আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ: তদন্তে সাড়া মিলছে না by মহিউদ্দিন অদুল
আইনশৃঙ্খলা
বাহিনীর বিরুদ্ধে আমলে নেয়া অভিযোগ তদন্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ
সদর দপ্তরের সাড়া পাচ্ছে না জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। গত পাঁচ বছরে পুলিশ,
র্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে
মানবাধিকার লঙ্ঘনের ১২৮টি অভিযোগ গ্রহণ করেছে কমিশন। নিয়ম অনুযায়ী এসব
অভিযোগের তদন্ত করার কথা সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের। এ জন্য
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দপ্তর ও সংশ্লিষ্ট বিভাগে অভিযোগ তদন্ত
করে প্রতিবেদন চায় মানবাধিকার কমিশন। তবে তদন্তের বিষয়ে আশানুরূপ সাড়া
পাচ্ছে না কমিশন। কমিশনের চিঠির প্রেক্ষিতে যে কয়টি ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন
দেয়া হয়েছে তা পুরো বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে মনে করছে কমিশন।
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিষয়টি প্রেসিডেন্টকেও অবহিত করেছে কমিশন।
২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে চাঞ্চল্যকর ও ব্যাপক আলোচিত ঘটনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (জামাকন) সুয়োমটোভাবে ও ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবার কর্তৃক অভিযোগগুলো গ্রহণের পর আইন অনুযায়ী তদন্তের জন্য পাঠায়। বেশিরভাগ অভিযোগেরই তদন্তের বিষয়ে কোনো তথ্য পায়নি কমিশন। যে কয়টি ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট এসেছে তাও সন্তোষজনক নয় বলে কমিশন মনে করে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক মানবজমিনকে বলেন, ‘পুলিশ, র্যাব ও প্রশাসনের সদস্যদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পেলে আইন অনুযায়ী আমরা সরাসরি তদন্ত করতে পারি না। তাই সংশ্লিষ্ট অভিযোগগুলো গ্রহণের পর তদন্তের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখছি। চাঞ্চল্যকর অনেক ঘটনার তদন্তই আটকে আছে কয়েক বছর ধরে। তা তদন্তের জন্য সব সময় বলে আসছি। কিছু কিছু প্রতিবেদন পাওয়া গেলেও বেশিরভাগ তদন্তেই ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায় না বলে প্রতিবেদন দেয়া হচ্ছে। এতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা সন্তুষ্ট হতে পারি না। এই বিষয়টি মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে জানানো হয়েছে। আমরা আশা করবো সত্যিকারের গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত প্রতিবেদন যাতে পাওয়া যায়। তাতে অন্তত মানবাধিকার রক্ষা পাবে।’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সূত্র জানায়, দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় রাষ্ট্রীয় মানবাধিকার সংস্থাটি অভিযোগ গ্রহণ, পর্যবেক্ষণ ও তদন্ত করে থাকে। কিন্তু পুলিশ, র্যাব ও প্রশাসনের সদস্যদের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে একইভাবে অভিযোগ গ্রহণ করে। তবে এসব ঘটনা সরাসরি কমিশনের তদন্তের এখতিয়ারভুক্ত নয়। তা তদন্তের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠাতে হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পুলিশ সদর দপ্তর তা তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়। দেশে গত কয়েক বছর ধরে পুলিশ, র্যাব ও প্রশাসনের সদস্যদের দ্বারা খুন, গুম, নির্যাতনসহ বিভিন্নভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু অভিযোগ এই সংস্থাটি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে অধিকাংশই ন্যায় বিচার না পেয়ে ভিকটিম ও তাদের পরিবার কমিশনে অভিযোগ দাখিল করেছে। আর কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনায় কমিশন সুয়োমটোভাবে অভিযোগ গ্রহণ করেছে। নিয়ম অনুযায়ী যথারীতি তা তদন্তের জন্য পাঠানো হয়ে আসছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তদন্তভার যাচ্ছে স্বয়ং যে সংস্থার সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ সেই পুলিশ বা র্যাবে। গত ৫ বছরে পুলিশ ও র্যাব সদস্য এবং কারারক্ষীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কয়েকশ’ অভিযোগ তদন্তের জন্য কমিশন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তার একটা বড় অংশের তদন্ত হলেও প্রতিবেদনে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়। তবে এর একটা বড় অংশের তদন্তও এখন পর্যন্ত হয়নি। ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত গত ৫ বছরে কমিশনের এমন ১২৮টি অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন আজও পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে ২০১২ সালের ৪টি, ২০১৩ সালের ১০, ২০১৪ সালের ৪৫, ২০১৫ সালের ৫৭ এবং ২০১৬ সালের ১২টি অভিযোগ রয়েছে।
