বাংলা ভাষার দরজা-জানালা খোলা থাকুক by অধ্যাপক ড. হ্যান্স হার্ডার
আমি
জার্মানির মানুষ হলেও বাংলা সাহিত্যের বিশেষ অনুরাগী। তাই বাংলা একাডেমির
আমন্ত্রণ পেয়ে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে ছুটে এলাম। ঢাকার একুশে বইমেলার
সরগরম পরিবেশ আমিও উপভোগ করব। আমিও বইয়ের পাতায় নাক গুঁজে নেশা করব। অসংখ্য
বইয়ের মলাট আমার মস্তিষ্কে ঘুরে ঘুরে নতুন কল্পনা, চিন্তাধারার আভাস
জাগিয়ে তুলবে। আমি আপনাদের বলে রাখি যে, আমি বইয়ের কট্টর পক্ষপাতী। আমি বই
পড়ি, বই লিখি এবং বাংলা একাডেমি বোধহয় এ কথা অনুমান করেই আমাকে বলার সুযোগ
দিয়েছে, এই লোকটি বইয়ের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলবে না। চিন্তা করবেন না, আমি এ
রকম কোনো কথা বলব না। আসলে আমি অত বড় বইয়ের পোকা নই যে, বইয়ের নিন্দা কখনও
আমার কর্ণগোচর হয়নি। তাই বই জিনিসটা কী আর কী নয় সেটা ভাবতে গেলে বইয়ের
নিন্দুকদের বিতর্ক একটু আলোচনা করে দেখা যেতে পারে। তো প্রথম নিন্দা এ হতে
পারে_ বই জিনিসটা শুধু কাগুজে জ্ঞানের বাহক। বই কাগজে পাণ্ডিত্য দেখাতে
পারে বটে। কিন্তু সে সব কাগুজে কথা। কাগুজে কিতাবের মতোই নকল। আসল জ্ঞান
অর্জন করতে হলে বই নয়, জীবনই আমাদের পরশমণি। এই নিন্দা খণ্ডন করা কিন্তু
সহজ। কারণ বইয়ের সম্ভাবনা তো অনেক। আপনারা বই কিনে সেটা তাকে রাখতে পারেন
পাণ্ডিত্য দেখানোর জন্য অথবা একদিন পড়বেন বলে। কেনা বই বাড়ির কাউকে এনে
দিতে পারেন মনোরঞ্জনের জন্য অথবা একটা বই কিনে আপনারা খুব মন দিয়ে পড়তে
পারেন। হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে বই আর কাগুজে জিনিস থাকে না। সেটা
এই পড়ার প্রক্রিয়ার মধ্যেই অন্য কিছু হয়ে যায়। এমন একটা প্রক্রিয়া যেটা
মানুষকে বদলাতে পারে। কিন্তু এমন গভীর পাঠেরও একটা সীমানা আছে। ২শ' বছর হলো
জার্মানির প্রখ্যাত লেখক ইয়োহান উলফ গ্যাঙ ফন গেঁ্যটে একটা উপন্যাস লেখেন,
দি সরোজ অব ইয়াং ওয়ার্থার। অর্থাৎ তরুণ ওয়ার্থারের দুঃখ। সেই উপন্যাসটা
পড়ে আমার দেশের তরুণরা আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছিল। এমন করতে আমি কাউকে
পরামর্শ দেব না। মূল কথা আসলে বই যে কী সে সিদ্ধান্তটা অনেকটা আমাদের হাতে।
দ্বিতীয় নিন্দা, আজকাল অনেককে বলতে শোনা যাচ্ছে, বই ব্যাপারটা সেকেলে হয়ে পড়েছে। একদিকে আমরা অনেকে শিখে এসেছি যে, বই শিক্ষার প্রধান মাধ্যম এবং উন্নতির সোপান। বই আমাদের সামনে এগিয়ে দেয়। উর্দু শায়ের মির্জা গালিবের একটা কথা আছে_ এক কিতাব, এক কদম। অর্থাৎ একটি নতুন বই একটি পদক্ষেপ।
