‘রাজনীতি কম’ by মিজানুর রহমান খান
সমস্যা
চিহ্নিত। কিন্তু আমরা বের হতে পারি না। বাংলাদেশের মানুষ কি সত্যি
রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছে? যদি নিত তাহলে যার মুখে যা সাজে না,
সেসব কথা বলা সম্ভব হয় কী করে? (প্রথম আলো, ৪ ও ৭ ফেব্রুয়ারি, পৃ. ১)
দেশের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তার মুখেও বিনা বিচারে হত্যার বোল ফুটল। এটা
গণতন্ত্রের ঘাটতি, নাকি রাজনীতির ঘাটতি?
ওয়াশিংটনভিত্তিক পিউ গবেষণাকেন্দ্রের ‘২০১৪ বৈশ্বিক আচরণ সমীক্ষা’ অনুযায়ী রাজনীতি-সংশ্লিষ্টতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ৩৩টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে প্রথম স্থান দখল করেছে। এটা সুসংবাদ হলে আমাদের কেন এত দৈন্য? আমরা কিছুকালের বিরতিতে কেন পুনঃপুন খাদের কিনারে পৌঁছে যাই? পিউ প্রতিটি দেশে কমবেশি এক হাজার লোকের ওপর এই সমীক্ষা চালায়। ফলাফলটা বিস্ময়কর। অঞ্চল হিসেবে গণতন্ত্রে পিছিয়ে থাকা মধ্যপ্রাচ্য ৫৩ ও আফ্রিকা ৪৪ পেয়ে রাজনীতিতে শীর্ষ অংশগ্রহণকারী অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। রাজনীতিতে লাতিন আমেরিকা ৩১ ও এশীয়দের অংশগ্রহণ সবচেয়ে কম (২৪ শতাংশ)। এর মধ্যে দেশ হিসেবে ৬৫ শতাংশ পেয়ে বাংলাদেশিরাই শ্রেষ্ঠ রাজনীতিসচেতন ব্যক্তির মর্যাদা পেয়েছে। এটা প্রমাণ করে যে ভোট দেখলেই পড়িমরি ভোটকেন্দ্রে ছুটে যাওয়া, প্রতিবাদ কর্মসূচিতে, ধর্মঘটে অংশ নিতে জানা আর গণতান্ত্রিক সমাজের বাসিন্দা হতে পারা এক নয়। তাই এই শীর্ষ হতে পারাটা সুসংবাদ নাকি দুসংবাদ, সেটা ভাবতে হচ্ছে।
সচিব থেকে শিক্ষাবিদ হওয়া একজন বিদগ্ধ নাগরিক আমাকে এই লেখাটির রসদ জুগিয়েছেন। তাঁর রসবোধ প্রখর। তিনি পিউ-র সমীক্ষার ফল দেখে অমিতাভ বচ্চনের চিনি কম-এর আদলে এই লেখার শিরোনাম ‘রাজনীতি কম’ রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। কীভাবে চিনি কম, সে কথায় পরে আসছি।
র্যাবের মহাপরিচালকের পদে এসে হঠাৎ উচ্চকিত বেনজীর আহমেদের ‘হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আইনি প্রতিশোধ’ এবং পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলামের ‘একটি লাশ পড়লে দুটি লাশ ফেলা’ ইত্যাদি ধরনের মন্তব্য, যা সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণবিধির সরাসরি লঙ্ঘন, সেসব তাঁকে বিচলিত করেছে। ‘নিজ অধিক্ষেত্রের বিষয়’ নয় বলে তিনি নিজে না লিখে আমাকে তাঁর ভাবনা ধার দিয়েছেন। আর এটা নির্দেশ করে যে দেশের বিরাজমান জরুরি পরিস্থিতি নিতান্ত রাজনীতি নিরাসক্ত মানুষকেও স্পর্শ করছে। তাঁরা আর নিস্পৃহ থাকতে পারছেন না।
ওই শিক্ষাবিদের প্রশ্ন যথার্থ যে এমন একটি রাজনীতিসচেতন চ্যাম্পিয়ন দেশে ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচন হয় কীভাবে? সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৫৪ জন সাংসদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন কীভাবে? বিএনপি কী করে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ভীতিকর অবরোধ, হরতাল ডেকে নাগরিক জীবন বিষিয়ে তুলতে পারে? জীবন্ত দগ্ধ ও পীড়িতের আহাজারি এদের কারোরই কানে কেন পৌঁছাচ্ছে না? তবে কি অতিমাত্রায় রাজনীতিসচেতনতাই আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে?
