সাদাকালো-ভালো-মন্দে কেমন চলছে জীবন by আহমদ রফিক
বিজয় দিবস নয়, স্বাধীনতা দিবস নয়, তবু জুন-জুলাইয়ের গরমে-গুমোটে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে বিতর্ক বড় বেশি উত্তাপ ছড়াচ্ছে। ঘরে-বাইরে আলাপ-আলোচনায়, সংবাদপত্রের মুক্ত কলামে ও টিভি চ্যানেলের টক শোতে মহাবিতর্ক। নানা প্রসঙ্গে উচ্চারণ : 'ভালো নেই বাংলাদেশ।' বিপরীত বিবেচনায় : 'ভালো চলছে বর্তমান বাংলাদেশ।'
এ বিতর্ক যেমন প্রধান দুই বা তিন দলের সমর্থকদের মধ্যে, তেমনি দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের মধ্যে, বিশেষ করে যাঁরা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষ। যাঁরা দলীয় নেতা ও কর্মী কিংবা দলবিশেষের সমর্থক- তাঁদের বিশ্বাস, তাঁদের দলীয় শাসনে দেশের উন্নতি ঘটছে, বিরোধী দলের প্রচার সত্য নয়। বরং প্রতিপক্ষের শাসনামলে তৈরি হয়েছে আর্থ-সামাজিক সমস্যা। এর বিপরীত বক্তব্য বিরোধী দলগুলোর নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের।
আর যাঁরা দলভুক্ত নন এবং সে হিসেবে নিরপেক্ষ; কিন্তু 'শিশু বা পাগল নন', তাঁদের হিসাব-নিকাশ অনেকটাই ভিন্ন। দলীয় চশমা চোখে না থাকায় দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সত্যটা দেখে নিতে তাঁদের ভুল হয় না। তাঁরা একচক্ষু হরিণের মতো নন। আশ্চর্য যে তাঁদেরও কেউ কেউ বলে থাকেন, দেশের অবস্থা সাধারণ বিচারে আগের তুলনায় ভালো।
ওই বক্তব্যের সমর্থনে তাঁরা যেসব যুক্তি তুলে ধরেন, তা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। যেমন- তাঁদের মতে, গ্রামে এখন কোনো মানুষ একেবারে না খেয়ে থাকে না। অভাব আছে; কিন্তু অন্নহীনতা নেই। অনশনে আত্মহত্যার কথা শোনা যায় না, যেমনটা মাঝেমধ্যে ভারতীয় কৃষকদের মধ্যে দেখা যায়, কাগজে তেমন খবর ছাপা হয়।
শহরে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় রিকশাচালকদের গায়ে জামা, সে জামা ছেঁড়াফাড়া নয়। গ্রাম থেকে আসা বস্তিবাসী মানুষ অনাহারে নেই, যদিও দারিদ্র্য রয়েছে। পোশাক শিল্পে কর্মরত গ্রামীণ তরুণীদের উপার্জন, তা যত কমই হোক- গ্রামের দারিদ্র্য কমাতে কিছুটা সাহায্য করেছে এবং করছে। অনেক গ্রামেই আসছে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের উপার্জনের টাকা। অর্থাৎ অর্থনৈতিক অবস্থা মন্দের ভালো, আগের চেয়ে ভালো।
কথাগুলো মিথ্যা নয়। কিন্তু এ সত্যের মধ্যেও যেসব ফাঁকফোকর আছে, সেগুলো নিয়ে প্রশ্নের জবাব মেলে না। কথিত ভালো অবস্থার সঙ্গে অর্থনৈতিক মন্দার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এর মধ্য কোথায় যে 'শুভংকরের ফাঁকি', তা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের বুঝে ওঠা দায়। তবু সাধারণ জ্ঞান বলে, অবস্থা যদি ভালোই হবে, তাহলে অর্থনৈতিক সূচকগুলো নড়বড়ে কেন? কেন এত মূল্যস্ফীতি? কেন কম জাতীয় প্রবৃদ্ধি? কেন ডলার-পাউন্ডের বিপরীতে টাকার মূল্যমান ক্রমেই নামছে, প্রতিবেশী দেশের তুলনায়ও