নেতানিয়াহু কেমন নেতা? by উরি আভনেরি
ইসরাইলের
প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান ও কলামিস্ট উরি আভনেরি। ইহুদিদের মধ্যে যে ক’জন
মানবতাবাদী ও শান্তিকামী ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, ‘গুশ শালোম’ আন্দোলনের
কাণ্ডারি হিসেবে তিনি তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তার লেখনী বরাবরই ফিলিস্তিন
ইস্যুর যথাযথ সমাধান তথা ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার হিসেবে
স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার। তিনি সব সময় উগ্র ইহুদিবাদের
দখলদারি ও আগ্রাসী মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে। এ দিকে কট্টরপন্থী রাজনীতিক
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পরিচালিত ইসরাইলি সরকার ফিলিস্তিনিদের ওপর
নির্যাতন-নিপীড়নের মাত্রাকে চরমপর্যায়ে পৌঁছিয়েছে। সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে
জেরুসালেমের আরববাসিন্দাদের ইসরাইলের প্রতি আনুগত্যহীনতার অজুহাতে শাস্তি
প্রদানের আইন করা হয়েছে। নেতানিয়াহু গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত
হলেও ইহুদিরা তার মতো উগ্রপন্থী নেতার মোহ থেকে মুক্ত হয়নি এখনো। এ
প্রেক্ষাপটে আভনেরি ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় তার তীব্র সমালোচনা করে এই নিবন্ধ
লিখেছেন। গত ৫ মার্চ CounterPunch.org-এ প্রকাশিত লেখাটি কিছুটা সংক্ষেপে
ভাষান্তর করেছেন মীযানুল করীম। উরি আভনেরি উল্লেখ করেছেন, ‘নেতানিয়াহু পুরো
ফিলিস্তিনি জাতিকেই ফিলিস্তিন ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করার সুযোগের অপেক্ষায়
রয়েছেন।’ তবে বাস্তবে তা সম্ভব হবে না বলেই আভনেরির অভিমত। দুর্নীতির
অভিযোগের বন্যা নেতানিয়াহু পরিবার এবং তাদের দোসর ও চাকরদের ডুবিয়ে দিচ্ছে।
তবুও তাদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা কমছে বলে মনে হয় না, যারা নিজেদের মনে করে
‘জনগণ’। বরং তার দল ছাড়াও অন্যান্য জাতীয়তাবাদী দলের ভোটাররা ‘বিবি’র
(নেতানিয়াহু) উদ্ধারে ছুটে যাচ্ছে। তাদের বিশ্বাস, নেতানিয়াহু একজন বিরাট
রাষ্ট্রনেতা। তাই তার ব্যাপারে ঘুষ, দুর্নীতি, উপঢৌকন প্রভৃতি ভুলে গিয়ে
তাকে ক্ষমা করে দিতে তারা প্রস্তুত। আশ্চর্য! আমি এর ঠিক বিপরীত মতই পোষণ
করি। বড় রাষ্ট্রনায়ক যদি হনও, তবুও ক্ষমা করতে রাজি নই। আমি মনে করি,
নেতানিয়াহু একেবারে নগণ্য স্টেটসম্যান বা রাষ্ট্রনায়ক। আসলে তাকে
স্টেটসম্যানই বলা যায় না। নেতানিয়াহু প্রকৃতপক্ষে কী, সে সম্পর্কে চূড়ান্ত
রায় দিয়ে গেছেন তার বাবা। তখন নেতানিয়াহুর ক্যারিয়ার কেবল শুরু হয়েছে। বাবা
বেনজিওন নেতানিয়াহু ছিলেন ইতিহাসের অধ্যাপক। তিনি স্পেনের ইনকুইজিশন
সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। (ইনকুইজিশন হলো, বিশেষত পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে
‘ধর্মদ্রোহিতা’ দমনের জন্য গির্জার মনোনীত বিচারালয়ের কার্যক্রম। তারা
নির্ধারণ করতেন, কোন বইগুলো বিনা অনুমতিতে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানেরা পড়তে
পারবেন না- অনুবাদক) নেতানিয়াহু বাবার মেজো ছেলে, যার ব্যাপারে তার তেমন
উঁচু ধারণা ছিল না; বরং বাবা বেশি পছন্দ করতেন বড় ছেলে জোনাথনকে। উগান্ডার
এন্টেবি বিমানবন্দর অপারেশনের সময় তিনি নিহত হন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে
নেতানিয়াহুর বাবা বেনজিওন ছিলেন চরম দক্ষিণপন্থী। তিনি উদারতাকে দুর্বলতা
ভাবতেন এবং কোনো কোনো দক্ষিণপন্থী নেতাকেও ঘৃণা করতেন তারা কিছুটা উদার মনে
করে। অপর দিকে, বেনজিওন মনে করতেন- ইসরাইলে তার মেধা কাজে লাগছে না। তাই
তিনি আমেরিকায় অধ্যাপনা করতে চলে যান। সেখানেই ছেলেদের বড় করেছেন। ছেলে
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রসঙ্গে তার উক্তি : ‘সে পররাষ্ট্র সচিব হলে ভালো
করতে পারে; তবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়।’ বেনিয়ামিন সম্পর্কে এর চেয়ে সঠিক
ধারণা আর হতে পারে না। আসলেই বেনিয়ামিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার চমৎকার
বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তিনি আমেরিকান স্টাইলে ইংরেজি বলেন। অবশ্য, পূর্বসূরি আবা
ইবানের মতো সাহিত্যের গভীর জ্ঞান তার নেই। যা হোক, বিবি (নেতানিয়াহু)
জানেন, দুনিয়ার সেরা ব্যক্তিদের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক
সম্মেলনগুলোতে তার উপস্থিতি অন্যদের নজর কাড়ে। তিনি ভালো প্রস্তুতি নিয়ে
বক্তব্য রেখে থাকেন। তবে তিনি আদিম যুগের এমন সব কথা বলে চমক লাগাতে চান,
যা (ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী) চার্চিল পর্যন্ত ব্যবহার করেননি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাজ বর্তমান যুগে হলো, বিভিন্ন দেশ সফর করে নিজ দেশের
সেলসম্যানের ভূমিকা রাখা। আসলেই নেতানিয়াহু একসময় ছিলেন একটি ফার্নিচার
কোম্পানির সেলসম্যান।
এখন সফর করা এত সহজ হয়ে গেছে যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
সেসব কাজ করছেন, যা অতীতে রাষ্ট্রদূতদের জন্য নির্ধারিত ছিল। নেতানিয়াহুর
বাবা ঠিকই বুঝেছিলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর প্রধানমন্ত্রীর কাজের মাঝে
ব্যবধান বিরাট। পররাষ্ট্রমন্ত্রী পলিসি বাস্তবায়ন করেন আর প্রধানমন্ত্রী
সেই পলিসি নির্ধারণ করে থাকেন। একজন প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি থাকা চাই।
স্বদেশের কী প্রয়োজন, তা জানতে হয় তাকে। ভবিষ্যতের কয়েক জেনারেশনের চাহিদা
সম্পর্কে তার জানা থাকতে হবে। অপর দিকে, পররাষ্ট্র সম্পর্ক হলো তার দেশের
নানা চাহিদার মাত্র একটা দিক। তবে এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।
প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী পরিকল্পনা থাকতে হবে সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও
প্রতিরক্ষার বিষয়ে। বেনজিওন নেতানিয়াহু জানতেন, তার ছেলে বেনিয়ামিন
নেতানিয়াহুর এসব যোগ্যতা নেই। শুধু চেহারা সুন্দর হলেই চলে না; ইসরাইলের
মতো জটিল সমস্যাক্লিষ্ট কোনো রাষ্ট্রের নেতা সম্পর্কে এ কথা বিশেষভাবে
প্রযোজ্য। (সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট) ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের কথা মনে
পড়লেই স্মরণ হবে তার উক্তি : আমাদের ভয় করার কিছু নেই শুধু ভীতিকে ভয় করা
ছাড়া। (সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী) উইনস্টন চার্চিলের কথা স্মরণ হলে মনে
পড়ে যায় তার একটি উক্তি : আর কখনো এত মানুষ এত বেশি ঋণী ছিল না এত
স্বল্পসংখ্যক মানুষের কাছে। কিন্তু নেতানিয়াহুর কোন কথাটি মনে আসবে? একটিও
না। তবে মনে পড়বে দুর্নীতির বহু মামলার কথা, যেগুলোতে তিনি জড়িত। তাকে
ফৌজদারি মামলায় জেরা করার ফাঁকে ফাঁকে তার বড় কাজ হচ্ছে, বিদেশে ঘুরে
বেড়ানো এবং বিশ্বনেতাদের সাথে সাক্ষাৎ। একই সপ্তাহে প্রথমে প্যারিসে ফরাসি
প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ, এরপর মস্কোতে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে দেখা
করেন নেতানিয়াহু। এ দুই জায়গা সফরের মধ্যে ঘুরে আসেন আফ্রিকার একটি কি
দু’টি দেশ। এত সফরের মাধ্যমে তার অর্জনটা কী? না, বলার মতো কোনো কিছুই
অর্জিত হয়নি। জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে অনেক দেশে ইহুদিরা ছিল অসহায়
সংখ্যালঘু। তারা স্থানীয় লর্ড, কাউন্ট, সুলতান প্রমুখের দয়ার ওপর পুরোপুরি
নির্ভরশীল ছিল। তাদের সুনজরে থাকার জন্য একজন ইহুদি- সাধারণত সমাজের সবচেয়ে
ধনী ব্যক্তি- শাসককে খুশি রাখার দায়িত্ব নিজে পালন করতেন। এ জন্য তোষামোদ
করা হতো, উৎকোচ দেয়া হতো। এই ব্যক্তি ইহুদি ‘ঘেটোর রাজা’ হয়ে যেতেন আর
নিজের সম্প্রদায় তার প্রশংসা করত। নেতানিয়াহু এই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী।
নেতানিয়াহু আগে ছিলেন কমান্ডো যোদ্ধা। ইসরাইলিরা যেমন বীরপুরুষ চায়, তাকে
তেমন একজন মনে করা হয়। কিন্তু যারা তার তারিফ করছে, তাদের কাউকে জিজ্ঞেস
করে দেখুন- ‘নেতানিয়াহু ১২ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী; কিন্তু তার সাফল্য কী?’
