সাক্ষাৎকার-আরাফাতের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না by সুহা আরাফাত
আরাফাতের বিধবা স্ত্রী সুহা আরাফাত আলজাজিরার সঙ্গে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার স্বামীর মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। তিনি এটাকে ঘৃণ্য অপরাধ বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি এবং তাদের একমাত্র মেয়ে সুইস একটি প্রতিষ্ঠিত পরীক্ষাগারে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলার সময় এর ফলাফল জানার জন্য কীভাবে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা
করেছেন, তার আনুপূর্বিক বর্ণনা দিয়েছেন। আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর করেছেন সুভাষ সাহা
আলজাজিরা :অনুসন্ধানের ফল জানার পর আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
সুহা :আরাফাতের রক্ত, তার পরিধেয় কাপড়-চোপড়, তার টুপি, তার চুল, অন্তর্বাস_ প্রায় সর্বত্র একই তেজস্ক্রিয় পলোনিয়াম পাওয়া গেছে। আসলে তারা উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয় পলোনিয়াম দেখতে পেয়েছেন। তার অর্থ দাঁড়ায়, আরাফাতের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না।
এখানে আমি অপরাধ সংঘটিত হওয়া দেখতে পাচ্ছি। আর সুইজারল্যান্ডের এই পরীক্ষাগার বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান। এই ফাইন্ডিংসের সঙ্গে তাদের প্রতিষ্ঠানের সুনাম রক্ষার ব্যাপারটি জড়িয়ে আছে। আর ডাক্তাররা যেটা আবিষ্কার করেছেন, সেটা লুকোছাপার কিছু নেই। এই পর্যায়ে আমরা প্রতিষ্ঠানটির বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ পাই।
আরাফাত যখন মৃত্যুবরণ করেন, সেই আট বছর আগে তার শবদেহের কোনোরকম ময়নাতদন্ত হয়নি। তাই আমরা তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কিছুই জানতে পারিনি। তবে এবার যখন তার মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের অনুরোধ নিয়ে আমার কাছে এলো, তখন আমি তাতে সম্মতি দিই। আমি তখন মনে করি যে, মৃত্যুর পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আমার কাছে দেওয়া তার পরিধেয় কাপড়চোপড়সহ অন্যান্য জিনিস থেকে এর কিছু আলামত মিলতে পারে। আর এটা জানার পর আলজাজিরা অনেক বড় ঝুঁকি গ্রহণে সম্মত হয়। তখন সুইস পরীক্ষাগারের শরণাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তারা আমার মেয়ের পরীক্ষার জন্য ডিএনএ সংগ্রহ করে। এই তদন্তে মেয়ে আমার সঙ্গেই ছিল। সে প্রকাশ্যে আসতে চায়নি। তবে কীভাবে তার পিতা মৃত্যুবরণ করলেন, কেউ তাকে খুন করেছে কিনা_ সেসব জানার জন্য সে সবসময় উদগ্রীব থাকত। এ কারণেই সে তার ডিএনএ দিয়েছিল। তার ডিএনএ পাওয়ার পর তারা আমার দেওয়া কাপড়চোপড় ও জিনিসপত্র থেকে পাওয়া ডিএনএর সঙ্গে এর মিল খুঁজতে পরীক্ষা চালায়। উভয় ডিএনএর মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তখন তারা নিশ্চিত হয় যে, আমার দেওয়া কাপড়চোপড় ও জিনিসপত্র আরাফাতেরই।
আমরা নয় মাস আগে এই কাজ শুরু করি। আর এতদিন ধরে সঙ্গোপনে একটা অনুসন্ধান কাজ চালানো যে কতটা কঠিন, তা সহজেই অনুমেয়। আমাকে তার প্রতিটা জিনিস খুঁজে বের করতে হয়েছে। তার ওষুধপত্র, তার ঘড়ি_ সবকিছু। এর ফল পেতে আমাদের তিন মাস অপেক্ষা করতে হয়। কারণ, পলোনিয়ামের পরিমাণ কেমন ছিল এবং তা কতটা উচ্চমাত্রার ছিল, সেটা নির্ণয় করা কঠিন কাজ ছিল। এজন্য পরীক্ষাগারটিকে উচ্চ জটিল পরীক্ষা সম্পন্ন করতে হয়।
