চলচ্চিত্র শিল্প- চলচ্চিত্র আমদানি বিতর্ক ও নাবালকের ভয় by ফাহমিদুল হক
ভারতীয়
ছবি আমদানি নিয়ে চলচ্চিত্রাঙ্গনে এখন বিতর্ক চলছে। প্রথম দফা এই বিতর্ক
শুরু হয় ২০১০ সালে। সেবার তিনটি ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র আমদানি করে
বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেওয়া হয়। আর চলমান বিতর্ক শুরু হয়েছে
আমদানি করা চারটি হিন্দি চলচ্চিত্রের একটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেওয়ার
প্রেক্ষাপটে। উভয় ক্ষেত্রে আমদানিকারক পক্ষ হলেন চলচ্চিত্রের প্রদর্শকেরা,
এঁরা প্রেক্ষাগৃহের মালিক। এর তীব্র বিরোধিতা করছে চলচ্চিত্র ঐক্য পরিষদ।
পরিষদে আছেন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক ও কলাকুশলীরা। তাঁরা মনে করছেন,
ভারতীয় চলচ্চিত্র বাণিজ্যিকভাবে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেলে বাংলাদেশের
রুগ্ণ চলচ্চিত্রশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। তাঁরা মানববন্ধন করেছেন,
প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন, গায়ে কাফন জড়িয়ে মিছিল
করেছেন, হলে হলে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন, হিন্দি চলচ্চিত্রের
ব্যানার ছিঁড়েছেন। এই ডামাডোলে তথ্যমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি মোতাবেক
ঐক্য পরিষদ তাদের আন্দোলন আপাতত স্থগিত করেছে।
বাংলাদেশে কেবল দুটি দেশের চলচ্চিত্র আমদানি নিষিদ্ধ—ভারত ও পাকিস্তান। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক দিন পর পাকিস্তান সরকার ভারতীয় চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করে। আবার ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার উর্দু বা পাকিস্তানি চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করে। ১৯৬৫ ও ১৯৭২ সালের এই দুই নিষেধাজ্ঞা এখন পর্যন্ত বলবৎ আছে। বাংলাদেশে আমেরিকার ইংরেজি চলচ্চিত্র নিয়মিতই আসছে, তবে তার প্রদর্শনী স্টার সিনেপ্লেক্স ও যমুনা ব্লকবাস্টারের মধ্যে সীমিত থাকে। বলা যায়, হলিউডের চলচ্চিত্রের ব্যাপক দর্শক আমাদের দেশে নেই। এর আগে হংকংয়ের চলচ্চিত্রও এ দেশে আসত, তবে এখন আর আসে না। এই প্রেক্ষাপটে বিদেশি চলচ্চিত্রের এ দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির বিতর্কটি একেবারেই ভারতীয় চলচ্চিত্রকে ঘিরে আবর্তিত।
ঘটনাক্রমে স্পষ্ট যে বর্তমান সরকার ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির ব্যাপারে উদার। তবে এটা স্পষ্ট নয় যে কোন আইনবলে ইন উইন এন্টারপ্রাইজ (মধুমিতা) ২০১০ সালে তিনটি বাংলাভাষী চলচ্চিত্র আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে সমর্থ হয়েছিল। আন্দোলনের মুখে সরকার ২০১০ সালের ১৪ জুন ভারতীয় উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্র আমদানি করার ওপর পুনরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। আমদানিকারকেরা এরপর আদালতের দ্বারস্থ হন। এই পর্যায়ে তিনটির জায়গায় ১২টি চলচ্চিত্রের ঋণপত্র খোলার কথা শোনা যায় এবং আদালতের আদেশবলে জানুয়ারিতে সেই ১২টির মধ্য থেকে চারটি হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানি করে, ওয়ান্টেড চলচ্চিত্রটি ৫০টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেওয়া হয়।
অন্যদিকে, এ রকম একটি আদেশও আছে যে বাংলাদেশের কোনো আমদানিকারক ভারতীয় চলচ্চিত্র আনতে পারবেন,
সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি চলচ্চিত্রকে ভারতে মুক্তি দিতে হবে। এই নিয়মের আওতায় করপোরেট প্রতিষ্ঠান অটবি ভারতীয় চলচ্চিত্র রোর স্টার সিনেপ্লেক্সে মুক্তি দিয়েছিল, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ‘বৈষম্য’ মহারাষ্ট্রের এক প্রত্যন্ত প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেওয়ার মাধ্যমে।
পরিস্থিতি এই, প্রদর্শকেরা হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানির মাধ্যমে তঁাদের প্রেক্ষাগৃহগুলো রক্ষা করতে উৎসাহী। কারণ, স্থানীয় চলচ্চিত্রশিল্প রুগ্ণ হয়ে পড়ায় প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা ১ হাজার ২০০ থেকে কমে ৩৫০-এ নেমেছে এবং এই কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহ চালু রাখতে যে সংখ্যক ও মানের চলচ্চিত্র প্রয়োজন, তা আর নির্মিত হচ্ছে না। সরকারও নানা ইঙ্গিতে জানাচ্ছে যে ভারতীয় ছবি আমদানির ব্যাপারে তারা ইতিবাচক, তবে এ-সংক্রান্ত যথাযথ আইনকানুন-নীতিমালা গড়ে তুলতে সচেষ্ট নয়। আর এফডিসিকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র নির্মাণপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা সরাসরি যুক্ত, তারা এর তীব্র বিরোধী। সচেতন মহল এবং এফডিসির বাইরের চলচ্চিত্র চর্চাকারীদের সমর্থনও তারা পাচ্ছে।
আপাতত ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির ব্যাপারটা স্থগিত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প যখন ঘুরে দাঁড়ানোর কষ্টকর কাজটি করছে, সরকার নানা প্রণোদনার মাধ্যমে সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছে, তখন বড় বাজেটের হিন্দি চলচ্চিত্র এই মুহূর্তে আমদানি করার প্রয়োজন হয়তো নেই। কিন্তু বিষয়টি চিরকালীন সুবিধা প্রদানের মতো হলে চলবে না।
নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে, একটা কার্যকর নীতিমালা গঠন করে, একসময় এটা খুলে দিতেই হবে। এই আটকে রাখার বিষয়টির পেছনে খুব বেশি যৌক্তিক কারণও নেই। একজন দর্শকের অধিকার রয়েছে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে বিভিন্ন ভাষার, বিভিন্ন স্বাদের চলচ্চিত্র আস্বাদনের। সুদূর আমেরিকার চলচ্চিত্র এ দেশে আসতে পারলে প্রতিবেশী দেশের চলচ্চিত্র কেন আসতে পারবে না? ভারতীয় বই আসতে পারলে চলচ্চিত্র কেন আসতে পারবে না? আর এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল পাকিস্তান সরকারপ্রধান আইয়ুব খান। কিন্তু ২০০৬ সাল থেকে পাকিস্তানেই ভারতীয় চলচ্চিত্র চলছে। নেহাত পাকিস্তানের জন্য অবমাননাকর চলচ্চিত্র তারা আটকে দেয়।
একটা যুক্তি আছে যে বড় বাজেটের হিন্দি চলচ্চিত্র এ দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেলে আমাদের রুগ্ণ চলচ্চিত্রের যতটুকু অস্তিত্ব রয়েছে, তা-ও ধ্বংস হয়ে যাবে। এটা যে অনিশ্চয়তাজনিত ভীতি, তা পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটটি বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হবে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর ২০১৪ সালের ২০ মার্চের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০৫ সালে সেখানে মাত্র ২০টি প্রেক্ষাগৃহ ছিল। কিন্তু প্রতিবেদন লেখার সময় প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৪, এবং আরও ১০০টি প্রেক্ষাগৃহ শিগগিরই আসছে। বিভিন্ন বড় শহরে মাল্টিপ্লেক্স তৈরি হচ্ছে। আর স্থানীয় চলচ্চিত্র নির্মাণেও একটা পরিবর্তন এসেছে। ২০১৩ সালে সাতটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল। ২০১৪ সালে নির্মিত হচ্ছিল ২৫টি চলচ্চিত্র। ২০০৬-পরবর্তী সময়েই পাকিস্তান ৫০ বছরের মধ্যে প্রথম অস্কারে পাঠিয়েছে জিন্দা ভাগ (২০১৩) চলচ্চিত্রটি। এই সময়কালেই নির্মিত হয়েছে পাকিস্তানের ইতিহাসে রেকর্ড ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র ওয়ার (২০১৩)। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত চলচ্চিত্র খুদা কে লিয়ে (২০০৭) কিংবা ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্র বোল (২০১১) এই সময়কালেই নির্মিত। বলা যায়, ভারতীয় চলচ্চিত্র পাকিস্তানি চলচ্চিত্রকে ধ্বংস করতে পারেনি, বরং পরিবর্তনে পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে।
আমাদের দেশে চলমান বিতর্ক থেকে এই উপলব্ধিতে আমরা পৌঁছাতে পারছি যে প্রদর্শক-কলাকুশলী-সরকার—তিনটি পক্ষকেই তাদের অবস্থান নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। এটা তো ঠিকই যে প্রেক্ষাগৃহ না বাঁচলে চলচ্চিত্রও বাঁচে না। কিন্তু প্রদর্শকেরা প্রায়ই নিছক বেনিয়াদের মতো আচরণ করেন। তাঁদের মধ্যে চলচ্চিত্র ব্যবসাকে নিজেদের কবজায় রাখার মানসিকতা দেখা যায়। অনেক শিল্পসম্মত ও স্বাধীন চলচ্চিত্রকে তাঁরা নির্দয়ভাবে প্রেক্ষাগৃহ থেকে নামিয়ে দিয়েছেন। এই অভিযোগের পেছনে সত্যতা আছে যে তাঁরা প্রযোজকের প্রাপ্য অর্থ ফেরত দেন না, নানা ফাঁকিতে টিকিট বিক্রির বড় অংশ নিজেদের পকেটস্থ করেন। আবার যখন পরিচালক-কলাকুশলীরা আন্দোলন করছেন, তাঁরা ওঁদের ছবি না চালানোর ঘোষণা দিয়েছেন। এটা একধরনের পেশিশক্তি প্রদর্শনের মনোভাব। কেবল মারদাঙ্গা হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানির মধ্যে সীমিত না থেকে তঁাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে হবে। তঁাদের জানা দরকার যে ছোট ছোট ঘটনার পারিবারিক কাহিনির ইরানি চলচ্চিত্র কিংবা কোরীয় থ্রিলার চলচ্চিত্রের দর্শক এ দেশে রয়েছে।
আর পুরো ব্যাপারটি সরকারকে পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করতে হবে। যে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেল পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায় না, সে ক্ষেত্রে এ রকম একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় দ্বিপক্ষীয় স্বার্থের বিষয়টি সমুন্নত রাখতে হবে। আমদানির ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে। চীনে বছরে ২০টি বিদেশি ছবি আমদানি হয়, সেন্সর-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় সেসব ছবিকে। বাংলাদেশেও বিদেশি চলচ্চিত্রের আমদানির ক্ষেত্রে সংখ্যাটি সীমিত রাখতে হবে। আর কোনো প্রেক্ষাগৃহ যেন একচেটিয়াভাবে বিদেশি চলচ্চিত্র না দেখাতে পারে, সে জন্য নীতিমালায় বলা থাকতে হবে, দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্রের শতকরা হার কত হবে। আর সব ধরনের চলচ্চিত্রই আসতে দেওয়া উচিত হবে না। অপেক্ষাকৃত উন্নত রুচির ও উন্নত নির্মাণশৈলীর চলচ্চিত্রকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
জাতীয় একটি কমিটি থাকতে পারে, যার সদস্যরা সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। করারোপের মধ্য দিয়ে বিদেশি ও দেশি চলচ্চিত্রের টিকিটের মূল্যের একটা ব্যবধানও রাখতে হবে। একজন চলচ্চিত্রামোদীর সেই উত্তেজনাকর সুযোগ পাওয়ার অধিকার আছে যে মুম্বাই ও ঢাকার প্রেক্ষাগৃহে একই দিনে মুক্তি পাবে পিকের মতো চলচ্চিত্র। আজ না হোক, ভবিষ্যতে এই সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আমরা আশা করতে চাই, তত দিনে স্থানীয় চলচ্চিত্রেরও দৃশ্যপট পাল্টাবে। দশকের পর দশক পূর্ণ প্রটেকশন পেয়ে ‘প্রলম্বিত শৈশব’-এ আটকে থাকা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রও ক্রমেই সাবালক হয়ে উঠবে, সে ভারতীয় চলচ্চিত্রের উপস্থিতিকে আর ভয় পাবে না। সে ক্ষেত্রে হিন্দি ও তামিল চলচ্চিত্রের ব্যর্থ অনুকরণ না করে বাস্তবসম্মত ও নিজ ঐতিহ্যনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণের দিকে মনোযোগ ফেরাতে হবে।
