সংঘাতের মধ্যেই কাল ভোট by মসিউর রহমান ও খানজয়দেব দাশ
হরতাল-অবরোধ
ও রাজনৈতিক সংঘাতের মধ্যেই আগামীকাল রোববার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট
গ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। গতকালই দেশের ৬টি জেলার ১৪টি ভোটকেন্দ্র
পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া দেশজুড়ে সহিংসতাও অব্যাহত আছে। দেশজুড়ে
অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচির পাশাপাশি নির্বাচন ঠেকাতে ৪৮ ঘণ্টার টানা
হরতালের ডাক দিয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট। বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা
জিয়া গতকাল শুক্রবার এক বিবৃতিতে নিজেকে গৃহবন্দি দাবি করে ভোট বর্জনের
জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক দায়িত্ব
রক্ষায় নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাখা হয়েছে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায়। ভোট
গ্রহণের সর্বশেষ প্রস্তুতি জানাতে আজ শনিবার সকাল সাড়ে ১১টায় ইসি কার্যালয়ে
সাংবাদিকদের মুখোমুখি হচ্ছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী
রকিবউদ্দীন আহমদ। দেশের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৪৭টিতে আগামীকাল সকাল ৮টা থেকে
বিকেল ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোট গ্রহণ চলবে। বাকি ১৫৩টি আসনে একক প্রার্থীর
কারণে ভোট গ্রহণের প্রয়োজন হচ্ছে না।
গত ২৫ নভেম্বর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই বিরোধী জোটের কর্মসূচিকে ঘিরে শতাধিক ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটেছে। গতকালও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীর পরীবাগ ও গুলিস্তানে দুটি যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ ও উত্তরার আবদুল্লাহপুরে দুটি বাসে অগি্নসংযোগ করা হয়েছে। ফেনীতে চারটি ভোটকেন্দ্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার
একটি কেন্দ্রে বোমা হামলা চালানো হয়। হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে নির্বাচনী মিছিলে হামলা চালিয়েছে ছাত্রদল। গাইবান্ধায় নির্বাচনী কেন্দ্র পরিদর্শনকালে পুলিশের ওপর হামলায় বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ফলে বাকি আসনগুলোতেও শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণ নিয়ে জনমনে সংশয় রয়েছে। সাধারণ ভোটারদের মধ্যে কমবেশি আতঙ্ক বিরাজ করছে। খোদ নির্বাচন কমিশনই প্রায় ১৮ হাজার ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ১০ হাজার কেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ (গুরুত্বপূর্ণ) হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় ভোটের পরও অধিক সময় সেনাবাহিনীকে মাঠে রাখার কথাও জানিয়েছেন সিইসি।
নির্বাচন কমিশন সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিক গতকাল সমকালকে জানিয়েছেন, ভোটারদের নির্বিঘ্নে ভোটদান নিশ্চিত করতে কমিশনের সাধ্যের মধ্যে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। দেশের দুর্গম তিন পার্বত্য জেলায় বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারও ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের বড় একটি রাজনৈতিক জোটের নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার হুমকির কারণে সঙ্গত কারণেই নিরাপত্তা বৃদ্ধির বিষয়টি কমিশন গুরুত্বসহকারে নিয়েছে।
ভোট ১৪৭ আসনে :নির্বাচন কমিশন সচিবালয় সূত্র জানায়, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জনের বিজয়ের ফলে এবার পাঁচ জেলায় নির্বাচনই হচ্ছে না। এগুলো হচ্ছে_ জয়পুরহাট, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও চাঁদপুর। এরই মধ্যে ১৯টি জেলার প্রায় সব ক'টি আসনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করছে নির্বাচন কমিশন। বিরোধী জোটের নির্বাচন প্রতিরোধে গঠিত সংগ্রাম কমিটির হামলা, জামায়াত-শিবিরের নাশকতার আশঙ্কা এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের শক্তি প্রদর্শনকে বিবেচনায় নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র চিহ্নিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা মাঠ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। সর্বশেষ গত বুধবার একটি গোয়েন্দা সংস্থা সারাদেশে গঠিত নির্বাচনবিরোধী সংগ্রাম কমিটি এবং কমিটির সদস্যদের নামের তালিকা নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়েছে। বৃহস্পতিবার গোয়েন্দা সংস্থার এ প্রতিবেদন রিটার্নিং কর্মকর্তা (জেলা প্রশাসক) ও জেলা পুলিশ সুপারদের কাছে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ ও র্যাব এ তালিকা ধরে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং সংগ্রাম কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি অভিযান চালাতে পারে।
