নির্বাচন বন্ধ করার জন্য একদিন আগেও দুই ফ্রন্টের যুক্ত অভিযান by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সরকার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে
চলেছে। গত বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) আওয়ামী লীগ নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা
যে নির্বাচনী ভাষণ দিয়েছেন, তাতেও তিনি এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। অতীতে
তার সরকার যেসব ভালো কাজ করেছে এবং এবার নির্বাচনোত্তর সরকার গঠন করে যেসব
ভালো কাজ করবে, তার ফিরিস্তি দিয়েছেন। তাতে দুটি কথা দেশের গণতান্ত্রিক
শিবিরকে আশ্বস্ত করবে। একটি. দেশ থেকে সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ
উচ্ছেদের প্রতিজ্ঞা; অন্যটি. '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ডদান
সমাপ্ত করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা।
প্রধানমন্ত্রীর এসব কথায় বিরোধী জামায়াত ও বিএনপি-শিবির, তাদের 'নিরপেক্ষ মিত্র' সুশীল সমাজ এবং তাদের মুখপত্র দুটি মিডিয়া কান দেবে তা মনে হয় না। তারা অনবরত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বন্ধ করার দাবিতে প্রচার চালাচ্ছে। একটি ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক তো একেবারে আদাজল খেয়ে লেগেছেন। প্রায় প্রত্যহ ঢাউস প্রতিবেদন লিখছেন নির্বাচন বন্ধ করার জন্য।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন বন্ধ করার জন্য এক ফ্রন্টে চলছে সুশীল সমাজের কলম ও বাগ্যুদ্ধ এবং অন্য ফ্রন্টে চলছে জামায়াত-বিএনপির হত্যা ও বোমাবাজির সন্ত্রাস। আজ শুক্রবারের (গতকাল) পবিত্র জুমার দিনেও দিনাজপুরের হিলিতে বোমাবাজি করে দু'জন নির্দোষ মানুষকে হত্যার খবর পেয়েছি। বড় ধরনের কিছু করতে না পারলেও ক্রমশ হীনবল সন্ত্রাসীরা দেশের এখানে-সেখানে সন্ত্রাস চালাচ্ছে। শুক্রবারও চালিয়েছে।
সরকার এই সন্ত্রাস দমনে কঠোর ব্যবস্থা নিলেও ৫ জানুয়ারিকে টার্গেট করে সুশীল সমাজের কলমযুদ্ধ এবং জমায়াত-বিএনপির সন্ত্রাস যুক্তভাবে চূড়ান্ত পর্যায়ে পেঁৗছবে বলে আশঙ্কা হয়। নির্বাচন কেন্দ্রগুলোতে হামলা হবে। নির্বাচন প্রার্থী ও ভোটদাতাদের ভয় দেখানোর জন্য এমন কোনো হিংস্রতা নেই, যার প্রকাশ ঘটানো হবে না। ইতিমধ্যে জামায়াত-বিএনপির হিংস্রতার টার্গেট করা হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোকে, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়কে। হিন্দু অধ্যুষিত অনেক এলাকায় অগি্নসংযোগ, নারী নির্যাতন চালাচ্ছে জামায়াতিরা। সাইলেন্ট এক্সোডাস বা নীরব দেশত্যাগ চলছে সংখ্যালঘুদের। ভারত তাই বাংলাদেশের সঙ্গে তার সীমান্ত এলাকায় আবার কাঁটাতারের বেড়া ও সীমান্ত রক্ষীদের পাহারা কঠোর করেছে।
এই যে একটি নির্বাচন বন্ধ করার জন্য এত ধ্বংস ও নিরীহ মানুষ হত্যার অব্যাহত অভিযান, তার জন্য কোনো প্রকার বিবেকজ্বালা নেই তথাকথিত সুশীল সমাজের নেতাদের মনে। কোনো প্রকার অনুতাপ ও অশ্রুপাত নেই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার। তিনি একবারের জন্য একজন আহতকে বা নিহতের লাশ দেখতে যাননি। কোনো শোকবাণী উচ্চারণ করেননি। কিংবা আহত ও নিহতদের শোকে ভেঙে পড়া অসহায় পরিবার-পরিজনের পাশে গিয়ে দাঁড়াননি। তাদের মুখে শুধু একটি দাবি, শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়ো। যেন শেখ হাসিনা ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালেই দেশের সব সমস্যার রাতারাতি সমাধান হয়ে যাবে।