রাষ্ট্রীয় এই মানবাধিকার কমিশন সূত্রে জানা যায়, তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষমাণ ২০১২ সালের ৪ অভিযোগের মধ্যে রয়েছে গাজীপুরের কালিগঞ্জ উপজেলার বালু ব্যবসায়ী মামুনকে গ্রেপ্তারের পর খুনিদের হাতে তুলে দেয়ার (সুয়োমটো ২৬৪/১২) অভিযোগ এবং জেলহাজতে প্রেরণের পর এক আসামির মৃত্যুর অভিযোগ। ২০১৩ সালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ১০ অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন গত ৪ বছরেও পায়নি জামাকন। এর মধ্যে রয়েছে থানায় পুলিশি নির্যাতনে এক আসামির মৃত্যুর সুয়োমটো (৬/১৩) অভিযোগ। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় পিন্টুর গ্যারেজ থেকে মো. ফখরুল ইসলাম র্যাব কর্তৃক গ্রেপ্তার ও গুম (অভিযোগ-১৫৩/১৩) এবং অপর ঘটনায় র্যাব কর্তৃক হত্যা (২১২/১৩)। একই বছর পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপর অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে, গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থেকে রাজা ও রণি নাম দু’জনকে ধরে নেয়ার পর থেকে নিখোঁজ (২৩২/১৩), কুষ্টিয়া ডিবি ও খোকশা থানা পুলিশ কর্তৃক ফজলু খাঁ ওরফে ফাইজাকে আটক ও নির্যাতনের পর ক্রসফায়ার (অভিযোগ নং ৩৭২/১৩), রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি সদর দপ্তরে বিচারবহির্ভূত হত্যা (৪২০/১৩), পুলিশের অমানবিক শারীরিক নির্যাতন (২৪৫/১৩) ও পুলিশের সহায়তায় ব্যবসার অর্থ লুট (৪০৪/১৩)।
পরের বছর ২০১৪ সালের আটকে থাকা ৪৫ অভিযোগের মধ্যে ৭টিই কমিশন গৃহীত সুয়োমটো অভিযোগ। এ অভিযোগগুলো হলো- পল্লবী থানার এসআই কর্তৃক বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে তুলে নিয়ে যুবককে নির্যাতনের পর হত্যা (সুয়োমটো অভিযোগ নং ২/১৪), এক হাজার টাকার জন্য আশুলিয়া থানা কর্তৃক রিপন শিকদারকে হত্যা (৯/১৪), যশোরে চাঁদার টাকা না পেয়ে সালমান শিকদার ওরফে বিকি নামে এক ব্যবসায়ীর পায়ে গুলি করা (১৩/১৪), জিসান নামে এক ব্যক্তিকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তারের পর ব্যাপক নির্যাতন (১৬/১৪), সাভারে ওসির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীর হাত ভেঙে দেয়ার অভিযোগ (১৭/১৪), গাজীপুরের কাউলিয়ায় স্কুল শিক্ষক আবুল কাশেমের পুত্র খাইরুল ইসলামকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে বাড়ি থেকে ধরে নেয়ার ৪৫ দিন পর জঙ্গি হিসেবে গ্রেপ্তার (১৯/১৪), এসআই আনোয়ার কর্তৃক শাহ আলমকে মিথ্যা সন্ত্রাসী বানানো ও পায়ে গুলি করা (২২/১৪)। ওই বছরের তদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় থাকা বাকি ৩৮ অভিযোগ ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের করা। এগুলো মধ্যে রয়েছে- যাত্রাবাড়ীতে ক্রয়ফায়ার (৩৫/১৪), গুম (৯৫/১৪), ঘুষ দাবির ঘটনাকে কেন্দ্র করে র্যাব-পুলিশ কর্তৃক শাওনকে গুম (১৫৬/১৪), র্যাব কর্তৃক আটক ও নিখোঁজ (১৩৩/১৪) এবং গ্রেপ্তারের পর অস্বীকার (১৬১/১৪), খিলক্ষেতে থানা হেফাজতে হৃদয় ইসলাম মমিনের মৃত্যু (১৮৬/১৪) ইত্যাদি অভিযোগ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তদন্ত আটকে থাকা মানবাধিকার কমিশনের ২০১৫ সালের ৫৭টি অভিযোগের মধ্যে ৯টিই জামাকন স্বপ্রণোদিত হয়ে গ্রহণ করেছে। এগুলো হলো- পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে ৯ অরাজনৈতিক ব্যক্তিসহ ১৫ জন গুলিবিদ্ধ হওয়া (সুয়োমটো ১/১৫), ফরিদপুরের ভাঙ্গায় হ্যান্ডকাফের চেন পেঁচিয়ে পুলিশ কর্তৃক আসাদুলকে হত্যা (৩/১৫), বিনা দোষে এক ব্যক্তির ২২ দিন কারাভোগ (১০/১৫), পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে এক ব্যক্তির নিহত হওয়া (১১/১৫), গাজীপুরে র্যাবের