বিপদে 'মোরা' না যেন করি ভয় by অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন
ঘোর বিপদ এখন চারদিকে। একটি নির্বাচনী
পর্যালোচনা দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করি। গত ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষক সমিতির নির্বাচন হয়ে গেছে। একটি শীর্ষ দৈনিকে ওইদিন অধ্যাপক আসিফ
নজরুল একটি অত্যন্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নিবন্ধ লেখেন। 'এরা মুক্তিযুদ্ধের
পক্ষশক্তি (!)' এই শিরোনামের ওই লেখার উদ্দেশ্য ব্যর্থ প্রমাণিত হয়, যখন
টানটান উত্তেজনার ওই নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের
গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল মোর্চা সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ চারটি শীর্ষ পদ ও
পাঁচটি সদস্যপদসহ মোট ৯টি আসনে জয়লাভ করে। বিএনপি-জামায়াত মোর্চা সহ-সভাপতি
ও পাঁচটি সদস্যপদসহ ছয়টি আসন পায়। আমার পর্যালোচনা ও ঘোর বিপদের আশঙ্কা ওই
ছয়টি আসন নিয়ে। এদের মধ্যে তিনজন সরাসরি জামায়াত ও বাকি তিনজন জামায়াতের
একনিষ্ঠ অনুসারী। বাংলাদেশের পেশাজীবী সংগঠনগুলোর নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ
করলে একই চিত্র পাওয়া যাবে।
এসব সংগঠনে এখন আর বিএনপিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তারা লীন হয়ে গেছে জামায়াত-হেফাজত-উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীতে। ঘোর বিপদটি সেখানেই। ভেবে দেখুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির এ নির্বাচনটিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ছকে প্রতিস্থাপন করে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং তার পুত্র তারেক রহমান যেভাবে এ রাজনৈতিক দল ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোকে জামায়াতি ভাবাদর্শ এবং শক্তির অধীনতায় নিয়ে গেছেন, সেখানে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত মোর্চার জয়লাভের অর্থ দাঁড়ায় সরাসরি জামায়াত এবং তাদের একনিষ্ঠ অনুসারীদের জয়লাভ।
তার ভয়াবহতার কথা ভেবে দেখুন। ক্ষমতায় আসার আগেই যে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে তারা লিপ্ত হয়েছে, গত ২৯ ডিসেম্বর খালেদা জিয়া কোনো রাখঢাক ছাড়াই যেসব হুমকি দিয়েছেন, তার কথা ভাবুন। বিপরীতে গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল মোর্চার জয়লাভটি ব্যাখ্যা করি। যখন এই শক্তি ঐক্যবদ্ধ, দৃঢ় মোর্চাবদ্ধ, তখন আসিফ নজরুল, ফরহাদ মজহার, পিয়াস করিম, রিজওয়ানা হাসান, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, ড. ইউনূস গংয়ের মতো সুশীলদের তীক্ষষ্ট, তীব্র প্রচারণার পরও তারা জয়লাভ করতে পারে।
পেশাজীবী সংগঠনগুলোর মধ্যকার চরম দলীয়করণ, লেজুড়বৃত্তি এবং একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার পরিস্থিতি কেন হলো, তা আরও একটু পর্যালোচনা করা যাক। ইদানীং বাংলাদেশের সুশীলরা এ বিষয়ে হা-হুতাশ করছেন। তাদের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করার সঙ্গত কারণও আছে। কিন্তু এমনটা কেন হলো, তার ব্যাখ্যায় যাচ্ছেন না কেউ।
