ফারাক্কার উজানে থৈ থৈ পানি : ভাটিতে ধুধু বালুচর
ভারত-বাংলাদেশ
৩০ বছরমেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হয়েছে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর। গত
২১ বছর ধরে নদী পাড়ের মানুষ দেখছেন, চুক্তি অনুযায়ী পদ্মায় পানি আসছে না।
ভারতীয় অংশে গঙ্গা পানিতে ভরপুর। ভাটির বাংলাদেশ অংশে পদ্মায় মাইলের পর
মাইল ধুধু বালুচর। উজানে পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করায় প্রমত্তা পদ্মা এখন মরা
গাঙে পরিণত হয়েছে। পদ্মা ও এর অসংখ্য শাখা-প্রশাখা নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। অথচ
চুক্তিটি আজ পর্যন্ত রিভিউ করা হয়নি। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌরা
নতুন দিল্লির হায়দরাবাদ হাউজে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন সংক্রান্ত ৩০
বছরমেয়াদি চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন। ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চুক্তি
কার্যকর হয়েছে। চুক্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে, শুষ্ক সময়ে বাংলাদেশ ৩৫
হাজার কিউসেক পানি পাবে। কিন্তু বাংলাদেশ কোনো বছরই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী
পানি পাচ্ছে না। চুক্তিতে বলা হয়েছে, এই চুক্তি পাঁচ বছর পরপর উভয় সরকার
রিভিউ করবে। যদি প্রয়োজন হয় অন্তর্বর্তীকালীন রিভিউ করা যাবে। চুক্তিতে আরো
বলা হয়েছে, আগামী দুই বছর পর যদি কোনো পক্ষ চুক্তিটি রিভিউ করতে চায় তা
করা হবে। সমঝোতার ব্যত্যয় ঘটলে বা সমন্বয়ের অভাব দেখা দিলে এই রিভিউ হবে।
কিন্তু ২১ বছর অতিক্রান্ত হলেও চুক্তিটি রিভিউ করা হয়নি। ভাটির বাংলাদেশ
অংশে পদ্মার প্রশস্ততা ও পানির স্তর ক্রমাগত কমে আসছে। চুক্তি মতে
ফারাক্কায় যে পানি জমে তাই ভাগ করে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু গঙ্গার পুরো পানির
ভাগাভাগির প্রসঙ্গ চুক্তিতে উল্লেখ নেই।
তাই চুক্তির পানি দিয়ে বাংলাদেশের
চাহিদার অর্ধেকও পূরণ হচ্ছে না। শুষ্ক মওসুমে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উজান ও
ভাটিতে পানির স্তর কমে যাওয়ায় পদ্মা ও এর শাখা-প্রশাখা নদীগুলো পানিশূন্য
হয়ে পড়ছে। দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে চুক্তি
রিভিউ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। পদ্মা অববাহিকার অন্যতম প্রধান শাখা
গড়াইয়ে পানিপ্রবাহ নেই। এ নদীর উৎসমুখে পলি ও বালু পড়ে ভরাট হয়ে গেছে।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলা, হরিপুর ও মিরপুর উপজেলার তালবাড়িয়া এলাকার পাশ দিয়ে
বয়ে যাওয়া পদ্মা থেকে গড়াই নদীর উৎস মুখ শুরু হয়েছে। এ নদীতে পানিপ্রবাহ না
থাকায় খুলনা, যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় নদী অববাহিকায়
নোনাপানি বেড়েছে। গড়াই নদী মাগুরা, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, যশোর ও
খুলনা হয়ে সুন্দরবনে মিশেছে। এ নদী সুন্দরবন ছাড়াও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের
জেলাগুলোয় নোনা পানির আগ্রাসন রুখতে বড় ভূমিকা রাখে। পরিবেশবিদদের মতে,
খুলনা বিভাগের মধ্যে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার দিক থেকে পদ্মার প্রধান শাখা
নদী গড়াইকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়।
বিশেষ করে সুন্দরবনের জন্য গড়াইয়ের মিঠা পানি অপরিহার্য। ১৯৫৪ সালে
পাকিস্তান সরকার কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্প
