‘তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে’ by ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
কবি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় সহে/তব ঘৃণা যেন
তারে তৃণসম দহে।’ এখন অন্যায়ের কাল। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে সমাজের সব
জায়গা থেকে ন্যায় উধাও হয়ে গেছে। লুটেরা, অন্যায়কারী, জবরদস্তিকারী কেবলই
শাসককুলের প্রশ্রয় পাচ্ছে। ফলে সমাজে অন্যায় বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। আর
অন্যায়কারীর উল্লাসে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। তেমনি
ঘটনা ঘটেছে গত ৭ মার্চ রাজধানীজুড়ে। সে দিন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে
আওয়ামী লীগ এক জনসভা আহ্বান করে। সে জনসভার জনস্রোতে এসেছিল আওয়ামী লীগের
উচ্ছৃঙ্খল এক শ্রেণীর কর্মী, তারা নারীদের বিভিন্ন স্থানে যৌন হয়রানি
করেছে। তাদের একাধিক শিকার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সে কথা জানিয়ে দিয়েছে।
তাদের একজন তার ফেসবুকে বলেছে, ‘আল্লাহ কেন মেয়েদের মাত্র দুটো হাত দিলো!
দুটো হাত দিয়ে এতগুলো হাত থেকে বুক পেট বাঁচাব, নাকি কোমর পেট বাঁচাব, ওড়না
ধরে রাখব নাকি তাদের হাতগুলো সরাব।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কলেজছাত্রী
বলেছেন, আমার সঙ্গে যা ঘটেছে। সেটা রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে ভেবে নেয়া
দুর্ভাগ্যজনক। আমি তখন লজ্জায় কাঁদছি। তার মধ্যে আমার মনে হচ্ছিল- আমার
দোষটা কী, কেন ওরা আমার সাথে এমনটা করছে। আমি তাদের আটকাতে চেষ্টা করছিলাম।
চিৎকার দিচ্ছিলাম। কিন্তু একজনও আসেনি। আমি দুঃখে কাঁদিনি। ঘেন্নায়
কেঁদেছি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন সালমা (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘গাড়ি
চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে খামারবাড়ির দিকে যাওয়ার সময় সামনে দুই তিনটা
ট্রাকভর্তি ছেলে স্লোগান দিতে দিতে যাচ্ছিল। রাস্তা ফাঁকা কিন্তু তাদের
ট্রাক চলছিল ধীরগতিতে এবং আমার গাড়িকে কোনোভাবেই সাইড দিচ্ছে না। এক-দু’বার
আমার গাড়ি তাদের পাশ কাটিয়ে যেতে চেষ্টা করতেই গাড়ির দিকে বোতল ছুড়ে মারতে
থাকে তারা। আমার চালক জানালার কাচ নামানোর সাথে সাথে অশ্রাব্য গালি। তাদের
বক্তব্য, আমার গাড়ি তাদের পেছন পেছন যেতে হবে।’ আরেকজন তার স্ট্যাটাসে
বলেছেন, ‘হল থেকে বের হয়ে কোনো রিকশা পাইনি। কেউ শাহবাগ যাবে না। হেঁটে
শহীদ মিনার পর্যন্ত আসতে হয়েছে। আর রাস্তাজুড়ে ৭ মার্চ পালন করা দেশভক্ত
সোনার ছেলেরা একা মেয়ে পেয়ে ইচ্ছেমতো টিজ করেছে। নোংরা কথা থেকে শুরু করে
যেমন পারছে টিজ করেছে। বহু হয়রানির পর শহীদ মিনার থেকে রিকশা নিয়ে শাহবাগ
যাচ্ছি। এতেও রক্ষা নেই। চারুকলার সামনে একদল ছেলে পানির বোতল থেকে
ইচ্ছেমতো পানি ছিটাচ্ছে গায়ে। যখন রাগান্বিত হচ্ছিলাম তখন তো একজন রিকশার
পেছন থেকে চুল টেনে দৌড় দিয়েছে। সিরিয়াসলি। রিকশা থেকে নামতে চাচ্ছিলাম।
জুতাবো ওইটাকে তাই। পাশের রিকশার ভদ্রলোক খুব ভদ্রভাবে না করল। তাই রিকশা
থেকে নামিনি। গৌরবময় ৭ মার্চ। সোনার ছেলেরা এত ভালোভাবে পালন করেছে যে,
নিজের ক্যাম্পাসে হ্যারাস হতে হয়।’ অর্থাৎ নারীরা কোথায়ও নিরাপদ নয়। বরং
সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, ৯৪ শতাংশ নারী গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার
হন। সে হয়রানি করেন বাসের কন্ডাক্টর থেকে শুরু করে যাত্রীরা পর্যন্ত। ওই
জরিপে উল্লেখ করা হয়, যৌন হয়রানিকারীদের ৬০ শতাংশেরও বেশি পুরুষ মাঝবয়সী।
তাহলে নারীরা পথ চলবে কিভাবে। যে শিক্ষার্থী প্রথম পোস্টটা দিয়েছিলেন, তিনি
পরে আরেকটি পোস্ট দিয়ে বলেছেন, তিনি সুস্থ আছেন এবং কোনো রাজনৈতিক
উদ্দেশ্যে পোস্টটি দেননি। তা ছাড়া একে কেউ কেউ রাজনৈতিক উসকানিভাবে শেয়ার