আমাদের মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র রূপবান (১৯৬৫), বেদের মেয়ে জোসনা (১৯৮৯) ও মনপুরা (২০০৯)। তিনটির কাহিনিতেই দেশ ও মাটির গন্ধ লেপ্টে রয়েছে।
ফাহমিদুল হক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং চলচ্চিত্র গবেষক।
বাংলাদেশে কেবল দুটি দেশের চলচ্চিত্র আমদানি নিষিদ্ধ—ভারত ও পাকিস্তান। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক দিন পর পাকিস্তান সরকার ভারতীয় চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করে। আবার ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার উর্দু বা পাকিস্তানি চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করে। ১৯৬৫ ও ১৯৭২ সালের এই দুই নিষেধাজ্ঞা এখন পর্যন্ত বলবৎ আছে। বাংলাদেশে আমেরিকার ইংরেজি চলচ্চিত্র নিয়মিতই আসছে, তবে তার প্রদর্শনী স্টার সিনেপ্লেক্স ও যমুনা ব্লকবাস্টারের মধ্যে সীমিত থাকে। বলা যায়, হলিউডের চলচ্চিত্রের ব্যাপক দর্শক আমাদের দেশে নেই। এর আগে হংকংয়ের চলচ্চিত্রও এ দেশে আসত, তবে এখন আর আসে না। এই প্রেক্ষাপটে বিদেশি চলচ্চিত্রের এ দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির বিতর্কটি একেবারেই ভারতীয় চলচ্চিত্রকে ঘিরে আবর্তিত।
ঘটনাক্রমে স্পষ্ট যে বর্তমান সরকার ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির ব্যাপারে উদার। তবে এটা স্পষ্ট নয় যে কোন আইনবলে ইন উইন এন্টারপ্রাইজ (মধুমিতা) ২০১০ সালে তিনটি বাংলাভাষী চলচ্চিত্র আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে সমর্থ হয়েছিল। আন্দোলনের মুখে সরকার ২০১০ সালের ১৪ জুন ভারতীয় উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্র আমদানি করার ওপর পুনরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। আমদানিকারকেরা এরপর আদালতের দ্বারস্থ হন। এই পর্যায়ে তিনটির জায়গায় ১২টি চলচ্চিত্রের ঋণপত্র খোলার কথা শোনা যায় এবং আদালতের আদেশবলে জানুয়ারিতে সেই ১২টির মধ্য থেকে চারটি হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানি করে, ওয়ান্টেড চলচ্চিত্রটি ৫০টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেওয়া হয়।
অন্যদিকে, এ রকম একটি আদেশও আছে যে বাংলাদেশের কোনো আমদানিকারক ভারতীয় চলচ্চিত্র আনতে পারবেন,
সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি চলচ্চিত্রকে ভারতে মুক্তি দিতে হবে। এই নিয়মের আওতায় করপোরেট প্রতিষ্ঠান অটবি ভারতীয় চলচ্চিত্র রোর স্টার সিনেপ্লেক্সে মুক্তি দিয়েছিল, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ‘বৈষম্য’ মহারাষ্ট্রের এক প্রত্যন্ত প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেওয়ার মাধ্যমে।
