ভোট নেই, গণতন্ত্র আছে
ভোট নেই। দেশের অর্ধেকেরও বেশি ভোটারের মতো অধমেরও ভোট নেই। অর্থাৎ অর্ধেকেরও বেশি আসনে পাঠকমাত্রই জানেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। যেসব আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ নির্বাচিত হয়ে গেছেন—ইদানীং নতুন শব্দ চালু হয়েছে, ‘অটো এমপি’—তাঁদের এলাকার ভোটারদের ভোট নেই, ভোট দেওয়ার দরকার নেই। অন্যান্য এলাকার ভোটাররা অনেক বেশি সৌভাগ্যবান। ইচ্ছে করলে তাঁরা ভোট দিতে পারবেন। পারবেন বলেই যে ভোট দিতে যাবেন, এমন মুচলেকা নিশ্চয় কেউ দেননি। হয়তো যাবেন, হয়তো যাবেন না। তথাকথিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে এমন অনেক এলাকায় আসলেই প্রতিদ্বন্দ্বী আছেন কি না, সেটাও তো সঠিক করে বলা যাচ্ছে না। এরশাদ সাহেব বলছেন, তিনি নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেই। অন্যরা বলছেন, এরশাদ সাহেব গলফ খেলায় ব্যস্ত, তাই নির্বাচনী প্রচারণায় নেই, তবে নির্বাচনে আছেন। তাঁর স্ত্রী রওশন সম্ভবত নির্বাচনে আছেন, তাঁর ভাই জি এম কাদের যে নেই, সেটা মোটামুটি নিশ্চিত। কারও ভোট আছে, তবে বেশির ভাগেরই নেই, কোথাও প্রার্থী আছেন একাধিক, কোথাও কোথাও আছেন কি নেই, সেটাও বোঝা মুশকিল। এত সব উদ্ভট পরিস্থিতিতে নির্বাচন হচ্ছে, গণতন্ত্র নাকি আছে। কথা তাই জমে গেছে অনেক। দেশ অশান্ত, মনও তাই বিক্ষিপ্ত। সবারই।
২. যুক্তরাজ্য থেকে নিকট আত্মীয় ছুটিতে বেড়াতে ঢাকায় এসেছে। এখন ওরা যুক্তরাজ্যের নাগরিক, যদিও বহু বছর আগে জন্ম বাংলাদেশে। তাদের মতো বাংলাদেশে জন্ম কিন্তু এখন যুক্তরাজ্যের নাগরিক অর্থাৎ ‘ব্রিটিশ পাসপোর্ট’, এমন লোকের সংখ্যা লক্ষাধিক। বেড়াতে আসা এমন এক আত্মীয়কেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম—আপনাদের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন যদি আপনাকে কটাক্ষ করে বলতেন—আপনাদের জন্ম তো বাংলাদেশে। এত ‘ইংল্যান্ড ইংল্যান্ড’ করেন কেন, তাহলে কেমন লাগত? প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোক তাজ্জব। ভাবখানা, জন্ম যেখানেই হোক না কেন, আমি তো এখন ব্রিটিশ, আমার জন্মস্থানের কথা তুলে আমাকে যদি কোনো প্রকারে ছোট বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়, তাহলে সেটা তো হবে বৈষম্যমূলক আচরণ। ধর্ম, বর্ণ, জন্মস্থান ইত্যাদির দোহাই দিয়ে ভিন্ন আচরণ করা তো সংবিধান বা সাংবিধানিক আইনে নিষিদ্ধ করা আছে। তোমাদের সংবিধান কি বৈষম্যমূলক আচরণ অনুমোদন করে? পাল্টা প্রশ্ন ভদ্রলোকের। বেশ কয়েক মাস ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের বাড়িঘর, ব্যবসা-দোকানপাট জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অভিযোগের তর্জনী জামায়াত-শিবিরের দিকে। কেন জ্বালাচ্ছে? কারণটা নিঃসন্দেহে বৈষম্যমূলক চিন্তা-চেতনা থেকেই উদ্ভূত। অর্থাৎ হিন্দু, অতএব এই ভিন্নধর্ম সহ্য করা হবে না বা যাবে না। এবং যেহেতু তারা হিন্দু, অতএব তাদের দেশপ্রেম নিশ্চয় কম, তারা নিশ্চয় হিন্দু-ভারতের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। ধর্ম, বর্ণ, জন্মস্থানের