নুশু : কেবল মহিলাদের জন্য এক ভাষা by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
আমরা মেয়েদের মায়ের জাত বলি। আবার তাদের পরনির্ভরতার কথা ভেবে বলি, মেয়েমানুষ পরের ভাগ্যে খায়। মেয়ে বুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী। দশ কাপড়েও মেয়ে ন্যাংটা। আমরা পথি নারী বিবর্জিতা ভেবে সাবধানতা অবলম্বন করি। মেয়েদের জন্য নানা নিষেধ, নানান বিধি। বিধবার জন্য বিধি-নিষেধের আরো কড়াকড়ি।
মেয়েদের অনেক নাম উচ্চারণ নিষেধ, স্বামীর নাম করতে নেই, ভাসুরের নাম করতে নেই। কেবল কিছু প্রবাদ, সাধারণ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে নাম পেয়েছে মেয়েলি প্রবাদ।
যেকোনো দেশেই কিছু কিছু শব্দ পুরুষরা মেয়েদের এবং মেয়েরা পুরুষদের সামনে উচ্চারণ করে না। হতে পারে অশ্লীল বলে। আবার ট্যাবু বলেও। যেমন নুন নাম করে চাইতে নেই। শিশুর হাম হলে হাম বলতে নেই, বলতে হয় মাসিপিসি। কুষ্ঠরোগের নাম করতে নেই, বলতে হয় মহারোগ। হলুদকে হলুদ বলতে নেই, বলতে হয় বর্ণ বা বন্ন। ইত্যাকার নানা বিধি-নিষেধ এবং নারী-পুরুষভেদ পরিহার করে চীনের কিছু অঞ্চলে কেবল মহিলাদের জন্য একটি ভাষা প্রচলিত হয়। এখন তা হারিয়ে যাচ্ছে। একসময় চীনে শুধু পুরুষরা লেখাপড়া করত। বড় ঘরের মেয়েরা পা বাঁধাই করে সামাজিক বিধি-নিষেধ মেনে অন্তঃপুরে দিন কাটাত। খেটে খাওয়া মেয়েদের অবশ্য তেমন বড়মানুষি করা হতো না। কেমন করে চীনের উনান প্রদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে উর্বর উপত্যকায় মেয়েরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করার জন্য এক স্বতন্ত্র ভাষার উদ্ভাবন করে; পণ্ডিতরা তার সৃষ্টি-রহস্য সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন না। দাদি-নানিদের কাছ থেকে নাতনি-পুতনিদের কাছে, বয়স্ক চাচি-মামিদের কাছ থেকে কুমারী ভাইঝি-বোনঝিদের কাছে, সখী থেকে সখীর কাছে এই ভাষা ছড়িয়ে পড়ে। পুরুষ বা ছেলেদের সঙ্গে এ ভাষায় কোনো কথা হতো না। এই ভাষা নুশু বা নারীলিপি। পৃথিবীর নারীদের একক ভাষা।
নুশু ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। বছর চারেক আগে ইয়াং উয়ানির বয়স ছিল ৯৮। নুশু ভাষা সম্পর্কে তিনি বলেন, 'মেয়েরা একসঙ্গে হলে এই ভাষায় কথা বলত এবং আমরা এভাবে এই ভাষা শিখি। এভাবে আমরা নিজেদের প্রকাশ করতাম এবং আমাদের জীবনটা ভালোই ছিল।'
পণ্ডিতবর্গ ও স্থানীয় কর্মকর্তারা নবোৎসাহে এ ভাষা রক্ষার চেষ্টা করছেন। বংশপরম্পরায় মেয়েরা এই ভাষায় তাদের দিনপঞ্জি লিখতেন এবং এতে ব্যক্তিগত জীবনের অনন্য কিছু নিদর্শনের খোঁজ পাওয়া যেত। আজকে মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে চীনা ভাষা শেখে, নুশু ভাষার সেই আকর্ষণ নেই।