শেখ হাসিনা একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। তিনি বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের 'নিরপেক্ষ মিত্র' সুশীল সমাজের আবদার মেনে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব ত্যাগ করতে না চাইলেও নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার স্বার্থে সর্বদলীয় সরকার গঠন করে তাতে বিএনপিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো ছেড়ে দিতে চেয়েছেন। অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থেও পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে বিরোধী দলকে যে সর্বোচ্চ কনসেশন দেওয়া হয় না, বাংলাদেশে হাসিনা সরকার বিরোধী দলকে সেই কনসেশন দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। বিএনপি তাতে রাজি হয়নি।
বিএনপির (আড়ালে জামায়াত) একমাত্র লক্ষ্য হাসিনা-বধ। এই বধ কার্যটি করতে পারলে বিএনপি তাদের পছন্দসই 'নিরপেক্ষ ও অদলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে' ২০০১ সালের মতো ম্যানুপুলেট করে (সুশীল সমাজের সহায়তায়) নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ গোটা সেক্যুলাারিস্ট শিবিরকে ধরাশায়ী করতে পারে এবং তাদের দোসর জামায়াতিদের লক্ষ্য একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তিদান ভণ্ডুল করা, তাও পূরণ হবে। বর্তমানের অর্থাৎ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি যতই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির অস্বাভাবিক নির্বাচন হোক, তা অনুষ্ঠিত না হলে জামায়াত-বিএনপির এই উদ্দেশ্যই পূর্ণ হবে। এটা জেনেশুনেও আমাদের সুশীল সমাজ এবং তাদের মিডিয়া এই নির্বাচন বন্ধ করে জামায়াত-বিএনপির অসদুদ্দেশ্য হাসিলে সমর্থন জুগিয়ে চলেছে।
৫ জানুয়ারি মাত্র একদিন বাকি। এই দু'একদিন আগেও ড. কামাল হোসেনের মতো ব্যক্তিও (তার হাসিনা-ফোবিয়া সবার জানা) নির্বাচন বন্ধ করার দাবি জানাতে এগিয়ে এসেছেন। এই ভদ্রলোকের ব্যক্তিগতভাবেও নির্বাচনভীতি আছে। বঙ্গবন্ধু একবার (১৯৭৩) নির্বাচনে দুটি আসনে বিজয়ী হয়ে একটি আসন ড. কামাল হোসেনকে ছেড়ে দিয়ে উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাকে জিতিয়ে এনেছিলেন। তারপর আর কোনো নির্বাচনে (রাষ্ট্রপতি নির্বাচনসহ) তিনি এখন পর্যন্ত নির্বাচিত হননি। নির্বাচনের প্রতি তার একটা স্বাভাবিক অসূয়াবোধ আছে।
তা সত্ত্বেও ড. কামাল হোসেন জানেন, জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থন থাকলে কোনো ব্যক্তি বা দলের নির্বাচন বিজয় ঠেকিয়ে রাখা সহজ নয়। ১৯৭০ সালে অখণ্ড পাকিস্তানের শেষ সাধারণ নির্বাচনে সামরিক শাসকদের অধীনে তাদের এলএফও নামক নির্বাচনবিধি মেনে নির্বাচনে যেতে বঙ্গবন্ধুকে অনেকেই নিষেধ করেছিলেন। মওলানা ভাসানী তো নানা অজুহাতে নির্বাচন বর্জনই করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন সামরিক শাসকদের এলএফও মেনে নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া সম্পর্কে তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। আমি যতদূর জানি, তাজউদ্দীন আহমদসহ তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা এলএফও মেনেই নির্বাচনে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সামরিক শাসকদের সব কারচুপি ব্যর্থ করে নির্বাচন জয়ে দৃঢ় আশা ব্যক্ত করেছিলেন। শুনেছি, তখন বঙ্গবন্ধুর তরুণ সমর্থক ড. কামাল হোসেনও ছিলেন এই নির্বাচনে যাওয়ার পরামর্শদাতাদের দলে।
তাহলে এখন ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে বৃদ্ধ বয়সে কামাল সাহেবদের এই ভীমরতি কেন? শেখ হাসিনা তো সামরিক শাসক নন। খালেদা জিয়ার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বড় বড় কারচুপির ঘটনা যেখানে প্রমাণিত, সেখানে শেখ হাসিনার দুই দফার সরকারের আমলেই নির্বাচন-কারচুপির কোনো অভিযোগও নেই। বরং হাসিনা সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনেই বিএনপি ভূমিধস বিজয়ের অধিকারী হয়েছে। তারপরও নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে এত ন্যাকামি কেন?
