গণতন্ত্র ও সংবাদপত্র পরস্পরের সহায়ক by এম এ আজিজ
গণতন্ত্র
ও সংবাদপত্র একে অন্যের পরিপূরক শব্দ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনায় এ
দু’টি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে দেশের সরকার গণতান্ত্রিক, সেই দেশে
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা
অর্থবহ হয়ে ওঠে না। সেজন্য বাকস্বাধীনতা, মিছিল, মিটিংয়ের স্বাধীনতা ছাড়া
জনগণের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার সংরক্ষিত হতে পারে না। যে দেশের জনগণ
মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ও সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়; সে দেশে
উন্নয়ন আগে, পরে গণতন্ত্রের কথা বলা হয়। সে দেশে গণতন্ত্র কার্যত থাকে না,
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বাক-ব্যক্তিস্বাধীনতা কোনোটাই আর অবশিষ্ট থাকে না।
আমাদের সংবিধানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছিল; কিন্তু ১৯৭৩
সালে প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্টে জেলা প্রশাসকের হাতে
সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়ার ক্ষমতা অর্পণ করার ঘটনা সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে
প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। ক্ষমতার অপব্যবহার যে দেশের ক্ষমতাবানদের ভূষণ হিসেবে
বিবেচিত, সে দেশে এ ধরনের বিতর্কিত আইন থাকাই স্বাভাবিক। তবে বিষয়টি সে সময়
তোলপাড় সৃষ্টি করে। তখনকার বিরোধী দলের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেয়া
হয়েছিল, তারা ক্ষমতায় গেলে এই কালাকানুন ছুড়ে ফেলে দেবেন; কিন্তু পরে যারা
ক্ষমতায় গেছেন, তারা বাতিল না করে এই অ্যাক্টকে সংবাদপত্র দলনের হাতিয়ার
হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল ১৯৯১ সালে
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই কালো আইন
বাতিল করেছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে কালাকানুনের খড়গ থেকে রক্ষার
উদ্দেশ্যে তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে এ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এই কালাকানুন বাতিল
করে একজন বিচারক হিসেবে নিয়েছেন সাহসী পদক্ষেপ।
শুধু সাংবাদিক, লেখক,
শিক্ষক, কবি, সাহিত্যিক, সংবাদপত্রের মালিক, কলামিস্ট, বুদ্ধিজীবী নন,
দেশের সব শ্রেণীর মানুষের মনোভাবের উপলব্ধি থেকে যে ঐতিহাসিক কাজটি করেছেন;
তাতে চিরদিন জাতির কাছে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।লজ্জার কথা হলো, বাতিলকৃত
অধ্যাদেশটি পুনরুজ্জীবিত করার ভ্রান্ত চিন্তাভাবনা আছে সরকার মহলের। জেলা
প্রশাসকেরা সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে দিতে পারেন- এর মধ্য দিয়ে
সংবাদপত্রের প্রতি সরকারের মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এটা সংবাদপত্রের
স্বাধীনতার জন্য বিসংবাদ বলে বিবেচিত হবে। গণতন্ত্রের স্বার্থেই তথ্য ও
যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন সরকারের একটা বড় ভুল। দেশবাসীকে হতাশ করে ৫৭(২) ধারা
জারি হওয়ার মধ্য দিয়ে সর্বমহলে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। সরকারের এ
সিদ্ধান্তকে কালাকানুন বা নিবর্তনমূলক আইন হিসেবে সহজেই চিহ্নিত করা যায়।
এই কালাকানুনের শিকার হয়েছেন বহু সাংবাদিক। গ্রেফতারসহ কর্তব্যরত
সাংবাদিকদের প্রতি পুলিশি নির্যাতন চলছে। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয়
ভাগে, ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা
হইতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।’ গত কয়েক বছরে যেমন মতপ্রকাশের
স্বাধীনতার পথে বাধা-নিষেধের নানা ঘটনা প্রত্যক্ষ করি, তেমনি প্রত্যক্ষ করি
জীবনের নিরাপত্তার অভাবও। অনেকের স্মরণে থাকতে পারে, সাংবাদিক প্রবীর