চীনা চিত্রাক্ষরের সঙ্গে নুশুর কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে, কোনো কোনো চিত্রাক্ষরের টান লম্বা এবং কিছুটা পরিবর্তিত। যথেষ্ট পার্থক্যও রয়েছে। অক্ষর শব্দের পরিচায়ক। আঞ্চলিক ছেং কুয়ান তুউয়ার শব্দের মতো, লিখিত ও কথ্য চীনা চিত্রাক্ষরের মতো নয়। নুশু লেখা হয় ওপর থেকে নিচে, দীর্ঘায়িত কুণ্ডলীর আকারে এবং পড়তে হয় ডান দিক থেকে বামে। তৃতীয় শতাব্দীতে এই ভাষার জন্ম। দক্ষিণ-মধ্য চীনের উনানের চিয়াং ইয়ংয়ে তার চল ছিল। কোয়াংচোর প্রায় ২০০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে শুং চিয়ান শহরে পুমেই অবস্থিত ছিল। এসব কথা অবশ্য নিশ্চিত করে বলা যায় না।
অবশ্য এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, ওই অঞ্চলের 'অঙ্গীকারবদ্ধ ভগিনী' প্রথা নুশু নারী-ভাষার সূত্রপাত ঘটায়। এই প্রথায় গ্রামের মেয়েরা দিব্যি পরস্পরকে সখী হিসেবে গ্রহণ করত। বিয়ের পর এই সখিত্বে টান পড়ত। তিন দিন পর প্রাপ্ত যৌবনা কনে তৃতীয় দিনের বই পেত। কাপড়ে বাঁধাই সেই বইয়ে কনের মা এবং অঙ্গীকারবদ্ধ বোনেরা কন্যা ও বন্ধু হারানোর দুঃখের কথা লিপিবদ্ধ করত এবং নববিবাহিতার জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করত। এই বইয়ের প্রথম ছয় পৃষ্ঠায় থাকত নুশু ভাষার লেখা দুঃখ ও আশার কথা। যা পুরুষ স্বামী পড়তে পারত না। বাকিটা খালি রাখা হতো, যেখানে কনে তার অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার কথা লিখত। কালক্রমে ব্যক্তিগত দিনপঞ্জির এ এক ধনাগার হয়ে ওঠে। সেই সময় দাদি-নানিরা ওই ভাষায় গান করতেন এবং লিখতে-পড়তে পারতেন। সেই সময় নারী-পুরুষের মধ্যে বেশ বৈষম্য ও অবিচার ছিল এবং নিজেদের প্রকাশ করতে মহিলাদের নুশু ভাষার প্রয়োজন ছিল।
এসব গোপনীয়তার কথা ভেবে পণ্ডিতদের মধ্যে কেউ কেউ ভাবেন যে এই ভাষা সমকামী নারীদের আবিষ্কার। ১৯৮০-এর দশকে বেইজিং এবং সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চাও লিমিং এই ভাষা সম্পর্কে গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর মতে, নুশু সমকামীদের ভাষা, ওই ধারণা সঠিক নয়। মেয়েরা যারা চীনা ভাষা জানত না তারা নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করতে এই ভাষার শরণাপন্ন হয়। যারা এই ভাষা শিখত তারা কাগজের অভাবে হাতের তালুতে লিখে রেখে তা মুখস্থ করত। এই ভাষা নারীদের নিরক্ষতা থেকে মুক্ত করে।
নুশু ভাষা নিয়ে নানা কথা উঠেছে। মিনেসেটো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিল লি লি লিখছেন_জিয়াংইয়ং অঞ্চলের এক মহিলা ১৯৮২ সালে বেইজিংয়ে আত্মীয়স্বজনকে অবাক করে এই ভাষায় গান করে এবং তা লিখে দিলে কেউ তা পড়তে পারে না। ব্যাপারটা পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে গবেষণা শুরু হয়।
নিকটবর্তী শহরের চো শোই মনে করেন ব্যাপারটা অন্য রকম। ছয় প্রজন্ম আগে তাঁর এক নানি 'মেয়েদের শিক্ষা দাও' শীর্ষক একটি কবিতা লেখেন। বংশপরম্পরায় কবিতাটি হাতবদল হয়। স্থানীয় গ্রাম্য মহিলারা তা নুুশু ভাষায় ভাষান্তরিত করে। তাঁর চাচি নুশু ভাষার লেখা কবিতাটা তাঁর বাবার বাড়িতে নিয়ে আসেন ১৯২০ সালের দিকে।