বন্দুকযুদ্ধে মো. মামুন আহমেদ নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু (১২/১৫), নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের চরকাকড়ায় ছামছুদ্দিন মিলনকে ডাকাত সাজিয়ে পুলিশের সামনে হত্যা ও টাকার বিনিময়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদায় (১৫/১৫), সুন্দরবনে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৬ জন নিহত (১৭/১৫) অন্যতম। এছাড়া ওই বছরের বাকি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো খুন, গুম, অপহরণ, নির্যাতন, অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করা, আটকে রেখে নির্যাতন করে চাঁদা আদায়, আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও হত্যা মামলা না নেয়া, হয়রানি। যার অধিকাংশই পুলিশ ও র্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে।
একই সঙ্গে ২০১৬ সালে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের আরো ১২টি ঘটনার তদন্ত চেয়ে প্রতিবেদনের অপেক্ষায় রয়েছে জামাকন। এর মধ্যে কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগটি মানবাধিকার কমিশন স্বপ্রণোদিত হয়ে সুটোমটো অভিযোগ হিসেবে গ্রহণ করে (অভিযোগ নং ৩/১৬)। কিন্তু তাসহ ১২ অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন এখনো পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয়, গত বছর ২০১৭ সালের বেশ কিছু অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদনও এখনো পায়নি মানবাধিকার কমিশন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা ফারহানা সাঈদ বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তদন্তের জন্য পাঠানো অভিযোগগুলোর প্রতিবেদন বারবার চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া মাঝে মাঝে কিছু তদন্ত প্রতিবেদন এলেও সেগুলোর অধিকাংশ চাঞ্চল্যকর হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবেদনে ঘটনার সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে না বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস) সহেলী ফেরদৌস এ বিষয়ে মানবজমিনকে বলেন, অনেক ক্ষেত্রে ঘটনা সত্য হলেও সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় না। এজন্য সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে হয়। খুনের মামলায়ও এমনটা ঘটে থাকে। প্রথম দিকে ভিকটিম বা পরিবার আগ্রহী থাকলেও পরে সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করতে আগ্রহী হয় না। ডিআইজি মিজান ও মিরপুরের এসআই জাহিদের ঘটনা তো তদন্ত হচ্ছে। মানবাধিকার কমিশনের বাকি অভিযোগগুলো পর্যায়ক্রমে তদন্ত হবে।
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিষয়টি প্রেসিডেন্টকেও অবহিত করেছে কমিশন।
২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে চাঞ্চল্যকর ও ব্যাপক আলোচিত ঘটনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (জামাকন) সুয়োমটোভাবে ও ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবার কর্তৃক অভিযোগগুলো গ্রহণের পর আইন অনুযায়ী তদন্তের জন্য পাঠায়। বেশিরভাগ অভিযোগেরই তদন্তের বিষয়ে কোনো তথ্য পায়নি কমিশন। যে কয়টি ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট এসেছে তাও সন্তোষজনক নয় বলে কমিশন মনে করে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক মানবজমিনকে বলেন, ‘পুলিশ, র্যাব ও প্রশাসনের সদস্যদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পেলে আইন অনুযায়ী আমরা সরাসরি তদন্ত করতে পারি না। তাই সংশ্লিষ্ট অভিযোগগুলো গ্রহণের পর তদন্তের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখছি। চাঞ্চল্যকর অনেক ঘটনার তদন্তই আটকে আছে কয়েক বছর ধরে। তা তদন্তের জন্য সব সময় বলে আসছি। কিছু কিছু প্রতিবেদন পাওয়া গেলেও বেশিরভাগ তদন্তেই ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায় না বলে প্রতিবেদন দেয়া হচ্ছে। এতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা সন্তুষ্ট হতে পারি না। এই বিষয়টি মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে জানানো হয়েছে। আমরা আশা করবো সত্যিকারের গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত প্রতিবেদন যাতে পাওয়া যায়। তাতে অন্তত মানবাধিকার রক্ষা পাবে।’