কালকের ভোট গ্রহণের জন্য ইসির প্রশিক্ষিত পৌনে তিন লাখ ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রায় সাড়ে চার কোটি ব্যালট মুদ্রণ করে তা কমিশনের আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভোট গ্রহণের দিন সকালে ব্যালট পেপারসহ অন্যান্য সামগ্রী ভোটকেন্দ্রে নেওয়া হবে।
অর্ধেক ভোটার বঞ্চিত :সারাদেশের ৯ কোটি ১৯ লাখ ৯৬ হাজার ১০৬ ভোটারের মধ্যে এবার ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন মাত্র ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৮ জন। ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছেন ১২টি রাজনৈতিক দলের ৩৯০ প্রার্থী। ভোটকেন্দ্র ১৮ হাজার ২০৮টি; ভোটকক্ষ ৯১ হাজার ২১৩টি। নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করছেন ৫৯ জন, সহকারী রিটার্নিং অফিসার ২৮৭ জন। প্রিসাইডিং অফিসার ১৮ হাজার ২০৮ জন; সহকারী প্রিসাইডিং ৯১ হাজার ২১৩ ও পোলিং অফিসার ১ লাখ ৮২ হাজার ৪২৬ জন দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া দুই সদস্যের ইলেকট্রোরাল ইনকোয়ারি কমিটি কাজ করবে ১০৩টি, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্বে থাকবেন ১৪৭ জন; নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মধ্যে দায়িত্ব পালন করবেন ২৯৪ জন। এ ছাড়া দুর্গম এলাকা বিবেচনায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পার্বত্য তিন জেলার ৩৩টি কেন্দ্রে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হচ্ছে।
নির্বাচনে ১২ দল :ইসির নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪৩টি। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ১২টি দল। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থীসংখ্যা ১২০ জন, জাতীয় পার্টির (জাপা) ৬৫, জাতীয় পার্টির (জেপি) ২৭, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ২১, ওয়ার্কার্স পার্টির ১৬ ও বিএনএফের ২২ জন। এ ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী অন্য দলের মধ্যে গণতন্ত্রী পার্টি একটি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ছয়টি, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন তিনটি, গণফ্রন্ট একটি, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট একটি ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস দুটি আসনে প্রার্থী দিয়েছে।
কেন্দ্রে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা :নির্বাচন কমিশন গত বুধবার ভোটকেন্দ্র ও নির্বাচনী মালপত্রের সুরক্ষায় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কেউ যাতে আক্রমণ করে নির্বাচনী মালপত্র নষ্ট করতে না পারে, সে জন্য ভোটকেন্দ্রের চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করতে হবে। নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, ভোটকেন্দ্রসংলগ্ন রাস্তায় সব ধরনের যানবাহন ও জনসাধারণের চলাচল সীমিত করতে হবে। একই সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভ্রাম্যমাণ দল ও স্ট্রাইকিং ফোর্সের টহল জোরদার করতে হবে।
হেলিকপ্টার ব্যবহার করবে র্যাব :আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে র্যাব হেলিকপ্টার ব্যবহার করবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ইসি সচিবালয় ও বাহিনীগুলোর অনুরোধে বিমানবাহিনী প্রয়োজনীয়সংখ্যক হেলিকপ্টার পরিবহনে সহায়তা দেবে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক হেলিকপ্টার সুবিধাজনক স্থানে মোতায়েন রাখবে বিমানবাহিনী। সেনা সদরের বিবেচনায় প্রতিটি স্তরে প্রয়োজনীয়সংখ্যক সেনাসদস্য রিজার্ভ হিসেবে মোতায়েন থাকবে। তা ছাড়া দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে নির্বাচন কর্মকর্তা, নির্বাচনী মালপত্র পাঠাতেও হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হবে।
নতুন সাজে নির্বাচন কমিশন :প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ না নিলেও নির্বাচন কমিশন দেখে তা বোঝার উপায় নেই। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাজ সাজ রব বিরাজ করছে কমিশনে। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি গুছিয়ে নিতে চারদিকে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
