মিছিল থেকে যৌন নিপীড়ন



নিপীড়নের শিকার কলেজছাত্রী কর্তৃক ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ‘রাজনৈতিক প্রচারে’ ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কায় সেটি তাঁর তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তটিও ভালো বিবেচনাপ্রসূত। তাঁর এই প্রতিবাদী মনোভাব ও পরিমিতিবোধের বিষয়টি অনুসরণীয়। তাঁর হৃদয়স্পর্শী ফেসবুক স্ট্যাটাস সত্যি অনেকেরই বিবেককে জাগ্রত করেছে। যৌন হয়রানির শিকার নারীর প্রতিবাদের নতুন হাতিয়ার হয়ে ওঠা সামাজিক মাধ্যমে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ার কারণে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল দুটোকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। শ্মশ্রুমণ্ডিত পুলিশ, যিনি মেয়েটিকে ‘উদ্ধার’ করে বাসে তুলে দিয়েছিলেন, তাঁকে ধন্যবাদ! কিন্তু পুলিশের উচিত হবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিজেদের এই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করানো যে প্রকাশ্য রাজপথে যেখানে ৭ মার্চ উপলক্ষে তারা নিরাপত্তার চাদরে গোটা শহর ঢেকে দিয়েছিল, তাদের সম্ভাব্য উপস্থিতি কেন স্লোগানদানকারী ওই বিপথগামী তরুণদের যৌন হয়রানির অপরাধ সংঘটন করা থেকে নিবৃত্ত করেনি। সরকারি দলের বড় একটি জমায়েতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কৃতিত্ব নিশ্চয়ই পুলিশের অথচ সেখানে নারীকেই প্রকাশ্যে সহিংসতার শিকার হতে হলো। স্পষ্টতই অভিযুক্ত নির্লজ্জ তরুণেরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা  সামাজিক প্রতিরোধ, কোনোটি থেকেই কোনো ধরনের বাধার আশঙ্কা করেনি। দেশ ও সমাজের এই পরিস্থিতি খুবই হতাশাজনক। নারীর বিরুদ্ধে ব্যাপকভিত্তিক সহিংসতা এবং তার বিচার করতে পিছিয়ে থাকা একটি দেশ হিসেবে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত লজ্জাজনক। নারীর সুরক্ষায় আমরা বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ড প্রথার মতো নানাবিধ কাগুজে আইনি রক্ষাকবচ সৃষ্টি করার পরে যেন ধরেই নিয়েছি যে নারীদের জন্য রাষ্ট্র যথেষ্ট করেছে। কিন্তু রূঢ় বাস্তবতা হলো পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি হয়নি। বিদ্যমান ফৌজদারি ব্যবস্থা এমনিতেই রুগ্‌ণ, দ্রুত ন্যায়বিচার আশা করা দুরূহ। তদুপরি এটাও সত্য যে পুরুষের থেকে তুলনামূলকভাবে নারী বিচারপ্রার্থীরা উদ্বেগজনকভাবে পিছিয়ে আছেন। ধর্ষণ, হত্যা ও যৌন নিপীড়নের মতো অপরাধে ট্রাইব্যুনালগুলোতে ১৫ বছরে ৭ হাজার ৮৭৪টি মামলা হয়েছে; অভিযুক্তদের ৯৭ শতাংশের কোনো সাজা হয়নি। ওই পরিসংখ্যান সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করছে যে সমাজে নারীরা সবচেয়ে বেশি বিচারহীনতার শিকার। আবার এ কথাও সত্য যে নারীদের দায়ের করা উল্লেখযোগ্য মামলার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু সেখানেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, যার অনুষঙ্গ হিসেবে রয়েছে একশ্রেণির অসাধু পুলিশ, আদালতের বারান্দায় ঘোরাফেরা করা টাউট এবং অসাধু আইনজীবীদের একটি চক্র। নারী বাস্তবে নিগ্রহ হওয়ার পর তার প্রতিকারের নামে চলে আরেক ধরনের পদ্ধতিগত নারী নিগ্রহ। এই প্রেক্ষাপটে দৃশ্যত ঐতিহাসিক ৭ মার্চের জনসভায় যোগ দিতে আসা একদল উচ্ছৃঙ্খল তরুণের হাতে কলেজছাত্রীর লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাটি হয়তো আরও এ রকম বহু ঘটনার একটি হিসেবে জানাজানির বাইরে থাকারই কথা। কিন্তু একটি সাহসী ফেসবুক স্ট্যাটাসের কারণে ঘটনাটি ভাইরাল (ছড়িয়ে পড়া) হয়ে যায়। তবে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ওই দিন উল্লিখিত ঘটনাটিই কেবল ঘটেনি, আরও কিছু নারী লাঞ্ছিত হয়েছেন, কিন্তু সেসব নিয়ে হইচই হয়নি বলে তার বিচার হবে না? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ‘সমাবেশের বাইরে রাস্তায় কী হয়েছে, তা দলের বিষয় নয়’ বলে যে মন্তব্য করেছেন, তা দুর্ভাগ্যজনক। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান অবশ্য জনগণকে আশ্বস্ত করে বলেছেন যে ওই ছাত্রীকে নিপীড়নের ভিডিও ফুটেজ ধরে নিপীড়কদের ধরার চেষ্টা চলছে। এর আগে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনে নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটলেও এখন পর্যন্ত কেউ শাস্তি পায়নি। আমরা আশা করব এবার তার পুনরাবৃত্তি হবে না, বরং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করার মাধ্যমে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.