কারণে যে কারও প্রতি ভিন্ন আচরণ করা সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ, সেটা জামায়াত-শিবিররা সম্ভবত এখনো জানে না। তাই তারা সংখ্যালঘুদের ঘৃণা করে। তাই বলে খোদ প্রধানমন্ত্রীও কি একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করবেন? ‘তার জন্ম ভারতে আর অন্তরে পাকিস্তান’—বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর উক্তি (প্রথম আলো, ২ জানুয়ারি)। প্রেসিডেন্ট ওবামা সম্পর্কে আমেরিকার কোনো রাজনীতিবিদ যদি ঘুণাক্ষরেও ইঙ্গিত করতেন—ওবামার বাবা তো কেনিয়ার, তাই ওবামার আফ্রিকাপ্রীতি আমেরিকাপ্রীতি থেকে বেশি, তাহলে এত জঘন্য বৈষম্যমূলক আচরণ বা কথনের জন্য সে রাজনীতিবিদ হয়ে যেতেন সারা জীবনের জন্য ত্যাজ্য—জনগণের দ্বারা। বলা বাহুল্য, খালেদা জিয়াও মোটামুটি একই দোষে দোষী ‘গোপালি’ উক্তির কারণে। তবে রাগের মাথায় ক্ষোভের মাথায় দুটো কড়া শব্দ বেরিয়ে গেছে—এটা স্বীকার করে নিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। তবে শঙ্কা, আমাদের রাজনীতিতে যে যত বেশি অগণতান্ত্রিক-অসহিষ্ণু-অযৌক্তিক হতে পারেন, সে তত বড় নেতা। এটাই আমাদের কালো-নীতি।
৩. আমাদের ইদানীংকার গণতন্ত্র আমেরিকান সিনেটর জোসেফ ম্যাককার্থির কথা মনে করিয়ে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সিনেটর নির্বাচিত হওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যুদ্ধসংক্রান্ত ব্যবসায় প্রচুর লাভবান হওয়ার এবং নিজেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীর যোদ্ধা হিসেবে (মিথ্যা) প্রচার করে নির্বাচনে জিতেছিলেন। পরে ১৯৫০-এর দশকে, সিনেটর থাকা অবস্থায় যে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বা প্রতিযোগী বা বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা/সদস্যকে অপছন্দ বা ঘায়েল করতে চাইতেন, তাঁকেই তিনি কমিউনিস্ট হিসেবে আখ্যায়িত করতেন। গত শতাব্দীর মধ্যভাগে সোভিয়েত আর যুক্তরাষ্ট্রের ‘ঠান্ডা যুদ্ধের’ সময় সিনেটর জোসেফ ম্যাককার্থির কমিউনিস্টবিরোধী তৎপরতা ম্যাককার্থিজম হিসেবে পরিচিতি লাভ। হলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের থেকে শুরু করে কবি, সাহিত্যিক, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, আইনজীবী এবং সরকারি চাকুরে—কেউ রেহাই পাননি। ম্যাককার্থি আর তাঁর দলবলের তথাকথিত অনুসন্ধানে কেউ ‘কমিউনিস্ট’ ‘প্রমাণিত’ হলেই তাঁর পেশা-জীবিকা সব শেষ। আশঙ্কা হয়, আমাদের রাজনীতিতে ম্যাককার্থিজমের কু-প্রভাব পড়ছে। যাকে-তাকে সত্য-মিথ্যার বাছবিচার না করে অথবা তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে বলা হচ্ছে—ওই ব্যাটা যুদ্ধাপরাধী বা যুদ্ধাপরাধীর দোসর। অমুকের বাবা ১৯৭১ সালে চাকরি করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন বা ছাত্র ছিলেন—অতএব তারা যুদ্ধাপরাধীর দোসর। দেশ স্বাধীন করেছে কেবল এবং শুধু আওয়ামী লীগ। অতএব যারা আওয়ামী লীগ পছন্দ করে না বা আওয়ামী রাজনীতির বিরোধিতা করে, তারা নিঃসন্দেহে রাজাকার-যুদ্ধাপরাধী। কি