তারা আরাফাতের কাপড়চোপড় ও জিনিসপত্রে উচ্চমাত্রার যে পলোনিয়ামের সন্ধান পেল, সেটা স্বাভাবিক পলোনিয়াম নয়। এটা ছিল তেজস্ক্রিয় পলোনিয়াম। এ ধরনের তেজস্ক্রিয় পদার্থ সাধারণত অত্যন্ত উন্নত দেশের কাছে থাকে। আমি আসলে এর মাধ্যমে কী বোঝাতে চাইছি, সেটা খোলাসা করে বলার দরকার পড়ে না।
সুতরাং আমরা এখন তার মৃত্যুর ব্যাপারে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, তার মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল না। ফিলিস্তিনি জনগণ, আরব ও গোটা মুসলিম জাহান এই সত্য জানতে পারবে।
তদন্তের এই ফল পাওয়ার পর আমি অবশ্যই এখন তার দেহাবশেষ কবর থেকে তুলে পরীক্ষার আবেদন জানাব। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবে বলে আশা রাখি। আর তারাও তাদের নেতার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে আগ্রহী। চিকিৎসকরা বলেছেন, এতদিন পর কবর থেকে লাশ তুলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পলোনিয়ামের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে সেটা যদি উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তাসম্পন্ন হয়, তাহলেই কিছুটা পরিমাণে তার অস্তিত্ব মিললেও মিলতে পারে। সুইস চিকিৎসকরা যদিও নিশ্চিত যে, আরাফাতের মৃত্যু এই পলোনিয়াম প্রয়োগেই হয়েছিল, তারপরও বিষয়টি স্পর্শকাতর বিধায় তারা কবর থেকে তার দেহাবশেষ তুলে পরীক্ষা করার মাধ্যমে সব বিতর্কের অবসান ঘটাতে চায়। তবে তাড়াতাড়ি করাটাই ভালো বলে মনে করেন তারা। কারণ বেশি দেরি হয়ে গেলে দেহে পলোনিয়ামের অস্তিত্ব নাও মিলতে পারে।
যদি সত্যি সত্যিই আরাফাতের দেহে পলোনিয়াম প্রয়োগ করা হয়ে থাকে, তবে সব হাড়গোড়েই এর অস্তিত্ব মিলতে পারে। কারণ এটা সারা দেহে ছড়িয়ে যায়।
আমি জানি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে আন্তরিক। কিন্তু তার স্ত্রী হিসেবে আমি আমার কর্তব্য করে যাচ্ছি। আর এ ব্যাপারে চূড়ান্ত দায়টা আমি এবং আমার ১৮ বছরের মেয়ের। সুইস পরীক্ষাগার দিয়ে তদন্তের ব্যাপারে আমাদের অনুমতি ছিল। ফ্রান্স হাসপাতালে যেখানে আরাফাতের চিকিৎসা চলেছে এবং যেখানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন, সেখানকার চিকিৎসকদের আমি সব নমুনা সংরক্ষণের জন্য বলেছিলাম। কিন্তু এবার যখন তার রক্ত ও মূত্রের নমুনা চাইতে গেলাম, আমাকে জানানো হলো, তারা সবকিছু ধ্বংস করে ফেলেছে।
আমি তাদের এই জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। সাধারণত ইয়াসির আরাফাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির দেহের বিভিন্ন পরীক্ষার চিহ্ন তারা রাখবেই_ এটাই স্বতঃসিদ্ধ। মনে হয়, তারা এটাকে ঝামেলা মনে করেছে। এতে তারা জড়িত থাকতে চায়নি। যারা তার চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন ৫০ জনের মতো চিকিৎসকের কাছে আমি তথ্য পাওয়ার জন্য চিঠি লিখি। এদের মধ্যে কেউ তথ্য দেন, কেউ অপারগতা প্রকাশ করেন।
আলজাজিরা :আপনার স্বামীর মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করা এবং তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করাসহ গোটা অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটায় আপনার কেমন বোধ হয়েছে?
