আমি যদি মোহাম্মদ বিন সালমান হতাম... by রবার্ট ফিস্ক
ঈশ্বরকে
ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন
সালমানকে উষ্ণ অভিবাদনই দিয়েছেন। কারণ, এটিই যথোপযুক্ত। মহামান্য ক্রাউন
প্রিন্স একজন সাহসী আরব সংস্কারক। তিনি তার ধনাঢ্য দেশকে একুশ শতকে পদার্পণ
করাতে ভীষণ আগ্রহী। নারী অধিকার, ব্যাপক অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, মধ্যপন্থী
ইসলাম, পাশ্চাত্যের জন্য আরও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও ‘সন্ত্রাস-বিরোধী
যুদ্ধে’ আরও ঘনিষ্ঠভাবে অংশগ্রহণের মতো একগাদা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
ঈশ্বরকে আবারও ধন্যবাদ।
মুন্ডু শিরশেদকারী আক্রমণাত্মক এক আরব ক্রাউন প্রিন্স, যার সাংঘাতিক যুদ্ধ কিনা হাজার হাজার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ইয়েমেনে; ইয়েমেনের জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে তেরেসা মের কাছ থেকে কয়েক মিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র কিনে যেই প্রিন্স কিনা যুক্তরাজ্যকে তার দুর্নামের ভাগীদার করেছেন; যিনি কিনা তার ধনবান কাতারি ভাইদের ধ্বংস করতে চান; যেই প্রিন্স কিনা মধ্যপ্রাচ্যের শিয়াদের বিরুদ্ধে সৌদি যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কতিপয় পশ্চিমা দেশকে সম্পৃক্ত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন, সেই ক্রাউন প্রিন্সকে অভ্যর্থনা জানিয়ে অযথা নিজের সময় নষ্ট না করে তেরেসা মে অগাধ প্রজ্ঞার স্বাক্ষর রেখেছেন।
সমস্যাটা ধরতে পেরেছেন? অর্থ, অস্ত্র ও ক্ষমতার প্রশ্ন যখন এসে হাজির হয়, তখন আমরা যেকোনো আরব স্বৈরাচারের সঙ্গে দহরম মহরম করবো। বিশেষ করে যখন ওয়াশিংটনে আমাদের সর্দারও ওই স্বৈরাচারের ব্যাপারে একই মনোভাব পোষণ করে, তখন তো কথাই নেই। আর যদি বা যখন ওই স্বৈরাচারের কোনো মূল্য থাকবে না, আমাদের সমরাস্ত্র কিনবে না, কিংবা যখন তার অর্থ ফুরিয়ে যাবে বা ক্ষমতাচ্যুত হবে, তখন আমরা স্রেফ আমাদের হাত ধুয়ে মুছে ফেলবো। এ কারণে যুবক মোহাম্মদের জন্য আমি সামান্য করুণা অনুভব করি।
আরেকটু যোগ করে বলি, মানবাধিকার প্রশ্নে তেরেসা মের ‘আসুন পুরাতন ভুলে নতুন করে শুরু করি’ ধাঁচের বক্তব্য যদি কারও কয়েক মিনিটের বেশি শুনতে ইচ্ছে হয়, তাদের প্রতিও আমার করুণা রইলো। সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল-জুবেইর খুবই ঝানু একজন কূটনীতিক। বৃটিশ কর্তাদের সুস্পষ্ট অসৎ ও অসংলগ্ন কথাবার্তা শোনার সময় তিনিও নিশ্চয়ই অধৈর্য বোধ করছিলেন। ১২ মাসের বিরতিতে বেলফোর ঘোষণাপত্রের প্রতি অবজ্ঞা থেকে ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে বরিস জনসনের। আরব বিশ্বে একে নিকৃষ্ট হেঁয়ালিপনা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