হাসিনা তো ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যোগদানের জন্য কোনো এলএফও জারিও করেননি। একমাত্র জামায়াত ছাড়া ছোট-বড় সব দলের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণের দরজা খোলা। বর্তমানে এক ব্যক্তির পক্ষে নির্বাচন প্রভাবিত করা সম্ভব কীভাবে? সরকারি প্রশাসনের সাহায্যে? এই প্রশাসনের একটা বিরাট অংশেই তো বিএনপি-জামায়াতের সমর্থকরা ঘাপটি মেরে বসে আছে। প্রচার-মিডিয়া সবই তাদের কবলে। তারপরও নির্বাচনে অংশগ্রহণে এত ভয় কেন?
খবরের কাগজেই খবর দেখেছি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের হয়ে তাদের নেতা উইলিয়াম হানা কিছুদিন আগেই খালেদা জিয়ার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সর্বশক্তি প্রয়োগ করে এমনভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে যে, নির্বাচনে কোনো প্রকার কারচুপি করা সম্ভব হবে না। যদি হয়, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নই সর্বাগ্রে কার্যকর প্রতিবাদ জানাবে। সুতরং বিএনপি যেন নির্বাচনে যায়। খালেদা জিয়া তার অনুরোধ রাখতে সম্মত হননি।
এ ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের কি কর্তব্য ছিল না দেশের এবং গণতন্ত্রের বৃহত্তর স্বার্থে খালেদা জিয়ার কাছে সম্মিলিতভাবে উপস্থিত হয়ে তাকে নির্বাচনে আসার জন্য চাপ দেওয়া? তাকে এই বলে আশ্বাস দেওয়া যে, সুশীল সমাজ এবং মিডিয়া দেশের সব নির্বাচন কেন্দ্রে কঠোর ও সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। কোনো প্রকার কারচুপি হলে সঙ্গে সঙ্গে তা দেশবাসীকে জানিয়ে এই নির্বাচনকে রুখে দেবে। তা না করে তারা নির্বাচনবিরোধী এমন একটি আন্দোলনে সমর্থন জানাচ্ছে যা আন্দোলন নয়, রাষ্ট্র ও জনগণের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস এবং এই সন্ত্রাসেরও একটি মাত্র টার্গেট শেখ হাসিনা। ব্যক্তিবিদ্বেষই এই সন্ত্রাসের মূলধন। সুশীল সমাজ তাদের বর্তমানের কার্যকলাপ দ্বারা এই ব্যক্তিবিদ্বেষ ও সন্ত্রাসের সঙ্গেই কার্যত একাত্মতা ঘোষণা করেছে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যদি কোনো মিরাকল না ঘটে, তাহলে এই নির্বাচন যথানিয়মে অনুষ্ঠিত হবে। হয়তো কিছু ক্ষেত্রে নাশকতামূলক কাজ চলবে। কিন্তু নির্বাচনে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে বলে অনেকের মতো আমারও ধারণা। নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হলে পরবর্তী ধাপে ২৪ জানুয়ারি বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ এবং নতুন সংসদের সূচনা। নতুন মন্ত্রিসভাও তখন গঠিত হবে।
এই সরকার পূর্ণ ৫ বছর মেযাদে ক্ষমতায় থাকতে চাইবে, না দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে একটি মধ্যবর্তীকালীন নির্বাচনের (সব দলের অংশগ্রহণে) ব্যবস্থা করবে, তা এখন দেখার রইল। আমার ধারণা, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত শেষ করতে পারলে এবং দেশ থেকে জামায়াতি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ কঠোর হাতে দমন করতে পারলে শেখ হাসিনা একটি মধ্যবর্তীকালীন নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্রকে তার স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।
এ ক্ষেত্রে বিএনপির ভাগ্যে কী আছে তা জানি না। এই নির্বাচনে যোগ না দিয়ে দলটি তাদের অস্তিত্ব বিলোপের পথই সুগম করল বলে দলটির অনেকেরই ধারণা। সুশীল সমাজও কি পারবে তাদের বর্তমানের ভ্রান্ত বুদ্ধি ও সমর্থন দিয়ে এই দলটিকে টিকিয়ে রাখতে?