যে লক্ষ্য ও স্বপ্ন নিয়ে এ ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধ করেছে এবং সীমাহীন আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে জয়লাভও করেছে, তা থেকে ক্রমে আমরা পশ্চাদপসরণ করেছি। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা, পরে জাতীয় চার নেতাসহ মুক্তিযুদ্ধের অগ্রনায়কদের হত্যা এবং তারপর জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়া চক্রের হাতে দীর্ঘ ২১ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে জামায়াত-যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসনের বিষময় ফল হচ্ছে আজকের পেশাজীবী সংগঠনগুলোর চরম দেউলিয়াত্ব। জামায়াত ও তাদের অর্থ সাম্রাজ্যের কাছে পদানত হয়ে গেছেন এসব সংগঠনের নেতা-সদস্য। পদানত হয়ে গেছে তাদের মানবিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। পদানত হয়ে গেছেন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সরব সুশীলরা।
ঘোর বিপদের আরও কিছু চিত্র তুলে ধরি। ঢাকাসহ বাংলাদেশের অন্যান্য শহর ও জনপদের খেলার মাঠগুলো কাদের দখলে, তা একটু অনুসন্ধান করুন। জামায়াত-শিবির ও জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোর সদস্যদের খেলাধুলার নামে প্রশিক্ষণ ও মিলনস্থলে পরিণত হয়েছে এসব পাবলিক স্থাপন। এবার আসুন মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এসব শিক্ষা (?) প্রতিষ্ঠান এবং তাদের ছাত্রাবাসগুলোর খবর নিন। খবর নিন ব্যাংক, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিকস, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, ট্রান্সপোর্ট ও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর। একই চিত্র, একই ভয়াবহ অবস্থা। বাংলাদেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশের বিরুদ্ধে বিষফোঁড়াসম এসব মিউট্যান্ট এবং হ্যারি পটার উপাখ্যানে বর্ণিত হিম শীতল নিঃশ্বাস ফেলা 'মানুষের আত্মা শোষণকারী ডিমেন্টাররা' ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখের সামনে কি নিশ্চিন্তেই না এরা নিজেদের সংগঠিত করছে।
বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর কথাই ভাবুন। এ অস্থিতিশীল সময়েও হাজার হাজার ছেলেমেয়ের হাতে বই পেঁৗছে গেছে, সে জন্য তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। একই সঙ্গে তাকে বিনীত অনুরোধ করি_ এই যে খোদ ঢাকা শহরে সরকারি কলেজগুলোয় পদায়িত শিক্ষক, তাদের রাজনৈতিক পরিচয়টি আপনি জেনে নিন। কীভাবে সেখানে জামায়াতিকরণ করা হয়েছে, সেই চিত্রটি আপনার অজানা থাকার কথা নয়। কয়েক মাস আগে সংসদে দাঁড়িয়ে মাননীয় মন্ত্রী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষকদের সমালোচনা করলেন বটে। তবে অবাক হই যখন দেখি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে ১৯৭৩ সালের আইন অনুযায়ী পরিচালনা করতে গেলে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নূ্যনতম সহযোগিতাও আমাকে দেওয়া হয় না। এতে লাভবান হয় বিএনপি-জামায়াতপন্থি এবং সরকারি দলের কিছু সন্ত্রাসী শিক্ষক। শিক্ষামন্ত্রীর 'সকলের সাথে' সমঝোতা করে চলার নীতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসী শিক্ষকদের ত্রাসের রাজত্বের সমাপ্তি ঘটে না। 'প্রথম আলোর' সমীক্ষায় যেখানে দেখানো হয়, জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভয়াবহ বিপর্যয়ের কথা, সেই একই সমীক্ষাতেই শতকরা ৯০ ভাগ এই মন্ত্রী মহোদয়কে ইয়েস দেন। এর রহস্য কী? যে ৫ হাজার ব্যক্তি এ সমীক্ষায় অংশ নিয়েছেন, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় কী? শুধু তথাকথিত 'ক্লিন ইমেজ'-এর কারণেই কি শিক্ষামন্ত্রীর এত গ্রহণযোগ্যতা? দুর্নীতির কারণে ব্যাপকভাবে সমালোচিত শিক্ষামন্ত্রীর এপিএসের কথাই বলি। সবকিছুর পরও মন্ত্রী তার এপিএসের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। আমাদের