এই সপ্তাহে অ্যামনেস্টি ও অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে। একই কাজ করছে বিক্ষোভকারীরা। কেউ এই বিক্ষোভে বাধা দিলে তারা সৌদির কাজই করবে, আমরা নিশ্চিত। কিন্তু আমার আশঙ্কা হলো, ক্রাউন প্রিন্সের উচিৎ ওই দেশের সরকারকে নিয়ে বেশি চিন্তিত হওয়া যারা এখন তার নেতৃত্বের প্রতি মাথা নত করছে। কারণ, তিনি একটি পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে লেনদেন করছেন, তার বেলায় সেই শক্তি হলো বৃটেন। তাকে এখন একটাই উপদেশ দেওয়া উচিৎ। সেটা হলো: নিজের পেছনটার দিকে খেয়াল রাখুন।
প্রয়াত মুয়াম্মার গাদ্দাফি যখন বাদশাহ ইদরিসকে উৎখাত করলেন, বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খুশি হলো। তেলসমৃদ্ধ দেশের নেতৃত্বে নতুন চালক, নতুন একজোড়া হাত। আমরা এই দেশের সম্পদের কিছু অংশ ভোগ করতে চাই। তাই আমরা ভেবেছি গাদ্দাফিই হতে পারে আমাদের লোক। আমেরিকানরা এমনকি তাকে এক পাল্টা-অভ্যুত্থান সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়। আমরাও পরে তার ভিন্নমতালম্বীদের নির্যাতনের জন্য বন্দী করতে তাকে সহায়তা করি। এরপর হুট করে গাদ্দাফি উপনিবেশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদীতে পরিণত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। এক পর্যায়ে সে আইআরএ’র সঙ্গে জড়িত হলো। পশ্চিম বার্লিনের একটি নাইটক্লাবে বোমা হামলায় তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেল। আর তাতেই সে হঠাৎ করে সন্ত্রাসী হয়ে গেল! এরপর যখন ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু হলো, দখল হলো ইরাক, তখন পরম পূজনীয় ব্লেয়ার পারলে গাদ্দাফিকে চুমু খান, এই অবস্থা! গাদ্দাফি তখন আবার মহান রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হলো। ২০১১ সালের বিপ্লবের আগে আগে, গাদ্দাফি ফের সন্ত্রাসী হয়ে যান। এবার তাকে বোমা মেরে উৎখাত করে ন্যাটো। তাকে হত্যা করে তার নিজের লোকেরা।
ইরাকের প্রসঙ্গ যেহেতু উঠলো, সেহেতু বলতে হয়, সাদ্দামেরও একই পরিণতি হয়েছিল। প্রথমে আমরা তাকে পছন্দ করেছিলাম। আমেরিকানরা তাকে তার কম্যুনিস্ট প্রতিপক্ষদের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিল। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সেও ছিল মস্তক বিদীর্ণকারী। কিন্তু যতদিন সাদ্দাম পশ্চিমা পছন্দসই রাষ্ট্র দখল করেছিল, ততদিন সে ছিল মহান রাষ্ট্রনায়ক। এ কারণেই ১৯৮০ সালে আমরা তার ইরান দখল অভিযানে সহায়তা দিয়েছিলাম। কিন্তু ১৯৯০ সালে যখন সাদ্দাম ভুল রাষ্ট্র অর্থাৎ কুয়েত দখলে নেন, তখন আমরা তাকে কুখ্যাত সন্ত্রাসী আখ্যা দিলাম। গাদ্দাফির মতো সাদ্দামকেও হত্যা করে তার নিজ দেশের মানুষ, যদিও আমেরিকানদের ঠিক করে দেওয়া আদালতই তাকে ফাঁসি দেওয়ার রায় দেয়।
