রক্ষা পাবে না যক্ষ্মা তহবিল! by সারফুদ্দিন আহমেদ
ফারাও
বাদশাহ তুতেনখামেন থেকে ভেনেজুয়েলার বিপ্লবী সিমোন বলিভার; বিলেতের কবি
কিটস থেকে বাংলার সুকান্ত; মুঘল-এ-আজম-এর নায়িকা মধুবালা থেকে জওহরলাল
নেহরুর স্ত্রী কমলা নেহরু-এই রকম বিখ্যাত মানুষের পঞ্চপ্রাপ্তি ঘটেছিল যে
রোগে, সে রোগ যারে তারে ধরে না। সে রাজরোগ। নাম তার যক্ষ্মা। কেউ বলে
ক্ষয়রোগ; কেউ বলে টিবি। একসময় লোকে বলত, ‘যার হয় যক্ষ্মা, তার নাই রক্ষা’।
ধনীরা মৃত্যুর তারিখটা পেছানোর আশায় যেতেন বিশুদ্ধ বাতাসের দেশ
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়। সেখানে কমলা নেহরু চিকিৎসা নিয়েছিলেন। মারাও
গেছেন জেনেভার কাছের শহর লুসানের এক স্যানাটোরিয়ামে। সেই সুইজারল্যান্ড,
সেই জেনেভা এখনো যক্ষ্মার বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে। বড় কষ্টের কথা, মহান
জেনেভার একটি দাতা সংস্থা যক্ষ্মার নামে আমাদের মান-ইজ্জত সব শেষ করে
দিয়েছে। একটি বিদেশি দাতা সংস্থা যে এত বড় ছোটলোক হতে পারে তা ৪ মার্চ
প্রথম আলোয় ছাপা প্রতিবেদন না পড়লে বুঝতে পারতাম না। সংস্থাটির নাম গ্লোবাল
ফান্ড। জানলাম, গরিব-গারাব মানুষ যাতে কাশতে কাশতে না মরে সে জন্য গ্লোবাল
ফান্ড কিছু টাকাপয়সা দিয়েছিল। কথা ছিল স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা
মন্ত্রণালয় টাকাটার সদ্গতি করবে। মন্ত্রণালয় ‘জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ
কর্মসূচি’র আওতায় ‘কাজ’ শুরু করল। দেখা গেল প্রকল্পটি ওই অর্থের সদ্গতি
করতে গিয়ে সৎকার করে বসেছে। পয়সাপাতি খরচ হয়ে যাওয়ার পর গ্লোবাল ফান্ড
গোয়েন্দাগিরি করে বের করেছে, আমাদের এখানকার ‘অফিসার’ এবং ‘কর্মকর্তারা’
একজোট হয়ে ভুয়া সই স্বাক্ষর দিয়ে ‘অরিজিনাল’ বিল ভাউচার-রসিদপত্র
বানিয়েছেন। তারপর টুক করে ৮৮ লাখ ৪৩ হাজার ২১৫ টাকা ‘নাই’ করে দিয়েছেন। এই
নিয়ে ২২ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট গ্লোবাল ফান্ড তার ওয়েবসাইটে সেঁটে দিয়েছে।
সারা বিশ্বের ‘গ্রামে গ্রামে এই বার্তা রটে গেল ক্রমে’: বাংলাদেশের
স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা গরিব যক্ষ্মা রোগীর ক্ষয় কাশ ও শ্লেষ্মামাখা টাকা
মেরে দিতেও এদিক-ওদিক চান না। মহাজনের মতো বিদেশিরা ঝাড়ি দিয়ে বলেছে, ৩০
জুনের মধ্যে ওই টাকা ভালোয় ভালোয় ফেরত না দিলে খবর আছে! স্বাস্থ্য
মন্ত্রণালয়ের সৎসাহস সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখার মতো। তারা গ্লোবাল ফান্ডকে
মুখের ওপর বলে দিয়েছে, ‘ম্যান ইজ মরটাল, দ্যাট মিনস্ মানুষ মাত্রই চুরি
করে। এইটা কোনো টাকার মধ্যে পড়ে? যা, তোর টাকা জুনের মধ্যে চান্দা উঠায়ে
দিয়ে দেব!’ এশিয়া ও আফ্রিকায় যক্ষ্মা, এইচআইভি/এইডস ও ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ
কর্মসূচিগুলোতে সবচেয়ে বড় দাতা সংস্থা হিসেবে কাজ করছে গ্লোবাল ফান্ড। এত
বড় একটা হাতির মতো কলিজাওয়ালা তহবিলের এই রকমের পুঁটি মাছের পরান দেখে বড়
কষ্ট পেলাম। আরে সাহেব, আপনি নিজেকে যখন ‘দাতা’ বলবেন, তখন আপনি যে
টাকাটুকা দেবেন সেটাকে তো আমরা দানই ভাবব, নাকি? দান করার পর খুঁটিয়ে
খুঁটিয়ে সেই টাকার হিসাব নেওয়া কি কোনো বংশীয় ঘরের ভদ্দরলোকের কাজ?
ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় একজন উপদেষ্টাকে সকালে বিকেলে বলতে শুনতাম,
‘ট্রাস্ট বাট ভেরিফাই’। গ্লোবাল ফান্ড দুনিয়ায় আর লোক পেল না, সেই
উপদেষ্টার উপদেশ নিল। দান করেও দাবি ছাড়ল না। তাদের উপলব্ধির অন্তর্লোকে
কবিগুরুর এই বাণী একটিবারের জন্যও উঁকি দিল না, ‘অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার
রাখিতে যাইবার মতো এমন বিড়ম্বনা আর নাই।’ আল্টিমেটলি এখন বিড়ম্বনার সীমা
নেই। গ্লোবাল ফান্ড ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরের যক্ষ্মা
নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রশিক্ষণসংক্রান্ত খরচাপাতির হিসাব নিরীক্ষা করতে
গিয়ে দেখে, প্রশিক্ষণের জন্য ব্যাগ, কলম ও প্যাড সরবরাহকারীদের জমা দেওয়া
রসিদ আসলে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিসংখ্যান কর্মকর্তা, কোষাধ্যক্ষ ও
লাইন ডিরেক্টরের ব্যক্তিগত সহকারীর লেখা। ৮৬ শতাংশ রসিদ একজন কর্মকর্তার
নিজের লেখা। ৪৩টি সন্দেহজনক রসিদ চিহ্নিত করেছিল নিরীক্ষক দল।
প্রশিক্ষণসামগ্রী সরবরাহকারী তিনটি প্রতিষ্ঠান নিরীক্ষক দলকে জানিয়েছিল,
রসিদের লেখা তাদের না। সইও তাদের প্রতিষ্ঠানের কারও না। এই রকমের কত
সৃজনশীল কায়দায় যে টাকাগুলো সৎকার করা হয়েছে তা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। খুব
আমোদের বিষয় হলো নিরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই কর্মকর্তারা অনিয়ম স্বীকার করে
নিয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের বদলি করা
হয়েছে। মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্তের পর দোষী সাব্যস্ত
হওয়া কর্মচারী ও কর্মকর্তারা কে কত টাকা ফেরত দেবেন তা ঠিক করা হবে।
মন্ত্রণালয়ের এই বাণী থেকে আমরা বুঝতে পারি সরকারি চাকরি কী জিনিস। এর যেমন
লিকার, তেমনি ফ্লেভার। একবার হাতিয়ে নিতে পারলেই হলো। চুরি ধরা পড়েছে।
চোরও কে তাও জানা। এরপরও কমিটি বানিয়ে ‘তদন্ত’ হবে। সেই তদন্তের ময়নাতদন্তে
আবার কমিটি হবে। সেই কমিটি বলবে, ‘এই এরা এরা চোর’। মন্ত্রণালয় তখন ঠিক
করবে, এই টাকা ওনারা ভাগেযোগে, মানে ‘চান্দা’ তুলে ফেরত দেবেন। কে কত টাকা
ফেরত দেবে তাও ঠিক করে দেওয়া হবে। কোনো জেল-ফাঁস নাই। টাকা ফেরত দেওয়ার পর
সবাই আবার ধোয়া তুলসীপাতার মতো আয়ুর্বেদিক কর্মকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হবেন
এবং বাইনোকুলার হাতে নতুন ফান্ডের অনুসন্ধান শুরু করবেন। এখানে লজ্জা-শরমের
বিষয় নাই। কারসাজি করে টাকা চুরি আর রাতের বেলা পরের খোপের মুরগি চুরির
মধ্যে যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নাই, তা বোঝার বোধ তাঁরা বহু আগেই হারিয়ে
ফেলেছেন। ‘তাঁরা’ মানে কারা? ‘তাঁরা’ মানে ‘তুমি আমি সে’। আমরা সবাই।
আমাদের হায়া গেছে। লজ্জা গেছে। শরম গেছে। আমি ৪০ হাজার টাকার বেশি মাইনে
পাই না; এ কথা জেনেও আমার কোটি টাকার গাড়িতে উঠে বাবার মনে হয় না তিনি একজন
চোরের বাপ। একই লজ্জায় যার মাথা কাটা যাওয়ার কথা ছিল সেই আমার মায়ের গলা
দেখা যাচ্ছে ইয়া লম্বা! সমাজের অল্প কিছু মানুষ, যাঁদের কারণে এখনো সমাজটা
কোনো রকমে টিকে আছে তারা বাদে আমরা সবাই ‘সিস্টেম’ নামক এক স্বরচিত কলের
মধ্যে আটকা পড়ে গেছি। আমাদের বোধের ফুসফুসে যক্ষ্মা বাসা বেঁধেছে। এই
রাজরোগ সারাতে পারে এমন স্যানাটোরিয়াম জেনেভাতেও নেই।
সারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
sarfuddin2003@gmail.com
সারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
sarfuddin2003@gmail.com
No comments