করেছে। জড়ানো হয়েছিল তার কলেজকেও। ওই শিক্ষার্থী বলেছেন, এ ব্যাপারে তার
কলেজের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। আরেকজন লিখেছেন, ‘আজ যে আমি স্বাভাবিকভাবে
বাসায় ফিরতে পারব জানতাম না। সায়েন্স ল্যাব থেকে কাকরাইলের জার্নি আমার
জন্য কম কষ্টের ছিল না, তা-ও পুরো পথ হেঁটে এসেছি। তবে কিছু কিছু হায়েনার
চোখের ভাষা দেখে কেঁদে দেবো ভাবছিলাম (কারণটা বুঝে নেবেন।)। তবে একদম যে
বেঁচে গেছি তা কিন্তু না। কেউ বোতলের জল পান করার চেয়ে আমার গায়ে ফেলা
দেয়াটা বেশি উপযোগী ভাবছেন। বুঝতেছিলাম না যে, পানি ঢেলে দেয়ার জন্য আপসেট
হবো কি না। খালি পানি তো ঢালছে। এটা ভেবে খুশি হবো। কী ভেবে সান্ত্বনা দেবো
নিজেকে। জানি না, এটা কেমন ৭ মার্চ। একাত্তরের ৭ মার্চেও কি এমন হতো,
জানার খুবই ইচ্ছা। প্রতিদিন একটা না একটা ঘটনার সম্মুখীন হওয়া আমার জন্য,
ইনফ্যাক্ট সব মেয়ের জন্য, অভ্যাসের বিষয়। ইনফ্যাক্ট যে দিন কিছু ঘটে না, সে
দিন নিজেকে অনেক বেশি ভাগ্যবতী মনে হয়। যা হোক, অনেকে আমাকে রাস্তার হাল
জানিয়ে ইনফো দিয়ে সাহায্য করেছে। এ জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। কারণ আপনাদের
তথ্যের জন্য অন্তত কিছুটা রাস্তা সেইফলি বেছে নিতে পারছিলাম।’ এখন ধর্মের
ঢাক দ্রুতই বেজে যায়। সময় বদলেছে। প্রযুক্তির অনেক উন্নতি হয়েছে,
প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। ফলে খুব দ্রুত এসব তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। সে দিনের
ঘটনা দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং ভাইরাল হয়ে যায়। তথ্যপ্রযুক্তির এই
যুগে কোনো সত্যকেই চেপে রাখা যায় না। সত্য প্রকাশ হয়েই পড়ে। ওই যে একজন
লিখেছেন, যে দিন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়, সে দিন তিনি নিজেকে
ভাগ্যবতী মনে করেন। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে। স্কুল-কলেজ, রাস্তাঘাট ও
বাড়িঘরেও নারীরা এখন আর নিরাপদ নেই। কেউ বলাৎকারের শিকার হচ্ছে। কেউ কাউকে
জোর করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তাতেও সম্মত না হলে- তার শরীরে ছুরি বসিয়ে
দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের যথেচ্ছ হত্যা পর্যন্ত করছে। মাঝবয়সী নারী থেকে
শিশুরা পর্যন্ত কেউই সমাজের এই দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে নিস্তার পাচ্ছে
না। বিচারের ঘটনা যে ঘটে না, এমন বলব না। তবে ঘটনার তুলনায় তার সংখ্যা অতি
নগণ্য। বহু ক্ষেত্রে তা হারিয়ে যায়। মেয়েপক্ষ যদি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়,
তাহলে তাদের পক্ষে বেশি দিন আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। একসময়
তারা রণে ভঙ্গ দেয়। কোনো এক ফাঁকে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছাড়া পেয়ে যায়। এ রকম
বহু আসামি ছাড়া পেয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় করা মামলা প্রত্যাহারের কারণে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কোনোরূপ বাছবিচার না করে এ রকম সাত হাজার মামলা
প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। তার মধ্যে খুন, ধর্ষণের মামলাও ছিল বহু। এরপর
যথেচ্ছভাবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমাও ব্যবহার করা হয়েছে নারী নির্যাতনের এই
আসামিদের জন্য। কিন্তু আমরা আশ্চর্য হলাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক
ওবায়দুল কাদেরের কথায়। গত ৮ মার্চ ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সমাবেশস্থলের
বাইরে নারী লাঞ্ছিত হওয়ার কোনো ঘটনা ঘটলে সেটা আমাদের দলের বিষয় নয়। তবে এ
ব্যাপারে সরকারের দায় আছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাস
করে। ফলে এই দলের নেতাকর্মীরা নারী লাঞ্ছনার ঘটনার সাথে জড়িত থাকতে পারে