শুক্রবার থেকেই কমিশন প্রাঙ্গণে টানানো হয়েছে বিশেষ ধরনের শামিয়ানা। রাতের জন্য করা হয়েছে আলোকসজ্জাও। নির্বাচনের পরদিনও কমিশনের এ সাজসজ্জা থাকবে। নির্বাচন কমিশনের জনসংযোগ পরিচালক এসএম আসাদুজ্জামান বলেন, নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ও গণমাধ্যমের কর্মীরা কমিশনে ভিড় করেন। এ জন্যই প্রতিবারের মতো এবারও কমিশন প্রাঙ্গণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
প্রচার ও যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা :প্রচার ও যানবাহন চলাচল সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের পরিপত্রে বলা হয়েছে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৭৮ বিধি অনুসারে ভোট গ্রহণ শুরুর পূর্ববর্তী ৪৮ ঘণ্টা হতে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা (শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে ৭ জানুয়ারি বিকেল ৪টা) পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকায় কোনো ধরনের প্রচার-প্রচারণা ও সমাবেশ করা যাবে না। এ সময়ে কোনো ধরনের নাশকতামূলক কর্মকা , ভোটার ও ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের কোনো ধরনের ভয়-ভীতি বা অস্ত্র প্রদর্শন করা যাবে না। এ ধরনের অপরাধের জন্য দুই থেকে সাত বছর সশ্রম কারাদ ের বিধান আছে।
পরিপত্রে আরও বলা হয়েছে, ৪ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১২টা থেকে ৫ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১২টা পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকায় ট্যাক্সিক্যাব, বেবিট্যাক্সি বা অটোরিকশা, মাইক্রোবাস, জিপ, পিকআপ, কার, বাস, ট্রাক, টেম্পো, লঞ্চ, ইজিবাইক, ইঞ্জিনবোট ও স্পিডবোটের চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকবে। মহানগর এলাকায় ট্যাক্সিক্যাব, মাইক্রোবাস, পিকআপ ও জিপ চলাচলের ওপর উক্ত নিষেধাজ্ঞা থাকবে। এ ছাড়া আজ রাত ১২টা থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকবে। তবে জাতীয় হাইওয়ের ক্ষেত্রে এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না। গত ১৯ নভেম্বর বর্তমান কমিশন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে ২৫ নভেম্বর দশম সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে।
ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশন কেন্দ্র স্থাপন :রিটার্নিং অফিসারদের থেকে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে ভোট গ্রহণ চলাকালে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও ভোট গ্রহণ শেষে প্রাথমিক বেসরকারি ফলাফল সংগ্রহ ও প্রকাশ করতে ইসি সচিবালয়ে একটি 'ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশন কেন্দ্র' স্থাপন করা হয়েছে। আগামীকাল রোববার সকাল ৮টা থেকে সর্বশেষ বেসরকারি ফলাফল না পাওয়া পর্যন্ত এ কেন্দ্রের কর্মীরা কাজ করবেন।
এ ছাড়া রেজাল্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (আরএমএস) পদ্ধতিতে ইন্টারনেটের মাধ্যমেও সারাদেশের ফলাফল সংগ্রহ করবে কমিশন। ইতিমধ্যে সারাদেশে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে এ জন্য সফটওয়্যার বিতরণ করা হয়েছে।
গত ২৫ নভেম্বর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই বিরোধী জোটের কর্মসূচিকে ঘিরে শতাধিক ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটেছে। গতকালও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীর পরীবাগ ও গুলিস্তানে দুটি যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ ও উত্তরার আবদুল্লাহপুরে দুটি বাসে অগি্নসংযোগ করা হয়েছে। ফেনীতে চারটি ভোটকেন্দ্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার
একটি কেন্দ্রে বোমা হামলা চালানো হয়। হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে নির্বাচনী মিছিলে হামলা চালিয়েছে ছাত্রদল। গাইবান্ধায় নির্বাচনী কেন্দ্র পরিদর্শনকালে পুলিশের ওপর হামলায় বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ফলে বাকি আসনগুলোতেও শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণ নিয়ে জনমনে সংশয় রয়েছে। সাধারণ ভোটারদের মধ্যে কমবেশি আতঙ্ক বিরাজ করছে। খোদ নির্বাচন কমিশনই প্রায় ১৮ হাজার ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ১০ হাজার কেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ (গুরুত্বপূর্ণ) হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় ভোটের পরও অধিক সময় সেনাবাহিনীকে মাঠে রাখার কথাও জানিয়েছেন সিইসি।
