উভয় সংকটে সাদ হারিরি (পর্ব-২) by অরিয়ের দাহেল
লেবাননের
পরিস্থিতি মোটেই সৌদি আরবের অনুকূলে নেই। সাদ হারিরির সঙ্গে মিটমাট করলেই
সৌদি আরব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে, তা নয়। আসছে মে মাসে লেবাননের
আইনসভা নির্বাচন। কিন্তু জনমত জরিপে ভালো ফল করছে না রিয়াদের মিত্র দলগুলো।
প্রথমত, হারিরি এখন পর্যন্ত লেবাননে সৌদি আরবের খ্রিস্টান মিত্র দলগুলোকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। সামির গিগিয়ার নেতৃত্বাধীন লেবানিজ ফোর্সেস ও সামি গিমায়েলের নেতৃত্বাধীন কাতায়েব দল অতীতে হারিরির দল ফিউচার কারেন্ট’র প্রধান মিত্র ছিল। কিন্তু এবার হারিরি চান, এই দল দুইটির প্রার্থীরা তার জোট থেকে নির্বাচন না করুক। নভেম্বরে বন্দিত্ব কাটিয়ে হারিরি যখন দেশে ফেরেন, তখন তিনি জানতে পারেন যে, গিগিয়া ও গিমায়েল উভয়েই তাকে পদত্যাগে বাধ্য করতে সৌদি আরবকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এ দু’জন সেপ্টেম্বরে সৌদি আরব সফর করেছিলেন। তারা সৌদি আরবকে গোপনে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, হারিরিকে সরিয়ে আরো আক্রমণাত্মক কাউকে ক্ষমতায় বসাতে, যিনি কিনা হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে কথা বলবেন। এই দুই জনের ভূমিকা নিয়ে তাই হারিরি ক্ষুব্ধ। তাই তাদেরকে জোটে চান না তিনি। শুধু তাই নয়, এই দু’জনের প্রধান খ্রিস্টান প্রতিদ্বন্দ্বী ও হিজবুল্লাহর মিত্র প্রেসিডেন্ট আয়োনের দল ফ্রি প্যাট্রিয়টিক মুভমেন্টের সঙ্গে জোট গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছেন হারিরি। রিয়াদ যদি এখন গিগিয়া ও গিমায়েলের পক্ষে না নামে ও হারিরির মত পরিবর্তনে সক্ষম না হয়, তাহলে সৌদিপন্থি খ্রিস্টান দলগুলোর আসনে এবার ধস নামবে।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, হারিরির নিজের অবস্থাও অত ভালো নয়। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহের কারণে হারিরি এখন রাজনৈতিকভাবে আরো ভালো অবস্থায় রয়েছেন। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা।
প্রথমত, সংকট চলাকালে লেবাননের সুন্নি সম্প্রদায় হারিরির পক্ষে ছিল। তারা দাবি জানান, হারিরিকে সৌদি আরব থেকে ফেরত আসতে হবে। এক্ষেত্রে তারা মনে করেছিলেন, হারিরির বন্দিত্ব লেবাননের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন। কিন্তু ২০০৯ সালের দিকেও ব্যাপক সমর্থন ভোগ করা সাদ হারিরি এখন দুর্বল হয়ে গেছেন। তার চারিত্রিক দুর্বলতা, বিভ্রান্তিকর রাজনীতি ও দেশের প্রতিটি বড় সংকটে দেশত্যাগের প্রবণতা তার ভক্তদেরও বিরক্ত করেছে। অপরদিকে, সিরিয়ার যুদ্ধে কিছু জিহাদি গ্রুপকে সৌদি আরবের সমর্থন লেবাননের অনেক সুন্নিকে ক্ষুব্ধ করেছে। আর শেষ কথা হলো, গত কয়েক বছর ধরে হারিরি নিজেও আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত। রিয়াদ এই সমস্যার জন্য অনেকখানি দায়ী। অবস্থা এত বাজে ছিল যে, হারিরি নিজের কর্মচারিদের বেতন ও রাজনৈতিক কর্মীদের অর্থ দিতে পারেননি।
হারিরি নিজের দুর্বল অবস্থান সম্পর্কে জানেন। এবার তিনি নিজের শহর সাইদা থেকে না লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ২০০৫ সালে পিতা রফিক হারিরি হত্যার পর থেকে, বৈরুতে তিনি সহজেই জয় পেতেন। সেখানেও এবার লড়বেন না। গুজব জোরালো হয়েছে যে, তিনি হাসবায়া-মার্জিয়োন জেলা থেকে লড়বেন। এখানকার বাসিন্দারা শিয়া ও ড্রুজ অঞ্চল দিয়ে ঘেরাও হয়ে আছেন। তাদের অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে এখান থেকে জয় ঘরে তুলতে চান সাদ হারিরি। কিন্তু বেকা অঞ্চলের সুন্নিরা বলছেন, হারিরিকে নয়, তারা আয়োনের দলের সুন্নি প্রার্থীদের ভোট দেবেন।