কি তবে বিশ্বাস করতে হবে প্রথম আলো সমীক্ষায় অংশ নেওয়া কেউই এ কথা জানেন না? গত ৫ বছরে যাদের অর্থনৈতিক সম্পদ ব্যাপক এবং অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে, তাদের একজন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। গত ৩১ ডিসেম্বরের প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে, মাহবুবউল আলম হানিফের হাত ধরে কুষ্টিয়ার এক জামায়াত নেতার আওয়ামী লীগে যোগদান করার খবর। জামায়াতের এ নেতা দাবি করছেন, বর্তমান সময়ে জামায়াতের আন্দোলনের নামে নাশকতামূলক কাজকে তিনি সমর্থন করেন না এবং তাই তিনি স্বাধীনতার সপক্ষের দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে রাজনীতি করতে চান। কথাগুলো সুন্দর শোনালেও, ভাবনার বিষয় অবশ্যই। জামায়াতে ইসলামী দলটিতে থেকে দীর্ঘদিনের 'ইনডকট্রিনেশন'-এর পথ পেরিয়ে নেতৃত্বের স্তরে পেঁৗছানো কুষ্টিয়ার এই নেতার 'হঠাৎ' উপলব্ধিকে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। একদিকে সবার সঙ্গে সমঝোতা করে চলার নীতি অবলম্বন ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়কে জোড়াতালি দিয়ে পরিচালনায় উৎসাহ দিয়ে 'নৈতিক দুর্নীতি'তে লিপ্ত হওয়া এবং অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতার বিত্তের পাহাড় গড়ে জামায়াতের সঙ্গে অগ্রহণযোগ্য সখ্য। বন ও পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের হেফাজতের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও তার কারণে দেশ ও বর্তমান সরকারের অপূরণীয় ক্ষতি এবং অন্যদিকে গত ৫ বছরে তার বিপুল বিত্তবৈভবের অধিকারী হয়ে যাওয়া_ এসব বিষয়কে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করি বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে, ফাঁসি হবে, ৪২ বছর ধরে গড়ে তোলা জামায়াতিদের সাম্রাজ্যের পতন হবে, তা কি শিবির-জঙ্গি-হেফাজতরা মেনে নিতে পারে? তাই গত বছরব্যাপী জামায়াত-শিবিরের মরিয়া সহিংসতা এবং গৃহযুদ্ধের হুমকি। ড. সলিমুল্লাহ খান যখন বলেন, বর্তমান সহিংসতার মূলে রয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সে কথায় ন্যায্যতা খুঁজে পাই।
এমনই একটি পরিস্থিতিকে সামনে নিয়ে করণীয় সম্পর্কে গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি, সরকার এবং বিশেষ করে গণজাগরণ সৃষ্টি করা নতুন প্রজন্মকে ভাবতে হবে। কর্তব্য স্থির করতে হবে। একটি সময়ে প্রলেতারিয়েত একনায়কত্বের কথা আমরা শুনেছি। তার অনুসারীও হয়েছি। যৌক্তিকতাও ছিল তার স্বপক্ষে। এখন ভিন্ন সময়। ভিন্ন পরিস্থিতি। ভিন্ন দ্বন্দ্ব। বর্তমান বিশ্বে শুভ পরিবর্তনের যে দোলাচল আমরা লক্ষ্য করছি, তাতে প্রয়োজনে সীমিত সময়ের জন্য হলেও 'গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের' কথা আমাদের গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করতে হবে। পূর্বে বর্ণিত মিউট্যান্ট এবং ডিমেন্টরদের সমূলে উপড়ে ফেলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শক্তির সুস্থ বিকাশের জন্য একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টিতে 'গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব' কাজ করবে। এ বিষয়ে লাতিন আমেরিকার একাধিক দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা আমাদের আলোকিত করতে পারে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটিকে সেসব বিবেচনা থেকে দেখতে হবে।
