বাঁধভাঙা হাসিতে সাফল্যের ছবি
শিক্ষার প্রসার বিশেষত প্রাথমিক ও
মাধ্যমিক পর্যায়ে যে সাফল্য বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে দেখিয়ে আসছে, তা
দেশ-বিদেশে স্বীকৃত। কিন্তু এর মাত্রাগত দিক বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সূচক
হতে পারে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে বই বিতরণ কর্মসূচি।
আমাদের মনে আছে, বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর
পাঠ্যপুস্তক সংক্রান্ত দুটি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিল। প্রথমত, বছরের প্রথম
দিনই শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া; দ্বিতীয়ত, প্রাথমিকের পর
মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদেরও বিনামূল্যে বই প্রদান। তখন এই
পরিকল্পনাকে 'উচ্চাভিলাষী' আখ্যা দিয়ে অনেকে এর সাফল্য সম্পর্কে সন্দেহ
প্রকাশ করেছিলেন। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই বিতরণ সরকারের
ব্যয় বাড়িয়ে দেবে_ আশঙ্কা করে এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ঔচিত্য নিয়ে
সন্দিহান ছিল উন্নয়ন সহযোগীরা। আমরা আনন্দিত, সেসব শঙ্কা ও সমালোচনা উড়িয়ে
দিয়ে সরকার গত পাঁচ বছর ধরেই আন্তরিকতা ও দক্ষতার পরীক্ষায় পাস করে চলেছে।
নতুন বছরে নতুন বই বিতরণ আক্ষরিক অর্থেই 'বই উৎসব' হিসেবে পরিণত হয়েছে।
শুক্রবার সমকালের প্রতিবেদনে যথার্থই বলা হয়েছে_ 'নতুন বইয়ের গন্ধ ছড়িয়ে
গেছে সারাদেশের সব স্কুলের আঙিনায়। শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনে ক্লাসে এসে
নতুন বই হাতে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা শিক্ষার্থীরা।' স্বীকার করতে হবে, বই
বিতরণের পর শিশু-কিশোরদের যে বাঁধভাঙা হাসির চিত্র বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে
প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে, তা কেবল চলমান রাজনৈতিক গুমোট পরিবেশে এক পশলা
রোদ্দুরই এনে দেয়নি, শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের সাফল্যের প্রতিফলনও
ঘটিয়েছে। আমরা ভুলে যাইনি পূর্ববর্তী সরকারগুলোর শাসনামলে যদিও শিক্ষার
প্রসারে ধারাবাহিকতা বজায় ছিল; পাঠ্যপুস্তক সংক্রান্ত জটিলতা, দীর্ঘসূত্রতা
এমনকি কালোবাজারিতে নাকাল হতেন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। বছরের
মাঝামাঝিও শিক্ষার্থীরা নতুন বই পায়নি_ এমন সংবাদ তখন বিরল ছিল না। এর
সঙ্গে ছিল নতুন ক্লাসে গিয়েও পুরাতন এমনকি ছেঁড়া-ফাড়া বই হাতে পাওয়ার
বিড়ম্বনা। এতে সোনামণিদের নতুন শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার উৎসাহ-উদ্দীপনায় যে
ভাটা পড়ত_ তাতে সন্দেহ নেই। মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক কেনার সামর্থ্য
না থাকায় কত মেধাবী শিক্ষার্থীকে যে মাঝপথে ঝরে পড়তে হয়েছে! এখন সবই
ইতিহাসের অংশ। পাঠ্যপুস্তক ছাপা, পরিবহন ও বিতরণকে কেন্দ্র করে একটি অসাধু
চক্র প্রায় প্রতি বছরই প্রাথমিক শিক্ষার্থী তথা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার
ভিত্তিকেই কীভাবে জিম্মি করে ফেলত, আমাদের মনে আছে। বর্তমান সরকার যখন
বছরের প্রথম দিনই বই বিতরণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে, তখন ওই চক্রটি নানা
বিঘ্ন সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়েছিল। নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডও আমরা দেখেছি।
সরকার সব বিপত্তি দূর করতে সক্ষম হয়েছে। একই সঙ্গে মাধ্যমিক পর্যায়েও
বিনামূল্যে বই প্রদানের চ্যালেঞ্জ গ্রহণও সম্পন্ন করেছে। কাগজ, মুদ্রণ ও
সম্পাদনার মান নিয়ে প্রথম বছর প্রশ্ন থাকলেও পরে তা কাটিয়ে ওঠা গেছে।
ভবিষ্যতে গুণগত মানের দিক আরও মনোযোগ পাবে বলে প্রত্যাশা। প্রায় সাড়ে চার
কোটি শিক্ষার্থীর হাতে প্রায় ৩২ কোটি নতুন বই তুলে দেওয়ার দুরূহ কাজটি
সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য আমরা সরকার বিশেষত শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে
সাধুবাদ জানাই। এটি একই সঙ্গে বিশ্বরেকর্ড বলে যে দাবি কেউ কেউ করছেন, তা
আমলযোগ্য। আমরা বিশ্বাস করি, বর্তমান সরকারের কঠোরতম সমালোচকও পাঠ্যপুস্তক
সংস্থান ও বিতরণ বিষয়ে প্রশংসা না করে পারবেন না। আমরা আশা করি, সাফল্যের
এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। সদিচ্ছা থাকলে দুরূহ কাজও সম্পন্ন করার যে
মাইলফলক বর্তমান সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে, তা ভবিষ্যতের সরকারগুলোর জন্যও
নিশ্চয় অনুসরণীয় হবে।
No comments