সাহসে তারা বাংলাদেশের পতাকা ধরে! স্পষ্টতই অধম আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ত্যক্তবিরক্ত। তাই ইতিমধ্যে রাজাকার হয়ে না গেলেও অচিরেই হয়ে যাব। ম্যাককার্থির আমেরিকায় যেমন নিঃসন্দেহে হয়ে যেতাম কমিউনিস্ট। আর বিএনপির সময় ভারতের দালাল। সেদিন বিরোধী দলের নেত্রীর কথায় ভীষণ ঝাঁজ ছিল র্যাবের বিরুদ্ধে। প্রথম ক্রসফায়ারের পর ২০০৪-এ লিখেছিলাম, ২০০৫-এ লিখেছিলাম, ২০০৬-এও লিখেছিলাম র্যাব ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হবে। এ সরকারের আমলে লিখেছি, এখন গুম হচ্ছে বিরোধীরা; যখন আপনারা বিরোধী হবেন, তখনো গুম হবে বিরোধীরা।
৪. আমরা যাঁরা ভোট দিতে পারছি না, তাঁরা কি যাঁরা আমাদের ‘প্রতিনিধি’ হয়ে সংসদে বসবেন, তাঁদের কি আমরা মানতে বাধ্য? নৈতিকভাবে বা নৈতিকতার বিচারে তাঁদের যে জনপ্রতিনিধি মানতে বাধ্য না, সেটা নিশ্চয় কেউ অস্বীকার করবেন না। বলতে পারেন, আইনগতভাবে মানতে বাধ্য। কারণ, তাঁরা আইনানুযায়ী নির্বাচিত। হতে পারেন, না-ও হতে পারেন, সে বিতর্কে যাচ্ছি না। দেশ-জাতির বড় বড় ইস্যুতে যেখানে আইন ও নৈতিকতা পরস্পরবিরোধী অবস্থানে, তখন অনৈতিক আইনের বিধান অমান্য করাই সর্বোচ্চ নৈতিক দায়িত্ব। শতবর্ষ আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় ট্রেনের গার্ড যখন মহাত্মা গান্ধীকে ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট থাকা সত্ত্বেও ট্রেন থেকে নামিয়ে দিয়েছিল এই বলে যে অশেতাঙ্গের অর্থাৎ কালো-আদমির ফার্স্ট ক্লাসে চড়া নিষেধ, কারণ এটাই আইন। তখন ট্রেন থেকে বহিষ্কৃত হয়ে ট্রেনের প্ল্যাটফর্মে বসে ছিলেন প্রতিবাদ করে এ কারণেই যে অনৈতিক আইন অমান্য করাই সর্বোত্তম নৈতিকতা। ১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আইন যখন বিধান করে রেখেছিল সাদা-কালো তফাত-ফারাক-ভিন্ন থাকবে, তখন মার্টিন লুথার কিংয়ের সেই বিখ্যাত বক্তৃতা—আমি স্বপ্ন দেখি যে একদিন আমেরিকায় সব মানুষ সমান হবে (সাদা-কালোয় ফারাক থাকবে না)। কমবেশি আমরা পাঁচ কোটি ভোটার এ নির্বাচনে ভোট দিতে পারছি না। আমাদের বলা হচ্ছে আমাদের প্রতিনিধি নাকি ‘নির্বাচিত’ হয়ে আছেন। আমরা ফাউ, কিন্তু আমাদের সংবিধান তো বলে আমরা নাগরিকেরা প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক। এখন দেখছি কিছু লোক জোগসাজশে তথাকথিত নির্বাচনের নামে আমাদের মালিকানা থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছেন। আর কমবেশি যে চার কোটি বা তার কিছু বেশি ভোটারের নামকাওয়াস্তে ভোট প্রয়োগের আইনানুগ সুযোগ আছে, তাঁরা কি মনে করবেন যে নৈতিকভাবেও এটা সিদ্ধ নির্বাচন। তর্কের খাতিরে আপাতত মেনে নিচ্ছি যে শত দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও এটা আইনানুগ নির্বাচন। কিন্তু এই নির্বাচনে ভোট দিয়ে নিজের বিবেককে, নৈতিকতাকে উৎফুল্ল করতে পারবেন? আর আমাদের ভোট হারানোর বেদনায় একটুও সমবেদনা কি আশা করতে পারি না। আশা কি করতে পারি যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আর নৈতিকতার প্রশ্নে ভোটদানে বিরত থাকবেন!