এ নির্বাচনের পর কেমন সরকার, কেমন মন্ত্রিসভা আমরা চাই, কী আমাদের প্রত্যাশা হবে তাদের কাছে, জেগে ওঠা নতুন প্রজন্মের করণীয় কী হবে_ সে সম্পর্কে আরও বলার ইচ্ছা রাখি পরবর্তী নিবন্ধে।
এই লেখার শিরোনামটি কবি গুরুর
"বিপদে মোরে রক্ষা করো
এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়" থেকে নিয়েছি। 'আমি'র জায়গায় 'মোরা' ব্যবহার করেছি সচেতনভাবেই। এ আহ্বানটি আমাদের সবার জন্য যারা ঘোর বিপদের মধ্যে থেকেও অসম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধকে সমাপ্ত করতে চান। আমরা তা করতে পারব, কারণ নতুন প্রজন্ম সেই গুরুভারটি নিজ স্কন্ধে নিয়েছে সচেতনভাবেই।
এসব সংগঠনে এখন আর বিএনপিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তারা লীন হয়ে গেছে জামায়াত-হেফাজত-উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীতে। ঘোর বিপদটি সেখানেই। ভেবে দেখুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির এ নির্বাচনটিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ছকে প্রতিস্থাপন করে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং তার পুত্র তারেক রহমান যেভাবে এ রাজনৈতিক দল ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোকে জামায়াতি ভাবাদর্শ এবং শক্তির অধীনতায় নিয়ে গেছেন, সেখানে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত মোর্চার জয়লাভের অর্থ দাঁড়ায় সরাসরি জামায়াত এবং তাদের একনিষ্ঠ অনুসারীদের জয়লাভ।
তার ভয়াবহতার কথা ভেবে দেখুন। ক্ষমতায় আসার আগেই যে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে তারা লিপ্ত হয়েছে, গত ২৯ ডিসেম্বর খালেদা জিয়া কোনো রাখঢাক ছাড়াই যেসব হুমকি দিয়েছেন, তার কথা ভাবুন। বিপরীতে গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল মোর্চার জয়লাভটি ব্যাখ্যা করি। যখন এই শক্তি ঐক্যবদ্ধ, দৃঢ় মোর্চাবদ্ধ, তখন আসিফ নজরুল, ফরহাদ মজহার, পিয়াস করিম, রিজওয়ানা হাসান, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, ড. ইউনূস গংয়ের মতো সুশীলদের তীক্ষষ্ট, তীব্র প্রচারণার পরও তারা জয়লাভ করতে পারে।
পেশাজীবী সংগঠনগুলোর মধ্যকার চরম দলীয়করণ, লেজুড়বৃত্তি এবং একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার পরিস্থিতি কেন হলো, তা আরও একটু পর্যালোচনা করা যাক। ইদানীং বাংলাদেশের সুশীলরা এ বিষয়ে হা-হুতাশ করছেন। তাদের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করার সঙ্গত কারণও আছে। কিন্তু এমনটা কেন হলো, তার ব্যাখ্যায় যাচ্ছেন না কেউ।
যে লক্ষ্য ও স্বপ্ন নিয়ে এ ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধ করেছে এবং সীমাহীন আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে জয়লাভও করেছে, তা থেকে ক্রমে আমরা পশ্চাদপসরণ করেছি। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা, পরে জাতীয় চার নেতাসহ মুক্তিযুদ্ধের অগ্রনায়কদের হত্যা এবং তারপর জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়া চক্রের হাতে দীর্ঘ ২১ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে জামায়াত-যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসনের বিষময় ফল হচ্ছে আজকের পেশাজীবী সংগঠনগুলোর চরম দেউলিয়াত্ব। জামায়াত ও তাদের অর্থ সাম্রাজ্যের কাছে পদানত হয়ে গেছেন এসব সংগঠনের নেতা-সদস্য। পদানত হয়ে গেছে তাদের মানবিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। পদানত হয়ে গেছেন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সরব সুশীলরা।