প্রধানমন্ত্রীর এসব কথায় বিরোধী জামায়াত ও বিএনপি-শিবির, তাদের 'নিরপেক্ষ মিত্র' সুশীল সমাজ এবং তাদের মুখপত্র দুটি মিডিয়া কান দেবে তা মনে হয় না। তারা অনবরত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বন্ধ করার দাবিতে প্রচার চালাচ্ছে। একটি ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক তো একেবারে আদাজল খেয়ে লেগেছেন। প্রায় প্রত্যহ ঢাউস প্রতিবেদন লিখছেন নির্বাচন বন্ধ করার জন্য।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন বন্ধ করার জন্য এক ফ্রন্টে চলছে সুশীল সমাজের কলম ও বাগ্যুদ্ধ এবং অন্য ফ্রন্টে চলছে জামায়াত-বিএনপির হত্যা ও বোমাবাজির সন্ত্রাস। আজ শুক্রবারের (গতকাল) পবিত্র জুমার দিনেও দিনাজপুরের হিলিতে বোমাবাজি করে দু'জন নির্দোষ মানুষকে হত্যার খবর পেয়েছি। বড় ধরনের কিছু করতে না পারলেও ক্রমশ হীনবল সন্ত্রাসীরা দেশের এখানে-সেখানে সন্ত্রাস চালাচ্ছে। শুক্রবারও চালিয়েছে।
সরকার এই সন্ত্রাস দমনে কঠোর ব্যবস্থা নিলেও ৫ জানুয়ারিকে টার্গেট করে সুশীল সমাজের কলমযুদ্ধ এবং জমায়াত-বিএনপির সন্ত্রাস যুক্তভাবে চূড়ান্ত পর্যায়ে পেঁৗছবে বলে আশঙ্কা হয়। নির্বাচন কেন্দ্রগুলোতে হামলা হবে। নির্বাচন প্রার্থী ও ভোটদাতাদের ভয় দেখানোর জন্য এমন কোনো হিংস্রতা নেই, যার প্রকাশ ঘটানো হবে না। ইতিমধ্যে জামায়াত-বিএনপির হিংস্রতার টার্গেট করা হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোকে, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়কে। হিন্দু অধ্যুষিত অনেক এলাকায় অগি্নসংযোগ, নারী নির্যাতন চালাচ্ছে জামায়াতিরা। সাইলেন্ট এক্সোডাস বা নীরব দেশত্যাগ চলছে সংখ্যালঘুদের। ভারত তাই বাংলাদেশের সঙ্গে তার সীমান্ত এলাকায় আবার কাঁটাতারের বেড়া ও সীমান্ত রক্ষীদের পাহারা কঠোর করেছে।
এই যে একটি নির্বাচন বন্ধ করার জন্য এত ধ্বংস ও নিরীহ মানুষ হত্যার অব্যাহত অভিযান, তার জন্য কোনো প্রকার বিবেকজ্বালা নেই তথাকথিত সুশীল সমাজের নেতাদের মনে। কোনো প্রকার অনুতাপ ও অশ্রুপাত নেই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার। তিনি একবারের জন্য একজন আহতকে বা নিহতের লাশ দেখতে যাননি। কোনো শোকবাণী উচ্চারণ করেননি। কিংবা আহত ও নিহতদের শোকে ভেঙে পড়া অসহায় পরিবার-পরিজনের পাশে গিয়ে দাঁড়াননি। তাদের মুখে শুধু একটি দাবি, শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়ো। যেন শেখ হাসিনা ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালেই দেশের সব সমস্যার রাতারাতি সমাধান হয়ে যাবে।
শেখ হাসিনা একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। তিনি বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের 'নিরপেক্ষ মিত্র' সুশীল সমাজের আবদার মেনে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব ত্যাগ করতে না চাইলেও নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার স্বার্থে সর্বদলীয় সরকার গঠন করে তাতে বিএনপিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো ছেড়ে দিতে চেয়েছেন। অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থেও পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে বিরোধী দলকে যে সর্বোচ্চ কনসেশন দেওয়া হয় না, বাংলাদেশে হাসিনা সরকার বিরোধী দলকে সেই কনসেশন দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। বিএনপি তাতে রাজি হয়নি।
