পদ্মা সেতু প্রকল্প-দায় নিতে হবে সরকারকেই by শওকত হোসেন
স্বপ্নের পদ্মা সেতু দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। এ জন্য মূলত দায়ী মাত্র একজন ব্যক্তি। তিনি হলেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী। তাঁর কারণেই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন প্রথমে স্থগিত করে রাখে, আর সর্বশেষ তা বাতিলই করে দিয়েছে দাতা সংস্থাটি।
সৈয়দ আবুল হোসেনের দায়িত্ব ছিল পদ্মা সেতু প্রকল্পের বাস্তবায়ন। কিন্তু তিনি করেছেন ঠিক উল্টোটা। এতে পদ্মা সেতু নির্মাণ যেমন অনিশ্চিত হয়ে গেছে, তার চেয়ে বেশি ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছে দেশ। বাংলাদেশ নিয়ে এত বড় অভিযোগ নিকট ভবিষ্যতে আর কখনো হয়নি। এ ঘটনায় দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকারকে দেশে ও বিদেশে বড় ধরনের ভাবমূর্তির সংকটে পড়তে হলো। এর রাজনৈতিক মূল্য আওয়ামী লীগ ও সরকারকেই দিতে হবে।
এর দায়ও নিতে হবে সরকারকেই। পদ্মা সেতু নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছিল ১০ মাস আগে। এর পর থেকে একের পর এক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ব্যর্থতা দেখিয়েছে সরকার। পাশাপাশি ছিল সবকিছু অস্বীকার করার প্রবণতা। কেবল অস্বীকার করেই চুপ থাকেনি সরকার, সংসদের ভেতরে-বাইরে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্যান্য মন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে একটার পর একটা বক্তৃতা দিয়েছেন। মুখে বলেছেন, সব ষড়যন্ত্র এবং দুর্নীতি হয়নি। একধরনের একগুঁয়েমি দেখিয়েছে সরকার। অথচ ভেতরে ভেতরে ঠিকই আলোচনা চালিয়ে গেছে। এই দ্বৈতনীতির কারণে বারবার বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। এতে ভুল সংকেত যায় বিশ্বব্যাংকের কাছেও।
সরকারের এক উপদেষ্টার অনুরোধে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তির মেয়াদ বাড়ালেও অন্য মন্ত্রীরা এর জন্য বিশ্বব্যাংকের সমালোচনা করেছেন তীব্র ভাষায়। আবার চুক্তি বাতিলের পর এটিকে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত মতামত বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী। অথচ নতুন প্রেসিডেন্ট এসেই বললেন, সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। এসব কর্থবার্তাও বাংলাদেশের পক্ষে যায়নি।
দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) যে সরকারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, তা আবার প্রমাণিত হলো। গত ফেব্রুয়ারিতে তারা তদন্ত করে সার্টিফিকেট দিল যে, কোনো দুর্নীতি হয়নি। কিন্তু গত এপ্রিলের পর বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে নতুন করে আলোচনা শুরু হলে দুদকও নতুন করে তদন্ত শুরু করে। এখানেও রয়েছে বিভ্রান্তি। অর্থমন্ত্রী গত সোমবার এবং প্রধানমন্ত্রী গতকাল বুধবার সংসদে একদিকে বলেছেন, দুর্নীতি প্রমাণিত হলে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আবার তাঁরাই বললেন, কোনো দুর্নীতিই হয়নি। তাহলে দুদক কেন তদন্ত করছে?