বেশ নিচে। কেন যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া নিত্যদিনের দরকারি জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বমুখী, এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারদর উপেক্ষা করে। কেন দফায় দফায় বড় দাগে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পেট্রল-কেরোসিনের দাম বাড়ছে? বাড়ছে পানির দামও! কেন ভর্তুকি কমাতে বা বাদ দিতে বিদেশি অর্থনৈতিক সংস্থার কঠিন চাপ? এসব 'কেন'র সদুত্তর মেলে না।
যখন মেলে না, তখন কী করে বুঝব যে ভালো আছি বা বাংলাদেশ ভালো আছে? কে বুঝিয়ে দেবে! টিআইবি বা সিডিবির মতো সংগঠন হরদম বলে যাচ্ছে, অর্থনীতি ভালো নেই। ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধে গরম বক্তৃতা বা বিবৃতি দিচ্ছে। দুর্নীতির জন্যই নাকি শেয়ারবাজারে ধস। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কান্না, আর এই ফাঁকে কিছুসংখ্যকের পোয়াবারো। ওই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা কি ভালো আছেন? ভালো থাকতে পারেন? শুনেছি, চরম হতাশায় দু-একজন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।
সত্যি বলতে কি, থেকে থেকে বেসামাল বাজারদর মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলছে। প্রতিদিন গায়ে আঁচড় কে সইতে চায়? কাগজে কাগজে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন। কিন্তু তার কী-ই বা প্রয়োজন। যে বাজারে যায়, তার অভিজ্ঞতাই শেষ কথা। শুধু কি বাজার? জীবনযাপনের প্রতিটি খাতে মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ ও হতাশ করছে। তখন নিম্নবর্গীয়দের ভালো থাকা নিয়ে পূর্বোক্ত সান্ত্বনার ছবিটা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। এবং স্বস্তির কোনো সুবাতাস আনে না। বরং বিপরীত সত্য একজনের জবানিতে হলেও বাস্তবে বহুজনার সত্য হয়ে দাঁড়ায়?
যেমন- জনৈক নিম্নবর্গীয় শ্রেণীর কর্মজীবী আবুল কালাম হতাশার সুরে বলেন : 'বিশ-বাইশ বছর আগে দেড় হাজার টাকার মাস-কাবারি বেতনে যেমন চলতে পারছি, এখন বারো হাজার টাকার মাসিক বেতনেও তেমন চলতে পারি না। চলাই এখন কষ্ট। বাজারে আগুন, বাড়িভাড়া কয়েক গুণ, ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ এত বাড়তি যে লেখাপড়া বন্ধ কইরা না দিতে হয়। তা ছাড়া ডাক্তারের ফি, ওষুধের দাম দিয়া আর পারা যায় না। কেম্নে চলুম? এ অবস্থা আমার মতো মানুষ সবাইর।'
মিরপুরের বাসিন্দা ছাপোষা মানুষ কালামের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। জীবনের পোড়খাওয়া অভিজ্ঞতা তাঁর অনেক। তাঁর পছন্দের সরকারের আমলে অবস্থা স্বচ্ছন্দ নয় বলে তাঁর কষ্টটা আরো বেশি। ভাবছেন, আগামী নির্বাচনে ভোট দিতে আদৌ যাবেন কি না। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ ভোটের রাজনীতি নিয়ে এমন পাগল যে ভোটের বাজনা বাজলেই তাঁর মন উচাটন, মন ছুটে যায় ভোটকেন্দ্রে। কালামও মনে হয় ভোটকেন্দ্রে যাবেন, ভোট দেবেন তাঁর পছন্দসই দলকেই। আশা করেন যে এবার হয়তো অবস্থা অন্য রকম হবে।