সৌদি আরব এই উত্তাল পরিস্থিতিতে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চায়। ১৪ই ফেব্রুয়ারি হারিরি পরোক্ষ কিন্তু স্পষ্টভাবে রিয়াদের প্রতি কিছু ইতিবাচক বার্তা দেন। নিজের পিতা রফিক হারিরি হত্যার বার্ষিকীতে দেয়া এক ভাষণে তিনি বলেন, আমাদের দল হিজবুল্লাহর সঙ্গে কোনো ধরনের নির্বাচনী সমঝোতায় যেতে নারাজ। উল্লেখ্য, রফিক হারিরির হত্যার পেছনে হিজবুল্লাহ দায়ী বলে ভাবা হয়।
ওই বক্তব্যের পরদিন সাদ হারিরি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। টিলারসনকে তিনি প্রকাশ্যে বলেন, আঞ্চলিক সংঘাতে জড়ানো থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে লেবানন অঙ্গীকারাবদ্ধ। এটি সৌদি আরবের বড় একটি দাবি। সিরিয়ার সংঘাতে লেবাননের হিজবুল্লাহর সম্পৃক্ততা নিয়ে ভীষণ ক্ষুব্ধ সৌদি আরব।
ফলে সৌদি আরবের প্রতি সাদ হারিরির ইতিবাচক বার্তা সেখানে ভালোভাবেই গৃহীত হয়েছে। নিজের বক্তব্যে সাদ হারিরি বলেন, এই বছরের নির্বাচনে টাকার ছড়াছড়ি থাকবে না। এ কথা বলে হয়তো তিনি স্বীকার করে নিলেন, অতীতে তার দলের বিরুদ্ধে টাকা ছড়িয়ে ভোট কেনার যে অভিযোগ ছিল তা একেবারে অসত্য নয়। কিন্তু তার এই বক্তব্যের আরেকটা মানে হতে পারে এই যে, সৌদির প্রতি তিনি অনেকটা হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, ‘তোমাদের কারণে আমার এখন অর্থ নেই। যদি আমি হারি, দোষটা কিন্তু তোমাদের।’ উল্লেখ্য, কিছুকাল আগে সৌদি আরব হারিরিকে আর্থিক সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে। এমনকি সৌদি ওগারসহ হারিরির বেশ কয়েকটি প্রধান কোম্পানি সৌদি সরকার নিয়ে নিয়েছে।
তাই আগামী নির্বাচনে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে না চাইলে, সৌদি সাহায্য দরকার হারিরির। কিন্তু সৌদি সহায়তা পাওয়ার জন্য কিছুটা মূল্যও চুকাতে হবে তাকে। হিজবুল্লাহর সঙ্গে যেকোনো ধরনের জোট গঠন বা আপসরফা প্রত্যাখ্যান করতে হবে তাকে। তার মানে হলো, নিজের প্রণীত তীব্র জনপ্রিয় জাতীয় ঐক্যমতের ফর্মুলা হারিরি নিজেই ধ্বংস করবেন। কারণ, ওই ঐক্যমতের ভিত্তিতেই ২০১৬ সালে মতপার্থক্য সত্ত্বেও সরকার গঠন সম্ভব হয়েছিল। কয়েক বছরব্যাপী চলা অচলাবস্থার অবসান হয়েছিল। কিন্তু সৌদি দাবি মেনে নিলে, হারিরিকে এখন ফের আক্রমণাত্মক রূপে চলে যেতে হবে। হিজবুল্লাহর সমালোচনা করতে হবে। যার দরুন দেশে আন্তঃসম্প্রদায় বিদ্বেষ ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।
আবার নিজের দলের শক্তি অক্ষুণ্ন রেখে আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভালো ফল করতে গেলেও, আরেক সমস্যা আছে। হারিরি যদি হিজবুল্লাহর সমালোচনা করে সৌদি সহায়তা নিয়ে নির্বাচনে ভালো করেনও, তাকে হয়তো প্রধানমন্ত্রী পদ ছাড়তে হবে। প্রধানমন্ত্রী পদ যদি না থাকে, সাদ হারিরির রাজনৈতিক গুরুত্ব লেবাননে অনেকখানি হ্রাস পাবে।