হাতে নেয়। ১৯৬৯ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। এই প্রকল্পের ১২টি ছোট পাম্প ও
তিনটি বড় পাম্প চালু রাখতে নদীর পানির স্তর ন্যূনতম ১৫ ফুট প্রয়োজন। জিকে
প্রকল্পের মোট সাড়ে ৩ লাখ একর জমি সেচসুবিধার আওতায় আনা হলেও পদ্মায় পানি
সঙ্কটের কারণে এক লাখ একরের বেশি জমিতে সেচসুবিধা সম্প্রসারণ করা হয়নি।
সমুদ্রতল থেকে ৪২ ফুট উঁচুতে অবস্থিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্ট থেকে ভারত
সীমান্ত ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ১৮ কিলোমিটার
উজানে ফারাক্কা বাঁধ অবস্থিত। ভারতের গোমুখিতে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশের
মেঘনা সঙ্গম স্থান পর্যন্ত এক হাজার ৬৮০ মাইলব্যাপী প্রবাহিত। মুর্শিদাবাদ
জেলা থেকে গঙ্গার মূল অংশ চলে আসে বাংলাদেশে।
গঙ্গার নি¤œস্রোত ধারার নাম
পদ্মা। পদ্মা রাজশাহী চারঘাটে প্রবেশ করে পাবনার বেড়া উপজেলার নতিবপুরের
কাছে বারকোদালিয়া নামক স্থানে যমুনার সাথে মিশেছে। পদ্মা ও যমুনার মিলিত
প্রবাহ পদ্মা নামে অভিহিত। অবশ্য গঙ্গা বাংলাদেশে আসার পর থেকেই পদ্মা নামে
পরিচিত। এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মার বুকে এখন অসংখ্য চর। পশ্চিমবঙ্গের
মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর মহকুমার কাছে গঙ্গা বিভক্ত হয়ে ভাগিরথী ও পদ্মা
হয়েছে। জলঙ্গি হয়ে নদীয়ার মধুগাড়ি পর্যন্ত আসে। এই এলাকার দৈর্ঘ্য ১২০
মিটার। এরপর বাংলাদেশে ঢোকে। পশ্চিম বাংলায় পদ্মার কোনো উপনদী নেই। শাখা
নদীর মধ্যে ভাগিরথী, ভৈরব ও জলঙ্গি। সেখানে কোনো জোয়ার-ভাটার প্রভাব নেই।
পদ্মায় বছরে পলিপ্রবাহ ৪০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন টন। পাবনার পাকশী থেকে রাজবাড়ীর
গোয়ালন্দ পর্যন্ত প্রতি কিলোমিটারে এ নদীর ঢাল প্রায় পাঁচ সেন্টিমিটার।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উজানে রয়েছে পদ্মার পানিপ্রবাহ মাপার মিটার গেইজ। এখানে
বাংলাদেশ ও ভারতের পানি বিভাগের কর্মকর্তারা পানি মাপেন ১ জানুয়ারি থেকে ৩১
মে পর্যন্ত। এখানে ছাড়াও গোয়ালন্দের বারুলিয়া এবং মাওয়ার ভাগ্যকূলে পদ্মার
পানিপ্রবাহ পরিমাপ করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত
গঙ্গার সর্বাপেক্ষা কম প্রবাহকালে ১০ দিনের পালাক্রমে উভয় দেশের মধ্যে
পানির ভাগ হয়ে থাকে। ১০ দিনের যেকোনো পালায় পানিপ্রবাহ ৫০ হাজার কিউসেকের
নিচে নেমে গেলে দুই দেশের সরকার জরুরি ভিত্তিতে আলোচনা করে পানি বণ্টনে
সামঞ্জস্য বিধান করে। ফারাক্কা পয়েন্টে পানিপ্রবাহ ৭৫ হাজার কিউসেকের বেশি
হলে বা তার কম হলে উভয় দেশ সমান সমান ভাগে পানি পায়। কিন্তু গঙ্গার পানির
পুরো ভাগ দেয়া হচ্ছে না। অন্যান্য মাসে সমস্যা না হলেও মে মাসে পানিসমস্যা
তীব্র আকার ধারণ করে। ১৯৮৮ সালের মার্চ মাসে গঙ্গার প্রবাহ ছিল ৩৫ হাজার
কিউসেক।
তখন পাবনার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির উচ্চতা ছিল ৬.৩৬ মিটার।
১৯৯৬ সালের মার্চে তা কমে দাঁড়ায় ৩৪ হাজার ৮৩৮ কিউসেক এবং পানির উচ্চতা ছিল
৩.৯৬ মিটার। এ অবস্থার অবনতি হয়েছে। গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির পর থেকে
পাবনা হাইড্রোলজি বিভাগ পদ্মায় পানিপ্রবাহ সংক্রান্ত কোনো তথ্য সাংবাদিকদের
দিচ্ছে না। পদ্মা পাড়ের মানুষ দেখছেন গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি অনুযায়ী
পদ্মায় পানি আসছে না। এ অঞ্চলের নদনদী শুকিয়ে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। পদ্মায়
