আলোর মিছিল by নাজমুল হক ইমন
(মোশাররফ হোসেনের)
চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট হলেও দৃষ্টিশক্তি এখনও বেশ প্রখর। ৮৫ বছর
বয়সে এসেও চশমা পরতে হয় না তার। তবে হালকা গড়নের শরীরটি যে ক্ষয়ে এসেছে,
দেখেই বোঝা যায়। শারীরিক দুর্বলতা আর বয়স তার অদম্য ইচ্ছাশক্তিকে দমিয়ে
রাখতে পারেনি। আর তাই জীবনের এ শেষ প্রান্তে এসেও ছাড়েননি হাল। তিনি নওগাঁর
বদলগাছি উপজেলার ভাতশাইল গ্রামের মোশাররফ হোসেন চৌধুরী। আজন্ম বইপাগল এক
মানুষ। বইয়ের সঙ্গে তার নিত্য বসবাস। সত্তর বছরেরও বেশি সময় ধরে বইয়ের
সঙ্গে তার এ সখ্য। সেই স্কুলে পড়ার দিনগুলো থেকে শুরু। বই থেকে তিনি নিংড়ে
পান করেন আলো। অন্যদের মাঝেও সে আলো ছড়িয়ে দিতে ১৯৪৬ সালে গড়ে তুলেছিলেন
একটি লাইব্রেরি। মোশাররফ তখন স্কুলপড়ূয়া কিশোর। তারপর ঝড়, বন্যা,
দুর্ভিক্ষ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা_ সব রকম বাধা পেরিয়ে আজও
সন্তানের মতো পরম মমতায় আগলে রেখেছেন পাঠাগারটি।
রাত জেগে পাহারা দেন মূল্যবান সব বইপত্র। সকালে পাঠাগার খুলে কিছুক্ষণ ঝাড়া-মোছার কাজ করেন। তারপর কাউকে দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে বেরিয়ে পড়েন মোশাররফ হোসেন চৌধুরী। মাইলের পর মাইল, গ্রামের পর গ্রাম, দিনমান হাঁটেন তিনি_ একটি মাত্র বইয়ের জন্য। কাজটি তিনি করে চলেছেন ৭০ বছর ধরে।
১৯৫০ সালের কথা। ম্যাট্রিক পাসের পর তরুণ মোশাররফ ভর্তি হন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। পড়াশোনা করতেন চাচাতো ভাই কবি ও সাহিত্যিক তালিম হোসেনের বাসায় থেকে। তালিম হোসেনের ছিল বিশাল পারিবারিক পাঠাগার। প্রতি মাসে অন্তত একবার সেখানে সাহিত্য সভা হতো। সাহিত্য সভার আমন্ত্রণপত্র বিলির দায়িত্ব পড়ত মোশাররফের ওপর। কবি শামসুর রাহমান, রাবেয়া খাতুনসহ নামীদামি অনেক কবি-সাহিত্যিক আসতেন সে পাঠাগারে। এ ছাড়া মোশাররফকে সঙ্গে নিয়ে তালিম হোসেন যেতেন কবি-সাহিত্যিকদের বাসায়। সেখানে তিনি দেখতেন বড় বড় পাঠাগার। গ্রামে রেখে আসা পাঠাগারটির কথা তখন মনে পড়ত মোশাররফের।
১৯৫২ সাল। মাতৃভাষার জন্য বাঙালি যখন রাজপথে তখন সে দলেও নাম লেখান মোশাররফ। 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত ঢাকার অলিগলি। কিন্তু হঠাৎ খবর আসে মায়ের মৃত্যুর। আন্দোলনের মাঝপথে বাড়ি ফেরেন তিনি। সময় বয়ে চলে, মোশাররফ হোসেন চৌধুরীও ছুটতে থাকেন বইয়ের খোঁজে।
এক সময় স্থানীয় সোনাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন মোশাররফ। বই সংগ্রহের এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিদ্যালয় কমিটির সঙ্গে দেখা দেয় বিরোধ। রাগ করে চাকরি ছেড়ে শুরু করেন কাপড়ের ব্যবসা। বই সংগ্রহের নেশায় ব্যবসাও লাটে ওঠে। এসব নিয়ে স্ত্রী রিজিয়া খাতুনের সঙ্গে প্রায়ই মনোমালিন্য হতো। বই জোগাড় করতে গিয়ে বিরাগভাজন হয়েছেন প্রিয়জনদের। আবার কারও কারও পরম বন্ধুও হয়েছেন।
মাত্র পাঁচটি বই নিয়ে ১৯৪৬ সালে যাত্রা শুরু করে মোশাররফ হোসেন চৌধুরীর পাঠাগার। নাম দেন 'ভাতসাইল প্রগতি সংঘ পাঠাগার'। প্রথমে মাটির দেয়াল ও টিনের ছাউনির ছোট্ট ঘরে পাঠাগারের কার্যক্রম চলত। ধীরে ধীরে ভিড় বাড়তে থাকে মানুষের। একসময় আরও জায়গার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সে সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন চাচাতো ভাই আবদুল মতিন চৌধুরী। পাঠাগারের জন্য তিনি ১৭ শতাংশ জমি দেন এবং তৎকালীন সাব-ডিভিশন অফিসার এমএ বাসিত পাঠাগারের জন্য ফাউন্ডেশন করে দেন। শুরুর দিকের আলীবাবা, গোপাল ভাঁড়, শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালা, আনোয়ারা ও মুসলিম পঞ্চসতি বইগুলো এখনও রেখেছেন সযত্নে।