ইয়াসির আরাফাতের কথা আমরা এখন অত মনেও করি না। তাকেও একসময় ভাবা হতো বৈরুতের ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসী। আইজাক রবিন ও বিল ক্লিনটনের সঙ্গে করমর্দন করার আগে আরাফাত ছিলেন বিশ্ব সন্ত্রাসের কেন্দ্রবিন্দু। করমর্দন করার পর তিনি হয়ে যান মহান রাষ্ট্রনেতা। কিন্তু আরাফাত যখন অসলো চুক্তি থেকে দূরে গিয়ে পশ্চিম তীরে ইসরাইলি একাধিপত্য মানতে অস্বীকার করলেন, তখন তিনি ফের হয়ে যান কুখ্যাত সন্ত্রাসী। রামাল্লায় তাকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখা হতো। বোমা হামলাও হয়েছে সেখানে। জীবনের শেষ মুহূর্তে তাকে বিমানে করে প্যারিসের এক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানেই তিনি মারা যান। ইসরাইলিরা তাকে ‘আমাদের বিন লাদেন’ হিসেবে আখ্যা দিত। আরাফাতের উত্তরসূরি মাহমুদ আব্বাসকেও এই উপাধি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু মাহমুদ আব্বাসের অত সৌভাগ্য ছিল না। তিনি ভয়াবহ সন্ত্রাসী বা মহান রাষ্ট্রনায়ক কোনটাই নন। তিনি ছিলেন আরও খারাপ কিছু। একজন ব্যর্থ নেতা।
নাসের উৎখাত করেছিলেন দুর্নীতিগ্রস্ত বাদশাহ ফারুককে। সুয়েজ খাল জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তিনি পশ্চিমের চোখে হয়ে যান সন্ত্রাসী। তৎকালীন বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি এডেন তাকে ‘নীল নদের মুসোলিনি’ আখ্যা দিয়েছিলেন। মনে করে দেখুন, সাদ্দামকেও ‘টাইগ্রিস নদের হিটলার’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল ১৯৯০ সালে। প্যারিসে নির্বাসিত থাকাকালে খোমেনিও ছিলেন সম্ভাব্য রাষ্ট্রনায়ক। কিন্তু যখন তিনি শাহকে হটিয়ে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেন ইরানে, তিনি হয়ে গেলেন সুপার টেরোরিস্ট-ইন-চীফ। ফরাসি বামপন্থীরা ভেবেছিল হাফেজ আল আসাদ হয়তো হবে মহান রাষ্ট্রনায়ক। কিন্তু তার ছেলে বাশার আল আসাদ, যিনি হৃষ্টপুষ্ট হন ফ্রান্সে, তিনি যখন তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে গেলেন, তখন তিনি তো ‘সুপার টেরোরিস্ট’ হলেনই, নিজের পিতাকেও ‘সন্ত্রাসী’ বানিয়ে ছাড়লেন। ওমানে ও কাতারের বাদশাহর বিরুদ্ধে তাদের ছেলেরা যখন অভ্যুত্থান করলো তখন আনুগত্য পরিবর্তনে একটুও সময় নেয়নি বৃটেন।
এ কারণে আদেল আল জুবেইরের উচিৎ হবে মোহাম্মদ বিন সালমানকে ‘মেমেন্টো হোমো’ শব্দদ্বয় মনে করিয়ে দেওয়া। মেমেন্টো হোমো - এই কথা গ্ল্যাডিয়েটরদের মনে করিয়ে দেওয়া হতো। এর মানে হলো তিনিই ‘একমাত্র মানুষ’। নিজে বৈ কেউ গ্ল্যাডিয়েটরদের সঙ্গে নেই। ইয়েমেন যুদ্ধ যদি আরও রক্তাক্ত হয়ে উঠে, সৌদি সামরিক বাহিনীর যদি যুদ্ধ থেকে মোহমুক্তি ঘটে, তাহলে কী হতে পারে? ক্রাউন প্রিন্সের ভিশন ২০৩০ যদি স্রেফ সাউথ সি বাবলের সৌদি সংস্করণ বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে কী ঘটবে? কী ঘটবে, যদি অপমানিত বিলিয়নিয়াররা, যাদেরকে ক্রাউন প্রিন্স রিয়াদের রিটয হোটেলে বন্দী করেছিলেন, তারা প্রতিশোধ নিতে আসে? কী হবে যদি ভবিষ্যৎ বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী আল ইয়ামামাহ অস্ত্র চুক্তি নিয়ে স্পেশাল ব্রাঞ্চের তদন্ত পুনরায় শুরু করেন? আর কী হবে, যদি কেউ আমেরিকার সমরাস্ত্র কীভাবে ২০১৪ সালের পর আইসিসের হাতে পৌঁছেছিল সেই পথ আবিষ্কার করে ফেলে? কিংবা যদি ইরানের সঙ্গে সত্যি সত্যি যুদ্ধ শুরু হয়?