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এভাবেই দলীয় রাজনীতির জোয়ার-ভাটায় আশা-নিরাশায় ভুগছে; কিন্তু রাজনৈতিক সচেতনতার প্রকাশ ঘটানোর সুযোগ পাচ্ছে না। ভোটের রাজনীতি দেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। ভোট তাকে দিতেই হয়। ইচ্ছা-অনিচ্ছার টানে কাউকে না কাউকে দিতেই হয়। কিন্তু তাতে তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটে না। কবে ঘটবে, আদৌ ঘটকে কি না তার জানা নেই।
কালামের মতো নিম্নবর্গীয় শ্রেণীর মানুষ যেমনই ভাবুক, শিক্ষিত পেশাজীবী সচ্ছল শ্রেণীর সদস্য- কারো কারো মনে হতেই পারে, বাংলাদেশ ভালোই আছে। রাজপথে রাজকীয় দামি গাড়ির যানজট, আকাশছোঁয়া বহুতল ভবন সূর্যাস্ত দেখতে দেয় না, পারিবারিক দামি অনুষ্ঠান- যেমন বিয়েতে কোটি টাকার উর্ধ্বে খরচ, উচ্চবিত্তের সাতমহলা ভবনের জৌলুসে অন্যদের চোখে ঈর্ষার মেঘ জমে, ঈদ উৎসবে তাদের খরচের বান বুঝিয়ে দেয়, দেশে অর্থবিত্তের অভাব নেই। সেটা আরো বুঝতে পারা যায় হরহামেশা কাজে-অকাজে, বায়ুবদলে বিদেশ ভ্রমণের নেশায়। কে বলবে বাংলাদেশ গরিব, তলাবিহীন ঝুড়ি?
হ্যাঁ, বাংলাদেশ ভালো আছে উচ্চ শ্রেণীর সুরম্য প্রাসাদে, সুশ্রী অফিসে, ক্বচিৎ বাগানবাড়িতে আছে শিল্পপতি, বৃহৎ ব্যবসায়ী, উঁচুকেতার রকমারি পেশাজীবী (যাঁদের দিনে লাখ টাকা আয়), রাজনীতিবিদ এবং রাজধানী ও বন্দরনগরীর বিলাসী পরিবারের আরাম-আয়েশের জীবনযাপনে। জুয়েলারি দোকানের বাড়বাড়ন্ত ও সুদর্শন ভিড়েও দেখা যাবে বিত্তবৈভবে ভারাক্রান্ত বাংলাদেশকে।
এদের এক পরিবারের দৈনিক গড় খরচে নিম্নবর্গীয় শত পরিবারের জীবন নির্বাহ সম্ভব। সাধারণ মানুষের চোখে যা বিলাসিতা, কখনো বা অপচয়, তা ওই শ্রেণীতে জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য। অন্য দেশের কথা জানি না, তবে বাংলাদেশে এই জীবনযাত্রা বহিরঙ্গে আধুনিক; কিন্তু মননধর্মের বিচারে সামন্ততান্ত্রিক চরিত্রের, যা অপ্রয়োজনীয় জৌলুসে ও অপচয়ে তৃপ্তির আস্বাদ খোঁজে।
এরা সংখ্যা হিসাবে সমাজের পাঁচ শতাংশেরও কম। তবে 'ওকুপাই ওয়াল স্ট্রিট' আন্দোলনের কথিত এক শতাংশের উর্ধ্বে। বাংলাদেশে এদের অস্বাভাবিক, দ্রুত আবির্ভাব- তাই উচ্চপর্যায়ের সামরিক-বেসামরিক আমলা-পেশাজীবীদের নিয়ে সংখ্যাটা তুলনায় কিছু বেশি। এই দুই বিপরীত মেরুর শ্রেণীবদ্ধ মানুষের দুই বাংলাদেশ নিয়ে বর্তমান বাংলাদেশ।
সুশীল সমাজীরা কোনো সমাজবিশ্লেষক সংগঠনকে দিয়ে একটা সামাজিক জরিপ চালিয়ে অবস্থার একটা বাস্তব চিত্র দেখতে পাবেন। এতে সবারই লাভ, বিশেষ করে যাঁরা সমাজের শ্রেণীবৈষম্য নিয়ে মাথা ঘামান, কথা বলেন বা লেখাজোখা করেন। বিশ্লেষণী জরিপে বোঝা যাবে, কী বিপুল মুনাফার বিনিময়ে অতিদ্রুত বাংলাদেশি ধনিক শ্রেণীর উত্থান, কেমন তাদের শ্রেণীচরিত্র! পাকিস্তানি আমলের সঙ্গে তুলনাও বেশ মজাদার হবে। আরো বোঝা যাবে এই 'হঠাৎ-নবাব' শ্রেণীর শাহী হালচাল একটি অপেক্ষাকৃত গরিব রাষ্ট্রের প্রকৃত আর্থ-সামাজিক পটভূমিতে কতটা অসংগত। গরিবি হালের সামাজিক জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো কতটা জরুরি।