পর্যাপ্ত পানিপ্রবাহ না থাকায় এর প্রধান শাখা বড়াল, আত্রাই ও গড়াই নদী
প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। কুষ্টিয়ার-রাজবাড়ী মহাসড়কের লাহিনী এলাকায় কয়ায়
গড়াই নদীর ওপর নির্মিত গড়াই রেলসেতু ও রুমী ব্রিজের নিচে গর্তে কিছু পানি
জমে আছে। আর উৎসমুখ তালবাড়িয়া থেকে শুরু করে লাহিনী এলাকা পর্যন্ত নদীতে
বিপুল পরিমাণ পলি ও বালু জমেছে। কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা,
ঝিনাইদহ, নড়াইল, সাতক্ষীরা ও ফরিদপুরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ২৫টি নদীর
উৎসমুখ পদ্মা। মধুমতি, নবগঙ্গা, কাজলা, মাথাভাঙ্গা, গড়াই, হিনসা, কুমার,
সাগরখালী, কপোতাক্ষ, চন্দনাসহ অসংখ্য শাখা-প্রশাখা নদী প্রায় শুকিয়ে
যাচ্ছে। কোনো কোনো স্থানে বালু স্থায়ী মৃত্তিকায় রূপ নেয়ায় ফসল আবাদ করেছেন
অনেকেই। বর্তমানে পদ্মার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ ব্রিজের নিচে খাস
জমিতে কৃষক চিনাবাদাম, বাঙি, তরমুজ, টমেটো, আখসহ নানা রকম রবিশস্য আবাদ
করেছেন। ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণ করে ভাগিরথী দিয়ে গঙ্গার (পদ্মা)
পানিপ্রবাহ ঘুরিয়ে নিয়েছে ভারত। ফারাক্কার উজানে পানি থই থই করছে। ভাটির
বাংলাদেশ পানি সঙ্কটে পড়েছে। এর সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলে
ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৩ থেকে ৭ মিটার নিচে নেমে গেছে। শুষ্ক মওসুমে
ফারাক্কার উজান থেকে হাজার হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত।
ফলে ফারাক্কা পয়েন্টে পানিপ্রবাহ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। পদ্মা সংযুক্ত
উত্তরের বরেন্দ্র অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত মহানন্দা, আত্রাই, বারনই, শিব,
রানী ও ছোট যমুনাসহ ১২টি নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। এসব নদী পলি ও বালু জমে ভরাট
হয়ে গেছে। ফলে এ অঞ্চলের কৃষি সেচব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভূগর্ভস্থ পানির ওপর
নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
পদ্মার পানি দিয়ে শুকনো মওসুমে রাজশাহী, পাবনা,
কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় সেচকাজ চালানো হয়। শুধু ফারাক্কার
প্রভাবে বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প-কারখানা ও পরিবেশসহ সবকিছুতেই মারাত্মক
ক্ষতি হচ্ছে। মিঠাপানি ছাড়া কৃষি তথা কোনো ধরনের শিল্প-কারখানা চলতে পারে
না। ফারাক্কার কারণে যশোর-খুলনা অঞ্চলে মিঠা পানির প্রবাহ কমে গেছে। পদ্মার
তলদেশ ওপরে উঠে এসেছে। শুষ্ক মওসুমে এখন পদ্মায় তেমন ইলিশ মাছ পাওয়া যায়
না। মাছ আসার জন্য পানিতে যে পরিমাণ প্রবাহ থাকার কথা সেটি না থাকায় এখন আর
পদ্মায় ইলিশ আসে না। অন্যান্য প্রজাতির মাছ আগের মতো পাওয়া যায় না। পদ্মায়
পানিস্বল্পতার কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধুমতী, আড়িয়াল খাঁ, ভৈরব,
মাথাভাঙ্গা, কুমার, কপোতাক্ষ, পশুর নদী পদ্মার সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নদীবিশেষজ্ঞ কামরুন নেছা জানান,
বাংলাদেশের পদ্মার যে বিপুল আয়তন তাতে স্বাভাবিক প্রবাহ থাকলে প্রাকৃতিক ও
পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টির কথা উঠত না। কিন্তু ভারত নেপালের কোশি থেকে শুরু
করে ফারাক্কা পর্যন্ত দীর্ঘ পথে পানি প্রত্যাহারের যে একতরফা কার্যক্রম
চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে।
No comments