সত্য হলো, আপনি কিছুতেই বলতে পারবেন না যে, কে আপনার বন্ধু। এই বৃটিশরাই কী সৌদি রাজবংশকে আরব সাম্রাজ্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিলিস্তিন, টান্স-জর্দান ও ইরাক তাদের দখলে রেখে দেয়নি? এই বৃটিশরাই কি বেলফোর ঘোষণাপত্র প্রকাশ করার পর ইহুদীদের ও আরবদের সঙ্গে প্রতারণা করার চেষ্টা করেনি? ইহুদীদেরকে বৃটিশরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তাদেরকে একটি দেশ পাইয়ে দেওয়ার। আর আরবদের ভূখ- রক্ষার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল বৃটিশরা।
এই বৃটিশরাই কি রোমানিয়ার একনায়ক চচেসকুকে সম্মানসূচক নাইটহুড দিয়ে আবার তার উৎখাতের পর তা প্রত্যাহার করেনি? আমরা মুগাবেকেও একই সম্মাননা দিয়েছিলাম, পরে আবার ফেরত নিয়েছিলাম। আমরা মুসোলিনিকেও সম্মাননা দিয়েছিলাম! হ্যাঁ, আমরা ১৯৪০ সালে তা ফেরত নিই।
তাই, ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ, সতর্ক হোন। বিশ্বাসঘাতক বৃটিশদের বিশ্বাস করবেন না। দেশে থাকুন, আর বিদেশে। অস্ত্র কিনেছেন, সেজন্য ধন্যবাদ। ধন্যবাদ আপনাকে ওয়াহাবি বিশ্বাসে ব্রেইনওয়াশড হওয়া ছেলেপেলেগুলোর পদচিহ্ন অনুসরণের কাজে আমাদেরকে গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহায়তার জন্য। কিন্তু যা-ই করুন না কেন, আমাদের সম্মানসূচক নাইটহুড নিয়ে উচ্ছ্বসিত হবেন না।
(রবার্ট ফিস্ক বৃটিশ পত্রিকা দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি। ইন্ডিপেনডেন্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তার এই কলাম অনুবাদ করেছেন মাহমুদ ফেরদৌস।)
ঈশ্বরকে আবারও ধন্যবাদ।
মুন্ডু শিরশেদকারী আক্রমণাত্মক এক আরব ক্রাউন প্রিন্স, যার সাংঘাতিক যুদ্ধ কিনা হাজার হাজার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ইয়েমেনে; ইয়েমেনের জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে তেরেসা মের কাছ থেকে কয়েক মিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র কিনে যেই প্রিন্স কিনা যুক্তরাজ্যকে তার দুর্নামের ভাগীদার করেছেন; যিনি কিনা তার ধনবান কাতারি ভাইদের ধ্বংস করতে চান; যেই প্রিন্স কিনা মধ্যপ্রাচ্যের শিয়াদের বিরুদ্ধে সৌদি যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কতিপয় পশ্চিমা দেশকে সম্পৃক্ত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন, সেই ক্রাউন প্রিন্সকে অভ্যর্থনা জানিয়ে অযথা নিজের সময় নষ্ট না করে তেরেসা মে অগাধ প্রজ্ঞার স্বাক্ষর রেখেছেন।
সমস্যাটা ধরতে পেরেছেন? অর্থ, অস্ত্র ও ক্ষমতার প্রশ্ন যখন এসে হাজির হয়, তখন আমরা যেকোনো আরব স্বৈরাচারের সঙ্গে দহরম মহরম করবো। বিশেষ করে যখন ওয়াশিংটনে আমাদের সর্দারও ওই স্বৈরাচারের ব্যাপারে একই মনোভাব পোষণ করে, তখন তো কথাই নেই। আর যদি বা যখন ওই স্বৈরাচারের কোনো মূল্য থাকবে না, আমাদের সমরাস্ত্র কিনবে না, কিংবা যখন তার অর্থ ফুরিয়ে যাবে বা ক্ষমতাচ্যুত হবে, তখন আমরা স্রেফ আমাদের হাত ধুয়ে মুছে ফেলবো। এ কারণে যুবক মোহাম্মদের জন্য আমি সামান্য করুণা অনুভব করি।