সুহা :এটা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক ছিল। আরও কষ্টের ছিল কারণ, এর সঙ্গে আমার মেয়েও জড়িত ছিল। আমরা তদন্তকাজ চলার সময় দেখেছি, এ নিয়ে অনেকেই আমাদের এড়িয়ে যাচ্ছেন। এ সময় আমার মেয়েকে নিয়ে বারবার হাসপাতালে ছুটে যেতে আমার মনে কষ্টকর অনুভূতি হয়েছে। আর যেহেতু প্রতিরক্ষা গোপনীয়তার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল পলোনিয়াম, যার অনুসন্ধানে অনেক প্রতিকূলতাকে আমাদের জয় করতে হয়েছে। কারণ, যারা আমাদের তথ্য দেবে তাদের চাকরি হারানোর ভয় ছিল। তবে এটা যন্ত্রণাদায়ক হলেও আমরা আমাদের প্রতিজ্ঞায় ছিলাম অটল। আর যখন এটা পরিষ্কার হচ্ছিল যে, আরাফাতের মত্যুর সঙ্গে একটা গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে, ততই আমাদের চেষ্টা জোরদার হয়। আর তখনকার সময়ে আরাফাত সম্পর্কে ইসরায়েলি নেতৃবৃন্দ ও মার্কিন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের মন্তব্য মনে করুন। দেখবেন, তারা প্রায় সবাই সমস্বরে আরাফাতকে অপ্রাসঙ্গিক ও শান্তির পথে কাঁটা বলে অভিহিত করছেন। ইসরায়েলের অ্যারিয়েল শ্যারন তো বলেছেন, ঈশ্বর আরাফাতকে তুলে নিয়ে ভালোই করেছেন। না হয় তারাই তাকে খুন করতেন। আর সে সময় আমরা চোখের জলে ভাসছিলাম।
দেখুন, একদিকে আরব বিপ্লবের একনায়কদের শাসনের অবসান ঘটছে, অন্যদিকে এই মানুষরাই দলে দলে আরাফাতের কবরে গিয়ে দোয়া পড়ছে। তাদের কাছে তিনি একজন পীরের মতো। আমরা ফিলিস্তিনের জনগণ হিসেবে এতে গর্ববোধ করি।
আমি ন্যায়বিচারে বিশ্বাস করি। জীবৎকালে বিচার না মিললেও মৃত্যুকালে তা মিলবে। আরব বিপ্লব আসলে এই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।
আলজাজিরা :তার উত্তরাধিকার বলতে আপনি কী বোঝাতে চান?
সুহা :কোনো ভূমির স্বত্ব ত্যাগ না করা।
আলজাজিরা :আরাফাতের দেহাবশেষ কবর থেকে তুলতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। তারা কি আপনাকে অনুমতি দেবে?
সুহা :আমি ইসরায়েলের ব্যাপারে সন্দিহান। তবে চাপ পড়লে তারাও শেষ পর্যন্ত রাজি হতে পারে। তবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ মৃত্যুরহস্যের কিনারা দেখতে চাইবে। এটাই তো স্বাভাবিক।
আলজাজিরা :পরবর্তী পরীক্ষায়ও যদি একই ফলাফল মেলে, তাহলে ফিলিস্তিনের কোনো পরিবর্তন হবে কি?