বিএনপির (আড়ালে জামায়াত) একমাত্র লক্ষ্য হাসিনা-বধ। এই বধ কার্যটি করতে পারলে বিএনপি তাদের পছন্দসই 'নিরপেক্ষ ও অদলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে' ২০০১ সালের মতো ম্যানুপুলেট করে (সুশীল সমাজের সহায়তায়) নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ গোটা সেক্যুলাারিস্ট শিবিরকে ধরাশায়ী করতে পারে এবং তাদের দোসর জামায়াতিদের লক্ষ্য একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তিদান ভণ্ডুল করা, তাও পূরণ হবে। বর্তমানের অর্থাৎ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি যতই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির অস্বাভাবিক নির্বাচন হোক, তা অনুষ্ঠিত না হলে জামায়াত-বিএনপির এই উদ্দেশ্যই পূর্ণ হবে। এটা জেনেশুনেও আমাদের সুশীল সমাজ এবং তাদের মিডিয়া এই নির্বাচন বন্ধ করে জামায়াত-বিএনপির অসদুদ্দেশ্য হাসিলে সমর্থন জুগিয়ে চলেছে।
৫ জানুয়ারি মাত্র একদিন বাকি। এই দু'একদিন আগেও ড. কামাল হোসেনের মতো ব্যক্তিও (তার হাসিনা-ফোবিয়া সবার জানা) নির্বাচন বন্ধ করার দাবি জানাতে এগিয়ে এসেছেন। এই ভদ্রলোকের ব্যক্তিগতভাবেও নির্বাচনভীতি আছে। বঙ্গবন্ধু একবার (১৯৭৩) নির্বাচনে দুটি আসনে বিজয়ী হয়ে একটি আসন ড. কামাল হোসেনকে ছেড়ে দিয়ে উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাকে জিতিয়ে এনেছিলেন। তারপর আর কোনো নির্বাচনে (রাষ্ট্রপতি নির্বাচনসহ) তিনি এখন পর্যন্ত নির্বাচিত হননি। নির্বাচনের প্রতি তার একটা স্বাভাবিক অসূয়াবোধ আছে।
তা সত্ত্বেও ড. কামাল হোসেন জানেন, জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থন থাকলে কোনো ব্যক্তি বা দলের নির্বাচন বিজয় ঠেকিয়ে রাখা সহজ নয়। ১৯৭০ সালে অখণ্ড পাকিস্তানের শেষ সাধারণ নির্বাচনে সামরিক শাসকদের অধীনে তাদের এলএফও নামক নির্বাচনবিধি মেনে নির্বাচনে যেতে বঙ্গবন্ধুকে অনেকেই নিষেধ করেছিলেন। মওলানা ভাসানী তো নানা অজুহাতে নির্বাচন বর্জনই করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন সামরিক শাসকদের এলএফও মেনে নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া সম্পর্কে তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। আমি যতদূর জানি, তাজউদ্দীন আহমদসহ তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা এলএফও মেনেই নির্বাচনে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সামরিক শাসকদের সব কারচুপি ব্যর্থ করে নির্বাচন জয়ে দৃঢ় আশা ব্যক্ত করেছিলেন। শুনেছি, তখন বঙ্গবন্ধুর তরুণ সমর্থক ড. কামাল হোসেনও ছিলেন এই নির্বাচনে যাওয়ার পরামর্শদাতাদের দলে।
তাহলে এখন ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে বৃদ্ধ বয়সে কামাল সাহেবদের এই ভীমরতি কেন? শেখ হাসিনা তো সামরিক শাসক নন। খালেদা জিয়ার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বড় বড় কারচুপির ঘটনা যেখানে প্রমাণিত, সেখানে শেখ হাসিনার দুই দফার সরকারের আমলেই নির্বাচন-কারচুপির কোনো অভিযোগও নেই। বরং হাসিনা সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনেই বিএনপি ভূমিধস বিজয়ের অধিকারী হয়েছে। তারপরও নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে এত ন্যাকামি কেন?