নির্বাচন কমিশন সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিক গতকাল সমকালকে জানিয়েছেন, ভোটারদের নির্বিঘ্নে ভোটদান নিশ্চিত করতে কমিশনের সাধ্যের মধ্যে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। দেশের দুর্গম তিন পার্বত্য জেলায় বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারও ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের বড় একটি রাজনৈতিক জোটের নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার হুমকির কারণে সঙ্গত কারণেই নিরাপত্তা বৃদ্ধির বিষয়টি কমিশন গুরুত্বসহকারে নিয়েছে।
ভোট ১৪৭ আসনে :নির্বাচন কমিশন সচিবালয় সূত্র জানায়, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জনের বিজয়ের ফলে এবার পাঁচ জেলায় নির্বাচনই হচ্ছে না। এগুলো হচ্ছে_ জয়পুরহাট, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও চাঁদপুর। এরই মধ্যে ১৯টি জেলার প্রায় সব ক'টি আসনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করছে নির্বাচন কমিশন। বিরোধী জোটের নির্বাচন প্রতিরোধে গঠিত সংগ্রাম কমিটির হামলা, জামায়াত-শিবিরের নাশকতার আশঙ্কা এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের শক্তি প্রদর্শনকে বিবেচনায় নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র চিহ্নিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা মাঠ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। সর্বশেষ গত বুধবার একটি গোয়েন্দা সংস্থা সারাদেশে গঠিত নির্বাচনবিরোধী সংগ্রাম কমিটি এবং কমিটির সদস্যদের নামের তালিকা নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়েছে। বৃহস্পতিবার গোয়েন্দা সংস্থার এ প্রতিবেদন রিটার্নিং কর্মকর্তা (জেলা প্রশাসক) ও জেলা পুলিশ সুপারদের কাছে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ ও র্যাব এ তালিকা ধরে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং সংগ্রাম কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি অভিযান চালাতে পারে।
কালকের ভোট গ্রহণের জন্য ইসির প্রশিক্ষিত পৌনে তিন লাখ ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রায় সাড়ে চার কোটি ব্যালট মুদ্রণ করে তা কমিশনের আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভোট গ্রহণের দিন সকালে ব্যালট পেপারসহ অন্যান্য সামগ্রী ভোটকেন্দ্রে নেওয়া হবে।
অর্ধেক ভোটার বঞ্চিত :সারাদেশের ৯ কোটি ১৯ লাখ ৯৬ হাজার ১০৬ ভোটারের মধ্যে এবার ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন মাত্র ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৮ জন। ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছেন ১২টি রাজনৈতিক দলের ৩৯০ প্রার্থী। ভোটকেন্দ্র ১৮ হাজার ২০৮টি; ভোটকক্ষ ৯১ হাজার ২১৩টি। নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করছেন ৫৯ জন, সহকারী রিটার্নিং অফিসার ২৮৭ জন। প্রিসাইডিং অফিসার ১৮ হাজার ২০৮ জন; সহকারী প্রিসাইডিং ৯১ হাজার ২১৩ ও পোলিং অফিসার ১ লাখ ৮২ হাজার ৪২৬ জন দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া দুই সদস্যের ইলেকট্রোরাল ইনকোয়ারি কমিটি কাজ করবে ১০৩টি, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্বে থাকবেন ১৪৭ জন; নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মধ্যে দায়িত্ব পালন করবেন ২৯৪ জন। এ ছাড়া দুর্গম এলাকা বিবেচনায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পার্বত্য তিন জেলার ৩৩টি কেন্দ্রে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হচ্ছে।
নির্বাচনে ১২ দল :ইসির নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪৩টি। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ১২টি দল। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থীসংখ্যা ১২০ জন, জাতীয় পার্টির (জাপা) ৬৫, জাতীয় পার্টির (জেপি) ২৭, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ২১, ওয়ার্কার্স পার্টির ১৬ ও বিএনএফের ২২ জন। এ ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী অন্য দলের মধ্যে গণতন্ত্রী পার্টি একটি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ছয়টি, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন তিনটি, গণফ্রন্ট একটি, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট একটি ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস দুটি আসনে প্রার্থী দিয়েছে।
কেন্দ্রে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা :নির্বাচন কমিশন গত বুধবার ভোটকেন্দ্র ও নির্বাচনী মালপত্রের সুরক্ষায় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কেউ যাতে আক্রমণ করে নির্বাচনী মালপত্র নষ্ট করতে না পারে, সে জন্য ভোটকেন্দ্রের চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করতে হবে। নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, ভোটকেন্দ্রসংলগ্ন রাস্তায় সব ধরনের যানবাহন ও জনসাধারণের চলাচল সীমিত করতে হবে। একই সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভ্রাম্যমাণ দল ও স্ট্রাইকিং ফোর্সের টহল জোরদার করতে হবে।