দীর্ঘদিন থেকেই শিক্ষক, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক নির্বিশেষে সবাই নিজের পেশায় থেকে রাজনীতি করেন—সাদা দল, নীল দল, স্বাচিপ, ড্যাব, অ্যাব, সাংবাদিক ইউনিয়ন, প্রেসক্লাব, আইনজীবী, উলামা সমিতি—সবাই আজ অপরাজনীতির পরিচয়ে দ্বিধাবিভক্ত। কে কোন পদে থাকবেন বা থাকবেন না, সেটা আজ আর পেশাজীবীর হাতে নেই। সার্বিকভাবে আমাদের সমাজ আজ অভিভাবকহীন। আগে তবু কিছু দল-বিবর্জিত পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ছিলেন। সংকটে জাতি তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকত। দুর্দিনের সময় যাওয়ার মতো আমাদের জন্য কোনো জায়গা অবশিষ্ট নেই। আমরাই তা রাখিনি। প্রত্যেকের ললাটে একটা সিল মেরে দিতে আমরা ইতিমধ্যে নিপুণ হন্তারক হয়ে উঠেছি। শ্রদ্ধাভাজন সাবেক প্রধান বিচারপতিসহ এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা স্বেচ্ছা গৃহবন্দিত্বকে শ্রেয় মনে করছেন। তাঁরা আমাদের আলোকিত সমাবেশগুলোতে অস্পৃশ্য হিসেবে অনুপস্থিত।
পেশাজীবীরা উর্বর মস্তিষ্ক হওয়া সত্ত্বেও এটা ঘটে কেন? জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞানী দীপঙ্কর গুপ্তের মতে, ‘মগজধারীরা দুই ধরনের হয়ে থাকেন—বড় এবং ছোট। ছোট মগজধারীরা ভাবাদর্শিক হন, তাঁরা রাজনীতি করে বাঁচেন এবং সব সময়ই মঞ্চের কেন্দ্রে অবস্থানের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন। বড় মগজধারীরা বুদ্ধিজীবী, তাঁরা সমাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে
থাকেন, কিন্তু রাজনীতির চৌহদ্দির বাইরে অবস্থান নেন। প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর কাছে দলীয় রাজনীতি সেই নিষিদ্ধ আপেল, যাতে তিনি কখনোই কামড় দেন না।’ রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবী এডওয়ার্ড সাঈদ অত্যন্ত আবেগের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের দাবি তুলে ধরেছেন। কিন্তু পিএলওতে যোগদানের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের সপক্ষে অবিচল আছি। কিন্তু তাই বলে দলীয় সদস্যপদ গ্রহণ কখনোই নয়।’ নোয়াম চমস্কির বেশির ভাগ লেখাই রাজনীতি নিয়ে। কিন্তু তিনি কোনো দলের নন। আমরা সম্ভবত পণ করেছি, এ রকম কাউকে হতে দেব না। বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা যাঁর থাকবে, আমরা তাঁকে কালির পোঁচ দিতে ওত পেতে থাকব।
পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের পক্ষপাত ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। দলীয় সহিংসতার চেয়ে এর ক্ষতিকর প্রভাব কম ভয়ংকর নয়। বিএনপি জনতার মঞ্চের কুশীলবদের বিচার করতে ইচ্ছা করে ব্যর্থ থেকেছে, কারণ তারও মনের গহিনে পাপ বাসা বেঁধেছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার রাজনৈতিক বক্তব্যে তাই সত্যিই বিস্ময়ের কিছু নেই। সরকারি ও বেসরকারি মহলের দূরত্ব ঘুচে যাচ্ছে। আবারও দীপঙ্কর গুপ্তের শরণাপন্ন হতে হয়: ‘একজন সেনাপ্রধান দলীয় প্রচারবিদ হবেন, এটা কেউ আশা করেন না, তেমনটি আশা করা যায় না একজন পুলিশ, বিচারক কিংবা ধর্মগুরুর কাছে। এর কারণ হচ্ছে, তাঁদের পেশাগুলো যতটা না ব্যক্তিস্বার্থনির্ভর, তারচেয়ে বেশি সামাজিক দায়সম্পন্ন।’ কিন্তু কি সরকারি আর কি বেসরকারি, কোনো পেশাজীবীর ‘সামাজিক দায়বোধ’ হয়তো আর সামান্যই অবশিষ্ট আছে।