আরেকটু যোগ করে বলি, মানবাধিকার প্রশ্নে তেরেসা মের ‘আসুন পুরাতন ভুলে নতুন করে শুরু করি’ ধাঁচের বক্তব্য যদি কারও কয়েক মিনিটের বেশি শুনতে ইচ্ছে হয়, তাদের প্রতিও আমার করুণা রইলো। সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল-জুবেইর খুবই ঝানু একজন কূটনীতিক। বৃটিশ কর্তাদের সুস্পষ্ট অসৎ ও অসংলগ্ন কথাবার্তা শোনার সময় তিনিও নিশ্চয়ই অধৈর্য বোধ করছিলেন। ১২ মাসের বিরতিতে বেলফোর ঘোষণাপত্রের প্রতি অবজ্ঞা থেকে ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে বরিস জনসনের। আরব বিশ্বে একে নিকৃষ্ট হেঁয়ালিপনা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
এই সপ্তাহে অ্যামনেস্টি ও অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে। একই কাজ করছে বিক্ষোভকারীরা। কেউ এই বিক্ষোভে বাধা দিলে তারা সৌদির কাজই করবে, আমরা নিশ্চিত। কিন্তু আমার আশঙ্কা হলো, ক্রাউন প্রিন্সের উচিৎ ওই দেশের সরকারকে নিয়ে বেশি চিন্তিত হওয়া যারা এখন তার নেতৃত্বের প্রতি মাথা নত করছে। কারণ, তিনি একটি পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে লেনদেন করছেন, তার বেলায় সেই শক্তি হলো বৃটেন। তাকে এখন একটাই উপদেশ দেওয়া উচিৎ। সেটা হলো: নিজের পেছনটার দিকে খেয়াল রাখুন।
প্রয়াত মুয়াম্মার গাদ্দাফি যখন বাদশাহ ইদরিসকে উৎখাত করলেন, বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খুশি হলো। তেলসমৃদ্ধ দেশের নেতৃত্বে নতুন চালক, নতুন একজোড়া হাত। আমরা এই দেশের সম্পদের কিছু অংশ ভোগ করতে চাই। তাই আমরা ভেবেছি গাদ্দাফিই হতে পারে আমাদের লোক। আমেরিকানরা এমনকি তাকে এক পাল্টা-অভ্যুত্থান সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়। আমরাও পরে তার ভিন্নমতালম্বীদের নির্যাতনের জন্য বন্দী করতে তাকে সহায়তা করি। এরপর হুট করে গাদ্দাফি উপনিবেশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদীতে পরিণত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। এক পর্যায়ে সে আইআরএ’র সঙ্গে জড়িত হলো। পশ্চিম বার্লিনের একটি নাইটক্লাবে বোমা হামলায় তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেল। আর তাতেই সে হঠাৎ করে সন্ত্রাসী হয়ে গেল! এরপর যখন ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু হলো, দখল হলো ইরাক, তখন পরম পূজনীয় ব্লেয়ার পারলে গাদ্দাফিকে চুমু খান, এই অবস্থা! গাদ্দাফি তখন আবার মহান রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হলো। ২০১১ সালের বিপ্লবের আগে আগে, গাদ্দাফি ফের সন্ত্রাসী হয়ে যান। এবার তাকে বোমা মেরে উৎখাত করে ন্যাটো। তাকে হত্যা করে তার নিজের লোকেরা।