চো-র বাবা একজন স্কুলশিক্ষক। তিনি এই অপরিচিত ভাষায় আকৃষ্ট হয়ে চোকে খোঁজ নিতে বলেন। ১৯৫০ সালের দিকে চিয়াং ইয়ং কাউন্টির সাংস্কৃতিক বিভাগে কাজ করার সময় বয়স্ক একাধিক মহিলাকে চো সেই ভাষা ব্যবহার করতে দেখেন।
চো ব্যাপারটা বেইজিং কর্তৃপক্ষকে জানান। ইতিমধ্যে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ঢেউ উঠলে তাঁকে ডানপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং তাঁকে এ কাজ করতে বাধা দেওয়া হয়। রেডগার্ডরা তাঁর বহু কষ্টে সংগৃহীত নুশু দলিলগুলো নষ্ট করে ফেলে। অবশ্য তাঁর মাথায় যা রয়ে যায়, তা কেউ ধ্বংস করতে পারেনি।
দেশ শান্ত হলে ১৯৭৯ সালে চো স্থানীয় জাদুঘরে গিয়ে নুশু ভাষা লিখতে ও পড়তে শুরু করেন। ১৯৮২ সালে ওই অঞ্চলের সংস্কৃতির ওপর তিনি একট বই লেখেন, যেখানে নুশুর ওপর একটা অধ্যায় ছিল।
উনান প্রাদেশিক সরকার বইটা প্রকাশ করলে নিকটবর্তী উহান ও দূরের বেইজিং এবং কালক্রমে দেশের সর্বত্র নুশুর কথা ছড়িয়ে পড়ে। ২৫ বছর ধরে চো নুশু ভাষায় শিক্ষা দিচ্ছেন। বর্তমানে এই ভাষায় ৬৭০ থেকে ১৫০০ শব্দ রয়েছে। চোর ছাত্ররা এ ভাষায় একটি অভিধান সংকলনে ব্যস্ত আছে। বিদ্বজ্জন ছাড়া ১০ জনেরও কম লোক দ্রুত এই ভাষা ব্যবহার করতে পারেন এবং অনেকেই তাঁদের জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ভাষাটির সাংস্কৃতিক মূল্য ও পর্যটন সম্ভাবনার কথা ভেবে পুমেইকে নুশু সাংস্কৃতিক গ্রাম বলে অভিহিত করেছে। পর্যটকদের জন্য শিল্পীরা ব্যাগ ও রুমালে নুশু অক্ষর এঁকে বিক্রি করতে উৎসাহ বোধ করেন। প্রতিটি নুশু শব্দ তো ফুলের মতো।
লেখক : সাবেক প্রধান বিচারপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা
যেকোনো দেশেই কিছু কিছু শব্দ পুরুষরা মেয়েদের এবং মেয়েরা পুরুষদের সামনে উচ্চারণ করে না। হতে পারে অশ্লীল বলে। আবার ট্যাবু বলেও। যেমন নুন নাম করে চাইতে নেই। শিশুর হাম হলে হাম বলতে নেই, বলতে হয় মাসিপিসি। কুষ্ঠরোগের নাম করতে নেই, বলতে হয় মহারোগ। হলুদকে হলুদ বলতে নেই, বলতে হয় বর্ণ বা বন্ন। ইত্যাকার নানা বিধি-নিষেধ এবং নারী-পুরুষভেদ পরিহার করে চীনের কিছু অঞ্চলে কেবল মহিলাদের জন্য একটি ভাষা প্রচলিত হয়। এখন তা হারিয়ে যাচ্ছে। একসময় চীনে শুধু পুরুষরা লেখাপড়া করত। বড় ঘরের মেয়েরা পা বাঁধাই করে সামাজিক বিধি-নিষেধ মেনে অন্তঃপুরে দিন কাটাত। খেটে খাওয়া মেয়েদের অবশ্য তেমন বড়মানুষি করা হতো না। কেমন করে চীনের উনান প্রদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে উর্বর উপত্যকায় মেয়েরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করার জন্য এক স্বতন্ত্র ভাষার উদ্ভাবন করে; পণ্ডিতরা তার সৃষ্টি-রহস্য সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন না। দাদি-নানিদের কাছ থেকে নাতনি-পুতনিদের কাছে, বয়স্ক চাচি-মামিদের কাছ থেকে কুমারী ভাইঝি-বোনঝিদের কাছে, সখী থেকে সখীর কাছে এই ভাষা ছড়িয়ে পড়ে। পুরুষ বা ছেলেদের সঙ্গে এ ভাষায় কোনো কথা হতো না। এই ভাষা নুশু বা নারীলিপি। পৃথিবীর নারীদের একক ভাষা।