দলীয় রাজনীতি আজ আর দেশের ভূখণ্ডে সীমিত নেই। সিডনি অমুক দল, ফিনল্যান্ড তমুক লীগ—এসব দলাদলি তো আছেই। এখন তাঁরা বিজেপি সভাপতির কথিত ফোনে স্বাস্থ্যকুশল জানা বড় মুখ করে বলে দেশের মুখ ছোট করেন, কেউ মার্কিন রাজনীতিকদের নামে ভুয়া বিবৃতি প্রচার করেন; আবার কেউ জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের নামে বিদেশে রাস্তার নামকরণের প্রতিবাদে কোর্ট-কাছারি করেন। দেশের রাষ্ট্রদূতও এতে যোগ দেন! বিদেশে কর্মরত আমাদের কূটনীতিকদের এসব লীগ ও দলের মন জুগিয়ে চলতে হয় বলে শোনা যায়। ব্রিটেনের সাউদাম্পটনে একদল প্রবাসী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমেছেন। পিউ-র সমীক্ষায় সেরা রাজনীতিসচেতন দেশ বলে বিশ্বে আমরাই হয়তো একমাত্র প্রবাসী, যারা হিংসাশ্রয়ী দলাদলির জীবাণু রপ্তানি করতে পেরেছি। ভাগ্যিস ভিনদেশি কেউ আজতক আক্রান্ত হননি!
অথচ, ভারতীয় প্রবাসীদের কথাই ধরুন। তাঁরা জগৎসেরা পুরস্কার ও স্বীকৃতি পাচ্ছেন। ঝুম্পা লাহিড়ী ও সিদ্ধার্থ মুখার্জি তো পুলিৎজারজয়ী। মার্কিন সিনেট, প্রতিনিধি পরিষদ, গভর্নর, প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয়, চিকিৎসালয়, মহাকাশ গবেষণা, কোথায় তাঁরা নেই? ববি জিন্দাল লুইজিয়ানার গভর্নর, সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী! দলীয় রাজনীতি না করেও প্রবাসী ভারতীয়রা তাঁদের প্রভাবের কারণে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে ভারতের অনুকূলে আনতে সক্ষম হয়েছেন। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও কি তাঁদের মেধা ও শ্রম দিয়ে দেশের জন্য এ ধরনের অবদান রাখতে পারেন না?
সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চন অভিনীত একটি ব্যবসাসফল ছবির নাম চিনি কম। অসম বয়সী প্রেমের কাহিনিসংবলিত এ ছবির নায়িকা টাবু ছবিতে মালিক ও শেফ অমিতাভের লন্ডনের রেস্টুরেন্টে হায়দরাবাদী জাফরানি পোলাও খেতে ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু মনমতো না হওয়ায় অভুক্ত থেকে খাবার ফেরত দেন। এতে গর্বিত শেফ অমিতাভের আঁতে লাগে। খাবারের কী সমস্যা জানতে চাইলে টাবু বলেন, ‘হায়দরাবাদী জাফরানি পোলাও’ এতটা মিষ্টি হওয়ার কথা নয়। অমিতাভ রান্নাঘরে গিয়ে দেখতে পান যে দেশে পরিবারের চিন্তায় অন্যমনস্ক পাচক লবণের বদলে পুনরায় চিনি দেয়। বিপত্তি ঘটে এ কারণেই। তারপর যথারীতি বলিউডের কায়দায় প্রেম, প্রতিবন্ধকতা ও শুভমিলন। এ থেকেই ছবির নাম চিনি কম। আজ আমাদের রাজনীতিও অতিমাত্রার কারণে, গৌরবময় ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও, চিনি কম ছবির হায়দরাবাদী জাফরানি পোলাওয়ের মতো অখাদ্যে পরিণত হয়েছে।