বাঙালি পাঠকদের মনে থাকতে পারে যে, উনিশ শতকে উপন্যাস পড়া কত যুগান্তকারী ঘটনা হতে পারত। বিশেষ করে মেয়েদের পক্ষে। যেমন রবীন্দ্রনাথের নষ্টনীড় গল্পের সন্ধিক্ষণে যখন চারুলতা লুকিয়ে লুকিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ উপন্যাসটি পড়ছে এবং সেই পড়াটা তার স্বামীর কাছে ধরা পড়ে। এগুলো তো পুরনো কথা। আজকাল দূরদর্শন, ইন্টারনেট, ভিসিডি ইত্যাদি জরাগ্রস্ত পুস্তকের জায়গা পুরোপুরি দখল করে নেয়নি তো! এখানে বলা দরকার যে, বই কেবল একটা কাগজের জিনিস না। বই একটা মাধ্যম বিশেষ। সাহিত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে এমন তো কথা নেই। বাংলার কথা ভাবতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই যে, মোহাম্মদ সগীর যখন ইউসুফ জোলেখা লেখেন অথবা আলাওল তার পদ্মাবতী। ওই সময় তো ছাপাখানা ছিল না এবং বেশিরভাগ লোক তো পুঁথি বা পাণ্ডুলিপি পড়ে নয় বরং আবৃত্তি বা গান শুনে সাহিত্যের রস আস্বাদন করত। তাই আজকাল যদি বইয়ের আশপাশে আরও নানা বিকল্প মাধ্যম সাহিত্যের শেকড় হতে উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তাতে মন্দই বা কী।
আমার অন্তত মনে হয় যে, অন্যান্য মাধ্যম থাকতেও বইয়ের একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে যেটা তাকে বিশিষ্ট এবং স্বাতন্ত্র্য করে দেয়। তাই আমি মনে করি যে, বই থাকবেই থাকবে। বইমেলা থাকবেই থাকবে।
এই বাংলা বইমেলা আবার বিদেশের মতো মামুলি বইমেলার মতো নয়। তার একটা আলাদা চরিত্র রয়েছে। একটি অসামান্য কবিতার কিছু পদ আবৃত্তি করে আপনারা বুঝতে পারবেন আমার অভিপ্রায়টা কি।
'দোকানে অপেক্ষা করি। প্রতীক্ষা সুদীর্ঘ হ'লে বলি,
নিজেকেই বলি, তুমি এই কোণে জীবনানন্দের
হরিণ মুখস্থ করো, দ্যাখো এ দোকান নিমেষেই
আচ্ছাদিত আগাগোড়া ওডেসির পাতায় পাতায়।
কখন যে দোকানের অভ্যন্তরে আরেক দোকান
জেগে ওঠে সপ্তবর্ণ কলরব নিয়ে। সে দোকানে
কোনো দ্রব্য নেই, তবু কেমন প্রোজ্জ্বল প্রদর্শনী_
কিন্নরের কণ্ঠে শুনি সেলসম্যানের শব্দাবলি,
জলকন্যা কাউন্টারে মূল্য তালিকার চতুস্পাশর্ে্ব
তোলে সমুদ্রের সুর। গ্রাহকেরা বন্দনা-মুখর।'
এটা শামসুর রাহমানের একটি কবিতার শেষ অংশ। আর এটা শুধু বাংলা বইমেলার প্রাঙ্গণেই সম্ভব যে একজন কবি বইমেলার কোণে বসে তার পূর্বগামী জীবনানন্দ দাশের অথবা গ্রিক মহাকবি হোমারের কবিতা পড়ছেন। এ রকম নিবিষ্ট দৃশ্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলায়ও সম্ভব নয়। কারণ ওখানে বাণিজ্য ও বিপণনই প্রধান এবং কবিতা অনেকটা কোণঠাসা হয়ে থাকে।
মোদ্দা কথা এই যে, এই বইমেলার পরিবেশই তাকে আলাদা করে দেয়। কিন্তু শুধু তাও নয়। ঢাকার বইমেলার আরেকটা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেটা তাকে অসাধারণ করে তোলে। আমি যে সূত্র ধরে কথাটা বলছি সেটা হলো এই যে, এই বাংলাদেশ থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়েছে। ভাষা ব্যবহারকারীর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলা আজ পৃথিবীর ষষ্ঠ বা সপ্তম ভাষা। আর আন্তর্জাতিক স্তরেও মাতৃভাষা দিবস আমাদের বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দিতে থাকে বাংলাদেশের মানুষের নিজের ভাষার জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম এবং মাতৃভাষা মাত্রেরই আপন গুরুত্ব। ভাষাই মানুষের যথার্থ আবাসন_ এ কথা বলেছেন একজন জার্মান দার্শনিক। আর তা যদি হয় তাহলে ভাষাকে খাতির করা, যত্ন করা আমাদের কর্তব্য। বিশেষ করে এই গোলকায়নের আমলে যখন অনেকে মনে করেন যে, ইংরেজির মতো একটা বিশ্ব ভাষার বাড়বাড়ন্ত সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস প্লাবিত করে দিচ্ছে। তখন হয় বাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে থাকতে হবে, না হয় সমুদ্রে ডুব দিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হবে। কিন্তু না। আমরা জানি যে এ দুটির কোনোটাই করা যাবে না_ বসে থাকা চলবে না, আর ডুবে মরাও চলবে না। এমন পরিস্থিতিতে মাতৃভাষা বাংলাকে সম্মান দেওয়ার মানেই বা কী। একটা ভাষাকে জাতিবিশেষের সম্পদ মনে করা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি মনে করি যে, বিশ্ব দর্শনে আসলে প্রত্যেকটি ভাষার এটা দায়িত্ব। আর আসলে একটা ভাষা কতটা আপন কতটা পর। আর পরকে আপন করাও ভাষার একটা কাজ। সুতরাং, অন্য ভাষা বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। কিছুটা দ্বিভাষিক হওয়া কেবল বাঙালিদের কেন, জার্মানদেরও দরকার। কিন্তু দ্বিভাষিক হতে হলেও মাতৃভাষাকে অবহেলা না করে তাকে মজবুত এবং এই বিশ্ব দর্শনের উপযোগী করে তোলা আমাদের কাজ। ভাষা দরজা-জানালা খুলে রাখুক। গ্রহণ করুক উদারভাবে। কিন্তু আগন্তুক ভাষায় প্লাবিত না হয়ে সমৃদ্ধ হোক। আর সমৃদ্ধ তখনি হবে যখন আমরা তাকে নতুন কল্পনা-চিন্তাধারা থেকে বঞ্চিত না করে তাকে সমৃদ্ধ করব, যত্ন করব। আমার শিক্ষক, গুরু, বন্ধু কবি অলোক চন্দ্র দাশগুপ্ত যেমন বলেছেন, মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে বিশ্ব ভাষার অনুশীলন আমাদের সংকীর্ণ জাতীয়তাবোধ থেকে মুক্ত করে। বাংলারও যে এমন একটা খোলা বাড়ি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, ক্ষমতা ও শক্তি রয়েছে তার সবচেয়ে সুন্দর প্রমাণ ও নিদর্শন আপনাদের এ বইমেলা। আর বীজমন্ত্র জুগিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ তার বিখ্যাত একটা গানে_ ও আমার দেশের মাটি, তোমার 'পরে ঠেকাই মাথা।/ তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা...।
নির্বাহী পরিচালক, সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট, হেইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটি, জার্মানি
১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলায় প্রদত্ত বক্তব্য
দ্বিতীয় নিন্দা, আজকাল অনেককে বলতে শোনা যাচ্ছে, বই ব্যাপারটা সেকেলে হয়ে পড়েছে। একদিকে আমরা অনেকে শিখে এসেছি যে, বই শিক্ষার প্রধান মাধ্যম এবং উন্নতির সোপান। বই আমাদের সামনে এগিয়ে দেয়। উর্দু শায়ের মির্জা গালিবের একটা কথা আছে_ এক কিতাব, এক কদম। অর্থাৎ একটি নতুন বই একটি পদক্ষেপ।