গত কয়েক দশকের পারিবারিক ও সামাজিক ধনের হিসাব নিলেই দেখা যাবে, কত দ্রুত মুনাফাবাজির দৌলতে কত হাজার পোশাক কারখানা এক থেকে দুই, দুই থেকে চার- এই অস্বাভাবিক হারে বেড়ে উঠেছে, তেমনি কতগুলো ব্যাংক, কত সংখ্যক বহু দামি বিলাসবহুল গাড়ি, টিভি চ্যানেল আর ভোগবিলাসে অর্থবিত্তের কী সঞ্চয় আর কী অপচয়! এত সহজে যখন এত অর্জন সম্ভব, তখন কী দরকার পূর্ব উচ্চারিত রাষ্ট্রিক, সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধ নিয়ে মাথা ঘামানো।
বরং যে ব্যবস্থায় শ্রেণীস্বার্থের অভাবিত সুরক্ষা সম্ভব, সেটাই সচল রাখা দরকার। বাংলাদেশে সামরিক, বেসামরিক শাসনব্যবস্থায় এ ধারাই চলেছে। চলেছে সামরিক-বেসামরিক ধনবাদের সঙ্গে রাজনীতির মালাবদলের মাধ্যমে। মুনাফাবাজি ও বিত্তের সঙ্গে দুর্নীতির, দুর্নীতির সঙ্গে রাজনীতির স্থায়ী বন্ধন তৈরি হয়ে গেছে। এ বন্ধন সহজে ছিন্ন হওয়ার নয়।
বাংলাদেশে তাই আনুমানিক প্রায় চার-পাঁচ শতাংশ উচ্চবর্গীয় মানুষ বেশ ভালো আছেন। হয়তো আরো ১০-১৫ শতাংশ মানুষ মোটামুটি ভালো। এভাবে ভালো থাকার সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেয়ে নিম্নআয়ে পৌঁছে গেছে। শ্রেণীস্বার্থের সিন্ডিকেট না ভেঙে ফেলা অবধি- এই সাধারণ অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখবে না। এটাই বর্তমান বাংলাদেশের সমাজ-বাস্তবতা।
অবাঞ্ছিত এ বাস্তবতার পরিবর্তন ঘটাতে দরকার সমাজ পরিবর্তন। দরকার বৈষম্যহীন সমাজ। একমাত্র জনস্বার্থের শাসনব্যবস্থাই আনতে পারে বাঞ্ছিত পরিবর্তন। সে শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন কিভাবে সম্ভব? পদ্ধতি বিচারে মতভেদ অনেক। কারো মতে বিপ্লব, কারো মতে সংসদীয় নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি। দেশের সমাজবাস্তবতাই বলে দিতে পারে, কোন্টা সঠিক পথ।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক
আর যাঁরা দলভুক্ত নন এবং সে হিসেবে নিরপেক্ষ; কিন্তু 'শিশু বা পাগল নন', তাঁদের হিসাব-নিকাশ অনেকটাই ভিন্ন। দলীয় চশমা চোখে না থাকায় দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সত্যটা দেখে নিতে তাঁদের ভুল হয় না। তাঁরা একচক্ষু হরিণের মতো নন। আশ্চর্য যে তাঁদেরও কেউ কেউ বলে থাকেন, দেশের অবস্থা সাধারণ বিচারে আগের তুলনায় ভালো।
ওই বক্তব্যের সমর্থনে তাঁরা যেসব যুক্তি তুলে ধরেন, তা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। যেমন- তাঁদের মতে, গ্রামে এখন কোনো মানুষ একেবারে না খেয়ে থাকে না। অভাব আছে; কিন্তু অন্নহীনতা নেই। অনশনে আত্মহত্যার কথা শোনা যায় না, যেমনটা মাঝেমধ্যে ভারতীয় কৃষকদের মধ্যে দেখা যায়, কাগজে তেমন খবর ছাপা হয়।