সুহা :ফিলিস্তিনে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়ে যাবে। অনেক সন্দেহ দূরীভূত হবে। কোনো কোনো মানুষ বলেন যে, আরাফাত ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি গ্রহণ করেননি। শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাননি। তাদের মুখ বন্ধ হবে। আরাফাত আসলে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে শান্তিকে যুক্ত করেছিলেন। জেরুজালেম ছেড়ে দিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো আলোচক শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতে পারবেন না। তখন ১৯৬৭ সালের সীমান্ত, স্বভূমিতে প্রত্যাবর্তন, বন্দি, পানি_ সব বিষয়ই সামনে চলে আসবে।
আগামী ৫০ বছরেও কোনো আলোচনা আরাফাত যে বিশ্বাসের বীজ আমাদের মধ্যে বপন করে গেছেন, তার থেকে এক চুলও হেলাতে পারবে না। জনগণ আজ জেগে উঠছে।
আলজাজিরা :অনুসন্ধানের ফল জানার পর আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
সুহা :আরাফাতের রক্ত, তার পরিধেয় কাপড়-চোপড়, তার টুপি, তার চুল, অন্তর্বাস_ প্রায় সর্বত্র একই তেজস্ক্রিয় পলোনিয়াম পাওয়া গেছে। আসলে তারা উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয় পলোনিয়াম দেখতে পেয়েছেন। তার অর্থ দাঁড়ায়, আরাফাতের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না।
এখানে আমি অপরাধ সংঘটিত হওয়া দেখতে পাচ্ছি। আর সুইজারল্যান্ডের এই পরীক্ষাগার বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান। এই ফাইন্ডিংসের সঙ্গে তাদের প্রতিষ্ঠানের সুনাম রক্ষার ব্যাপারটি জড়িয়ে আছে। আর ডাক্তাররা যেটা আবিষ্কার করেছেন, সেটা লুকোছাপার কিছু নেই। এই পর্যায়ে আমরা প্রতিষ্ঠানটির বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ পাই।
আরাফাত যখন মৃত্যুবরণ করেন, সেই আট বছর আগে তার শবদেহের কোনোরকম ময়নাতদন্ত হয়নি। তাই আমরা তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কিছুই জানতে পারিনি। তবে এবার যখন তার মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের অনুরোধ নিয়ে আমার কাছে এলো, তখন আমি তাতে সম্মতি দিই। আমি তখন মনে করি যে, মৃত্যুর পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আমার কাছে দেওয়া তার পরিধেয় কাপড়চোপড়সহ অন্যান্য জিনিস থেকে এর কিছু আলামত মিলতে পারে। আর এটা জানার পর আলজাজিরা অনেক বড় ঝুঁকি গ্রহণে সম্মত হয়। তখন সুইস পরীক্ষাগারের শরণাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তারা আমার মেয়ের পরীক্ষার জন্য ডিএনএ সংগ্রহ করে। এই তদন্তে মেয়ে আমার সঙ্গেই ছিল। সে প্রকাশ্যে আসতে চায়নি। তবে কীভাবে তার পিতা মৃত্যুবরণ করলেন, কেউ তাকে খুন করেছে কিনা_ সেসব জানার জন্য সে সবসময় উদগ্রীব থাকত। এ কারণেই সে তার ডিএনএ দিয়েছিল। তার ডিএনএ পাওয়ার পর তারা আমার দেওয়া কাপড়চোপড় ও জিনিসপত্র থেকে পাওয়া ডিএনএর সঙ্গে এর মিল খুঁজতে পরীক্ষা চালায়। উভয় ডিএনএর মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তখন তারা নিশ্চিত হয় যে, আমার দেওয়া কাপড়চোপড় ও জিনিসপত্র আরাফাতেরই।
আমরা নয় মাস আগে এই কাজ শুরু করি। আর এতদিন ধরে সঙ্গোপনে একটা অনুসন্ধান কাজ চালানো যে কতটা কঠিন, তা সহজেই অনুমেয়। আমাকে তার প্রতিটা জিনিস খুঁজে বের করতে হয়েছে। তার ওষুধপত্র, তার ঘড়ি_ সবকিছু। এর ফল পেতে আমাদের তিন মাস অপেক্ষা করতে হয়। কারণ, পলোনিয়ামের পরিমাণ কেমন ছিল এবং তা কতটা উচ্চমাত্রার ছিল, সেটা নির্ণয় করা কঠিন কাজ ছিল। এজন্য পরীক্ষাগারটিকে উচ্চ জটিল পরীক্ষা সম্পন্ন করতে হয়।