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি ছিল। সে অনুযায়ী, দাতা সংস্থাগুলোকে আস্থায় নিয়ে আসার কাজটি ভালোভাবেই করেছিল সরকার। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল তার পরেই। বড় বড় প্রকল্প নিয়ে সরকারগুলোর অতি আগ্রহের পেছনে বড় বড় কমিশন পাওয়ার কথা শোনা যায়। আর বর্তমান সরকারের সময় বেশির ভাগ বড় প্রকল্পই ছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের।
পদ্মা সেতু নিয়ে কিছু একটা হয়েছে, তা প্রথম টের পাওয়া গিয়েছিল ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। অর্থমন্ত্রী গিয়েছিলেন ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় যোগ দিতে। সেখানেই পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে করা একটি তদন্ত প্রতিবেদন অর্থমন্ত্রীকে দেওয়া হয়। ২১ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রীকে এই প্রতিবেদন দেন বিশ্বব্যাংকের ইন্টেগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্ট লিওনার্ড এফ ম্যাকার্থি। প্রতিবেদনে সব অভিযোগের আঙুল ছিল সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ও তার পারিবারিক প্রতিষ্ঠান সাকোর বিরুদ্ধে। প্রতিবেদনে বলা ছিল, যোগাযোগমন্ত্রী ও সাকোর কর্মকর্তারা মিলে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেন যে, সাকো হচ্ছে পদ্মা সেতু নির্মাণের যেকোনো কাজ পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারে একধরনের নীরব প্রতিনিধি (সাইলেন্ট এজেন্ট)। কোনো কাজ পেতে হলে বা প্রাকেযাগ্যতায় টিকতে হলে সাকোকে অর্থ দিতে হবে। সাকোর পক্ষ থেকে ঠিকাদারদের ভয়ভীতিও দেখানো হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাকোরই একজন প্রতিনিধি বিশ্বব্যাংককে জানান, পদ্মা সেতুর মূল অংশের জন্য যে চুক্তিমূল্য হবে, তার একটি নির্দিষ্ট অংশ সাকোর জন্য রাখার ব্যাপারে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর নির্দেশনা ছিল। বলা হয়, সাকোকে নির্দিষ্ট কমিশন দেওয়া হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজটি পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করবেন তিনি।
সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিবেদনটি হাতে পেলেও সরকার মন্ত্রী বদল করে অনেক পরে, গত জানুয়ারিতে। এরপর গত এপ্রিলে আবার একটি প্রতিবেদন দেয় বিশ্বব্যাংক। সেই প্রতিবেদনে মন্ত্রীসহ শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে বলা হয়, তাঁরা কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ১০ শতাংশ কমিশন চেয়েছিলেন।
গত রোববার সংবাদ সম্মেলনে গত বছরের সেপ্টেম্বর ও গত এপ্রিলে দেওয়া চিঠির প্রসঙ্গ এনে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। অর্থমন্ত্রী এর জবাব দেননি। তবে ওই দিন অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠানো ছয়টি চিঠি সাংবাদিকদের দেন। সেসব চিঠি পড়েও প্রধান অভিযোগ যে সাবেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে, তা সুস্পষ্টভাবেই বোঝা যায়।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) জ্যেষ্ঠ সচিব ইকবাল মাহমুদ বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসাবেল এম গুয়েরেরোকে একটি চিঠি লিখেছিলেন গত ২৮ জুন। চিঠিতে বলা হয়, বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ও দুজন কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়া হলে বিশ্বব্যাংক প্রকল্প পুনরায় চালু করবে বলে অর্থমন্ত্রীকে জানান। গওহর রিজভীর সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাদের বৈঠকেও বিষয়টি তোলা হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ ছাড়া উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী অনাগ্রহী ছিলেন। তবে, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এবং নির্বাচনী অঙ্গীকারের প্রতি সম্মান দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন আনেন।