শহরে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় রিকশাচালকদের গায়ে জামা, সে জামা ছেঁড়াফাড়া নয়। গ্রাম থেকে আসা বস্তিবাসী মানুষ অনাহারে নেই, যদিও দারিদ্র্য রয়েছে। পোশাক শিল্পে কর্মরত গ্রামীণ তরুণীদের উপার্জন, তা যত কমই হোক- গ্রামের দারিদ্র্য কমাতে কিছুটা সাহায্য করেছে এবং করছে। অনেক গ্রামেই আসছে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের উপার্জনের টাকা। অর্থাৎ অর্থনৈতিক অবস্থা মন্দের ভালো, আগের চেয়ে ভালো।
কথাগুলো মিথ্যা নয়। কিন্তু এ সত্যের মধ্যেও যেসব ফাঁকফোকর আছে, সেগুলো নিয়ে প্রশ্নের জবাব মেলে না। কথিত ভালো অবস্থার সঙ্গে অর্থনৈতিক মন্দার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এর মধ্য কোথায় যে 'শুভংকরের ফাঁকি', তা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের বুঝে ওঠা দায়। তবু সাধারণ জ্ঞান বলে, অবস্থা যদি ভালোই হবে, তাহলে অর্থনৈতিক সূচকগুলো নড়বড়ে কেন? কেন এত মূল্যস্ফীতি? কেন কম জাতীয় প্রবৃদ্ধি? কেন ডলার-পাউন্ডের বিপরীতে টাকার মূল্যমান ক্রমেই নামছে, প্রতিবেশী দেশের তুলনায়ও বেশ নিচে। কেন যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া নিত্যদিনের দরকারি জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বমুখী, এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারদর উপেক্ষা করে। কেন দফায় দফায় বড় দাগে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পেট্রল-কেরোসিনের দাম বাড়ছে? বাড়ছে পানির দামও! কেন ভর্তুকি কমাতে বা বাদ দিতে বিদেশি অর্থনৈতিক সংস্থার কঠিন চাপ? এসব 'কেন'র সদুত্তর মেলে না।
যখন মেলে না, তখন কী করে বুঝব যে ভালো আছি বা বাংলাদেশ ভালো আছে? কে বুঝিয়ে দেবে! টিআইবি বা সিডিবির মতো সংগঠন হরদম বলে যাচ্ছে, অর্থনীতি ভালো নেই। ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধে গরম বক্তৃতা বা বিবৃতি দিচ্ছে। দুর্নীতির জন্যই নাকি শেয়ারবাজারে ধস। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কান্না, আর এই ফাঁকে কিছুসংখ্যকের পোয়াবারো। ওই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা কি ভালো আছেন? ভালো থাকতে পারেন? শুনেছি, চরম হতাশায় দু-একজন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।
সত্যি বলতে কি, থেকে থেকে বেসামাল বাজারদর মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলছে। প্রতিদিন গায়ে আঁচড় কে সইতে চায়? কাগজে কাগজে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন। কিন্তু তার কী-ই বা প্রয়োজন। যে বাজারে যায়, তার অভিজ্ঞতাই শেষ কথা। শুধু কি বাজার? জীবনযাপনের প্রতিটি খাতে মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ ও হতাশ করছে। তখন নিম্নবর্গীয়দের ভালো থাকা নিয়ে পূর্বোক্ত সান্ত্বনার ছবিটা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। এবং স্বস্তির কোনো সুবাতাস আনে না। বরং বিপরীত সত্য একজনের জবানিতে হলেও বাস্তবে বহুজনার সত্য হয়ে দাঁড়ায়?