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সূত্র জানায়, দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় রাষ্ট্রীয় মানবাধিকার সংস্থাটি অভিযোগ গ্রহণ, পর্যবেক্ষণ ও তদন্ত করে থাকে। কিন্তু পুলিশ, র্যাব ও প্রশাসনের সদস্যদের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে একইভাবে অভিযোগ গ্রহণ করে। তবে এসব ঘটনা সরাসরি কমিশনের তদন্তের এখতিয়ারভুক্ত নয়। তা তদন্তের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠাতে হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পুলিশ সদর দপ্তর তা তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়। দেশে গত কয়েক বছর ধরে পুলিশ, র্যাব ও প্রশাসনের সদস্যদের দ্বারা খুন, গুম, নির্যাতনসহ বিভিন্নভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু অভিযোগ এই সংস্থাটি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে অধিকাংশই ন্যায় বিচার না পেয়ে ভিকটিম ও তাদের পরিবার কমিশনে অভিযোগ দাখিল করেছে। আর কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনায় কমিশন সুয়োমটোভাবে অভিযোগ গ্রহণ করেছে। নিয়ম অনুযায়ী যথারীতি তা তদন্তের জন্য পাঠানো হয়ে আসছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তদন্তভার যাচ্ছে স্বয়ং যে সংস্থার সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ সেই পুলিশ বা র্যাবে। গত ৫ বছরে পুলিশ ও র্যাব সদস্য এবং কারারক্ষীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কয়েকশ’ অভিযোগ তদন্তের জন্য কমিশন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তার একটা বড় অংশের তদন্ত হলেও প্রতিবেদনে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়। তবে এর একটা বড় অংশের তদন্তও এখন পর্যন্ত হয়নি। ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত গত ৫ বছরে কমিশনের এমন ১২৮টি অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন আজও পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে ২০১২ সালের ৪টি, ২০১৩ সালের ১০, ২০১৪ সালের ৪৫, ২০১৫ সালের ৫৭ এবং ২০১৬ সালের ১২টি অভিযোগ রয়েছে।
রাষ্ট্রীয় এই মানবাধিকার কমিশন সূত্রে জানা যায়, তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষমাণ ২০১২ সালের ৪ অভিযোগের মধ্যে রয়েছে গাজীপুরের কালিগঞ্জ উপজেলার বালু ব্যবসায়ী মামুনকে গ্রেপ্তারের পর খুনিদের হাতে তুলে দেয়ার (সুয়োমটো ২৬৪/১২) অভিযোগ এবং জেলহাজতে প্রেরণের পর এক আসামির মৃত্যুর অভিযোগ। ২০১৩ সালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ১০ অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন গত ৪ বছরেও পায়নি জামাকন। এর মধ্যে রয়েছে থানায় পুলিশি নির্যাতনে এক আসামির মৃত্যুর সুয়োমটো (৬/১৩) অভিযোগ। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় পিন্টুর গ্যারেজ থেকে মো. ফখরুল ইসলাম র্যাব কর্তৃক গ্রেপ্তার ও গুম (অভিযোগ-১৫৩/১৩) এবং অপর ঘটনায় র্যাব কর্তৃক হত্যা (২১২/১৩)। একই বছর পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপর অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে, গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থেকে রাজা ও রণি নাম দু’জনকে ধরে নেয়ার পর থেকে নিখোঁজ (২৩২/১৩), কুষ্টিয়া ডিবি ও খোকশা থানা পুলিশ কর্তৃক ফজলু খাঁ ওরফে ফাইজাকে আটক ও নির্যাতনের পর ক্রসফায়ার (অভিযোগ নং ৩৭২/১৩), রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি সদর দপ্তরে বিচারবহির্ভূত হত্যা (৪২০/১৩), পুলিশের অমানবিক শারীরিক নির্যাতন (২৪৫/১৩) ও পুলিশের সহায়তায় ব্যবসার অর্থ লুট (৪০৪/১৩)।