লেবাননে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট পদে কে বসবেন, তা চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করে হিজবুল্লাহ। তার মানে, হিজবুল্লাহর সঙ্গে সংঘাতে জড়ালে হারিরি নিজের রাজনৈতিক মৃত্যুই ডেকে আনবেন। বিকল্প প্রার্থীর অভাব নেই। আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি। ইতিমধ্যেই উত্তরাঞ্চলীয় সুন্নি রাজধানী ত্রিপোলির নির্বাচনে তিনিই বেশিসংখ্যক আসন পাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আছেন নুহাদ আল-মাশনুক। হারিরির দলের হলেও আল-মাশনুক আবার হিজবুল্লাহর সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক চান না।
লেবাননের সুন্নিরা নভেম্বরেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, হারিরি বা সৌদি আরবের জন্য তারা শিয়াদের সঙ্গে বিবাদে যেতে চান না। অপরদিকে হিজবুল্লাহও স্পষ্ট করেছে যে, দেশের সুন্নি আংশীদারদের সঙ্গে করা অঙ্গীকার রক্ষা করতে প্রস্তুত তারা। এমনকি রিয়াদ যখন হারিরিকে পদত্যাগে বাধ্য করে, তখন হিজবুল্লাহই তার প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বহালের জন্য লেবাননে তৎপরতা বৃদ্ধি করে। খোদ সাদ হারিরির চাচি, সাবেক এমপি ও হারিরির ফিউচার কারেন্ট দলের মন্ত্রী যেমনটা বলছিলেন যে, নাসরাল্লাহ (হিজবুল্লাহর প্রধান) না থাকলে, সাদকে হয়তো মুক্তি দেয়া হতো না।
এখন প্রশ্ন হলো, হারিরি কী করবেন। তিনি কি সৌদির সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষাকে অগ্রাধিকার দেবেন? নাকি, সৌদির সঙ্গে সম্পর্ক শিথিল করে আগামী নির্বাচন শেষে হিজবুল্লাহর নীরব সমর্থন নিয়ে প্রধানমন্ত্রিত্ব অক্ষুণ্ন রাখবেন? বোঝাই যাচ্ছে, ভীষণ জটিল পরিস্থিতি হারিরির সামনে।
(অরিয়ের দাহেল ফ্রান্সের প্যারিস-ডফাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো ও প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট-ডক্টোরাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ছিলেন। তিনি শিয়াবাদ, হিজবুল্লাহ, লেবানন ও মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে বিশেষজ্ঞ। তার এই নিবন্ধ মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট লোবলগ-এ প্রকাশিত হয়েছে।)
প্রথমত, হারিরি এখন পর্যন্ত লেবাননে সৌদি আরবের খ্রিস্টান মিত্র দলগুলোকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। সামির গিগিয়ার নেতৃত্বাধীন লেবানিজ ফোর্সেস ও সামি গিমায়েলের নেতৃত্বাধীন কাতায়েব দল অতীতে হারিরির দল ফিউচার কারেন্ট’র প্রধান মিত্র ছিল। কিন্তু এবার হারিরি চান, এই দল দুইটির প্রার্থীরা তার জোট থেকে নির্বাচন না করুক। নভেম্বরে বন্দিত্ব কাটিয়ে হারিরি যখন দেশে ফেরেন, তখন তিনি জানতে পারেন যে, গিগিয়া ও গিমায়েল উভয়েই তাকে পদত্যাগে বাধ্য করতে সৌদি আরবকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এ দু’জন সেপ্টেম্বরে সৌদি আরব সফর করেছিলেন। তারা সৌদি আরবকে গোপনে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, হারিরিকে সরিয়ে আরো আক্রমণাত্মক কাউকে ক্ষমতায় বসাতে, যিনি কিনা হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে কথা বলবেন। এই দুই জনের ভূমিকা নিয়ে তাই হারিরি ক্ষুব্ধ। তাই তাদেরকে জোটে চান না তিনি। শুধু তাই নয়, এই দু’জনের প্রধান খ্রিস্টান প্রতিদ্বন্দ্বী ও হিজবুল্লাহর মিত্র প্রেসিডেন্ট আয়োনের দল ফ্রি প্যাট্রিয়টিক মুভমেন্টের সঙ্গে জোট গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছেন হারিরি। রিয়াদ যদি এখন গিগিয়া ও গিমায়েলের পক্ষে না নামে ও হারিরির মত পরিবর্তনে সক্ষম না হয়, তাহলে সৌদিপন্থি খ্রিস্টান দলগুলোর আসনে এবার ধস নামবে।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, হারিরির নিজের অবস্থাও অত ভালো নয়। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহের কারণে হারিরি এখন রাজনৈতিকভাবে আরো ভালো অবস্থায় রয়েছেন। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা।
