কোন ক্ষমতার উৎস আপনি?
এক মহা-বয়কটের দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা। সরকারি দল তো ইতিমধ্যে ১৫৩টি আসনে ভোটারদের বয়কট করে জিতে আছে। বাকি আসনে ভোটাররা বয়কট করে বাকি প্রার্থীদেরও জিতিয়ে দেবেন। বিরোধী দল একের পর এক জনবিবর্জিত কর্মসূচি দিয়ে নিজেদেরই বয়কট হওয়া চূড়ান্ত করেছে। এখন শুনছি, বাংলাদেশই বয়কটের মুখে পড়বে। নির্বাচনের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র নাকি চূড়ান্ত অসহযোগিতা করবে বাংলাদেশকে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন তো বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা মোটামুটি বয়কটই করে ফেলেছেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মতামত দ্বারা প্রভাবিত নামজাদা পত্রিকা ফরেন পলিসির মতে, নতুন বছরে সংঘাতে ঝুঁকিপূর্ণ ১০ দেশের পঞ্চমটি হচ্ছে আমাদের সাধের সোনার বাংলা। আমাদের একশ্রেণীর ধনীরা ইতিমধ্যে সেই সোনার বাংলা উজাড় করে বিদেশে সম্পদ পাচার করছেন। দেশের অনেক মানুষ সুযোগ পেলে পরবাসী হতেও প্রস্তুত। এক আমলে এত বয়কট কেউ দেখেছে কি? পটভূমিতে চলছে বাংলা সিনেমার আঙ্গু কাবিলা বনাম মাঙ্গু কাবিলার গোত্রীয় যুদ্ধ। ঢাকাই সিনেমার শেষটা সব সময়ই মধুর। দেখা যায়, দুই কাবিলার সর্দার পরস্পরের বেয়াই হওয়ার উৎসবে বাঘ পুড়িয়ে খাচ্ছে। কিন্তু রাজনীতির শেষটা মধুর হয় না এই দেশে। এই তিক্ত শীতে রাজনীতির তেজস্ক্রিয় চুল্লিতে মানুষ কাবাব হচ্ছে। কাবাব মে হাড্ডি হলো মানবাধিকার। জনবিমুখ ‘মুক্তিযুদ্ধ’ আর গণবিচ্ছিন্ন ‘গণতন্ত্রের’ শিঙায় ফুঁ দিয়ে যাচ্ছে বিপর্যয়ের কুশীলবেরা। এই সর্বনাশা খেলা শেষ করার দুটি উপায়।
যারা এখনো যোগ দিইনি, জয় বাংলা জিন্দাবাদ হুংকার দিয়ে তারাও দুই কাবিলায় যোগ দিয়ে মারামারির ভলিউম বাড়িয়ে ফেলতে পারি। তাতে যুদ্ধটা ত্বরান্বিত হবে এবং উভয় পক্ষের বিনাশের মাধ্যমে অচিরেই যুদ্ধটা শেষ হবে। দ্বিতীয় উপায়টা কঠিন। দুই নেত্রীর সমঝোতার বদলে তাদের সমর্থকদের এক সমতলে সমঝোতায় আনা। তাহলে ক্ষমতার যুদ্ধের সেনাপতিরা বেকার হবেন। জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ রাজনীতি না পাই, ঐক্যবদ্ধ দেশ পাব। দেশ এক থাকলে রাষ্ট্রকে একদিন ঠিক করাই যাবে। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে এক হব? যে দুটি লাঠি নিয়ে মারামারি হচ্ছে, লাঠি দুটোকে এক করে বাঁধলেই দেশ শান্ত ও সবল হবে। তার মানে যুদ্ধাপরাধের বিচার আর গণতন্ত্রের দাবিকে এক সুতোয় গাঁথতে হবে। সেই সব অগণিত তরুণ-তরুণী, যাঁরা নাকি দেশকে টেনে তুলবেন ওপরে, তাঁরা কি পারেন না একই দেহমনে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রকে স্থান করে দিতে? মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র তো একে অপরের রক্ষাকবচ হতে পারে। একটি নিরাপদ না হলে তো অন্যটিও বাঁচবে না। স্বৈরশাসনে মানুষ মুক্ত হয়েছে, এমন নজির আধুনিক জমানায়নেই। স্বৈরশাসন ধনদৌলত বাড়াতে পারে, বড় বড় ইমারত বানাতে পারে, কিন্তু সমৃদ্ধ সহনশীল সুখী সমাজ বানাতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাদীরা সর্বদাই অগণতান্ত্রিক ছিলেন না। যাঁরা এই মুহূর্তে একতরফা নির্বাচনে বিপক্ষে, তাঁদের অনেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে। আর এই দুইয়ের মাঝখানে রয়েছে সেই বাংলাদেশ, যেখানে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র মানিকজোড় হয়ে আছে।