পরিস্থিতি এই, প্রদর্শকেরা হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানির মাধ্যমে তঁাদের প্রেক্ষাগৃহগুলো রক্ষা করতে উৎসাহী। কারণ, স্থানীয় চলচ্চিত্রশিল্প রুগ্ণ হয়ে পড়ায় প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা ১ হাজার ২০০ থেকে কমে ৩৫০-এ নেমেছে এবং এই কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহ চালু রাখতে যে সংখ্যক ও মানের চলচ্চিত্র প্রয়োজন, তা আর নির্মিত হচ্ছে না। সরকারও নানা ইঙ্গিতে জানাচ্ছে যে ভারতীয় ছবি আমদানির ব্যাপারে তারা ইতিবাচক, তবে এ-সংক্রান্ত যথাযথ আইনকানুন-নীতিমালা গড়ে তুলতে সচেষ্ট নয়। আর এফডিসিকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র নির্মাণপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা সরাসরি যুক্ত, তারা এর তীব্র বিরোধী। সচেতন মহল এবং এফডিসির বাইরের চলচ্চিত্র চর্চাকারীদের সমর্থনও তারা পাচ্ছে।
আপাতত ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির ব্যাপারটা স্থগিত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প যখন ঘুরে দাঁড়ানোর কষ্টকর কাজটি করছে, সরকার নানা প্রণোদনার মাধ্যমে সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছে, তখন বড় বাজেটের হিন্দি চলচ্চিত্র এই মুহূর্তে আমদানি করার প্রয়োজন হয়তো নেই। কিন্তু বিষয়টি চিরকালীন সুবিধা প্রদানের মতো হলে চলবে না।
নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে, একটা কার্যকর নীতিমালা গঠন করে, একসময় এটা খুলে দিতেই হবে। এই আটকে রাখার বিষয়টির পেছনে খুব বেশি যৌক্তিক কারণও নেই। একজন দর্শকের অধিকার রয়েছে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে বিভিন্ন ভাষার, বিভিন্ন স্বাদের চলচ্চিত্র আস্বাদনের। সুদূর আমেরিকার চলচ্চিত্র এ দেশে আসতে পারলে প্রতিবেশী দেশের চলচ্চিত্র কেন আসতে পারবে না? ভারতীয় বই আসতে পারলে চলচ্চিত্র কেন আসতে পারবে না? আর এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল পাকিস্তান সরকারপ্রধান আইয়ুব খান। কিন্তু ২০০৬ সাল থেকে পাকিস্তানেই ভারতীয় চলচ্চিত্র চলছে। নেহাত পাকিস্তানের জন্য অবমাননাকর চলচ্চিত্র তারা আটকে দেয়।
একটা যুক্তি আছে যে বড় বাজেটের হিন্দি চলচ্চিত্র এ দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেলে আমাদের রুগ্ণ চলচ্চিত্রের যতটুকু অস্তিত্ব রয়েছে, তা-ও ধ্বংস হয়ে যাবে। এটা যে অনিশ্চয়তাজনিত ভীতি, তা পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটটি বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হবে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর ২০১৪ সালের ২০ মার্চের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০৫ সালে সেখানে মাত্র ২০টি প্রেক্ষাগৃহ ছিল। কিন্তু প্রতিবেদন লেখার সময় প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৪, এবং আরও ১০০টি প্রেক্ষাগৃহ শিগগিরই আসছে। বিভিন্ন বড় শহরে মাল্টিপ্লেক্স তৈরি হচ্ছে। আর স্থানীয় চলচ্চিত্র নির্মাণেও একটা পরিবর্তন এসেছে। ২০১৩ সালে সাতটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল। ২০১৪ সালে নির্মিত হচ্ছিল ২৫টি চলচ্চিত্র। ২০০৬-পরবর্তী সময়েই পাকিস্তান ৫০ বছরের মধ্যে প্রথম অস্কারে পাঠিয়েছে জিন্দা ভাগ (২০১৩) চলচ্চিত্রটি। এই সময়কালেই নির্মিত হয়েছে পাকিস্তানের ইতিহাসে রেকর্ড ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র ওয়ার (২০১৩)। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত চলচ্চিত্র খুদা কে লিয়ে (২০০৭) কিংবা ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্র বোল (২০১১) এই সময়কালেই নির্মিত। বলা যায়, ভারতীয় চলচ্চিত্র পাকিস্তানি চলচ্চিত্রকে ধ্বংস করতে পারেনি, বরং পরিবর্তনে পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে।