যেমন- জনৈক নিম্নবর্গীয় শ্রেণীর কর্মজীবী আবুল কালাম হতাশার সুরে বলেন : 'বিশ-বাইশ বছর আগে দেড় হাজার টাকার মাস-কাবারি বেতনে যেমন চলতে পারছি, এখন বারো হাজার টাকার মাসিক বেতনেও তেমন চলতে পারি না। চলাই এখন কষ্ট। বাজারে আগুন, বাড়িভাড়া কয়েক গুণ, ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ এত বাড়তি যে লেখাপড়া বন্ধ কইরা না দিতে হয়। তা ছাড়া ডাক্তারের ফি, ওষুধের দাম দিয়া আর পারা যায় না। কেম্নে চলুম? এ অবস্থা আমার মতো মানুষ সবাইর।'
মিরপুরের বাসিন্দা ছাপোষা মানুষ কালামের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। জীবনের পোড়খাওয়া অভিজ্ঞতা তাঁর অনেক। তাঁর পছন্দের সরকারের আমলে অবস্থা স্বচ্ছন্দ নয় বলে তাঁর কষ্টটা আরো বেশি। ভাবছেন, আগামী নির্বাচনে ভোট দিতে আদৌ যাবেন কি না। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ ভোটের রাজনীতি নিয়ে এমন পাগল যে ভোটের বাজনা বাজলেই তাঁর মন উচাটন, মন ছুটে যায় ভোটকেন্দ্রে। কালামও মনে হয় ভোটকেন্দ্রে যাবেন, ভোট দেবেন তাঁর পছন্দসই দলকেই। আশা করেন যে এবার হয়তো অবস্থা অন্য রকম হবে।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এভাবেই দলীয় রাজনীতির জোয়ার-ভাটায় আশা-নিরাশায় ভুগছে; কিন্তু রাজনৈতিক সচেতনতার প্রকাশ ঘটানোর সুযোগ পাচ্ছে না। ভোটের রাজনীতি দেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। ভোট তাকে দিতেই হয়। ইচ্ছা-অনিচ্ছার টানে কাউকে না কাউকে দিতেই হয়। কিন্তু তাতে তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটে না। কবে ঘটবে, আদৌ ঘটকে কি না তার জানা নেই।
কালামের মতো নিম্নবর্গীয় শ্রেণীর মানুষ যেমনই ভাবুক, শিক্ষিত পেশাজীবী সচ্ছল শ্রেণীর সদস্য- কারো কারো মনে হতেই পারে, বাংলাদেশ ভালোই আছে। রাজপথে রাজকীয় দামি গাড়ির যানজট, আকাশছোঁয়া বহুতল ভবন সূর্যাস্ত দেখতে দেয় না, পারিবারিক দামি অনুষ্ঠান- যেমন বিয়েতে কোটি টাকার উর্ধ্বে খরচ, উচ্চবিত্তের সাতমহলা ভবনের জৌলুসে অন্যদের চোখে ঈর্ষার মেঘ জমে, ঈদ উৎসবে তাদের খরচের বান বুঝিয়ে দেয়, দেশে অর্থবিত্তের অভাব নেই। সেটা আরো বুঝতে পারা যায় হরহামেশা কাজে-অকাজে, বায়ুবদলে বিদেশ ভ্রমণের নেশায়। কে বলবে বাংলাদেশ গরিব, তলাবিহীন ঝুড়ি?