শাহবাগ আর শাপলার বিবাদে সেই মাঝখানের বাংলাদেশ ধসে পড়ে। যখন দুটি পক্ষের মাঝখানে কোনো জায়গা থাকে না, তখনই গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগে, সেটাই যুদ্ধ পরিস্থিতি, সেটাই অশান্তির সন্ধিক্ষণ। বাংলাদেশের প্রাণভোমরাটা আছে সেই মাঝখানের জমায়েতে; যেখানে মুক্তিযুদ্ধ আর গণতন্ত্র সহাবস্থান করে। আমাদের আবার সেই মাঝখানের জায়গাটা জাগাতে হবে। বিবাদের উত্তরাধিকার ছেড়ে এই দায়িত্ব নিতে হবে তরুণদেরই। বড় দুই দলের মহান দুই নেত্রীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তাঁদের চেয়ে তাঁদের অনুসারীরা কম যান না। একজন তো পত্রিকায় লিখে মত দিয়েছেন, প্রয়োজনে মানুষ মেরে হলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অপর পক্ষ তক্কে তক্কে আছে, সুযোগ পেলেই একাত্তরের কায়দায় জ্বালিয়ে দেবে দুশমনদের। দীর্ঘদিন ধরে দল থেকে, মিডিয়া থেকে, অনলাইন থেকে যতভাবে পারা যায় ঘৃণার আবাদ করা হয়েছে। তরুণ কয়েকটি প্রজন্মকে দুই ধরনের জাতীয়তাবাদী জোশে উন্মাতাল করেছেন একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী। দুই নেত্রী থামলেও এই সারিন্দাদের বাজনা থামবে না। আমরা বেড়ে উঠছিলাম গণতান্ত্রিক আমলে, আমাদের সমান সুযোগ-সুবিধা অতীতের কোনো প্রজন্মই পায়নি; আমাদের তো বিশ্বায়িত দুনিয়াকে নিবিড়ভাবে দেখে ঠেকে শেখার কথা!
আমরা কীভাবে এ রকম অমানবিক গোত্রযুদ্ধের সৈনিক হয়ে উঠলাম? এই বিত্তবেসাতির রাজনীতি আমাদের গাধা বানিয়েছে, আমরা সানন্দে নরকের দরজা পর্যন্ত তাদের বোঝা বাইছি। জাতীয় পতাকা লীগের লাঠিতে থাকবে নাকি দলের লাঠিতে থাকবে, তা নিয়েবিবাদে পতাকায়রক্ত আর কালিমা লাগাচ্ছি—লাঠিটা কেউ ছাড়তে চাই না। এক কবি ঠিকই বলেছেন, গাধা মোট বইবার সময় যেমন গাধা, বোঝা নামিয়ে রাখার পরও তেমনই গাধা। এই যুদ্ধে কেবল সম্পদ ও প্রতিষ্ঠানই ধ্বংস হয়নি, ধ্বংস হয়েছে পারস্পরিক বিশ্বাস। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বললেই এক দল বোঝে একদলীয় শাসন ও ভারতের তোষামোদি। গণতন্ত্রের কথা বললেই আরেক দল বোঝে জঘন্য যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে পাকিস্তানি ওকালতি। মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রকে যতই ক্ষমতার পাশাখেলার ঘুঁটি করা হয়েছে, ততই এসবের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়েছে। অথচ উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন হয়ে স্বাধীনতার সংগ্রামে এই দুই এক হয়েগিয়েছিল। গণতন্ত্রের পথে স্বাধীনতা এসেছে, স্বাধীনতা দাবির মধ্যে গণতন্ত্র ভরসা খুঁজেছে। স্বাধীনতার পরে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি যে হারে একচেটিয়া ক্ষমতাবাদী হয়েছে, সেই হারে জনসংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের আবেদন কমেছে। বিএনপি যতই বহুদলীয় গণতন্ত্রের জনকের দাবিদার হোক, তাদের বহুদলীয়তা ছিল যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামী এবং তার অপরাধী নেতাদের পুনর্বাসনের দরজা। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর দুই জোটের আক্রমণে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র বেচারার অবস্থা এতই নাজুক, এসবের প্রতি বিরক্ত মানুষের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবীরেরা থাকলে গণতন্ত্র থাকবে না, আবার গণতন্ত্রের সৈনিকেরা এলে মুক্তিযুদ্ধ পরাজিত হবে; এই যখন ভয়, তখন আসলে মুক্তিযুদ্ধ আর গণতন্ত্রের মর্মটা মরে যায়। এর সহজ সমাধান ছিল গণতন্ত্রকে নিরপেক্ষ নির্বাচন আর মুক্তিযুদ্ধকে বিচার দেওয়ার মাধ্যমে সবল করা। কিন্তু তা করা হয়নি। বরং এই দুটিকে মাত্র কয়েক লাখ লোকের ক্ষমতা ও বিত্তের ঢাল বানানো হয়েছে। মাত্র কয়েক লাখের হাতে আজ ১৬ কোটি মানুষ জিম্মি! আঘাত থেকে বাঁচতে আপন সন্তানকে কেউ ঢাল করে না। যারা করে, বুঝতে হবে তারা ওই সন্তানের প্রতি নিদয়া। এভাবে পরিস্থিতি তৈরি করছে গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধ বয়কটের। এভাবেই রাষ্ট্রের দুই ভিত্তিকেই আসলে উপড়ানো হচ্ছে। অথচ এই দুটি সোনার কাঠি রুপার কাঠির মতো। একটি না হলে অন্যটি কাজ করে না। কোনো দল বা গোষ্ঠীর বা পরিবারের একচেটিয়া শাসনের জন্য বাংলার জনগণ মুক্তিযুদ্ধ করেনি।
অপর কোনো দল বা গোষ্ঠী বা পরিবারের রাজত্ব কায়েমের জন্য এখনো কেউ জীবন দেবে না। বিএনপি যুদ্ধাপরাধী ও দুর্নীতিবাজদের ব্যাপারে আপসহীনতার প্রতিশ্রুতি দেয়নি। সুতরাং মানুষ কেন তাদের ভরসা করবে? গণতন্ত্রের স্বার্থেই বিচার দরকার, বিচারের সুরক্ষা গণতন্ত্র ছাড়া আসবে না। ডেভিড স্পিলবার্গের অ্যামিস্ট্যাড ছবিতে বন্দী দাসনেতাকে প্রশ্ন করেন সংকটে পড়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট: চরম দুঃসময়ে তোমরা কী করো? উত্তরে তিনি বলেন, ‘যখন সমাধান জানা নেই, তখন বুকের গভীরে শ্বাস নিয়ে তুলে আনি পূর্বপুরুষদের আত্মাকে। তাঁদের কাছে জিজ্ঞাসা করি, “কী করব আমরা এখন?’’’ আমরাও আমাদের চরমতম বিপদে হক মওলা বলে দম টানি, আর বুকের গভীর থেকে উঠে আসে জমানো ময়লা কফ, কাশি, বদরক্ত। সংকটে মানুষ তার শ্রেষ্ঠটা নিয়ে দাঁড়ায়। আমরা দাঁড়িয়েছি আমাদের নিকৃষ্টটা নিয়ে। দুই দল দেখিয়েছে কী তাদের পরিচয়। এবার জনগণের পরিচয়ও জনগণকে দেখাতে হবে। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চান, তাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও গণতন্ত্র একই সঙ্গে দাবি করুন। এটাই এ মুহূর্তে শ্রেষ্ঠ চাওয়া। যুদ্ধাপরাধী, দুর্নীতিবাজ, গডফাদার ও স্বৈরাচার ১৬ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার বাধা। তাদের দ্বারা দেশ ও জাতির মহাবয়কট থেকে বাঁচার একটাই পথ, জনগণের জনগণ হয়ে ওঠা এবং দাবি করা যে, আমরাই সকল ক্ষমতার উৎস। যুগের পর যুগ নাগরিকের এই ক্ষমতা-বয়কট বিপজ্জনক। এর দায়নাগরিকদেরই শোধ করতে হয় এবংসেটাই হচ্ছে এখন। গণবিরোধীক্ষমতাও জনসমর্থনকেই উৎস করে। কিছুই যদি না পারেন, তাহলে অন্তত আজ থেকে কারও সঙ্গে দেখা হলে ‘কেমন আছেন’ না বলে বলুন, ‘দেশের কোন ক্ষমতার উৎস আপনি?’ সুক্ষমতার নাকিকুক্ষমতার?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com
No comments