শিকদারকে ঢাকায় আটক করে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ফরিদপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭(২) ধারায় আটক হিসেবে তাকে আদালতে হাজির
করা হয়।
তার শারীরিক, মানসিক, পঙ্গু অবস্থার কথা বিবেচনায় না নিয়ে এবং
পুলিশ প্রবিধান বিবেচনা না করে তাকে পরানো হয়েছে হাতকড়া। তিনি অভিযোগ করেন,
থানায় তাকে মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সবাই
জানেন এবং বাংলাদেশের সব গণমাধ্যমে তার ছবিসহ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
দেশবাসী বিপন্ন বিস্ময়ে লক্ষ করল, সাংবাদিক নেতা ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শওকত
মাহমুদকে পুলিশ আটকের পর বলা হয়েছে, বিএনপির ঢাকা অবরোধের সময় গাড়িতে
অগ্নিসংযোগের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় তাকে আটক করা হয়েছে; কিন্তু এটি
স্পষ্ট নয় যে, কেন তাকে একটি সংবাদ সম্মেলনের আগমুহূর্তে আটক করা হলো।
দেশবাসী মনে করে, গণতন্ত্রের স্বার্থেই সরকার গণমাধ্যমসংক্রান্ত ভুল
সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে। ভিন্ন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বাধা যেমন
কাক্সিক্ষত হতে পারে না, তেমনি সংশ্লিষ্ট আইনের বিতর্কিত ধারাও গ্রহণযোগ্য
হতে পারে না। সরকারের পক্ষ থেকে যখন মতপ্রকাশের সীমা নির্ধারণের কথা বলা
হয়, তা সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র যদি ভিন্নমত প্রকাশের
সব ছিদ্র বন্ধ করে দিতে উদ্যোগী হয়; তবে সেই রাষ্ট্রের চরিত্র কি
গণতন্ত্রবিরোধী হয়ে যায় না? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পর্যালোচনা ও সংস্কার
করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
(এইচআরডব্লিউ)। সংস্থাটি বলছে, মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত এই আইনটির পরিসর বিশাল
ও অপব্যবহারযোগ্য। এজন্য আইনের কঠোর দিকগুলো সংশোধন জরুরি। গত ২৯ জানুয়ারি
মন্ত্রিসভা প্রস্তাবিত আইনটির অনুমোদন দেয়।
এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনে বলা
হয়েছে, প্রস্তাবিত আইনটি আগের আইনের চেয়ে আরো ব্যাপক এবং মতপ্রকাশের
স্বাধীনতা রক্ষায় আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার লঙ্ঘন। এইচআরডব্লিউর এশিয়া
অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যান্ড অ্যাডামস বলেন, মতপ্রকাশের অধিকার খর্ব করার
কোনো ইচ্ছা নেই বলে বাংলাদেশ সরকার যে দাবি করেছে, প্রস্তাবিত আইনটি তার
বিপরীত। আইনে কমপক্ষে পাঁচটি ধারায় মতপ্রকাশের বিষয়টি অস্পষ্টভাবে হলেও
অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আইনটি সমালোচনা ব্যাপকভাবে দমনের একটি
লাইসেন্স। তিনি বলেন, ‘মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের যে
বাধ্যবাধকতা আছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। সংসদের
উচিত বিলটি প্রত্যাখ্যান করা এবং দেশের নাগরিকেরা মুক্তভাবে কথা বলতে
পারবে, এমন আইনের প্রতি সম্মান জানানো।’ প্রতিবেদনে আইনটির ১৪, ২৫, ২৮, ২৯ ও
৩১ ধারার সমালোচনা করা হয়েছে। ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের
স্বাধীনতাযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অথবা জাতির পিতার বিরুদ্ধে অপপ্রচার- এ
অপরাধের শাস্তি ১৪ বছর জেল; কিন্তু জাতিসঙ্ঘের হিউম্যান রাইটস কমিটি মনে
করে- ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাপারে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে এ শাস্তি আরোপ করা
জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বেমানান। একইভাবে ২৫ ধারায় উল্লিখিত
রয়েছে আগ্রাসী ও ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টি করলে আইনের লঙ্ঘন হবে; কিন্তু কোন
কাজগুলো ‘আগ্রাসী ও ভয়ানক’ তার স্পষ্ট বিবরণ আইনে নেই। প্রস্তাবিত আইনের
২৮ ধারায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করলে পাঁচ বছরের শাস্তির বিধান রয়েছে;
কিন্তু প্রতিবেদন বলছে, এটি আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়নি।