ড. শাহদীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট; অধ্যাপক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি।
২. যুক্তরাজ্য থেকে নিকট আত্মীয় ছুটিতে বেড়াতে ঢাকায় এসেছে। এখন ওরা যুক্তরাজ্যের নাগরিক, যদিও বহু বছর আগে জন্ম বাংলাদেশে। তাদের মতো বাংলাদেশে জন্ম কিন্তু এখন যুক্তরাজ্যের নাগরিক অর্থাৎ ‘ব্রিটিশ পাসপোর্ট’, এমন লোকের সংখ্যা লক্ষাধিক। বেড়াতে আসা এমন এক আত্মীয়কেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম—আপনাদের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন যদি আপনাকে কটাক্ষ করে বলতেন—আপনাদের জন্ম তো বাংলাদেশে। এত ‘ইংল্যান্ড ইংল্যান্ড’ করেন কেন, তাহলে কেমন লাগত? প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোক তাজ্জব। ভাবখানা, জন্ম যেখানেই হোক না কেন, আমি তো এখন ব্রিটিশ, আমার জন্মস্থানের কথা তুলে আমাকে যদি কোনো প্রকারে ছোট বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়, তাহলে সেটা তো হবে বৈষম্যমূলক আচরণ। ধর্ম, বর্ণ, জন্মস্থান ইত্যাদির দোহাই দিয়ে ভিন্ন আচরণ করা তো সংবিধান বা সাংবিধানিক আইনে নিষিদ্ধ করা আছে। তোমাদের সংবিধান কি বৈষম্যমূলক আচরণ অনুমোদন করে? পাল্টা প্রশ্ন ভদ্রলোকের। বেশ কয়েক মাস ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের বাড়িঘর, ব্যবসা-দোকানপাট জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অভিযোগের তর্জনী জামায়াত-শিবিরের দিকে। কেন জ্বালাচ্ছে? কারণটা নিঃসন্দেহে বৈষম্যমূলক চিন্তা-চেতনা থেকেই উদ্ভূত। অর্থাৎ হিন্দু, অতএব এই ভিন্নধর্ম সহ্য করা হবে না বা যাবে না। এবং যেহেতু তারা হিন্দু, অতএব তাদের দেশপ্রেম নিশ্চয় কম, তারা নিশ্চয় হিন্দু-ভারতের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। ধর্ম, বর্ণ, জন্মস্থানের কারণে যে কারও প্রতি ভিন্ন আচরণ করা সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ, সেটা জামায়াত-শিবিররা সম্ভবত এখনো জানে না। তাই তারা সংখ্যালঘুদের ঘৃণা করে। তাই বলে খোদ প্রধানমন্ত্রীও কি একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করবেন? ‘তার জন্ম ভারতে আর অন্তরে পাকিস্তান’—বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর উক্তি (প্রথম আলো, ২ জানুয়ারি)। প্রেসিডেন্ট ওবামা সম্পর্কে আমেরিকার কোনো রাজনীতিবিদ যদি ঘুণাক্ষরেও ইঙ্গিত করতেন—ওবামার বাবা তো কেনিয়ার, তাই ওবামার আফ্রিকাপ্রীতি আমেরিকাপ্রীতি থেকে বেশি, তাহলে এত জঘন্য বৈষম্যমূলক আচরণ বা কথনের জন্য সে রাজনীতিবিদ হয়ে যেতেন সারা জীবনের জন্য ত্যাজ্য—জনগণের দ্বারা। বলা বাহুল্য, খালেদা জিয়াও মোটামুটি একই দোষে দোষী ‘গোপালি’ উক্তির কারণে। তবে রাগের মাথায় ক্ষোভের মাথায় দুটো কড়া শব্দ বেরিয়ে গেছে—এটা স্বীকার করে নিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। তবে শঙ্কা, আমাদের রাজনীতিতে যে যত বেশি অগণতান্ত্রিক-অসহিষ্ণু-অযৌক্তিক হতে পারেন, সে তত বড় নেতা। এটাই আমাদের কালো-নীতি।