সত্তর বছরেরও বেশি সময় ধরে মোশাররফ হোসেন চৌধুরী ছুটছেন বইয়ের পিছু। বইপাগল মানুষটি নতুন কোনো বইয়ের কথা শুনলেই রওনা হন সঙ্গে সঙ্গে। এ পর্যন্ত নিজ উদ্যোগে তিনি বই সংগ্রহ করেছেন লক্ষাধিক। চারটি কক্ষে, ৫২টি স্টিল ও কাঠের আলমারিতে বাংলা, ইংরেজি, উর্দুসহ নানান ভাষার বই সাজিয়ে রেখেছেন স্তরে স্তরে। নিজের টাকা, জেলা পরিষদ ও এলাকার মানুষের সহায়তায় এসব বই কিনেছেন মোশাররফ।
পাঠাগারেই রাত কাটান তিনি। তাই সবার জন্য এর দরজা ২৪ ঘণ্টাই খোলা। পাঠাগারে আছে বেশ কিছু দুর্লভ বই। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রায় দুইশ' বছরের পুরনো হাতে লেখা কোরআন শরীফ, আড়াইশ' বছরের পুরনো তালপাতার বই, আলিফ লায়লা, ফেরদৌসীর লেখা শাহনামা ও হাতে লেখা ইমাম হানিফার জীবনী। এ ছাড়া দুর্লভ কিছু পাণ্ডুলিপি, কবিতা, উপন্যাস আর গল্পের মূল্যবান প্রায় ১৩০টি বই যত্ন করে রাখা আছে পাঠাগারে। তার পাঠাগার থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও গবেষণার কাজে বই নেন প্রায়ই।
নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর নীরবতা ভাঙেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, 'বই সংগ্রহ করতে গিয়ে নিজের জমিজমা বিক্রি করে দিই। শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রীর ছিল প্রচুর জমি। বইকেনার নেশায় একপর্যায়ে স্ত্রীর জমিও বিক্রি করে ফেলি।'
নিজ হাতে গড়া পাঠাগারটির ভবিষ্যৎ নিয়ে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মোশাররফ হোসেন এখন চিন্তিত। তিনি যখন থাকবেন না, পাঠাগারে সারি সারি বইয়ের যত্নআত্তি করবে কে? মোশাররফ বলেন, 'আমার বই সংগ্রহ করতে কোনো কষ্ট হয় না। কিন্তু এ কথা ভাবতে কষ্ট হয়_ আমার বই পাঠাগারে কার হেফাজতে থাকবে? বইগুলো থাকবে তো পাঠকদের জন্য? কে নেবে এ দায়িত্ব?'
রাত জেগে পাহারা দেন মূল্যবান সব বইপত্র। সকালে পাঠাগার খুলে কিছুক্ষণ ঝাড়া-মোছার কাজ করেন। তারপর কাউকে দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে বেরিয়ে পড়েন মোশাররফ হোসেন চৌধুরী। মাইলের পর মাইল, গ্রামের পর গ্রাম, দিনমান হাঁটেন তিনি_ একটি মাত্র বইয়ের জন্য। কাজটি তিনি করে চলেছেন ৭০ বছর ধরে।
১৯৫০ সালের কথা। ম্যাট্রিক পাসের পর তরুণ মোশাররফ ভর্তি হন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। পড়াশোনা করতেন চাচাতো ভাই কবি ও সাহিত্যিক তালিম হোসেনের বাসায় থেকে। তালিম হোসেনের ছিল বিশাল পারিবারিক পাঠাগার। প্রতি মাসে অন্তত একবার সেখানে সাহিত্য সভা হতো। সাহিত্য সভার আমন্ত্রণপত্র বিলির দায়িত্ব পড়ত মোশাররফের ওপর। কবি শামসুর রাহমান, রাবেয়া খাতুনসহ নামীদামি অনেক কবি-সাহিত্যিক আসতেন সে পাঠাগারে। এ ছাড়া মোশাররফকে সঙ্গে নিয়ে তালিম হোসেন যেতেন কবি-সাহিত্যিকদের বাসায়। সেখানে তিনি দেখতেন বড় বড় পাঠাগার। গ্রামে রেখে আসা পাঠাগারটির কথা তখন মনে পড়ত মোশাররফের।