হেলিকপ্টার ব্যবহার করবে র্যাব :আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে র্যাব হেলিকপ্টার ব্যবহার করবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ইসি সচিবালয় ও বাহিনীগুলোর অনুরোধে বিমানবাহিনী প্রয়োজনীয়সংখ্যক হেলিকপ্টার পরিবহনে সহায়তা দেবে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক হেলিকপ্টার সুবিধাজনক স্থানে মোতায়েন রাখবে বিমানবাহিনী। সেনা সদরের বিবেচনায় প্রতিটি স্তরে প্রয়োজনীয়সংখ্যক সেনাসদস্য রিজার্ভ হিসেবে মোতায়েন থাকবে। তা ছাড়া দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে নির্বাচন কর্মকর্তা, নির্বাচনী মালপত্র পাঠাতেও হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হবে।
নতুন সাজে নির্বাচন কমিশন :প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ না নিলেও নির্বাচন কমিশন দেখে তা বোঝার উপায় নেই। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাজ সাজ রব বিরাজ করছে কমিশনে। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি গুছিয়ে নিতে চারদিকে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
শুক্রবার থেকেই কমিশন প্রাঙ্গণে টানানো হয়েছে বিশেষ ধরনের শামিয়ানা। রাতের জন্য করা হয়েছে আলোকসজ্জাও। নির্বাচনের পরদিনও কমিশনের এ সাজসজ্জা থাকবে। নির্বাচন কমিশনের জনসংযোগ পরিচালক এসএম আসাদুজ্জামান বলেন, নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ও গণমাধ্যমের কর্মীরা কমিশনে ভিড় করেন। এ জন্যই প্রতিবারের মতো এবারও কমিশন প্রাঙ্গণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
প্রচার ও যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা :প্রচার ও যানবাহন চলাচল সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের পরিপত্রে বলা হয়েছে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৭৮ বিধি অনুসারে ভোট গ্রহণ শুরুর পূর্ববর্তী ৪৮ ঘণ্টা হতে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা (শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে ৭ জানুয়ারি বিকেল ৪টা) পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকায় কোনো ধরনের প্রচার-প্রচারণা ও সমাবেশ করা যাবে না। এ সময়ে কোনো ধরনের নাশকতামূলক কর্মকা , ভোটার ও ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের কোনো ধরনের ভয়-ভীতি বা অস্ত্র প্রদর্শন করা যাবে না। এ ধরনের অপরাধের জন্য দুই থেকে সাত বছর সশ্রম কারাদ ের বিধান আছে।
পরিপত্রে আরও বলা হয়েছে, ৪ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১২টা থেকে ৫ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১২টা পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকায় ট্যাক্সিক্যাব, বেবিট্যাক্সি বা অটোরিকশা, মাইক্রোবাস, জিপ, পিকআপ, কার, বাস, ট্রাক, টেম্পো, লঞ্চ, ইজিবাইক, ইঞ্জিনবোট ও স্পিডবোটের চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকবে। মহানগর এলাকায় ট্যাক্সিক্যাব, মাইক্রোবাস, পিকআপ ও জিপ চলাচলের ওপর উক্ত নিষেধাজ্ঞা থাকবে। এ ছাড়া আজ রাত ১২টা থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকবে। তবে জাতীয় হাইওয়ের ক্ষেত্রে এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না। গত ১৯ নভেম্বর বর্তমান কমিশন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে ২৫ নভেম্বর দশম সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে।
ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশন কেন্দ্র স্থাপন :রিটার্নিং অফিসারদের থেকে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে ভোট গ্রহণ চলাকালে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও ভোট গ্রহণ শেষে প্রাথমিক বেসরকারি ফলাফল সংগ্রহ ও প্রকাশ করতে ইসি সচিবালয়ে একটি 'ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশন কেন্দ্র' স্থাপন করা হয়েছে। আগামীকাল রোববার সকাল ৮টা থেকে সর্বশেষ বেসরকারি ফলাফল না পাওয়া পর্যন্ত এ কেন্দ্রের কর্মীরা কাজ করবেন।
এ ছাড়া রেজাল্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (আরএমএস) পদ্ধতিতে ইন্টারনেটের মাধ্যমেও সারাদেশের ফলাফল সংগ্রহ করবে কমিশন। ইতিমধ্যে সারাদেশে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে এ জন্য সফটওয়্যার বিতরণ করা হয়েছে।
No comments