৩. আমাদের ইদানীংকার গণতন্ত্র আমেরিকান সিনেটর জোসেফ ম্যাককার্থির কথা মনে করিয়ে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সিনেটর নির্বাচিত হওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যুদ্ধসংক্রান্ত ব্যবসায় প্রচুর লাভবান হওয়ার এবং নিজেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীর যোদ্ধা হিসেবে (মিথ্যা) প্রচার করে নির্বাচনে জিতেছিলেন। পরে ১৯৫০-এর দশকে, সিনেটর থাকা অবস্থায় যে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বা প্রতিযোগী বা বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা/সদস্যকে অপছন্দ বা ঘায়েল করতে চাইতেন, তাঁকেই তিনি কমিউনিস্ট হিসেবে আখ্যায়িত করতেন। গত শতাব্দীর মধ্যভাগে সোভিয়েত আর যুক্তরাষ্ট্রের ‘ঠান্ডা যুদ্ধের’ সময় সিনেটর জোসেফ ম্যাককার্থির কমিউনিস্টবিরোধী তৎপরতা ম্যাককার্থিজম হিসেবে পরিচিতি লাভ। হলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের থেকে শুরু করে কবি, সাহিত্যিক, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, আইনজীবী এবং সরকারি চাকুরে—কেউ রেহাই পাননি। ম্যাককার্থি আর তাঁর দলবলের তথাকথিত অনুসন্ধানে কেউ ‘কমিউনিস্ট’ ‘প্রমাণিত’ হলেই তাঁর পেশা-জীবিকা সব শেষ। আশঙ্কা হয়, আমাদের রাজনীতিতে ম্যাককার্থিজমের কু-প্রভাব পড়ছে। যাকে-তাকে সত্য-মিথ্যার বাছবিচার না করে অথবা তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে বলা হচ্ছে—ওই ব্যাটা যুদ্ধাপরাধী বা যুদ্ধাপরাধীর দোসর। অমুকের বাবা ১৯৭১ সালে চাকরি করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন বা ছাত্র ছিলেন—অতএব তারা যুদ্ধাপরাধীর দোসর। দেশ স্বাধীন করেছে কেবল এবং শুধু আওয়ামী লীগ। অতএব যারা আওয়ামী লীগ পছন্দ করে না বা আওয়ামী রাজনীতির বিরোধিতা করে, তারা নিঃসন্দেহে রাজাকার-যুদ্ধাপরাধী। কি সাহসে তারা বাংলাদেশের পতাকা ধরে! স্পষ্টতই অধম আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ত্যক্তবিরক্ত। তাই ইতিমধ্যে রাজাকার হয়ে না গেলেও অচিরেই হয়ে যাব। ম্যাককার্থির আমেরিকায় যেমন নিঃসন্দেহে হয়ে যেতাম কমিউনিস্ট। আর বিএনপির সময় ভারতের দালাল। সেদিন বিরোধী দলের নেত্রীর কথায় ভীষণ ঝাঁজ ছিল র্যাবের বিরুদ্ধে। প্রথম ক্রসফায়ারের পর ২০০৪-এ লিখেছিলাম, ২০০৫-এ লিখেছিলাম, ২০০৬-এও লিখেছিলাম র্যাব ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হবে। এ সরকারের আমলে লিখেছি, এখন গুম হচ্ছে বিরোধীরা; যখন আপনারা বিরোধী হবেন, তখনো গুম হবে বিরোধীরা।