১৯৫২ সাল। মাতৃভাষার জন্য বাঙালি যখন রাজপথে তখন সে দলেও নাম লেখান মোশাররফ। 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত ঢাকার অলিগলি। কিন্তু হঠাৎ খবর আসে মায়ের মৃত্যুর। আন্দোলনের মাঝপথে বাড়ি ফেরেন তিনি। সময় বয়ে চলে, মোশাররফ হোসেন চৌধুরীও ছুটতে থাকেন বইয়ের খোঁজে।
এক সময় স্থানীয় সোনাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন মোশাররফ। বই সংগ্রহের এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিদ্যালয় কমিটির সঙ্গে দেখা দেয় বিরোধ। রাগ করে চাকরি ছেড়ে শুরু করেন কাপড়ের ব্যবসা। বই সংগ্রহের নেশায় ব্যবসাও লাটে ওঠে। এসব নিয়ে স্ত্রী রিজিয়া খাতুনের সঙ্গে প্রায়ই মনোমালিন্য হতো। বই জোগাড় করতে গিয়ে বিরাগভাজন হয়েছেন প্রিয়জনদের। আবার কারও কারও পরম বন্ধুও হয়েছেন।
মাত্র পাঁচটি বই নিয়ে ১৯৪৬ সালে যাত্রা শুরু করে মোশাররফ হোসেন চৌধুরীর পাঠাগার। নাম দেন 'ভাতসাইল প্রগতি সংঘ পাঠাগার'। প্রথমে মাটির দেয়াল ও টিনের ছাউনির ছোট্ট ঘরে পাঠাগারের কার্যক্রম চলত। ধীরে ধীরে ভিড় বাড়তে থাকে মানুষের। একসময় আরও জায়গার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সে সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন চাচাতো ভাই আবদুল মতিন চৌধুরী। পাঠাগারের জন্য তিনি ১৭ শতাংশ জমি দেন এবং তৎকালীন সাব-ডিভিশন অফিসার এমএ বাসিত পাঠাগারের জন্য ফাউন্ডেশন করে দেন। শুরুর দিকের আলীবাবা, গোপাল ভাঁড়, শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালা, আনোয়ারা ও মুসলিম পঞ্চসতি বইগুলো এখনও রেখেছেন সযত্নে।
সত্তর বছরেরও বেশি সময় ধরে মোশাররফ হোসেন চৌধুরী ছুটছেন বইয়ের পিছু। বইপাগল মানুষটি নতুন কোনো বইয়ের কথা শুনলেই রওনা হন সঙ্গে সঙ্গে। এ পর্যন্ত নিজ উদ্যোগে তিনি বই সংগ্রহ করেছেন লক্ষাধিক। চারটি কক্ষে, ৫২টি স্টিল ও কাঠের আলমারিতে বাংলা, ইংরেজি, উর্দুসহ নানান ভাষার বই সাজিয়ে রেখেছেন স্তরে স্তরে। নিজের টাকা, জেলা পরিষদ ও এলাকার মানুষের সহায়তায় এসব বই কিনেছেন মোশাররফ।
পাঠাগারেই রাত কাটান তিনি। তাই সবার জন্য এর দরজা ২৪ ঘণ্টাই খোলা। পাঠাগারে আছে বেশ কিছু দুর্লভ বই। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রায় দুইশ' বছরের পুরনো হাতে লেখা কোরআন শরীফ, আড়াইশ' বছরের পুরনো তালপাতার বই, আলিফ লায়লা, ফেরদৌসীর লেখা শাহনামা ও হাতে লেখা ইমাম হানিফার জীবনী। এ ছাড়া দুর্লভ কিছু পাণ্ডুলিপি, কবিতা, উপন্যাস আর গল্পের মূল্যবান প্রায় ১৩০টি বই যত্ন করে রাখা আছে পাঠাগারে। তার পাঠাগার থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও গবেষণার কাজে বই নেন প্রায়ই।
নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর নীরবতা ভাঙেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, 'বই সংগ্রহ করতে গিয়ে নিজের জমিজমা বিক্রি করে দিই। শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রীর ছিল প্রচুর জমি। বইকেনার নেশায় একপর্যায়ে স্ত্রীর জমিও বিক্রি করে ফেলি।'
নিজ হাতে গড়া পাঠাগারটির ভবিষ্যৎ নিয়ে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মোশাররফ হোসেন এখন চিন্তিত। তিনি যখন থাকবেন না, পাঠাগারে সারি সারি বইয়ের যত্নআত্তি করবে কে? মোশাররফ বলেন, 'আমার বই সংগ্রহ করতে কোনো কষ্ট হয় না। কিন্তু এ কথা ভাবতে কষ্ট হয়_ আমার বই পাঠাগারে কার হেফাজতে থাকবে? বইগুলো থাকবে তো পাঠকদের জন্য? কে নেবে এ দায়িত্ব?'
No comments