এই তিনজন হলেন: সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী, সাবেক সেতু বিভাগ সচিব ও সাবেক প্রকল্প পরিচালক। এর মধ্যে যোগাযোগমন্ত্রীর মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তন হয়েছে, সেতু বিভাগের সচিবকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে নেওয়া হয়েছে আর প্রকল্প পরিচালকের চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়নি।
গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রীর দেওয়া বিবৃতিতে বলা আছে, ‘ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকের গোপনীয় অনানুষ্ঠানিক প্রস্তাব বিবেচনা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেতু বিভাগে নতুন নেতৃত্ব দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। প্রথমে প্রকল্প পরিচালকের চুক্তি সমাপ্ত করে দেয়া হয়। তারপর সচিবকে অন্যত্র পদায়ন করে নতুন সচিব নিয়োগ দেয়া হয়। সর্বশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভা পুনর্বিন্যাসের উদ্যোগের মাধ্যমে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মাননীয় মন্ত্রীকে অন্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করেন।’
২৮ জুনের চিঠিতে ইআরডি সচিব আরেকটি আলোচিত বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘বিশ্বব্যাংকের আইএনটি বিভাগ গত এপ্রিল মাসে কিছু মানুষের তালিকা দিয়ে বলেছে যে এঁরা কানাডাভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন। একজন বিদেশির ঘুষ নেওয়ার অভিপ্রায় কানাডার আইনে অপরাধ। কিন্তু এই তথাকথিত সারবত্তাহীন “প্রমাণের” ভিত্তিতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে (যাঁদের নিজ নিজ পদ থেকে কয়েক মাস আগেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে) আইনি ব্যবস্থা নেওয়া এ দেশের আইন সমর্থন করে না। তার পরও সরকার দুদককে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে বাংলাদেশি আইনের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।’
কানাডায় এসএনসি-লাভালিনের দুই কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন ও রমেশ সাহার বিচার শুরু হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঘুষ দিতে চাওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। এঁদের একজনের ডায়েরিতেই কাদের ঘুষ দিতে হবে, সেই তালিকা রয়েছে। যিনি ঘুষ দিতে চাইলেন, তাঁর বিচার হচ্ছে। আর যিনি ঘুষ নিতে চাইলেন, তাঁর কিছুই হচ্ছে না। সূত্র জানায়, এটাই বিশ্বব্যাংকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাই বাতিল হলো পদ্মা সেতুর অর্থায়ন।
সরকার প্রথম থেকেই কেবল মন্ত্রীকে রক্ষার চেষ্টা করেছে। তাঁকে যে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দিতে সরকারের আগ্রহ ছিল না, তা বিশ্বব্যাংককে লেখা সরকারি চিঠিপত্রে উল্লেখ রয়েছে। আবার সাবেক যোগাযোমন্ত্রীকে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হলেও ঘটনা থেমে থাকেনি। টেলিযোগাযোগ খাতকে এর সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগ শুরু হয়ে যায়। অর্থাৎ, বেশি অর্থ আছে এমন খাতকে যুক্ত করার চেষ্টা চালানো হয়। কাকতালীয় হতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর বিশ্বব্যাংক এই মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রকল্পের অনুমোদন দেয়নি।