না। তবে যারাই এর সাথে জড়িত থাকুক, খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি
নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টরা কাজ করবে। ওবায়দুল কাদেরের ভাষা প্রণিধানযোগ্য।
তা হলো সমাবেশস্থলের বাইরে কোনো নারী যৌন হয়রানির শিকার হলে তার দায়িত্ব দল
নেবে না। আর তার দলের নেতাকর্মীরা নারী লাঞ্ছনার ঘটনার সাথে জড়িত থাকতে
পারে না। সমাবেশস্থলের বাইরে সমাবেশের দিকে আসা উচ্ছৃঙ্খল কর্মীদের দিয়ে
কোনো নারী লাঞ্ছিত হলে তার দায় কেন আওয়ামী লীগ নেবে না? আবার তিনি যেন এই
বলে ওই নেতাকর্মীদের দায়মুক্তি দিয়ে বসলেন যে, তার দলের নেতাকর্মীরা নারী
লাঞ্ছনার ঘটনার সাথে জড়িত থাকতে পারে না। অর্থাৎ আগে থেকেই তিনি নারী
নির্যাতনের পক্ষ অবলম্বন করে বসলেন। ওই উচ্ছৃঙ্খল কর্মীরা এখন দ্বিগুণ
উৎসাহে নারী লাঞ্ছনায় লেগে যেতে পারে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান
খান কামাল অতটা নিচে নামেননি। তিনি বলেছেন, শ্লীলতাহানির ভিডিও ফুটেজ পাওয়া
গেছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এটুকু আশার কথা। আমরা দেখতে
চাই যে, জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা
হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ কোনো ফেরেশতাদের দল নয়, তার প্রমাণ মিলেছে
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফারহানা মিলির ফেসবুক
স্ট্যাটাসে। তাতে তিনি বলেছেন, ‘রাজনীতি বুঝুক না বুঝুক সেক্সনীতি বুঝলে
বাপের বয়সী জেলা সাধারণ সম্পাদকের কোলে বসে ফুর্তি করাটাই রাজনীতিতে পদবি
পাওয়াতে কাজ দেবে। শিক্ষিত না হলে দোষ নেই। একাধিক নেতা ও ব্যবসায়ীদের
শারীরিক সুখ দিতে পারলেই পদবি পাওয়া যাবে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে দু-চারটা ভালো কথা
বলতে না পারলেও হোটেলে গিয়ে শিশুদের ভঙ্গিমায় প্রেমালাপ পারলেই রাজনীতি
হবে। স্বামীর রোজগারে ঠিকমতো বাসা ভাড়া আসে না, কিন্তু জীবনযাপনের স্টাইল
লাখ টাকার বাজেট করতে পারাটাই রাজনৈতিক সার্থকতা তাদের জন্য। বেসামাল শরীরে
অশালীন পোশাকে রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে সেসব নোংরা ছবি তুলে ফেসবুকে না নিয়ে
এলে তাদের ফেসবুক অচল হয়ে পড়ে। তাদের আপত্তিকর পোশাকে না দেখলে হয়তো
স্থানীয় বড় পদের বাপদের পেটের ভাত হজম হয় না। শারীরিক বেসামাল গড়ন ও দেহের
গড়ন যেন দেহ ব্যবসার বিশেষ পণ্য বস্তু। নিজের সন্তানকে কাজের লোকদের কাছে
রেখে রাজনীতির নামে সারা দিন বেশ্যাবৃত্তি করাটাই তাদের কাজ। পরিবারে নেই
কোনো জবাবদিহি। তাই যাচ্ছে-তাই করা যায়... স্থানীয় এমপি ও রাজনৈতিক বড় পদের
মালিকদের সাথে তাদের গোলাপঝরা সখ্য। আফটার অল তাদের ইয়াবা আর মাদক ব্যবসা
এবং রাজনৈতিক পদ বেচে দেহ ব্যবসায় সফল করতে ও সচল রাখতে এসব পদবি আর বয়সে
আব্বরাই তো এক মাত্র সহায়ক।’ এ ধরনের একটা স্ট্যাটাসের পরিণতি কী হতে পারে
ফারহানা মিলি তা জানতেন। কিন্তু সম্ভবত আত্মগ্লানির কারণে তিনি ঝুঁকি নিয়েই
এই কাজ করেছেন। তাকে পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তবে তিনি বলেছেন, তিনি
নিজেই পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। ফারহানা মিলি এ কথা বলেছেন, তার জেলার
আওয়ামী লীগকে নিয়ে। সর্বত্র কিন্তু একই চিত্র নয়। আওয়ামী লীগে ভালো মানুষ
একেবারে নেই এমন কথা আমরা বলি না। কিন্তু ফারহানা মিলি এর একটা নোংরা দিক
উন্মোচন করে দিয়েছেন। মিলি যেহেতু ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে এ কথা বলেছেন,
ফলে এটা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। তার কথা যদি সত্য হয়ে থাকে তবে কাজটি
ঘৃণ্য। আমরা আগের মতোই বলি ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/তব ঘৃণা যেন
তারে তৃণসম দহে।’
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com
No comments