দেখবেন, উত্তর দিতে গিয়ে হতভম্ব হয়ে যাবে লোকটা। ডেভিড বেন-গুরিয়ন ইসরাইল
রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা : মেনাচেম বেগিন মিসরের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠা
করেছিলেন; ইৎঝাক র্যাবিন ‘অসলো চুক্তি’ করেছেন? কিন্তু ‘বিবি’ কী করেছেন?
তবুও ইসরাইলিদের অন্তত ৫০ শতাংশ মানুষ নেতানিয়াহুর সীমাহীন প্রশংসায় মুখর।
তার অসংখ্য দুর্নীতির ঘটনাকেও ক্ষমার চোখে দেখতে তারা প্রস্তুত। অথচ তিনি
বিলিয়নিয়ারদের কাছ থেকে দামি কিউবান চুরুট নিয়েছেন উপঢৌকন হিসেবে এবং
সরাসরি ঘুষ নিয়েছেন বেশ কয়েক মিলিয়ন ডলার। নেতানিয়াহুর সমর্থকেরা প্রধানত
প্রাচ্যদেশীয় ইহুদি। তাদের এত দিন হেয় চোখে দেখা হতো। তারা বৈষম্যের শিকার
সব দিক দিয়ে। আশকানেজি বা উঁচুতলার শ্বেতাঙ্গ ইহুদিরা এটা করেছে। তবে,
নেতানিয়াহুর চেয়ে উঁচুতলার ‘আশকানেজি’ আর কেউ হতে পারেনি। কথা হলো,
ভবিষ্যতের জন্য নেতানিয়াহুর ‘ভিশন’ কী? উপনিবেশবাদী শক্তি হিসেবে ইসরাইল
কিভাবে টিকে থাকবে? আরব ও মুসলিমরা ইসরাইলকে ঘিরে আছে, যারা একদিন এক হবে
ইসরাইলের বিরুদ্ধে। পশ্চিম তীর আর গাজা হচ্ছে ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত এলাকা।
পূর্ব জেরুসালেমসহ ধর্মীয় স্থানগুলোর কথা না-ই বা বললাম। বিশ্বের ১৫০ কোটি
মুসলমানের কাছে এগুলো পবিত্র হিসেবে গণ্য। তাহলে ইসরাইল এসব জনপদের ‘প্রভু’
হয়ে থাকবে কিভাবে? মনে হয়, এসব প্রশ্নের জবাবে নেতানিয়াহুর নির্দেশ হলো-
‘এত কিছু দেখার দরকার নেই। কেবল চালিয়ে যাও।’ নেতানিয়াহুর যা চিন্তাভাবনা,
তাতে বলা যায়, তার দেয়া সমাধান আসলে সঙ্কট উত্তরণের কোনো পথই নয়। তিনি চান,
ইসরাইল যা করে আসছে, সেটাই করতে থাকুক। অর্থাৎ ফিলিস্তিনি জনগণের জাতীয় ও
মানবিক সব অধিকারকে অস্বীকার করা; অব্যাহতভাবে পশ্চিম তীরে ইসরাইলি বসতি
চাপিয়ে দেয়া এবং এসব সম্ভব না হলে আগের অবস্থা বজায় রাখা। নেতানিয়াহু সতর্ক
পদক্ষেপের মানুষ। যারা তার ভক্ত, তারা চায়- পশ্চিম তীর ইসরাইলের সাথে
প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত করা হোক। অন্তত এর বড় অংশ নিয়ে নেয়া হোক। ইসরাইলকে
সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ফিলিস্তিনিসহ পুরো আরব ও মুসলিম বিশ্বের সাথে শান্তি
স্থাপন, নাকি আরবদের নাগরিকত্ব না দিয়ে অধিকৃত এলাকাগুলো ইসরাইলের
অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া? এই বর্ণবাদী রাষ্ট্রের মধ্যে একদিন আরবরা
সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যেতে পারে। ইসরাইলের প্রায় সব ইহুদির জন্য এটা একটা
দুঃস্বপ্ন। আরেকটি ‘ভিশন’-এর কেউ উল্লেখ করছে না। তা হলো সুযোগের অপেক্ষা
করা, যাতে ফিলিস্তিন থেকে পুরো ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে বহিষ্কার করা যায়।
তবে (অতীতে এমনটি করা গেলেও) এমন সুযোগ আসবে বলে মনে হয় না।
বিবি/নেতানিয়াহু নির্বিকার। তার নিজের পৃথক ভিশন না থাকা মানে, তিনি বাবার
ভিশন লালন করছেন। তা হলো, ‘আরবদের বের করে দাও। এরপর অন্তত ভূমধ্যসাগর আর
জর্দানের মধ্যবর্তী সম্পূর্ণ এলাকা নাও দখল করে।’ অতীতে ইসরাইলিরা এটাই
করেছিল বলে বাইবেলে উল্লেখ আছে।
No comments