ধারণা করা হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক প্রথম থেকেই পদ্মা সেতু প্রকল্পের ওপর তীক্ষ দৃষ্টি রেখেছিল, এর দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর কারণেই। গত বছরের ৩০ এপ্রিল উইকিলিকস অনেকগুলো গোপন তারবার্তা ফাঁস করে দিয়েছে। ২০১০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টির পাঠানো এক তারবার্তায় বলা ছিল, বাংলাদেশের সড়ক ও রেলযোগাযোগের দায়িত্ব এমন এক মন্ত্রীর কাঁধে রয়েছে, যাঁর ‘সততা প্রশ্নবিদ্ধ’। ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো ওই গোপন তারবার্তায় রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি লিখেছিলেন, ‘চীনের সঙ্গে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাঁকে ঘিরে দুর্নীতির অনেক অভিযোগও রয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমাদের জানিয়েছেন, যোগাযোগমন্ত্রী যে পদ্ধতিতে কাজ করেন, তাতে অনেক সমস্যা রয়েছে।’
একজন লোকের জন্য আজ বাংলাদেশের মর্যাদা নষ্ট হয়েছে। অপমানিত হয়েছে বাংলাদেশ। পদ্মা সেতু নিয়ে সব ধরনের সংকট তৈরি হয় আবুল হোসেনের সময়ে। সুতরাং তাঁরই উচিত চলে যাওয়া। আর সেটি যেহেতু হচ্ছে না, তাঁকে অবিলম্বে সরকার থেকে সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। এই কাজটি প্রধানমন্ত্রীর আগেই করা উচিত ছিল। কেননা, শেখ হাসিনার এত বড় ক্ষতি বিএনপির সবাই মিলেও করতে পারেনি। তাঁর কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নেই—এ কথাটাও তিনি আর কখনো বলতে পারবেন না।
এর দায়ও নিতে হবে সরকারকেই। পদ্মা সেতু নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছিল ১০ মাস আগে। এর পর থেকে একের পর এক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ব্যর্থতা দেখিয়েছে সরকার। পাশাপাশি ছিল সবকিছু অস্বীকার করার প্রবণতা। কেবল অস্বীকার করেই চুপ থাকেনি সরকার, সংসদের ভেতরে-বাইরে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্যান্য মন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে একটার পর একটা বক্তৃতা দিয়েছেন। মুখে বলেছেন, সব ষড়যন্ত্র এবং দুর্নীতি হয়নি। একধরনের একগুঁয়েমি দেখিয়েছে সরকার। অথচ ভেতরে ভেতরে ঠিকই আলোচনা চালিয়ে গেছে। এই দ্বৈতনীতির কারণে বারবার বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। এতে ভুল সংকেত যায় বিশ্বব্যাংকের কাছেও।
সরকারের এক উপদেষ্টার অনুরোধে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তির মেয়াদ বাড়ালেও অন্য মন্ত্রীরা এর জন্য বিশ্বব্যাংকের সমালোচনা করেছেন তীব্র ভাষায়। আবার চুক্তি বাতিলের পর এটিকে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত মতামত বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী। অথচ নতুন প্রেসিডেন্ট এসেই বললেন, সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। এসব কর্থবার্তাও বাংলাদেশের পক্ষে যায়নি।
দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) যে সরকারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, তা আবার প্রমাণিত হলো। গত ফেব্রুয়ারিতে তারা তদন্ত করে সার্টিফিকেট দিল যে, কোনো দুর্নীতি হয়নি। কিন্তু গত এপ্রিলের পর বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে নতুন করে আলোচনা শুরু হলে দুদকও নতুন করে তদন্ত শুরু করে। এখানেও রয়েছে বিভ্রান্তি। অর্থমন্ত্রী গত সোমবার এবং প্রধানমন্ত্রী গতকাল বুধবার সংসদে একদিকে বলেছেন, দুর্নীতি প্রমাণিত হলে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আবার তাঁরাই বললেন, কোনো দুর্নীতিই হয়নি। তাহলে দুদক কেন তদন্ত করছে?