হাসিনা তো ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যোগদানের জন্য কোনো এলএফও জারিও করেননি। একমাত্র জামায়াত ছাড়া ছোট-বড় সব দলের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণের দরজা খোলা। বর্তমানে এক ব্যক্তির পক্ষে নির্বাচন প্রভাবিত করা সম্ভব কীভাবে? সরকারি প্রশাসনের সাহায্যে? এই প্রশাসনের একটা বিরাট অংশেই তো বিএনপি-জামায়াতের সমর্থকরা ঘাপটি মেরে বসে আছে। প্রচার-মিডিয়া সবই তাদের কবলে। তারপরও নির্বাচনে অংশগ্রহণে এত ভয় কেন?
খবরের কাগজেই খবর দেখেছি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের হয়ে তাদের নেতা উইলিয়াম হানা কিছুদিন আগেই খালেদা জিয়ার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সর্বশক্তি প্রয়োগ করে এমনভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে যে, নির্বাচনে কোনো প্রকার কারচুপি করা সম্ভব হবে না। যদি হয়, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নই সর্বাগ্রে কার্যকর প্রতিবাদ জানাবে। সুতরং বিএনপি যেন নির্বাচনে যায়। খালেদা জিয়া তার অনুরোধ রাখতে সম্মত হননি।
এ ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের কি কর্তব্য ছিল না দেশের এবং গণতন্ত্রের বৃহত্তর স্বার্থে খালেদা জিয়ার কাছে সম্মিলিতভাবে উপস্থিত হয়ে তাকে নির্বাচনে আসার জন্য চাপ দেওয়া? তাকে এই বলে আশ্বাস দেওয়া যে, সুশীল সমাজ এবং মিডিয়া দেশের সব নির্বাচন কেন্দ্রে কঠোর ও সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। কোনো প্রকার কারচুপি হলে সঙ্গে সঙ্গে তা দেশবাসীকে জানিয়ে এই নির্বাচনকে রুখে দেবে। তা না করে তারা নির্বাচনবিরোধী এমন একটি আন্দোলনে সমর্থন জানাচ্ছে যা আন্দোলন নয়, রাষ্ট্র ও জনগণের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস এবং এই সন্ত্রাসেরও একটি মাত্র টার্গেট শেখ হাসিনা। ব্যক্তিবিদ্বেষই এই সন্ত্রাসের মূলধন। সুশীল সমাজ তাদের বর্তমানের কার্যকলাপ দ্বারা এই ব্যক্তিবিদ্বেষ ও সন্ত্রাসের সঙ্গেই কার্যত একাত্মতা ঘোষণা করেছে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যদি কোনো মিরাকল না ঘটে, তাহলে এই নির্বাচন যথানিয়মে অনুষ্ঠিত হবে। হয়তো কিছু ক্ষেত্রে নাশকতামূলক কাজ চলবে। কিন্তু নির্বাচনে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে বলে অনেকের মতো আমারও ধারণা। নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হলে পরবর্তী ধাপে ২৪ জানুয়ারি বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ এবং নতুন সংসদের সূচনা। নতুন মন্ত্রিসভাও তখন গঠিত হবে।
এই সরকার পূর্ণ ৫ বছর মেযাদে ক্ষমতায় থাকতে চাইবে, না দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে একটি মধ্যবর্তীকালীন নির্বাচনের (সব দলের অংশগ্রহণে) ব্যবস্থা করবে, তা এখন দেখার রইল। আমার ধারণা, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত শেষ করতে পারলে এবং দেশ থেকে জামায়াতি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ কঠোর হাতে দমন করতে পারলে শেখ হাসিনা একটি মধ্যবর্তীকালীন নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্রকে তার স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।
এ ক্ষেত্রে বিএনপির ভাগ্যে কী আছে তা জানি না। এই নির্বাচনে যোগ না দিয়ে দলটি তাদের অস্তিত্ব বিলোপের পথই সুগম করল বলে দলটির অনেকেরই ধারণা। সুশীল সমাজও কি পারবে তাদের বর্তমানের ভ্রান্ত বুদ্ধি ও সমর্থন দিয়ে এই দলটিকে টিকিয়ে রাখতে?
No comments