নুশু ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। বছর চারেক আগে ইয়াং উয়ানির বয়স ছিল ৯৮। নুশু ভাষা সম্পর্কে তিনি বলেন, 'মেয়েরা একসঙ্গে হলে এই ভাষায় কথা বলত এবং আমরা এভাবে এই ভাষা শিখি। এভাবে আমরা নিজেদের প্রকাশ করতাম এবং আমাদের জীবনটা ভালোই ছিল।'
পণ্ডিতবর্গ ও স্থানীয় কর্মকর্তারা নবোৎসাহে এ ভাষা রক্ষার চেষ্টা করছেন। বংশপরম্পরায় মেয়েরা এই ভাষায় তাদের দিনপঞ্জি লিখতেন এবং এতে ব্যক্তিগত জীবনের অনন্য কিছু নিদর্শনের খোঁজ পাওয়া যেত। আজকে মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে চীনা ভাষা শেখে, নুশু ভাষার সেই আকর্ষণ নেই।
চীনা চিত্রাক্ষরের সঙ্গে নুশুর কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে, কোনো কোনো চিত্রাক্ষরের টান লম্বা এবং কিছুটা পরিবর্তিত। যথেষ্ট পার্থক্যও রয়েছে। অক্ষর শব্দের পরিচায়ক। আঞ্চলিক ছেং কুয়ান তুউয়ার শব্দের মতো, লিখিত ও কথ্য চীনা চিত্রাক্ষরের মতো নয়। নুশু লেখা হয় ওপর থেকে নিচে, দীর্ঘায়িত কুণ্ডলীর আকারে এবং পড়তে হয় ডান দিক থেকে বামে। তৃতীয় শতাব্দীতে এই ভাষার জন্ম। দক্ষিণ-মধ্য চীনের উনানের চিয়াং ইয়ংয়ে তার চল ছিল। কোয়াংচোর প্রায় ২০০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে শুং চিয়ান শহরে পুমেই অবস্থিত ছিল। এসব কথা অবশ্য নিশ্চিত করে বলা যায় না।
অবশ্য এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, ওই অঞ্চলের 'অঙ্গীকারবদ্ধ ভগিনী' প্রথা নুশু নারী-ভাষার সূত্রপাত ঘটায়। এই প্রথায় গ্রামের মেয়েরা দিব্যি পরস্পরকে সখী হিসেবে গ্রহণ করত। বিয়ের পর এই সখিত্বে টান পড়ত। তিন দিন পর প্রাপ্ত যৌবনা কনে তৃতীয় দিনের বই পেত। কাপড়ে বাঁধাই সেই বইয়ে কনের মা এবং অঙ্গীকারবদ্ধ বোনেরা কন্যা ও বন্ধু হারানোর দুঃখের কথা লিপিবদ্ধ করত এবং নববিবাহিতার জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করত। এই বইয়ের প্রথম ছয় পৃষ্ঠায় থাকত নুশু ভাষার লেখা দুঃখ ও আশার কথা। যা পুরুষ স্বামী পড়তে পারত না। বাকিটা খালি রাখা হতো, যেখানে কনে তার অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার কথা লিখত। কালক্রমে ব্যক্তিগত দিনপঞ্জির এ এক ধনাগার হয়ে ওঠে। সেই সময় দাদি-নানিরা ওই ভাষায় গান করতেন এবং লিখতে-পড়তে পারতেন। সেই সময় নারী-পুরুষের মধ্যে বেশ বৈষম্য ও অবিচার ছিল এবং নিজেদের প্রকাশ করতে মহিলাদের নুশু ভাষার প্রয়োজন ছিল।