তারা আরাফাতের কাপড়চোপড় ও জিনিসপত্রে উচ্চমাত্রার যে পলোনিয়ামের সন্ধান পেল, সেটা স্বাভাবিক পলোনিয়াম নয়। এটা ছিল তেজস্ক্রিয় পলোনিয়াম। এ ধরনের তেজস্ক্রিয় পদার্থ সাধারণত অত্যন্ত উন্নত দেশের কাছে থাকে। আমি আসলে এর মাধ্যমে কী বোঝাতে চাইছি, সেটা খোলাসা করে বলার দরকার পড়ে না।
সুতরাং আমরা এখন তার মৃত্যুর ব্যাপারে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, তার মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল না। ফিলিস্তিনি জনগণ, আরব ও গোটা মুসলিম জাহান এই সত্য জানতে পারবে।
তদন্তের এই ফল পাওয়ার পর আমি অবশ্যই এখন তার দেহাবশেষ কবর থেকে তুলে পরীক্ষার আবেদন জানাব। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবে বলে আশা রাখি। আর তারাও তাদের নেতার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে আগ্রহী। চিকিৎসকরা বলেছেন, এতদিন পর কবর থেকে লাশ তুলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পলোনিয়ামের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে সেটা যদি উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তাসম্পন্ন হয়, তাহলেই কিছুটা পরিমাণে তার অস্তিত্ব মিললেও মিলতে পারে। সুইস চিকিৎসকরা যদিও নিশ্চিত যে, আরাফাতের মৃত্যু এই পলোনিয়াম প্রয়োগেই হয়েছিল, তারপরও বিষয়টি স্পর্শকাতর বিধায় তারা কবর থেকে তার দেহাবশেষ তুলে পরীক্ষা করার মাধ্যমে সব বিতর্কের অবসান ঘটাতে চায়। তবে তাড়াতাড়ি করাটাই ভালো বলে মনে করেন তারা। কারণ বেশি দেরি হয়ে গেলে দেহে পলোনিয়ামের অস্তিত্ব নাও মিলতে পারে।
যদি সত্যি সত্যিই আরাফাতের দেহে পলোনিয়াম প্রয়োগ করা হয়ে থাকে, তবে সব হাড়গোড়েই এর অস্তিত্ব মিলতে পারে। কারণ এটা সারা দেহে ছড়িয়ে যায়।
আমি জানি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে আন্তরিক। কিন্তু তার স্ত্রী হিসেবে আমি আমার কর্তব্য করে যাচ্ছি। আর এ ব্যাপারে চূড়ান্ত দায়টা আমি এবং আমার ১৮ বছরের মেয়ের। সুইস পরীক্ষাগার দিয়ে তদন্তের ব্যাপারে আমাদের অনুমতি ছিল। ফ্রান্স হাসপাতালে যেখানে আরাফাতের চিকিৎসা চলেছে এবং যেখানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন, সেখানকার চিকিৎসকদের আমি সব নমুনা সংরক্ষণের জন্য বলেছিলাম। কিন্তু এবার যখন তার রক্ত ও মূত্রের নমুনা চাইতে গেলাম, আমাকে জানানো হলো, তারা সবকিছু ধ্বংস করে ফেলেছে।
আমি তাদের এই জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। সাধারণত ইয়াসির আরাফাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির দেহের বিভিন্ন পরীক্ষার চিহ্ন তারা রাখবেই_ এটাই স্বতঃসিদ্ধ। মনে হয়, তারা এটাকে ঝামেলা মনে করেছে। এতে তারা জড়িত থাকতে চায়নি। যারা তার চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন ৫০ জনের মতো চিকিৎসকের কাছে আমি তথ্য পাওয়ার জন্য চিঠি লিখি। এদের মধ্যে কেউ তথ্য দেন, কেউ অপারগতা প্রকাশ করেন।
আলজাজিরা :আপনার স্বামীর মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করা এবং তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করাসহ গোটা অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটায় আপনার কেমন বোধ হয়েছে?