প্রথমত, সংকট চলাকালে লেবাননের সুন্নি সম্প্রদায় হারিরির পক্ষে ছিল। তারা দাবি জানান, হারিরিকে সৌদি আরব থেকে ফেরত আসতে হবে। এক্ষেত্রে তারা মনে করেছিলেন, হারিরির বন্দিত্ব লেবাননের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন। কিন্তু ২০০৯ সালের দিকেও ব্যাপক সমর্থন ভোগ করা সাদ হারিরি এখন দুর্বল হয়ে গেছেন। তার চারিত্রিক দুর্বলতা, বিভ্রান্তিকর রাজনীতি ও দেশের প্রতিটি বড় সংকটে দেশত্যাগের প্রবণতা তার ভক্তদেরও বিরক্ত করেছে। অপরদিকে, সিরিয়ার যুদ্ধে কিছু জিহাদি গ্রুপকে সৌদি আরবের সমর্থন লেবাননের অনেক সুন্নিকে ক্ষুব্ধ করেছে। আর শেষ কথা হলো, গত কয়েক বছর ধরে হারিরি নিজেও আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত। রিয়াদ এই সমস্যার জন্য অনেকখানি দায়ী। অবস্থা এত বাজে ছিল যে, হারিরি নিজের কর্মচারিদের বেতন ও রাজনৈতিক কর্মীদের অর্থ দিতে পারেননি।
হারিরি নিজের দুর্বল অবস্থান সম্পর্কে জানেন। এবার তিনি নিজের শহর সাইদা থেকে না লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ২০০৫ সালে পিতা রফিক হারিরি হত্যার পর থেকে, বৈরুতে তিনি সহজেই জয় পেতেন। সেখানেও এবার লড়বেন না। গুজব জোরালো হয়েছে যে, তিনি হাসবায়া-মার্জিয়োন জেলা থেকে লড়বেন। এখানকার বাসিন্দারা শিয়া ও ড্রুজ অঞ্চল দিয়ে ঘেরাও হয়ে আছেন। তাদের অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে এখান থেকে জয় ঘরে তুলতে চান সাদ হারিরি। কিন্তু বেকা অঞ্চলের সুন্নিরা বলছেন, হারিরিকে নয়, তারা আয়োনের দলের সুন্নি প্রার্থীদের ভোট দেবেন।
সৌদি আরব এই উত্তাল পরিস্থিতিতে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চায়। ১৪ই ফেব্রুয়ারি হারিরি পরোক্ষ কিন্তু স্পষ্টভাবে রিয়াদের প্রতি কিছু ইতিবাচক বার্তা দেন। নিজের পিতা রফিক হারিরি হত্যার বার্ষিকীতে দেয়া এক ভাষণে তিনি বলেন, আমাদের দল হিজবুল্লাহর সঙ্গে কোনো ধরনের নির্বাচনী সমঝোতায় যেতে নারাজ। উল্লেখ্য, রফিক হারিরির হত্যার পেছনে হিজবুল্লাহ দায়ী বলে ভাবা হয়।
ওই বক্তব্যের পরদিন সাদ হারিরি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। টিলারসনকে তিনি প্রকাশ্যে বলেন, আঞ্চলিক সংঘাতে জড়ানো থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে লেবানন অঙ্গীকারাবদ্ধ। এটি সৌদি আরবের বড় একটি দাবি। সিরিয়ার সংঘাতে লেবাননের হিজবুল্লাহর সম্পৃক্ততা নিয়ে ভীষণ ক্ষুব্ধ সৌদি আরব।
ফলে সৌদি আরবের প্রতি সাদ হারিরির ইতিবাচক বার্তা সেখানে ভালোভাবেই গৃহীত হয়েছে। নিজের বক্তব্যে সাদ হারিরি বলেন, এই বছরের নির্বাচনে টাকার ছড়াছড়ি থাকবে না। এ কথা বলে হয়তো তিনি স্বীকার করে নিলেন, অতীতে তার দলের বিরুদ্ধে টাকা ছড়িয়ে ভোট কেনার যে অভিযোগ ছিল তা একেবারে অসত্য নয়। কিন্তু তার এই বক্তব্যের আরেকটা মানে হতে পারে এই যে, সৌদির প্রতি তিনি অনেকটা হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, ‘তোমাদের কারণে আমার এখন অর্থ নেই। যদি আমি হারি, দোষটা কিন্তু তোমাদের।’ উল্লেখ্য, কিছুকাল আগে সৌদি আরব হারিরিকে আর্থিক সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে। এমনকি সৌদি ওগারসহ হারিরির বেশ কয়েকটি প্রধান কোম্পানি সৌদি সরকার নিয়ে নিয়েছে।