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি ছিল। সে অনুযায়ী, দাতা সংস্থাগুলোকে আস্থায় নিয়ে আসার কাজটি ভালোভাবেই করেছিল সরকার। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল তার পরেই। বড় বড় প্রকল্প নিয়ে সরকারগুলোর অতি আগ্রহের পেছনে বড় বড় কমিশন পাওয়ার কথা শোনা যায়। আর বর্তমান সরকারের সময় বেশির ভাগ বড় প্রকল্পই ছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের।
পদ্মা সেতু নিয়ে কিছু একটা হয়েছে, তা প্রথম টের পাওয়া গিয়েছিল ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। অর্থমন্ত্রী গিয়েছিলেন ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় যোগ দিতে। সেখানেই পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে করা একটি তদন্ত প্রতিবেদন অর্থমন্ত্রীকে দেওয়া হয়। ২১ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রীকে এই প্রতিবেদন দেন বিশ্বব্যাংকের ইন্টেগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্ট লিওনার্ড এফ ম্যাকার্থি। প্রতিবেদনে সব অভিযোগের আঙুল ছিল সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ও তার পারিবারিক প্রতিষ্ঠান সাকোর বিরুদ্ধে। প্রতিবেদনে বলা ছিল, যোগাযোগমন্ত্রী ও সাকোর কর্মকর্তারা মিলে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেন যে, সাকো হচ্ছে পদ্মা সেতু নির্মাণের যেকোনো কাজ পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারে একধরনের নীরব প্রতিনিধি (সাইলেন্ট এজেন্ট)। কোনো কাজ পেতে হলে বা প্রাকেযাগ্যতায় টিকতে হলে সাকোকে অর্থ দিতে হবে। সাকোর পক্ষ থেকে ঠিকাদারদের ভয়ভীতিও দেখানো হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাকোরই একজন প্রতিনিধি বিশ্বব্যাংককে জানান, পদ্মা সেতুর মূল অংশের জন্য যে চুক্তিমূল্য হবে, তার একটি নির্দিষ্ট অংশ সাকোর জন্য রাখার ব্যাপারে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর নির্দেশনা ছিল। বলা হয়, সাকোকে নির্দিষ্ট কমিশন দেওয়া হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজটি পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করবেন তিনি।
সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিবেদনটি হাতে পেলেও সরকার মন্ত্রী বদল করে অনেক পরে, গত জানুয়ারিতে। এরপর গত এপ্রিলে আবার একটি প্রতিবেদন দেয় বিশ্বব্যাংক। সেই প্রতিবেদনে মন্ত্রীসহ শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে বলা হয়, তাঁরা কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ১০ শতাংশ কমিশন চেয়েছিলেন।
গত রোববার সংবাদ সম্মেলনে গত বছরের সেপ্টেম্বর ও গত এপ্রিলে দেওয়া চিঠির প্রসঙ্গ এনে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। অর্থমন্ত্রী এর জবাব দেননি। তবে ওই দিন অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠানো ছয়টি চিঠি সাংবাদিকদের দেন। সেসব চিঠি পড়েও প্রধান অভিযোগ যে সাবেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে, তা সুস্পষ্টভাবেই বোঝা যায়।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) জ্যেষ্ঠ সচিব ইকবাল মাহমুদ বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসাবেল এম গুয়েরেরোকে একটি চিঠি লিখেছিলেন গত ২৮ জুন। চিঠিতে বলা হয়, বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ও দুজন কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়া হলে বিশ্বব্যাংক প্রকল্প পুনরায় চালু করবে বলে অর্থমন্ত্রীকে জানান। গওহর রিজভীর সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাদের বৈঠকেও বিষয়টি তোলা হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ ছাড়া উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী অনাগ্রহী ছিলেন। তবে, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এবং নির্বাচনী অঙ্গীকারের প্রতি সম্মান দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন আনেন।
এই তিনজন হলেন: সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী, সাবেক সেতু বিভাগ সচিব ও সাবেক প্রকল্প পরিচালক। এর মধ্যে যোগাযোগমন্ত্রীর মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তন হয়েছে, সেতু বিভাগের সচিবকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে নেওয়া হয়েছে আর প্রকল্প পরিচালকের চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়নি।
গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রীর দেওয়া বিবৃতিতে বলা আছে, ‘ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকের গোপনীয় অনানুষ্ঠানিক প্রস্তাব বিবেচনা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেতু বিভাগে নতুন নেতৃত্ব দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। প্রথমে প্রকল্প পরিচালকের চুক্তি সমাপ্ত করে দেয়া হয়। তারপর সচিবকে অন্যত্র পদায়ন করে নতুন সচিব নিয়োগ দেয়া হয়। সর্বশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভা পুনর্বিন্যাসের উদ্যোগের মাধ্যমে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মাননীয় মন্ত্রীকে অন্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করেন।’
২৮ জুনের চিঠিতে ইআরডি সচিব আরেকটি আলোচিত বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘বিশ্বব্যাংকের আইএনটি বিভাগ গত এপ্রিল মাসে কিছু মানুষের তালিকা দিয়ে বলেছে যে এঁরা কানাডাভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন। একজন বিদেশির ঘুষ নেওয়ার অভিপ্রায় কানাডার আইনে অপরাধ। কিন্তু এই তথাকথিত সারবত্তাহীন “প্রমাণের” ভিত্তিতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে (যাঁদের নিজ নিজ পদ থেকে কয়েক মাস আগেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে) আইনি ব্যবস্থা নেওয়া এ দেশের আইন সমর্থন করে না। তার পরও সরকার দুদককে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে বাংলাদেশি আইনের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।’
কানাডায় এসএনসি-লাভালিনের দুই কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন ও রমেশ সাহার বিচার শুরু হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঘুষ দিতে চাওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। এঁদের একজনের ডায়েরিতেই কাদের ঘুষ দিতে হবে, সেই তালিকা রয়েছে। যিনি ঘুষ দিতে চাইলেন, তাঁর বিচার হচ্ছে। আর যিনি ঘুষ নিতে চাইলেন, তাঁর কিছুই হচ্ছে না। সূত্র জানায়, এটাই বিশ্বব্যাংকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাই বাতিল হলো পদ্মা সেতুর অর্থায়ন।
সরকার প্রথম থেকেই কেবল মন্ত্রীকে রক্ষার চেষ্টা করেছে। তাঁকে যে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দিতে সরকারের আগ্রহ ছিল না, তা বিশ্বব্যাংককে লেখা সরকারি চিঠিপত্রে উল্লেখ রয়েছে। আবার সাবেক যোগাযোমন্ত্রীকে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হলেও ঘটনা থেমে থাকেনি। টেলিযোগাযোগ খাতকে এর সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগ শুরু হয়ে যায়। অর্থাৎ, বেশি অর্থ আছে এমন খাতকে যুক্ত করার চেষ্টা চালানো হয়। কাকতালীয় হতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর বিশ্বব্যাংক এই মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রকল্পের অনুমোদন দেয়নি।
ধারণা করা হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক প্রথম থেকেই পদ্মা সেতু প্রকল্পের ওপর তীক্ষ দৃষ্টি রেখেছিল, এর দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর কারণেই। গত বছরের ৩০ এপ্রিল উইকিলিকস অনেকগুলো গোপন তারবার্তা ফাঁস করে দিয়েছে। ২০১০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টির পাঠানো এক তারবার্তায় বলা ছিল, বাংলাদেশের সড়ক ও রেলযোগাযোগের দায়িত্ব এমন এক মন্ত্রীর কাঁধে রয়েছে, যাঁর ‘সততা প্রশ্নবিদ্ধ’। ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো ওই গোপন তারবার্তায় রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি লিখেছিলেন, ‘চীনের সঙ্গে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাঁকে ঘিরে দুর্নীতির অনেক অভিযোগও রয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমাদের জানিয়েছেন, যোগাযোগমন্ত্রী যে পদ্ধতিতে কাজ করেন, তাতে অনেক সমস্যা রয়েছে।’
একজন লোকের জন্য আজ বাংলাদেশের মর্যাদা নষ্ট হয়েছে। অপমানিত হয়েছে বাংলাদেশ। পদ্মা সেতু নিয়ে সব ধরনের সংকট তৈরি হয় আবুল হোসেনের সময়ে। সুতরাং তাঁরই উচিত চলে যাওয়া। আর সেটি যেহেতু হচ্ছে না, তাঁকে অবিলম্বে সরকার থেকে সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। এই কাজটি প্রধানমন্ত্রীর আগেই করা উচিত ছিল। কেননা, শেখ হাসিনার এত বড় ক্ষতি বিএনপির সবাই মিলেও করতে পারেনি। তাঁর কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নেই—এ কথাটাও তিনি আর কখনো বলতে পারবেন না।
No comments