ঘোর বিপদের আরও কিছু চিত্র তুলে ধরি। ঢাকাসহ বাংলাদেশের অন্যান্য শহর ও জনপদের খেলার মাঠগুলো কাদের দখলে, তা একটু অনুসন্ধান করুন। জামায়াত-শিবির ও জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোর সদস্যদের খেলাধুলার নামে প্রশিক্ষণ ও মিলনস্থলে পরিণত হয়েছে এসব পাবলিক স্থাপন। এবার আসুন মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এসব শিক্ষা (?) প্রতিষ্ঠান এবং তাদের ছাত্রাবাসগুলোর খবর নিন। খবর নিন ব্যাংক, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিকস, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, ট্রান্সপোর্ট ও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর। একই চিত্র, একই ভয়াবহ অবস্থা। বাংলাদেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশের বিরুদ্ধে বিষফোঁড়াসম এসব মিউট্যান্ট এবং হ্যারি পটার উপাখ্যানে বর্ণিত হিম শীতল নিঃশ্বাস ফেলা 'মানুষের আত্মা শোষণকারী ডিমেন্টাররা' ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখের সামনে কি নিশ্চিন্তেই না এরা নিজেদের সংগঠিত করছে।
বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর কথাই ভাবুন। এ অস্থিতিশীল সময়েও হাজার হাজার ছেলেমেয়ের হাতে বই পেঁৗছে গেছে, সে জন্য তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। একই সঙ্গে তাকে বিনীত অনুরোধ করি_ এই যে খোদ ঢাকা শহরে সরকারি কলেজগুলোয় পদায়িত শিক্ষক, তাদের রাজনৈতিক পরিচয়টি আপনি জেনে নিন। কীভাবে সেখানে জামায়াতিকরণ করা হয়েছে, সেই চিত্রটি আপনার অজানা থাকার কথা নয়। কয়েক মাস আগে সংসদে দাঁড়িয়ে মাননীয় মন্ত্রী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষকদের সমালোচনা করলেন বটে। তবে অবাক হই যখন দেখি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে ১৯৭৩ সালের আইন অনুযায়ী পরিচালনা করতে গেলে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নূ্যনতম সহযোগিতাও আমাকে দেওয়া হয় না। এতে লাভবান হয় বিএনপি-জামায়াতপন্থি এবং সরকারি দলের কিছু সন্ত্রাসী শিক্ষক। শিক্ষামন্ত্রীর 'সকলের সাথে' সমঝোতা করে চলার নীতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসী শিক্ষকদের ত্রাসের রাজত্বের সমাপ্তি ঘটে না। 'প্রথম আলোর' সমীক্ষায় যেখানে দেখানো হয়, জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভয়াবহ বিপর্যয়ের কথা, সেই একই সমীক্ষাতেই শতকরা ৯০ ভাগ এই মন্ত্রী মহোদয়কে ইয়েস দেন। এর রহস্য কী? যে ৫ হাজার ব্যক্তি এ সমীক্ষায় অংশ নিয়েছেন, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় কী? শুধু তথাকথিত 'ক্লিন ইমেজ'-এর কারণেই কি শিক্ষামন্ত্রীর এত গ্রহণযোগ্যতা? দুর্নীতির কারণে ব্যাপকভাবে সমালোচিত শিক্ষামন্ত্রীর এপিএসের কথাই বলি। সবকিছুর পরও মন্ত্রী তার এপিএসের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। আমাদের কি তবে বিশ্বাস করতে হবে প্রথম আলো সমীক্ষায় অংশ নেওয়া কেউই এ কথা জানেন না? গত ৫ বছরে যাদের অর্থনৈতিক সম্পদ ব্যাপক এবং অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে, তাদের একজন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। গত ৩১ ডিসেম্বরের প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে, মাহবুবউল আলম হানিফের হাত ধরে কুষ্টিয়ার এক জামায়াত নেতার আওয়ামী লীগে যোগদান করার খবর। জামায়াতের এ নেতা দাবি করছেন, বর্তমান সময়ে জামায়াতের আন্দোলনের নামে নাশকতামূলক কাজকে তিনি সমর্থন