনগণের আপত্তি এখানেই। জনগণ মনে করে তিস্তার পানি বাংলাদেশের অধিকার। কোনো দেশের দয়ার দান নয়। কাজেই অধিকার আদায়ে সরকারকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। দেশের মানুষকে বোঝাতে হবে সরকার তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে বদ্ধপরিকর। কাজেই আসন্ন সফরে পানি বণ্টনের চুক্তিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। তিস্তা বাদ দিয়ে যদি অন্য কোনো চুক্তি হয় তবে জনগণ তা মেনে নেবে না। পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সম্প্রতি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে বলেন, তিস্তার পানি চুক্তির বিষয়ে ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রী (ড. মনমোহন সিংহ ও নরেন্দ্র মোদি) বাংলাদেশকে আশ্বাস দিয়েছেন। কাজেই তিস্তা চুক্তি হবেই। সে অনুযায়ী একটি খসড়াও তৈরি করেছে সরকার।
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরে এ চুক্তি হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত নয়। প্রায় অভিন্ন কথা বলেছেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমেদ খান। তিনি বলেন, তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে উভয় দেশ একটি খসড়া তৈরি করেছে। এটি কবে নাগাদ সই হতে পারে সে বিষয়টি নির্ভর করছে ভারতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। বিশেষ করে ভারতের কেন্দ্রীয় ও সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের মতামতের ভিত্তিতেই এ চুক্তি সই হবে। জানা গেছে, তিস্তার পানি নিয়ে একটি চুক্তি হোক সে ব্যাপারে বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশের সরকারই একমত। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরাও চান ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে তিস্তার পানি চুক্তি দেশ ও দলের জন্য অপরিহার্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালেও যখন ভারত সফর করেছিলেন, তখনও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি দিল্লিতে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। দীর্ঘ ৭ বছর পর আবারও প্রধানমন্ত্রী দিল্লি যাচ্ছেন। সেখানে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি তোলা হতে পারে। এ প্রসঙ্গে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মানে ভারতের রাষ্ট্রপতির দেয়া নৈশভোজে মমতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রের খবর, শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম ও সিকিমের মুখ্যমন্ত্রীরাও থাকবেন এবং তাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রস্তাবনা তুলে ধরা হবে। এবারই প্রথম সিকিমের মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কারণ তিস্তার পানি সিকিম হয়ে বাংলাদেশে এসেছে। তাই তাদের বক্তব্যও শুনতে চায় কেন্দ্রীয় সরকার। সেখানে তিস্তা নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে পারে রাজনৈতিক সমাধানের সূত্রও।
রোববার বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক কমরেড সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘প্রতিরক্ষা নয়, তিস্তা চুক্তি চাই।’ ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে দেশের জনগণের স্বার্থে তিস্তা নদীর পানি বণ্টনসহ দু’দেশের মধ্যে জিইয়ে থাকা বিরোধগুলোর সমাধান অগ্রাধিকার দিতে হবে। তিস্তাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ইস্যু বাদ দিয়ে প্রতিরক্ষা চুক্তি করলে দেশের জনগণের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের জন্ম হবে। দু’দেশের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বছরের পর বছর ধরে তিস্তার ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা হলে ভারত বিরোধিতা বাড়তে থাকবে এবং দু’দেশের সম্পর্ক নষ্ট হবে। দেশের পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, তিস্তা চুক্তির বিষয়টি ২০১১ সাল থেকে প্রায় চূড়ান্ত হয়ে আছে। বাকিটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। এর আগেও ভারত তার দায়িত্বের কথা মনে রেখে বাংলাদেশকে প্রয়োজনের তুলনায় কিছুটা হলেও তিস্তার পানি ছাড় দিত। কিন্তু ২০১১ সালের পর তারা উজান থেকে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করছে। যেটা সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ নয়। তিস্তা চুক্তি যত দ্রুত হবে ততই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল। এ বিষয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতে পানি সমস্যা সবচেয়ে বড় সমস্যা। এটি বাংলাদেশের জন্য জীবন-মরণ সমস্যা। ভারতের সঙ্গে যে কোনো চুক্তির চেয়ে তিস্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। দেশের মানুষের কথা বিবেচনা করে সরকারকে এটি অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন। জানা গেছে, ২০১০ সালে তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারতের সঙ্গে ১৫ বছর মেয়াদি একটি অন্তর্র্বর্তীকালীন চুক্তি হওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। ওই চুক্তির খসড়ায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়- তিস্তার ৪০ ভাগ পানি ভারত পাবে এবং ৪০ ভাগ পাবে বাংলাদেশ। আর তিস্তার নাব্য রক্ষার জন্য থাকবে বাকি ২০ ভাগ পানি। বাংলাদেশের এ প্রস্তাব নিয়ে মমতা ব্যানার্জির তীব্র আপত্তি থাকায় ঝুলে যায় বাংলাদেশ-ভারত অন্তর্র্বর্তীকালীন তিস্তা চুক্তি। সর্বশেষ গত ১৬ বছরে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় বাংলাদেশ অংশে কি পরিমাণ পানি ছিল তার তথ্য-উপাত্ত চায় পশ্চিমবঙ্গ। এ পরিপ্রেক্ষিতে যৌথ নদী কমিশন থেকেও পশ্চিমবঙ্গের কাছে জানতে চাওয়া হয়, জলপাইগুড়ির গজলডোবা বাঁধের সামনে গত ১৬ বছরে কী পরিমাণ পানি ছিল। একই সঙ্গে গজলডোবা বাঁধের ২৫ কিলোমিটার উজানে ডাইভার্সন পয়েন্ট থেকে পানি ভাগাভাগি হবে নাকি ডাইভার্সন পয়েন্টের ভাটিতে জমা পানি ভাগাভাগি হবে তাও জানতে চাওয়া হয়। ভারত থেকে তিস্তা বাংলাদেশের যে প্রান্ত দিয়ে প্রবেশ করেছে সেই নীলফামারীর ডোমার উপজেলার কালিগঞ্জ গ্রাম থেকে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত তিস্তার গতিপথ বাঁচিয়ে রাখতে কি পরিমাণ পানি ছাড়া হবে- এটাও নির্দিষ্ট করতে বলা হয় পশ্চিমবঙ্গকে। বিষয়টি সেখানেই ঝুলে রয়েছে।
No comments