ভয়ে লাশ নিতে আসছে না ডাকাত শহীদের স্বজনেরা by তানভীর হাসান

সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে ডাকাত শহীদের নিহত হওয়ার খবর পেয়েছেন মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে তাঁর পরিবারের সদস্যরা। তবে র‌্যাবের গুলিতে নিহত ব্যক্তিই ডাকাত শহীদ কি না তারা নিশ্চিত হতে পারেনি। শহীদের বড় ভাই নুরুল ইসলাম গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভয়ে লাশ শনাক্ত করতে যেতে পারছি না।


যদি কোনো ঝামেলা হয়। টেলিভিশন ও পত্রিকায় শহীদের আগের ছবি প্রকাশ করছে। তবে লাশের মুখ ও শরীর দেখাচ্ছে না। এ কারণে আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না।’
নুরুল বলেন, ‘আমার বিশ্বাস হয় না, ওটা শহীদ। শহীদ নিশ্চিত জানে যে দেশে এলে তাকে মেরে ফেলা হবে। দেশে ক্রসফায়ার হয়, এটা তার অজানা নয়।’
গতকাল শ্রীনগরের বাবু দীঘিরপার এলাকায় শহীদদের বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, বড় ভাই নুরুল ইসলামের বাড়িতে থাকেন তাঁর মা মারিয়া খাতুন (৮০)। বাবা শামসুল হক ভূঁইয়া অনেক আগেই মারা গেছেন। বৃদ্ধ মা বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছেন। তাঁকে এখনো শহীদের মৃত্যুর বিষয়টি জানায়নি পরিবারের সদস্যরা।
নুরুল ইসলাম জানান, তাঁদের পৈতৃক বাড়ি শ্রীনগরের কামারগাঁও ইউনিয়নের মাগডাইল গ্রামে। তাঁর বাবা নারায়ণগঞ্জের একটি অয়েল মিলে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে তাঁরা দুই ভাই নারায়ণগঞ্জের নলুয়াপাড়ায় থাকতেন। একসময় তিনি (নুরুল) আটা-ময়দার ব্যবসা করতেন। শহীদের বয়স পাঁচ-ছয় হলে সেখান থেকে তাঁরা শ্রীনগরে আরধীপাড়ায় নানাবাড়িতে ওঠেন। সেখানেই শহীদ বড় হন। শহীদ বিয়ে করেন শ্রীনগরের দামলা গ্রামে। এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে শহীদ থাকতেন পুরান ঢাকায়। নুরুল ইসলাম বলেন, ‘পরে শুনতে পাই, শহীদের নামে মানুষ নাকি লাখ লাখ টাকা দিয়ে যায়। তার নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৫ সালের দিকে শহীদ সপরিবারে কলকাতায় পালিয়ে যায়। পাঁচ বছর আগে সেখানে শহীদের একমাত্র ছেলে ইসমাইল জনি (১৯) বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায়। দুই মেয়ে কলকাতাতেই থাকে।’ নুরুল অভিযোগ করেন, প্রায় সাত বছর আগে শহীদ কলকাতা থেকে ফোন করে টাকা চেয়ে তাঁকে হুমকি দেন। এরপর আর তাঁর সঙ্গে শহীদের যোগাযোগ ছিল না।
শ্রীনগরের আরধীপাড়ার বাসিন্দা আসবাবপত্র ব্যবসায়ী মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘ছোটবেলায় নানার বাড়িতে থাকার সময় শহীদকে দেখেছি। তখন তো সে খুব নম্র-ভদ্র ছিল। বড় হয়ে সে প্রথমে কুয়েতে যায়। সেখান থেকে ফিরেই খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়ে। নাম হয় ডাকাত শহীদ।’
পুলিশ, স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৬ সালের দিকে জাতীয় পার্টির সরকারের সময় ডাকাত শহীদ এক চিকিৎসকের বাড়িতে ডাকাতির মামলায় গ্রেপ্তার হন। প্রায় তিন মাস কারাগারে থাকার পরে জামিনে মুক্তি পান।
এ ব্যাপারে বড় ভাই নুরুল জানান, ওই সময়ে জাতীয় পার্টির নেতা শ্রীনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল হক সেলিমের (বর্তমানে প্রয়াত) সঙ্গে শহীদের বিরোধ ছিল। সেই সেলিম পুলিশ দিয়ে শহীদকে গ্রেপ্তার করান। পরে তাঁরাই শহীদকে ডাকাত শহীদ বলে প্রচার করতে থাকেন। তিউন বলেন, কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে শহীদ তার স্ত্রীর স্বর্ণালংকার ও টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়।
শ্রীনগর থানার পুলিশ জানায়, শহীদ ১৬টি মামলার পরোয়ানাভুক্ত আসামি। এর মধ্যে একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন ও একটি অস্ত্র মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ডাদেশ রয়েছে। এসব পরোয়ানাভুক্ত মামলা ছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় আরও মামলা রয়েছে। তার সংখ্যা জানা যায়নি।
গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ডাকাত শহীদের বিরুদ্ধে সূত্রাপুর থানায় ১০টিসহ মোট ২০টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে সাতটি হত্যা মামলা, দুটি বিস্ফোরক উদ্ধারজনিত মামলা ও পাঁচটি অস্ত্র মামলা রয়েছে। ঢাকায় শহীদের সর্বশেষ ঠিকানা ছিল সূত্রাপুর থানাধীন টিপু সুলতান রোড।
ডিবি সূত্র জানায়, ২০০১ সালে শহীদের নাম ওঠে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায়। সরকার তাঁকে ধরার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে। তাঁর নামে পুরান ঢাকাসহ গোটা দেশেই কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়েছে। শুধু শহীদের বাহিনীই নয়, বিভিন্ন এলাকার ছিঁচকে সন্ত্রাসী, প্রতারকেরাও শহীদের নাম ব্যবহার করেছে। তাঁর ইশারায় নিহত মানুষের সারিও দীর্ঘ। এর মধ্যে বিএনপির নেতা হাবিবুর রহমান মণ্ডল, ছাত্রদলের নেতা ছগির আহমেদ, যুবলীগের নেতা শিমুল, ৭০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও যুবদল নেতা আহমেদ হোসেন, স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রেমকৃষ্ণ হত্যাকাণ্ড উল্লেখযোগ্য। পুরান ঢাকায় তাঁর ছিল তথ্যদাতাদের বিশাল নেটওয়ার্ক।
রাজধানীর লক্ষ্মীবাজার এলাকায় গত মঙ্গলবার রাতে র‌্যাবের গুলিতে শহীদ ও তাঁর সহযোগী কাল্লু নিহত হন। দুই মাস আগে শহীদকে গ্রেপ্তার করে পুশব্যাক করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।

No comments

Powered by Blogger.