করেন না এবং তাই তিনি স্বাধীনতার সপক্ষের দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে রাজনীতি করতে চান। কথাগুলো সুন্দর শোনালেও, ভাবনার বিষয় অবশ্যই। জামায়াতে ইসলামী দলটিতে থেকে দীর্ঘদিনের 'ইনডকট্রিনেশন'-এর পথ পেরিয়ে নেতৃত্বের স্তরে পেঁৗছানো কুষ্টিয়ার এই নেতার 'হঠাৎ' উপলব্ধিকে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। একদিকে সবার সঙ্গে সমঝোতা করে চলার নীতি অবলম্বন ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়কে জোড়াতালি দিয়ে পরিচালনায় উৎসাহ দিয়ে 'নৈতিক দুর্নীতি'তে লিপ্ত হওয়া এবং অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতার বিত্তের পাহাড় গড়ে জামায়াতের সঙ্গে অগ্রহণযোগ্য সখ্য। বন ও পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের হেফাজতের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও তার কারণে দেশ ও বর্তমান সরকারের অপূরণীয় ক্ষতি এবং অন্যদিকে গত ৫ বছরে তার বিপুল বিত্তবৈভবের অধিকারী হয়ে যাওয়া_ এসব বিষয়কে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করি বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে, ফাঁসি হবে, ৪২ বছর ধরে গড়ে তোলা জামায়াতিদের সাম্রাজ্যের পতন হবে, তা কি শিবির-জঙ্গি-হেফাজতরা মেনে নিতে পারে? তাই গত বছরব্যাপী জামায়াত-শিবিরের মরিয়া সহিংসতা এবং গৃহযুদ্ধের হুমকি। ড. সলিমুল্লাহ খান যখন বলেন, বর্তমান সহিংসতার মূলে রয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সে কথায় ন্যায্যতা খুঁজে পাই।
এমনই একটি পরিস্থিতিকে সামনে নিয়ে করণীয় সম্পর্কে গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি, সরকার এবং বিশেষ করে গণজাগরণ সৃষ্টি করা নতুন প্রজন্মকে ভাবতে হবে। কর্তব্য স্থির করতে হবে। একটি সময়ে প্রলেতারিয়েত একনায়কত্বের কথা আমরা শুনেছি। তার অনুসারীও হয়েছি। যৌক্তিকতাও ছিল তার স্বপক্ষে। এখন ভিন্ন সময়। ভিন্ন পরিস্থিতি। ভিন্ন দ্বন্দ্ব। বর্তমান বিশ্বে শুভ পরিবর্তনের যে দোলাচল আমরা লক্ষ্য করছি, তাতে প্রয়োজনে সীমিত সময়ের জন্য হলেও 'গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের' কথা আমাদের গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করতে হবে। পূর্বে বর্ণিত মিউট্যান্ট এবং ডিমেন্টরদের সমূলে উপড়ে ফেলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শক্তির সুস্থ বিকাশের জন্য একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টিতে 'গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব' কাজ করবে। এ বিষয়ে লাতিন আমেরিকার একাধিক দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা আমাদের আলোকিত করতে পারে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটিকে সেসব বিবেচনা থেকে দেখতে হবে।
এ নির্বাচনের পর কেমন সরকার, কেমন মন্ত্রিসভা আমরা চাই, কী আমাদের প্রত্যাশা হবে তাদের কাছে, জেগে ওঠা নতুন প্রজন্মের করণীয় কী হবে_ সে সম্পর্কে আরও বলার ইচ্ছা রাখি পরবর্তী নিবন্ধে।
এই লেখার শিরোনামটি কবি গুরুর
"বিপদে মোরে রক্ষা করো
এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়" থেকে নিয়েছি। 'আমি'র জায়গায় 'মোরা' ব্যবহার করেছি সচেতনভাবেই। এ আহ্বানটি আমাদের সবার জন্য যারা ঘোর বিপদের মধ্যে থেকেও অসম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধকে সমাপ্ত করতে চান। আমরা তা করতে পারব, কারণ নতুন প্রজন্ম সেই গুরুভারটি নিজ স্কন্ধে নিয়েছে সচেতনভাবেই।
No comments