সাবেক ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজ ‘রাজনীতি কম’-এর প্রবক্তা। তাঁর কথায় রাজনীতি বিষয়ে আমাদের মিতব্যয়ী হতে হবে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার সঙ্গে তুলনা করলে অনেকে রাগ করেন। কিন্তু দেখুন ওই চারটি অঞ্চলের মধ্যে এশিয়ায় ‘রাজনীতি কম’ বলে এখানেই তুলনামূলক গণতন্ত্র বেশি। সমাজসেবক জর্জ সোরোসের সঙ্গে সংলাপে শিমন পেরেজ বলেছিলেন, ‘যখন কোনো জাতি রাজনীতি নিয়ে পড়ে না থেকে রাজনীতি থেকে অর্থনৈতিক যাত্রায় শরিক হয়, তখন তারা আসলে বৈরিতা থেকে শান্তির পথে যায়। শেষ যুদ্ধের পরে ইউরোপে তা-ই ঘটেছে। তারা শান্তি পেয়েছে, কারণ কমবেশি তারা জাতীয় রাজনীতিকে পেছনে ঠেলতে পেরেছে। (লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস, ৯ মে ১৯৯৮)
পিউ সমীক্ষা বলছে, এশিয়ায় ভারতসহ সাত দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি নেতাদের ভাষণ শোনেন (৪৮ শতাংশ), সর্বাধিক মানুষ সক্রিয় দলীয় কর্মী (৩২ শতাংশ)। সেরা হরতালকারীর আসনটিও (৩১ শতাংশ) শুধু আমাদেরই করায়ত্ত, এমনকি ৩৩ দেশের মধ্যে হরতাল পালনে আমাদের ওপরে কেবল মিসর আছে। তাই পরিশেষে, অমিতাভ অভিনীত ছবির নাম চিনি কম অথবা বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ শিমন পেরেজের রাজনীতি বিষয়ে মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বানের অনুকরণে বলি, ‘রাজনীতি কম’।
রাজনীতি আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। কিন্তু অতিমাত্রায় রাজনীতির কারণে, আজ এসব অর্জন হুমকির সম্মুখীন। আমরা বিরাজনীতিকরণের কথা বলছি না। কেবল দলীয় রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের হাতেই রাখতে বলছি। দলীয় রাজনীতি দেশের ভূখণ্ডে সীমিত রাখার বিষয়ে বলছি। পেশাজীবীদের দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে অথচ সমাজমনস্ক থাকার কথা বলছি; দেশের দুর্দিনে জাতির আশ্রয় হওয়ার কথা বলছি। সর্বত্র, সবার দলীয় রাজনীতি করার কোনো প্রয়োজন নেই।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
ওয়াশিংটনভিত্তিক পিউ গবেষণাকেন্দ্রের ‘২০১৪ বৈশ্বিক আচরণ সমীক্ষা’ অনুযায়ী রাজনীতি-সংশ্লিষ্টতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ৩৩টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে প্রথম স্থান দখল করেছে। এটা সুসংবাদ হলে আমাদের কেন এত দৈন্য? আমরা কিছুকালের বিরতিতে কেন পুনঃপুন খাদের কিনারে পৌঁছে যাই? পিউ প্রতিটি দেশে কমবেশি এক হাজার লোকের ওপর এই সমীক্ষা চালায়। ফলাফলটা বিস্ময়কর। অঞ্চল হিসেবে গণতন্ত্রে পিছিয়ে থাকা মধ্যপ্রাচ্য ৫৩ ও আফ্রিকা ৪৪ পেয়ে রাজনীতিতে শীর্ষ অংশগ্রহণকারী অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। রাজনীতিতে লাতিন আমেরিকা ৩১ ও এশীয়দের অংশগ্রহণ সবচেয়ে কম (২৪ শতাংশ)। এর মধ্যে দেশ হিসেবে ৬৫ শতাংশ পেয়ে বাংলাদেশিরাই শ্রেষ্ঠ রাজনীতিসচেতন ব্যক্তির মর্যাদা পেয়েছে। এটা প্রমাণ করে যে ভোট দেখলেই পড়িমরি ভোটকেন্দ্রে ছুটে যাওয়া, প্রতিবাদ কর্মসূচিতে, ধর্মঘটে অংশ নিতে জানা আর গণতান্ত্রিক সমাজের বাসিন্দা হতে পারা এক নয়। তাই এই শীর্ষ হতে পারাটা সুসংবাদ নাকি দুসংবাদ, সেটা ভাবতে হচ্ছে।
সচিব থেকে শিক্ষাবিদ হওয়া একজন বিদগ্ধ নাগরিক আমাকে এই লেখাটির রসদ জুগিয়েছেন। তাঁর রসবোধ প্রখর। তিনি পিউ-র সমীক্ষার ফল দেখে অমিতাভ বচ্চনের চিনি কম-এর আদলে এই লেখার শিরোনাম ‘রাজনীতি কম’ রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। কীভাবে চিনি কম, সে কথায় পরে আসছি।