পরের বছর ২০১৪ সালের আটকে থাকা ৪৫ অভিযোগের মধ্যে ৭টিই কমিশন গৃহীত সুয়োমটো অভিযোগ। এ অভিযোগগুলো হলো- পল্লবী থানার এসআই কর্তৃক বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে তুলে নিয়ে যুবককে নির্যাতনের পর হত্যা (সুয়োমটো অভিযোগ নং ২/১৪), এক হাজার টাকার জন্য আশুলিয়া থানা কর্তৃক রিপন শিকদারকে হত্যা (৯/১৪), যশোরে চাঁদার টাকা না পেয়ে সালমান শিকদার ওরফে বিকি নামে এক ব্যবসায়ীর পায়ে গুলি করা (১৩/১৪), জিসান নামে এক ব্যক্তিকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তারের পর ব্যাপক নির্যাতন (১৬/১৪), সাভারে ওসির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীর হাত ভেঙে দেয়ার অভিযোগ (১৭/১৪), গাজীপুরের কাউলিয়ায় স্কুল শিক্ষক আবুল কাশেমের পুত্র খাইরুল ইসলামকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে বাড়ি থেকে ধরে নেয়ার ৪৫ দিন পর জঙ্গি হিসেবে গ্রেপ্তার (১৯/১৪), এসআই আনোয়ার কর্তৃক শাহ আলমকে মিথ্যা সন্ত্রাসী বানানো ও পায়ে গুলি করা (২২/১৪)। ওই বছরের তদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় থাকা বাকি ৩৮ অভিযোগ ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের করা। এগুলো মধ্যে রয়েছে- যাত্রাবাড়ীতে ক্রয়ফায়ার (৩৫/১৪), গুম (৯৫/১৪), ঘুষ দাবির ঘটনাকে কেন্দ্র করে র্যাব-পুলিশ কর্তৃক শাওনকে গুম (১৫৬/১৪), র্যাব কর্তৃক আটক ও নিখোঁজ (১৩৩/১৪) এবং গ্রেপ্তারের পর অস্বীকার (১৬১/১৪), খিলক্ষেতে থানা হেফাজতে হৃদয় ইসলাম মমিনের মৃত্যু (১৮৬/১৪) ইত্যাদি অভিযোগ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তদন্ত আটকে থাকা মানবাধিকার কমিশনের ২০১৫ সালের ৫৭টি অভিযোগের মধ্যে ৯টিই জামাকন স্বপ্রণোদিত হয়ে গ্রহণ করেছে। এগুলো হলো- পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে ৯ অরাজনৈতিক ব্যক্তিসহ ১৫ জন গুলিবিদ্ধ হওয়া (সুয়োমটো ১/১৫), ফরিদপুরের ভাঙ্গায় হ্যান্ডকাফের চেন পেঁচিয়ে পুলিশ কর্তৃক আসাদুলকে হত্যা (৩/১৫), বিনা দোষে এক ব্যক্তির ২২ দিন কারাভোগ (১০/১৫), পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে এক ব্যক্তির নিহত হওয়া (১১/১৫), গাজীপুরে র্যাবের বন্দুকযুদ্ধে মো. মামুন আহমেদ নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু (১২/১৫), নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের চরকাকড়ায় ছামছুদ্দিন মিলনকে ডাকাত সাজিয়ে পুলিশের সামনে হত্যা ও টাকার বিনিময়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদায় (১৫/১৫), সুন্দরবনে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৬ জন নিহত (১৭/১৫) অন্যতম। এছাড়া ওই বছরের বাকি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো খুন, গুম, অপহরণ, নির্যাতন, অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করা, আটকে রেখে নির্যাতন করে চাঁদা আদায়, আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও হত্যা মামলা না নেয়া, হয়রানি। যার অধিকাংশই পুলিশ ও র্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে।
একই সঙ্গে ২০১৬ সালে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের আরো ১২টি ঘটনার তদন্ত চেয়ে প্রতিবেদনের অপেক্ষায় রয়েছে জামাকন। এর মধ্যে কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগটি মানবাধিকার কমিশন স্বপ্রণোদিত হয়ে সুটোমটো অভিযোগ হিসেবে গ্রহণ করে (অভিযোগ নং ৩/১৬)। কিন্তু তাসহ ১২ অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন এখনো পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয়, গত বছর ২০১৭ সালের বেশ কিছু অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদনও এখনো পায়নি মানবাধিকার কমিশন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা ফারহানা সাঈদ বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তদন্তের জন্য পাঠানো অভিযোগগুলোর প্রতিবেদন বারবার চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া মাঝে মাঝে কিছু তদন্ত প্রতিবেদন এলেও সেগুলোর অধিকাংশ চাঞ্চল্যকর হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবেদনে ঘটনার সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে না বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস) সহেলী ফেরদৌস এ বিষয়ে মানবজমিনকে বলেন, অনেক ক্ষেত্রে ঘটনা সত্য হলেও সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় না। এজন্য সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে হয়। খুনের মামলায়ও এমনটা ঘটে থাকে। প্রথম দিকে ভিকটিম বা পরিবার আগ্রহী থাকলেও পরে সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করতে আগ্রহী হয় না। ডিআইজি মিজান ও মিরপুরের এসআই জাহিদের ঘটনা তো তদন্ত হচ্ছে। মানবাধিকার কমিশনের বাকি অভিযোগগুলো পর্যায়ক্রমে তদন্ত হবে।
No comments