৪. আমরা যাঁরা ভোট দিতে পারছি না, তাঁরা কি যাঁরা আমাদের ‘প্রতিনিধি’ হয়ে সংসদে বসবেন, তাঁদের কি আমরা মানতে বাধ্য? নৈতিকভাবে বা নৈতিকতার বিচারে তাঁদের যে জনপ্রতিনিধি মানতে বাধ্য না, সেটা নিশ্চয় কেউ অস্বীকার করবেন না। বলতে পারেন, আইনগতভাবে মানতে বাধ্য। কারণ, তাঁরা আইনানুযায়ী নির্বাচিত। হতে পারেন, না-ও হতে পারেন, সে বিতর্কে যাচ্ছি না। দেশ-জাতির বড় বড় ইস্যুতে যেখানে আইন ও নৈতিকতা পরস্পরবিরোধী অবস্থানে, তখন অনৈতিক আইনের বিধান অমান্য করাই সর্বোচ্চ নৈতিক দায়িত্ব। শতবর্ষ আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় ট্রেনের গার্ড যখন মহাত্মা গান্ধীকে ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট থাকা সত্ত্বেও ট্রেন থেকে নামিয়ে দিয়েছিল এই বলে যে অশেতাঙ্গের অর্থাৎ কালো-আদমির ফার্স্ট ক্লাসে চড়া নিষেধ, কারণ এটাই আইন। তখন ট্রেন থেকে বহিষ্কৃত হয়ে ট্রেনের প্ল্যাটফর্মে বসে ছিলেন প্রতিবাদ করে এ কারণেই যে অনৈতিক আইন অমান্য করাই সর্বোত্তম নৈতিকতা। ১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আইন যখন বিধান করে রেখেছিল সাদা-কালো তফাত-ফারাক-ভিন্ন থাকবে, তখন মার্টিন লুথার কিংয়ের সেই বিখ্যাত বক্তৃতা—আমি স্বপ্ন দেখি যে একদিন আমেরিকায় সব মানুষ সমান হবে (সাদা-কালোয় ফারাক থাকবে না)। কমবেশি আমরা পাঁচ কোটি ভোটার এ নির্বাচনে ভোট দিতে পারছি না। আমাদের বলা হচ্ছে আমাদের প্রতিনিধি নাকি ‘নির্বাচিত’ হয়ে আছেন। আমরা ফাউ, কিন্তু আমাদের সংবিধান তো বলে আমরা নাগরিকেরা প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক। এখন দেখছি কিছু লোক জোগসাজশে তথাকথিত নির্বাচনের নামে আমাদের মালিকানা থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছেন। আর কমবেশি যে চার কোটি বা তার কিছু বেশি ভোটারের নামকাওয়াস্তে ভোট প্রয়োগের আইনানুগ সুযোগ আছে, তাঁরা কি মনে করবেন যে নৈতিকভাবেও এটা সিদ্ধ নির্বাচন। তর্কের খাতিরে আপাতত মেনে নিচ্ছি যে শত দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও এটা আইনানুগ নির্বাচন। কিন্তু এই নির্বাচনে ভোট দিয়ে নিজের বিবেককে, নৈতিকতাকে উৎফুল্ল করতে পারবেন? আর আমাদের ভোট হারানোর বেদনায় একটুও সমবেদনা কি আশা করতে পারি না। আশা কি করতে পারি যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আর নৈতিকতার প্রশ্নে ভোটদানে বিরত থাকবেন!
ড. শাহদীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট; অধ্যাপক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি।
No comments