ইরাকের প্রসঙ্গ যেহেতু উঠলো, সেহেতু বলতে হয়, সাদ্দামেরও একই পরিণতি হয়েছিল। প্রথমে আমরা তাকে পছন্দ করেছিলাম। আমেরিকানরা তাকে তার কম্যুনিস্ট প্রতিপক্ষদের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিল। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সেও ছিল মস্তক বিদীর্ণকারী। কিন্তু যতদিন সাদ্দাম পশ্চিমা পছন্দসই রাষ্ট্র দখল করেছিল, ততদিন সে ছিল মহান রাষ্ট্রনায়ক। এ কারণেই ১৯৮০ সালে আমরা তার ইরান দখল অভিযানে সহায়তা দিয়েছিলাম। কিন্তু ১৯৯০ সালে যখন সাদ্দাম ভুল রাষ্ট্র অর্থাৎ কুয়েত দখলে নেন, তখন আমরা তাকে কুখ্যাত সন্ত্রাসী আখ্যা দিলাম। গাদ্দাফির মতো সাদ্দামকেও হত্যা করে তার নিজ দেশের মানুষ, যদিও আমেরিকানদের ঠিক করে দেওয়া আদালতই তাকে ফাঁসি দেওয়ার রায় দেয়।
ইয়াসির আরাফাতের কথা আমরা এখন অত মনেও করি না। তাকেও একসময় ভাবা হতো বৈরুতের ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসী। আইজাক রবিন ও বিল ক্লিনটনের সঙ্গে করমর্দন করার আগে আরাফাত ছিলেন বিশ্ব সন্ত্রাসের কেন্দ্রবিন্দু। করমর্দন করার পর তিনি হয়ে যান মহান রাষ্ট্রনেতা। কিন্তু আরাফাত যখন অসলো চুক্তি থেকে দূরে গিয়ে পশ্চিম তীরে ইসরাইলি একাধিপত্য মানতে অস্বীকার করলেন, তখন তিনি ফের হয়ে যান কুখ্যাত সন্ত্রাসী। রামাল্লায় তাকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখা হতো। বোমা হামলাও হয়েছে সেখানে। জীবনের শেষ মুহূর্তে তাকে বিমানে করে প্যারিসের এক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানেই তিনি মারা যান। ইসরাইলিরা তাকে ‘আমাদের বিন লাদেন’ হিসেবে আখ্যা দিত। আরাফাতের উত্তরসূরি মাহমুদ আব্বাসকেও এই উপাধি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু মাহমুদ আব্বাসের অত সৌভাগ্য ছিল না। তিনি ভয়াবহ সন্ত্রাসী বা মহান রাষ্ট্রনায়ক কোনটাই নন। তিনি ছিলেন আরও খারাপ কিছু। একজন ব্যর্থ নেতা।
নাসের উৎখাত করেছিলেন দুর্নীতিগ্রস্ত বাদশাহ ফারুককে। সুয়েজ খাল জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তিনি পশ্চিমের চোখে হয়ে যান সন্ত্রাসী। তৎকালীন বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি এডেন তাকে ‘নীল নদের মুসোলিনি’ আখ্যা দিয়েছিলেন। মনে করে দেখুন, সাদ্দামকেও ‘টাইগ্রিস নদের হিটলার’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল ১৯৯০ সালে। প্যারিসে নির্বাসিত থাকাকালে খোমেনিও ছিলেন সম্ভাব্য রাষ্ট্রনায়ক। কিন্তু যখন তিনি শাহকে হটিয়ে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেন ইরানে, তিনি হয়ে গেলেন সুপার টেরোরিস্ট-ইন-চীফ। ফরাসি বামপন্থীরা ভেবেছিল হাফেজ আল আসাদ হয়তো হবে মহান রাষ্ট্রনায়ক। কিন্তু তার ছেলে বাশার আল আসাদ, যিনি হৃষ্টপুষ্ট হন ফ্রান্সে, তিনি যখন তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে গেলেন, তখন তিনি তো ‘সুপার টেরোরিস্ট’ হলেনই, নিজের পিতাকেও ‘সন্ত্রাসী’ বানিয়ে ছাড়লেন। ওমানে ও কাতারের বাদশাহর বিরুদ্ধে তাদের ছেলেরা যখন অভ্যুত্থান করলো তখন আনুগত্য পরিবর্তনে একটুও সময় নেয়নি বৃটেন।