বাঙালি পাঠকদের মনে থাকতে পারে যে, উনিশ শতকে উপন্যাস পড়া কত যুগান্তকারী ঘটনা হতে পারত। বিশেষ করে মেয়েদের পক্ষে। যেমন রবীন্দ্রনাথের নষ্টনীড় গল্পের সন্ধিক্ষণে যখন চারুলতা লুকিয়ে লুকিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ উপন্যাসটি পড়ছে এবং সেই পড়াটা তার স্বামীর কাছে ধরা পড়ে। এগুলো তো পুরনো কথা। আজকাল দূরদর্শন, ইন্টারনেট, ভিসিডি ইত্যাদি জরাগ্রস্ত পুস্তকের জায়গা পুরোপুরি দখল করে নেয়নি তো! এখানে বলা দরকার যে, বই কেবল একটা কাগজের জিনিস না। বই একটা মাধ্যম বিশেষ। সাহিত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে এমন তো কথা নেই। বাংলার কথা ভাবতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই যে, মোহাম্মদ সগীর যখন ইউসুফ জোলেখা লেখেন অথবা আলাওল তার পদ্মাবতী। ওই সময় তো ছাপাখানা ছিল না এবং বেশিরভাগ লোক তো পুঁথি বা পাণ্ডুলিপি পড়ে নয় বরং আবৃত্তি বা গান শুনে সাহিত্যের রস আস্বাদন করত। তাই আজকাল যদি বইয়ের আশপাশে আরও নানা বিকল্প মাধ্যম সাহিত্যের শেকড় হতে উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তাতে মন্দই বা কী।
আমার অন্তত মনে হয় যে, অন্যান্য মাধ্যম থাকতেও বইয়ের একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে যেটা তাকে বিশিষ্ট এবং স্বাতন্ত্র্য করে দেয়। তাই আমি মনে করি যে, বই থাকবেই থাকবে। বইমেলা থাকবেই থাকবে।
এই বাংলা বইমেলা আবার বিদেশের মতো মামুলি বইমেলার মতো নয়। তার একটা আলাদা চরিত্র রয়েছে। একটি অসামান্য কবিতার কিছু পদ আবৃত্তি করে আপনারা বুঝতে পারবেন আমার অভিপ্রায়টা কি।
'দোকানে অপেক্ষা করি। প্রতীক্ষা সুদীর্ঘ হ'লে বলি,
নিজেকেই বলি, তুমি এই কোণে জীবনানন্দের
হরিণ মুখস্থ করো, দ্যাখো এ দোকান নিমেষেই
আচ্ছাদিত আগাগোড়া ওডেসির পাতায় পাতায়।
কখন যে দোকানের অভ্যন্তরে আরেক দোকান
জেগে ওঠে সপ্তবর্ণ কলরব নিয়ে। সে দোকানে
কোনো দ্রব্য নেই, তবু কেমন প্রোজ্জ্বল প্রদর্শনী_
কিন্নরের কণ্ঠে শুনি সেলসম্যানের শব্দাবলি,
জলকন্যা কাউন্টারে মূল্য তালিকার চতুস্পাশর্ে্ব
তোলে সমুদ্রের সুর। গ্রাহকেরা বন্দনা-মুখর।'
এটা শামসুর রাহমানের একটি কবিতার শেষ অংশ। আর এটা শুধু বাংলা বইমেলার প্রাঙ্গণেই সম্ভব যে একজন কবি বইমেলার কোণে বসে তার পূর্বগামী জীবনানন্দ দাশের অথবা গ্রিক মহাকবি হোমারের কবিতা পড়ছেন। এ রকম নিবিষ্ট দৃশ্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলায়ও সম্ভব নয়। কারণ ওখানে বাণিজ্য ও বিপণনই প্রধান এবং কবিতা অনেকটা কোণঠাসা হয়ে থাকে।