র্যাবের মহাপরিচালকের পদে এসে হঠাৎ উচ্চকিত বেনজীর আহমেদের ‘হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আইনি প্রতিশোধ’ এবং পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলামের ‘একটি লাশ পড়লে দুটি লাশ ফেলা’ ইত্যাদি ধরনের মন্তব্য, যা সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণবিধির সরাসরি লঙ্ঘন, সেসব তাঁকে বিচলিত করেছে। ‘নিজ অধিক্ষেত্রের বিষয়’ নয় বলে তিনি নিজে না লিখে আমাকে তাঁর ভাবনা ধার দিয়েছেন। আর এটা নির্দেশ করে যে দেশের বিরাজমান জরুরি পরিস্থিতি নিতান্ত রাজনীতি নিরাসক্ত মানুষকেও স্পর্শ করছে। তাঁরা আর নিস্পৃহ থাকতে পারছেন না।
ওই শিক্ষাবিদের প্রশ্ন যথার্থ যে এমন একটি রাজনীতিসচেতন চ্যাম্পিয়ন দেশে ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচন হয় কীভাবে? সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৫৪ জন সাংসদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন কীভাবে? বিএনপি কী করে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ভীতিকর অবরোধ, হরতাল ডেকে নাগরিক জীবন বিষিয়ে তুলতে পারে? জীবন্ত দগ্ধ ও পীড়িতের আহাজারি এদের কারোরই কানে কেন পৌঁছাচ্ছে না? তবে কি অতিমাত্রায় রাজনীতিসচেতনতাই আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে?
দীর্ঘদিন থেকেই শিক্ষক, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক নির্বিশেষে সবাই নিজের পেশায় থেকে রাজনীতি করেন—সাদা দল, নীল দল, স্বাচিপ, ড্যাব, অ্যাব, সাংবাদিক ইউনিয়ন, প্রেসক্লাব, আইনজীবী, উলামা সমিতি—সবাই আজ অপরাজনীতির পরিচয়ে দ্বিধাবিভক্ত। কে কোন পদে থাকবেন বা থাকবেন না, সেটা আজ আর পেশাজীবীর হাতে নেই। সার্বিকভাবে আমাদের সমাজ আজ অভিভাবকহীন। আগে তবু কিছু দল-বিবর্জিত পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ছিলেন। সংকটে জাতি তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকত। দুর্দিনের সময় যাওয়ার মতো আমাদের জন্য কোনো জায়গা অবশিষ্ট নেই। আমরাই তা রাখিনি। প্রত্যেকের ললাটে একটা সিল মেরে দিতে আমরা ইতিমধ্যে নিপুণ হন্তারক হয়ে উঠেছি। শ্রদ্ধাভাজন সাবেক প্রধান বিচারপতিসহ এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা স্বেচ্ছা গৃহবন্দিত্বকে শ্রেয় মনে করছেন। তাঁরা আমাদের আলোকিত সমাবেশগুলোতে অস্পৃশ্য হিসেবে অনুপস্থিত।
পেশাজীবীরা উর্বর মস্তিষ্ক হওয়া সত্ত্বেও এটা ঘটে কেন? জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞানী দীপঙ্কর গুপ্তের মতে, ‘মগজধারীরা দুই ধরনের হয়ে থাকেন—বড় এবং ছোট। ছোট মগজধারীরা ভাবাদর্শিক হন, তাঁরা রাজনীতি করে বাঁচেন এবং সব সময়ই মঞ্চের কেন্দ্রে অবস্থানের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন। বড় মগজধারীরা বুদ্ধিজীবী, তাঁরা সমাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে
থাকেন, কিন্তু রাজনীতির চৌহদ্দির বাইরে অবস্থান নেন। প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর কাছে দলীয় রাজনীতি সেই নিষিদ্ধ আপেল, যাতে তিনি কখনোই কামড় দেন না।’ রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবী এডওয়ার্ড সাঈদ অত্যন্ত আবেগের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের দাবি তুলে ধরেছেন। কিন্তু পিএলওতে যোগদানের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের সপক্ষে অবিচল আছি। কিন্তু তাই বলে দলীয় সদস্যপদ গ্রহণ কখনোই নয়।’ নোয়াম চমস্কির বেশির ভাগ লেখাই রাজনীতি নিয়ে। কিন্তু তিনি কোনো দলের নন। আমরা সম্ভবত পণ করেছি, এ রকম কাউকে হতে দেব না। বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা যাঁর থাকবে, আমরা তাঁকে কালির পোঁচ দিতে ওত পেতে থাকব।
পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের পক্ষপাত ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। দলীয় সহিংসতার চেয়ে এর ক্ষতিকর প্রভাব কম ভয়ংকর নয়। বিএনপি জনতার মঞ্চের কুশীলবদের বিচার করতে ইচ্ছা করে ব্যর্থ থেকেছে, কারণ তারও মনের গহিনে পাপ বাসা বেঁধেছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার রাজনৈতিক বক্তব্যে তাই সত্যিই বিস্ময়ের কিছু নেই। সরকারি ও বেসরকারি মহলের দূরত্ব ঘুচে যাচ্ছে। আবারও দীপঙ্কর গুপ্তের শরণাপন্ন হতে হয়: ‘একজন সেনাপ্রধান দলীয় প্রচারবিদ হবেন, এটা কেউ আশা করেন না, তেমনটি আশা করা যায় না একজন পুলিশ, বিচারক কিংবা ধর্মগুরুর কাছে। এর কারণ হচ্ছে, তাঁদের পেশাগুলো যতটা না ব্যক্তিস্বার্থনির্ভর, তারচেয়ে বেশি সামাজিক দায়সম্পন্ন।’ কিন্তু কি সরকারি আর কি বেসরকারি, কোনো পেশাজীবীর ‘সামাজিক দায়বোধ’ হয়তো আর সামান্যই অবশিষ্ট আছে।
দলীয় রাজনীতি আজ আর দেশের ভূখণ্ডে সীমিত নেই। সিডনি অমুক দল, ফিনল্যান্ড তমুক লীগ—এসব দলাদলি তো আছেই। এখন তাঁরা বিজেপি সভাপতির কথিত ফোনে স্বাস্থ্যকুশল জানা বড় মুখ করে বলে দেশের মুখ ছোট করেন, কেউ মার্কিন রাজনীতিকদের নামে ভুয়া বিবৃতি প্রচার করেন; আবার কেউ জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের নামে বিদেশে রাস্তার নামকরণের প্রতিবাদে কোর্ট-কাছারি করেন। দেশের রাষ্ট্রদূতও এতে যোগ দেন! বিদেশে কর্মরত আমাদের কূটনীতিকদের এসব লীগ ও দলের মন জুগিয়ে চলতে হয় বলে শোনা যায়। ব্রিটেনের সাউদাম্পটনে একদল প্রবাসী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমেছেন। পিউ-র সমীক্ষায় সেরা রাজনীতিসচেতন দেশ বলে বিশ্বে আমরাই হয়তো একমাত্র প্রবাসী, যারা হিংসাশ্রয়ী দলাদলির জীবাণু রপ্তানি করতে পেরেছি। ভাগ্যিস ভিনদেশি কেউ আজতক আক্রান্ত হননি!
অথচ, ভারতীয় প্রবাসীদের কথাই ধরুন। তাঁরা জগৎসেরা পুরস্কার ও স্বীকৃতি পাচ্ছেন। ঝুম্পা লাহিড়ী ও সিদ্ধার্থ মুখার্জি তো পুলিৎজারজয়ী। মার্কিন সিনেট, প্রতিনিধি পরিষদ, গভর্নর, প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয়, চিকিৎসালয়, মহাকাশ গবেষণা, কোথায় তাঁরা নেই? ববি জিন্দাল লুইজিয়ানার গভর্নর, সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী! দলীয় রাজনীতি না করেও প্রবাসী ভারতীয়রা তাঁদের প্রভাবের কারণে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে ভারতের অনুকূলে আনতে সক্ষম হয়েছেন। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও কি তাঁদের মেধা ও শ্রম দিয়ে দেশের জন্য এ ধরনের অবদান রাখতে পারেন না?
সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চন অভিনীত একটি ব্যবসাসফল ছবির নাম চিনি কম। অসম বয়সী প্রেমের কাহিনিসংবলিত এ ছবির নায়িকা টাবু ছবিতে মালিক ও শেফ অমিতাভের লন্ডনের রেস্টুরেন্টে হায়দরাবাদী জাফরানি পোলাও খেতে ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু মনমতো না হওয়ায় অভুক্ত থেকে খাবার ফেরত দেন। এতে গর্বিত শেফ অমিতাভের আঁতে লাগে। খাবারের কী সমস্যা জানতে চাইলে টাবু বলেন, ‘হায়দরাবাদী জাফরানি পোলাও’ এতটা মিষ্টি হওয়ার কথা নয়। অমিতাভ রান্নাঘরে গিয়ে দেখতে পান যে দেশে পরিবারের চিন্তায় অন্যমনস্ক পাচক লবণের বদলে পুনরায় চিনি দেয়। বিপত্তি ঘটে এ কারণেই। তারপর যথারীতি বলিউডের কায়দায় প্রেম, প্রতিবন্ধকতা ও শুভমিলন। এ থেকেই ছবির নাম চিনি কম। আজ আমাদের রাজনীতিও অতিমাত্রার কারণে, গৌরবময় ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও, চিনি কম ছবির হায়দরাবাদী জাফরানি পোলাওয়ের মতো অখাদ্যে পরিণত হয়েছে।
সাবেক ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজ ‘রাজনীতি কম’-এর প্রবক্তা। তাঁর কথায় রাজনীতি বিষয়ে আমাদের মিতব্যয়ী হতে হবে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার সঙ্গে তুলনা করলে অনেকে রাগ করেন। কিন্তু দেখুন ওই চারটি অঞ্চলের মধ্যে এশিয়ায় ‘রাজনীতি কম’ বলে এখানেই তুলনামূলক গণতন্ত্র বেশি। সমাজসেবক জর্জ সোরোসের সঙ্গে সংলাপে শিমন পেরেজ বলেছিলেন, ‘যখন কোনো জাতি রাজনীতি নিয়ে পড়ে না থেকে রাজনীতি থেকে অর্থনৈতিক যাত্রায় শরিক হয়, তখন তারা আসলে বৈরিতা থেকে শান্তির পথে যায়। শেষ যুদ্ধের পরে ইউরোপে তা-ই ঘটেছে। তারা শান্তি পেয়েছে, কারণ কমবেশি তারা জাতীয় রাজনীতিকে পেছনে ঠেলতে পেরেছে। (লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস, ৯ মে ১৯৯৮)
পিউ সমীক্ষা বলছে, এশিয়ায় ভারতসহ সাত দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি নেতাদের ভাষণ শোনেন (৪৮ শতাংশ), সর্বাধিক মানুষ সক্রিয় দলীয় কর্মী (৩২ শতাংশ)। সেরা হরতালকারীর আসনটিও (৩১ শতাংশ) শুধু আমাদেরই করায়ত্ত, এমনকি ৩৩ দেশের মধ্যে হরতাল পালনে আমাদের ওপরে কেবল মিসর আছে। তাই পরিশেষে, অমিতাভ অভিনীত ছবির নাম চিনি কম অথবা বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ শিমন পেরেজের রাজনীতি বিষয়ে মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বানের অনুকরণে বলি, ‘রাজনীতি কম’।
রাজনীতি আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। কিন্তু অতিমাত্রায় রাজনীতির কারণে, আজ এসব অর্জন হুমকির সম্মুখীন। আমরা বিরাজনীতিকরণের কথা বলছি না। কেবল দলীয় রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের হাতেই রাখতে বলছি। দলীয় রাজনীতি দেশের ভূখণ্ডে সীমিত রাখার বিষয়ে বলছি। পেশাজীবীদের দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে অথচ সমাজমনস্ক থাকার কথা বলছি; দেশের দুর্দিনে জাতির আশ্রয় হওয়ার কথা বলছি। সর্বত্র, সবার দলীয় রাজনীতি করার কোনো প্রয়োজন নেই।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
No comments