এ কারণে আদেল আল জুবেইরের উচিৎ হবে মোহাম্মদ বিন সালমানকে ‘মেমেন্টো হোমো’ শব্দদ্বয় মনে করিয়ে দেওয়া। মেমেন্টো হোমো - এই কথা গ্ল্যাডিয়েটরদের মনে করিয়ে দেওয়া হতো। এর মানে হলো তিনিই ‘একমাত্র মানুষ’। নিজে বৈ কেউ গ্ল্যাডিয়েটরদের সঙ্গে নেই। ইয়েমেন যুদ্ধ যদি আরও রক্তাক্ত হয়ে উঠে, সৌদি সামরিক বাহিনীর যদি যুদ্ধ থেকে মোহমুক্তি ঘটে, তাহলে কী হতে পারে? ক্রাউন প্রিন্সের ভিশন ২০৩০ যদি স্রেফ সাউথ সি বাবলের সৌদি সংস্করণ বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে কী ঘটবে? কী ঘটবে, যদি অপমানিত বিলিয়নিয়াররা, যাদেরকে ক্রাউন প্রিন্স রিয়াদের রিটয হোটেলে বন্দী করেছিলেন, তারা প্রতিশোধ নিতে আসে? কী হবে যদি ভবিষ্যৎ বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী আল ইয়ামামাহ অস্ত্র চুক্তি নিয়ে স্পেশাল ব্রাঞ্চের তদন্ত পুনরায় শুরু করেন? আর কী হবে, যদি কেউ আমেরিকার সমরাস্ত্র কীভাবে ২০১৪ সালের পর আইসিসের হাতে পৌঁছেছিল সেই পথ আবিষ্কার করে ফেলে? কিংবা যদি ইরানের সঙ্গে সত্যি সত্যি যুদ্ধ শুরু হয়?
সত্য হলো, আপনি কিছুতেই বলতে পারবেন না যে, কে আপনার বন্ধু। এই বৃটিশরাই কী সৌদি রাজবংশকে আরব সাম্রাজ্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিলিস্তিন, টান্স-জর্দান ও ইরাক তাদের দখলে রেখে দেয়নি? এই বৃটিশরাই কি বেলফোর ঘোষণাপত্র প্রকাশ করার পর ইহুদীদের ও আরবদের সঙ্গে প্রতারণা করার চেষ্টা করেনি? ইহুদীদেরকে বৃটিশরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তাদেরকে একটি দেশ পাইয়ে দেওয়ার। আর আরবদের ভূখ- রক্ষার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল বৃটিশরা।
এই বৃটিশরাই কি রোমানিয়ার একনায়ক চচেসকুকে সম্মানসূচক নাইটহুড দিয়ে আবার তার উৎখাতের পর তা প্রত্যাহার করেনি? আমরা মুগাবেকেও একই সম্মাননা দিয়েছিলাম, পরে আবার ফেরত নিয়েছিলাম। আমরা মুসোলিনিকেও সম্মাননা দিয়েছিলাম! হ্যাঁ, আমরা ১৯৪০ সালে তা ফেরত নিই।
তাই, ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ, সতর্ক হোন। বিশ্বাসঘাতক বৃটিশদের বিশ্বাস করবেন না। দেশে থাকুন, আর বিদেশে। অস্ত্র কিনেছেন, সেজন্য ধন্যবাদ। ধন্যবাদ আপনাকে ওয়াহাবি বিশ্বাসে ব্রেইনওয়াশড হওয়া ছেলেপেলেগুলোর পদচিহ্ন অনুসরণের কাজে আমাদেরকে গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহায়তার জন্য। কিন্তু যা-ই করুন না কেন, আমাদের সম্মানসূচক নাইটহুড নিয়ে উচ্ছ্বসিত হবেন না।
(রবার্ট ফিস্ক বৃটিশ পত্রিকা দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি। ইন্ডিপেনডেন্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তার এই কলাম অনুবাদ করেছেন মাহমুদ ফেরদৌস।)
No comments