৩১ ধারাও সমালোচনার যোগ্য বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। প্রসঙ্গত, এর আগে
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করেও অনুরূপ বেশ কিছু বিধান
রেখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করার আশঙ্কা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। ডিজিটাল
নিরাপত্তা আইনের খসড়া পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এতে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের
কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসেনি। ৫৭ ধারায় অপরাধের ধরনগুলো বিভিন্ন ধারায় ভাগ
করে দেয়া হয়েছে মাত্র। অ্যাডামস বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেকগুলো
বিষয় মূলত স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করবে। তাই পার্লামেন্টে
বিলটি প্রত্যাখ্যান করা উচিত।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
বলেন, কেউ তেমন কিছু না করলে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের
অপপ্রয়োগ হবে না। সাংবাদিক নেতা মনজুরুল আহসান বুলবুল মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত
ডিজিটাল আইন প্রসঙ্গে বলেন, আইনটি কখনো কখনো সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এবং
গণমাধ্যমে পেশাদারিত্বের বিরুদ্ধে ব্যবহারের সুযোগ থাকে। এটি চূড়ান্ত
অনুমোদনের আগে আরো আলোচনা করে সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে যাতে অপপ্রয়োগ না হয়,
তা নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাইবার ক্রাইম
বিরাট সমস্যা, নানাভাবে ব্যবহৃত হয়। সাইবার ক্রাইমের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী
জনমত আছে। প্রযুক্তি যেমন সুযোগ করে দেয়, মাঝে মধ্যে দুঃসহ যন্ত্রণাও দেয়।
আপনাদের এত আশঙ্কা কেন? যদি কেউ তেমন কিছু না করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে তো
অপপ্রয়োগ হবে না। ৫৭(২) ধারার বদলে ৩২ ধারার ভেতরে ৫৭(২) ধারার সবটুকু
মিশিয়ে ‘গোলাপজল বানিয়ে সুগন্ধ ছড়ালেও দুর্গন্ধ কিছুতেই লুকানো যাবে না।’
তা থেকে কেউ জাতির কাছে অব্যাহতি পাওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের প্রত্যাশা,
মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদিত ৩২ ধারাকে পার্লামেন্টে পাস করার আগে সাংবাদিক,
লেখক, কলামিস্ট, কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ এবং সব
পেশাজীবীর সাথে বৈঠক করে, সবার সর্বসম্মতিক্রমে ও খোলামেলা আলোচনা করে
আইনটির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সাংবাদিক, পত্রিকার মালিক,
পেশাজীবী সবাইকেই একটি কথা সবিনয়ে বলি, সুদূর অতীতে পত্রিকার নিউজ
প্রিন্টের দাম বাড়লে পত্রিকার মালিক-সাংবাদিকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা
অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো রাস্তায় ফেটে পড়তেন বিক্ষোভে। আন্দোলন ও প্রতিবাদের
মধ্য দিয়ে দাবি আদায় করতেন। তখন সাংবাদিক-মালিক-কর্মচারী সবাই ঐক্যবদ্ধ
ছিলেন। মূল্যবোধের শক্তির ওপর নির্ভর করে প্রতিবাদ করতেন। সরকার তাদের
প্রতিবাদকে আমলে নিত। এখন সাংবাদিকদের হাতকড়া পরিয়ে সাধারণ কয়েদির পর্যায়ে
নামানো হয়েছে। সরকার ও তথ্য মন্ত্রণালয় এখন আর তাদের আগের মতো গুরুত্বের
চোখে দেখে না। আবার সাংবাদিক, দেশপ্রেমিক পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের
গণবিরোধী কালাকানুন ও নিবর্তনমূলক আইন তথা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ৩২ ধারার
বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। পরিশেষে নজরুলের ভাষায় বাণী উচ্চারণ করতে চাই-
‘অসত্যের কাছে নত নাহি হবে শির
ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর।’
‘অসত্যের কাছে নত নাহি হবে শির
ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর।’
No comments