তাই আগামী নির্বাচনে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে না চাইলে, সৌদি সাহায্য দরকার হারিরির। কিন্তু সৌদি সহায়তা পাওয়ার জন্য কিছুটা মূল্যও চুকাতে হবে তাকে। হিজবুল্লাহর সঙ্গে যেকোনো ধরনের জোট গঠন বা আপসরফা প্রত্যাখ্যান করতে হবে তাকে। তার মানে হলো, নিজের প্রণীত তীব্র জনপ্রিয় জাতীয় ঐক্যমতের ফর্মুলা হারিরি নিজেই ধ্বংস করবেন। কারণ, ওই ঐক্যমতের ভিত্তিতেই ২০১৬ সালে মতপার্থক্য সত্ত্বেও সরকার গঠন সম্ভব হয়েছিল। কয়েক বছরব্যাপী চলা অচলাবস্থার অবসান হয়েছিল। কিন্তু সৌদি দাবি মেনে নিলে, হারিরিকে এখন ফের আক্রমণাত্মক রূপে চলে যেতে হবে। হিজবুল্লাহর সমালোচনা করতে হবে। যার দরুন দেশে আন্তঃসম্প্রদায় বিদ্বেষ ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।
আবার নিজের দলের শক্তি অক্ষুণ্ন রেখে আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভালো ফল করতে গেলেও, আরেক সমস্যা আছে। হারিরি যদি হিজবুল্লাহর সমালোচনা করে সৌদি সহায়তা নিয়ে নির্বাচনে ভালো করেনও, তাকে হয়তো প্রধানমন্ত্রী পদ ছাড়তে হবে। প্রধানমন্ত্রী পদ যদি না থাকে, সাদ হারিরির রাজনৈতিক গুরুত্ব লেবাননে অনেকখানি হ্রাস পাবে।
লেবাননে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট পদে কে বসবেন, তা চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করে হিজবুল্লাহ। তার মানে, হিজবুল্লাহর সঙ্গে সংঘাতে জড়ালে হারিরি নিজের রাজনৈতিক মৃত্যুই ডেকে আনবেন। বিকল্প প্রার্থীর অভাব নেই। আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি। ইতিমধ্যেই উত্তরাঞ্চলীয় সুন্নি রাজধানী ত্রিপোলির নির্বাচনে তিনিই বেশিসংখ্যক আসন পাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আছেন নুহাদ আল-মাশনুক। হারিরির দলের হলেও আল-মাশনুক আবার হিজবুল্লাহর সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক চান না।
লেবাননের সুন্নিরা নভেম্বরেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, হারিরি বা সৌদি আরবের জন্য তারা শিয়াদের সঙ্গে বিবাদে যেতে চান না। অপরদিকে হিজবুল্লাহও স্পষ্ট করেছে যে, দেশের সুন্নি আংশীদারদের সঙ্গে করা অঙ্গীকার রক্ষা করতে প্রস্তুত তারা। এমনকি রিয়াদ যখন হারিরিকে পদত্যাগে বাধ্য করে, তখন হিজবুল্লাহই তার প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বহালের জন্য লেবাননে তৎপরতা বৃদ্ধি করে। খোদ সাদ হারিরির চাচি, সাবেক এমপি ও হারিরির ফিউচার কারেন্ট দলের মন্ত্রী যেমনটা বলছিলেন যে, নাসরাল্লাহ (হিজবুল্লাহর প্রধান) না থাকলে, সাদকে হয়তো মুক্তি দেয়া হতো না।
এখন প্রশ্ন হলো, হারিরি কী করবেন। তিনি কি সৌদির সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষাকে অগ্রাধিকার দেবেন? নাকি, সৌদির সঙ্গে সম্পর্ক শিথিল করে আগামী নির্বাচন শেষে হিজবুল্লাহর নীরব সমর্থন নিয়ে প্রধানমন্ত্রিত্ব অক্ষুণ্ন রাখবেন? বোঝাই যাচ্ছে, ভীষণ জটিল পরিস্থিতি হারিরির সামনে।
(অরিয়ের দাহেল ফ্রান্সের প্যারিস-ডফাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো ও প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট-ডক্টোরাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ছিলেন। তিনি শিয়াবাদ, হিজবুল্লাহ, লেবানন ও মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে বিশেষজ্ঞ। তার এই নিবন্ধ মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট লোবলগ-এ প্রকাশিত হয়েছে।)
No comments