এসব গোপনীয়তার কথা ভেবে পণ্ডিতদের মধ্যে কেউ কেউ ভাবেন যে এই ভাষা সমকামী নারীদের আবিষ্কার। ১৯৮০-এর দশকে বেইজিং এবং সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চাও লিমিং এই ভাষা সম্পর্কে গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর মতে, নুশু সমকামীদের ভাষা, ওই ধারণা সঠিক নয়। মেয়েরা যারা চীনা ভাষা জানত না তারা নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করতে এই ভাষার শরণাপন্ন হয়। যারা এই ভাষা শিখত তারা কাগজের অভাবে হাতের তালুতে লিখে রেখে তা মুখস্থ করত। এই ভাষা নারীদের নিরক্ষতা থেকে মুক্ত করে।
নুশু ভাষা নিয়ে নানা কথা উঠেছে। মিনেসেটো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিল লি লি লিখছেন_জিয়াংইয়ং অঞ্চলের এক মহিলা ১৯৮২ সালে বেইজিংয়ে আত্মীয়স্বজনকে অবাক করে এই ভাষায় গান করে এবং তা লিখে দিলে কেউ তা পড়তে পারে না। ব্যাপারটা পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে গবেষণা শুরু হয়।
নিকটবর্তী শহরের চো শোই মনে করেন ব্যাপারটা অন্য রকম। ছয় প্রজন্ম আগে তাঁর এক নানি 'মেয়েদের শিক্ষা দাও' শীর্ষক একটি কবিতা লেখেন। বংশপরম্পরায় কবিতাটি হাতবদল হয়। স্থানীয় গ্রাম্য মহিলারা তা নুুশু ভাষায় ভাষান্তরিত করে। তাঁর চাচি নুশু ভাষার লেখা কবিতাটা তাঁর বাবার বাড়িতে নিয়ে আসেন ১৯২০ সালের দিকে।
চো-র বাবা একজন স্কুলশিক্ষক। তিনি এই অপরিচিত ভাষায় আকৃষ্ট হয়ে চোকে খোঁজ নিতে বলেন। ১৯৫০ সালের দিকে চিয়াং ইয়ং কাউন্টির সাংস্কৃতিক বিভাগে কাজ করার সময় বয়স্ক একাধিক মহিলাকে চো সেই ভাষা ব্যবহার করতে দেখেন।
চো ব্যাপারটা বেইজিং কর্তৃপক্ষকে জানান। ইতিমধ্যে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ঢেউ উঠলে তাঁকে ডানপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং তাঁকে এ কাজ করতে বাধা দেওয়া হয়। রেডগার্ডরা তাঁর বহু কষ্টে সংগৃহীত নুশু দলিলগুলো নষ্ট করে ফেলে। অবশ্য তাঁর মাথায় যা রয়ে যায়, তা কেউ ধ্বংস করতে পারেনি।
দেশ শান্ত হলে ১৯৭৯ সালে চো স্থানীয় জাদুঘরে গিয়ে নুশু ভাষা লিখতে ও পড়তে শুরু করেন। ১৯৮২ সালে ওই অঞ্চলের সংস্কৃতির ওপর তিনি একট বই লেখেন, যেখানে নুশুর ওপর একটা অধ্যায় ছিল।
উনান প্রাদেশিক সরকার বইটা প্রকাশ করলে নিকটবর্তী উহান ও দূরের বেইজিং এবং কালক্রমে দেশের সর্বত্র নুশুর কথা ছড়িয়ে পড়ে। ২৫ বছর ধরে চো নুশু ভাষায় শিক্ষা দিচ্ছেন। বর্তমানে এই ভাষায় ৬৭০ থেকে ১৫০০ শব্দ রয়েছে। চোর ছাত্ররা এ ভাষায় একটি অভিধান সংকলনে ব্যস্ত আছে। বিদ্বজ্জন ছাড়া ১০ জনেরও কম লোক দ্রুত এই ভাষা ব্যবহার করতে পারেন এবং অনেকেই তাঁদের জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ভাষাটির সাংস্কৃতিক মূল্য ও পর্যটন সম্ভাবনার কথা ভেবে পুমেইকে নুশু সাংস্কৃতিক গ্রাম বলে অভিহিত করেছে। পর্যটকদের জন্য শিল্পীরা ব্যাগ ও রুমালে নুশু অক্ষর এঁকে বিক্রি করতে উৎসাহ বোধ করেন। প্রতিটি নুশু শব্দ তো ফুলের মতো।
লেখক : সাবেক প্রধান বিচারপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা
No comments