মোদ্দা কথা এই যে, এই বইমেলার পরিবেশই তাকে আলাদা করে দেয়। কিন্তু শুধু তাও নয়। ঢাকার বইমেলার আরেকটা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেটা তাকে অসাধারণ করে তোলে। আমি যে সূত্র ধরে কথাটা বলছি সেটা হলো এই যে, এই বাংলাদেশ থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়েছে। ভাষা ব্যবহারকারীর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলা আজ পৃথিবীর ষষ্ঠ বা সপ্তম ভাষা। আর আন্তর্জাতিক স্তরেও মাতৃভাষা দিবস আমাদের বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দিতে থাকে বাংলাদেশের মানুষের নিজের ভাষার জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম এবং মাতৃভাষা মাত্রেরই আপন গুরুত্ব। ভাষাই মানুষের যথার্থ আবাসন_ এ কথা বলেছেন একজন জার্মান দার্শনিক। আর তা যদি হয় তাহলে ভাষাকে খাতির করা, যত্ন করা আমাদের কর্তব্য। বিশেষ করে এই গোলকায়নের আমলে যখন অনেকে মনে করেন যে, ইংরেজির মতো একটা বিশ্ব ভাষার বাড়বাড়ন্ত সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস প্লাবিত করে দিচ্ছে। তখন হয় বাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে থাকতে হবে, না হয় সমুদ্রে ডুব দিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হবে। কিন্তু না। আমরা জানি যে এ দুটির কোনোটাই করা যাবে না_ বসে থাকা চলবে না, আর ডুবে মরাও চলবে না। এমন পরিস্থিতিতে মাতৃভাষা বাংলাকে সম্মান দেওয়ার মানেই বা কী। একটা ভাষাকে জাতিবিশেষের সম্পদ মনে করা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি মনে করি যে, বিশ্ব দর্শনে আসলে প্রত্যেকটি ভাষার এটা দায়িত্ব। আর আসলে একটা ভাষা কতটা আপন কতটা পর। আর পরকে আপন করাও ভাষার একটা কাজ। সুতরাং, অন্য ভাষা বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। কিছুটা দ্বিভাষিক হওয়া কেবল বাঙালিদের কেন, জার্মানদেরও দরকার। কিন্তু দ্বিভাষিক হতে হলেও মাতৃভাষাকে অবহেলা না করে তাকে মজবুত এবং এই বিশ্ব দর্শনের উপযোগী করে তোলা আমাদের কাজ। ভাষা দরজা-জানালা খুলে রাখুক। গ্রহণ করুক উদারভাবে। কিন্তু আগন্তুক ভাষায় প্লাবিত না হয়ে সমৃদ্ধ হোক। আর সমৃদ্ধ তখনি হবে যখন আমরা তাকে নতুন কল্পনা-চিন্তাধারা থেকে বঞ্চিত না করে তাকে সমৃদ্ধ করব, যত্ন করব। আমার শিক্ষক, গুরু, বন্ধু কবি অলোক চন্দ্র দাশগুপ্ত যেমন বলেছেন, মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে বিশ্ব ভাষার অনুশীলন আমাদের সংকীর্ণ জাতীয়তাবোধ থেকে মুক্ত করে। বাংলারও যে এমন একটা খোলা বাড়ি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, ক্ষমতা ও শক্তি রয়েছে তার সবচেয়ে সুন্দর প্রমাণ ও নিদর্শন আপনাদের এ বইমেলা। আর বীজমন্ত্র জুগিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ তার বিখ্যাত একটা গানে_ ও আমার দেশের মাটি, তোমার 'পরে ঠেকাই মাথা।/ তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা...।
নির্বাহী পরিচালক, সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট, হেইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটি, জার্মানি
১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলায় প্রদত্ত বক্তব্য
No comments