আমাদের দেশে চলমান বিতর্ক থেকে এই উপলব্ধিতে আমরা পৌঁছাতে পারছি যে প্রদর্শক-কলাকুশলী-সরকার—তিনটি পক্ষকেই তাদের অবস্থান নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। এটা তো ঠিকই যে প্রেক্ষাগৃহ না বাঁচলে চলচ্চিত্রও বাঁচে না। কিন্তু প্রদর্শকেরা প্রায়ই নিছক বেনিয়াদের মতো আচরণ করেন। তাঁদের মধ্যে চলচ্চিত্র ব্যবসাকে নিজেদের কবজায় রাখার মানসিকতা দেখা যায়। অনেক শিল্পসম্মত ও স্বাধীন চলচ্চিত্রকে তাঁরা নির্দয়ভাবে প্রেক্ষাগৃহ থেকে নামিয়ে দিয়েছেন। এই অভিযোগের পেছনে সত্যতা আছে যে তাঁরা প্রযোজকের প্রাপ্য অর্থ ফেরত দেন না, নানা ফাঁকিতে টিকিট বিক্রির বড় অংশ নিজেদের পকেটস্থ করেন। আবার যখন পরিচালক-কলাকুশলীরা আন্দোলন করছেন, তাঁরা ওঁদের ছবি না চালানোর ঘোষণা দিয়েছেন। এটা একধরনের পেশিশক্তি প্রদর্শনের মনোভাব। কেবল মারদাঙ্গা হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানির মধ্যে সীমিত না থেকে তঁাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে হবে। তঁাদের জানা দরকার যে ছোট ছোট ঘটনার পারিবারিক কাহিনির ইরানি চলচ্চিত্র কিংবা কোরীয় থ্রিলার চলচ্চিত্রের দর্শক এ দেশে রয়েছে।
আর পুরো ব্যাপারটি সরকারকে পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করতে হবে। যে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেল পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায় না, সে ক্ষেত্রে এ রকম একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় দ্বিপক্ষীয় স্বার্থের বিষয়টি সমুন্নত রাখতে হবে। আমদানির ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে। চীনে বছরে ২০টি বিদেশি ছবি আমদানি হয়, সেন্সর-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় সেসব ছবিকে। বাংলাদেশেও বিদেশি চলচ্চিত্রের আমদানির ক্ষেত্রে সংখ্যাটি সীমিত রাখতে হবে। আর কোনো প্রেক্ষাগৃহ যেন একচেটিয়াভাবে বিদেশি চলচ্চিত্র না দেখাতে পারে, সে জন্য নীতিমালায় বলা থাকতে হবে, দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্রের শতকরা হার কত হবে। আর সব ধরনের চলচ্চিত্রই আসতে দেওয়া উচিত হবে না। অপেক্ষাকৃত উন্নত রুচির ও উন্নত নির্মাণশৈলীর চলচ্চিত্রকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
জাতীয় একটি কমিটি থাকতে পারে, যার সদস্যরা সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। করারোপের মধ্য দিয়ে বিদেশি ও দেশি চলচ্চিত্রের টিকিটের মূল্যের একটা ব্যবধানও রাখতে হবে। একজন চলচ্চিত্রামোদীর সেই উত্তেজনাকর সুযোগ পাওয়ার অধিকার আছে যে মুম্বাই ও ঢাকার প্রেক্ষাগৃহে একই দিনে মুক্তি পাবে পিকের মতো চলচ্চিত্র। আজ না হোক, ভবিষ্যতে এই সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আমরা আশা করতে চাই, তত দিনে স্থানীয় চলচ্চিত্রেরও দৃশ্যপট পাল্টাবে। দশকের পর দশক পূর্ণ প্রটেকশন পেয়ে ‘প্রলম্বিত শৈশব’-এ আটকে থাকা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রও ক্রমেই সাবালক হয়ে উঠবে, সে ভারতীয় চলচ্চিত্রের উপস্থিতিকে আর ভয় পাবে না। সে ক্ষেত্রে হিন্দি ও তামিল চলচ্চিত্রের ব্যর্থ অনুকরণ না করে বাস্তবসম্মত ও নিজ ঐতিহ্যনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণের দিকে মনোযোগ ফেরাতে হবে।
আমাদের মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র রূপবান (১৯৬৫), বেদের মেয়ে জোসনা (১৯৮৯) ও মনপুরা (২০০৯)। তিনটির কাহিনিতেই দেশ ও মাটির গন্ধ লেপ্টে রয়েছে।
ফাহমিদুল হক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং চলচ্চিত্র গবেষক।
No comments