সুহা :এটা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক ছিল। আরও কষ্টের ছিল কারণ, এর সঙ্গে আমার মেয়েও জড়িত ছিল। আমরা তদন্তকাজ চলার সময় দেখেছি, এ নিয়ে অনেকেই আমাদের এড়িয়ে যাচ্ছেন। এ সময় আমার মেয়েকে নিয়ে বারবার হাসপাতালে ছুটে যেতে আমার মনে কষ্টকর অনুভূতি হয়েছে। আর যেহেতু প্রতিরক্ষা গোপনীয়তার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল পলোনিয়াম, যার অনুসন্ধানে অনেক প্রতিকূলতাকে আমাদের জয় করতে হয়েছে। কারণ, যারা আমাদের তথ্য দেবে তাদের চাকরি হারানোর ভয় ছিল। তবে এটা যন্ত্রণাদায়ক হলেও আমরা আমাদের প্রতিজ্ঞায় ছিলাম অটল। আর যখন এটা পরিষ্কার হচ্ছিল যে, আরাফাতের মত্যুর সঙ্গে একটা গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে, ততই আমাদের চেষ্টা জোরদার হয়। আর তখনকার সময়ে আরাফাত সম্পর্কে ইসরায়েলি নেতৃবৃন্দ ও মার্কিন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের মন্তব্য মনে করুন। দেখবেন, তারা প্রায় সবাই সমস্বরে আরাফাতকে অপ্রাসঙ্গিক ও শান্তির পথে কাঁটা বলে অভিহিত করছেন। ইসরায়েলের অ্যারিয়েল শ্যারন তো বলেছেন, ঈশ্বর আরাফাতকে তুলে নিয়ে ভালোই করেছেন। না হয় তারাই তাকে খুন করতেন। আর সে সময় আমরা চোখের জলে ভাসছিলাম।
দেখুন, একদিকে আরব বিপ্লবের একনায়কদের শাসনের অবসান ঘটছে, অন্যদিকে এই মানুষরাই দলে দলে আরাফাতের কবরে গিয়ে দোয়া পড়ছে। তাদের কাছে তিনি একজন পীরের মতো। আমরা ফিলিস্তিনের জনগণ হিসেবে এতে গর্ববোধ করি।
আমি ন্যায়বিচারে বিশ্বাস করি। জীবৎকালে বিচার না মিললেও মৃত্যুকালে তা মিলবে। আরব বিপ্লব আসলে এই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।
আলজাজিরা :তার উত্তরাধিকার বলতে আপনি কী বোঝাতে চান?
সুহা :কোনো ভূমির স্বত্ব ত্যাগ না করা।
আলজাজিরা :আরাফাতের দেহাবশেষ কবর থেকে তুলতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। তারা কি আপনাকে অনুমতি দেবে?
সুহা :আমি ইসরায়েলের ব্যাপারে সন্দিহান। তবে চাপ পড়লে তারাও শেষ পর্যন্ত রাজি হতে পারে। তবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ মৃত্যুরহস্যের কিনারা দেখতে চাইবে। এটাই তো স্বাভাবিক।
আলজাজিরা :পরবর্তী পরীক্ষায়ও যদি একই ফলাফল মেলে, তাহলে ফিলিস্তিনের কোনো পরিবর্তন হবে কি?
সুহা :ফিলিস্তিনে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়ে যাবে। অনেক সন্দেহ দূরীভূত হবে। কোনো কোনো মানুষ বলেন যে, আরাফাত ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি গ্রহণ করেননি। শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাননি। তাদের মুখ বন্ধ হবে। আরাফাত আসলে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে শান্তিকে যুক্ত করেছিলেন। জেরুজালেম ছেড়ে দিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো আলোচক শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতে পারবেন না। তখন ১৯৬৭ সালের সীমান্ত, স্বভূমিতে প্রত্যাবর্তন, বন্দি, পানি_ সব বিষয়ই সামনে চলে আসবে।
আগামী ৫০ বছরেও কোনো আলোচনা আরাফাত যে বিশ্বাসের বীজ আমাদের মধ্যে বপন করে গেছেন, তার থেকে এক চুলও হেলাতে পারবে না। জনগণ আজ জেগে উঠছে।
No comments