হ্যাঁ, বাংলাদেশ ভালো আছে উচ্চ শ্রেণীর সুরম্য প্রাসাদে, সুশ্রী অফিসে, ক্বচিৎ বাগানবাড়িতে আছে শিল্পপতি, বৃহৎ ব্যবসায়ী, উঁচুকেতার রকমারি পেশাজীবী (যাঁদের দিনে লাখ টাকা আয়), রাজনীতিবিদ এবং রাজধানী ও বন্দরনগরীর বিলাসী পরিবারের আরাম-আয়েশের জীবনযাপনে। জুয়েলারি দোকানের বাড়বাড়ন্ত ও সুদর্শন ভিড়েও দেখা যাবে বিত্তবৈভবে ভারাক্রান্ত বাংলাদেশকে।
এদের এক পরিবারের দৈনিক গড় খরচে নিম্নবর্গীয় শত পরিবারের জীবন নির্বাহ সম্ভব। সাধারণ মানুষের চোখে যা বিলাসিতা, কখনো বা অপচয়, তা ওই শ্রেণীতে জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য। অন্য দেশের কথা জানি না, তবে বাংলাদেশে এই জীবনযাত্রা বহিরঙ্গে আধুনিক; কিন্তু মননধর্মের বিচারে সামন্ততান্ত্রিক চরিত্রের, যা অপ্রয়োজনীয় জৌলুসে ও অপচয়ে তৃপ্তির আস্বাদ খোঁজে।
এরা সংখ্যা হিসাবে সমাজের পাঁচ শতাংশেরও কম। তবে 'ওকুপাই ওয়াল স্ট্রিট' আন্দোলনের কথিত এক শতাংশের উর্ধ্বে। বাংলাদেশে এদের অস্বাভাবিক, দ্রুত আবির্ভাব- তাই উচ্চপর্যায়ের সামরিক-বেসামরিক আমলা-পেশাজীবীদের নিয়ে সংখ্যাটা তুলনায় কিছু বেশি। এই দুই বিপরীত মেরুর শ্রেণীবদ্ধ মানুষের দুই বাংলাদেশ নিয়ে বর্তমান বাংলাদেশ।
সুশীল সমাজীরা কোনো সমাজবিশ্লেষক সংগঠনকে দিয়ে একটা সামাজিক জরিপ চালিয়ে অবস্থার একটা বাস্তব চিত্র দেখতে পাবেন। এতে সবারই লাভ, বিশেষ করে যাঁরা সমাজের শ্রেণীবৈষম্য নিয়ে মাথা ঘামান, কথা বলেন বা লেখাজোখা করেন। বিশ্লেষণী জরিপে বোঝা যাবে, কী বিপুল মুনাফার বিনিময়ে অতিদ্রুত বাংলাদেশি ধনিক শ্রেণীর উত্থান, কেমন তাদের শ্রেণীচরিত্র! পাকিস্তানি আমলের সঙ্গে তুলনাও বেশ মজাদার হবে। আরো বোঝা যাবে এই 'হঠাৎ-নবাব' শ্রেণীর শাহী হালচাল একটি অপেক্ষাকৃত গরিব রাষ্ট্রের প্রকৃত আর্থ-সামাজিক পটভূমিতে কতটা অসংগত। গরিবি হালের সামাজিক জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো কতটা জরুরি।
গত কয়েক দশকের পারিবারিক ও সামাজিক ধনের হিসাব নিলেই দেখা যাবে, কত দ্রুত মুনাফাবাজির দৌলতে কত হাজার পোশাক কারখানা এক থেকে দুই, দুই থেকে চার- এই অস্বাভাবিক হারে বেড়ে উঠেছে, তেমনি কতগুলো ব্যাংক, কত সংখ্যক বহু দামি বিলাসবহুল গাড়ি, টিভি চ্যানেল আর ভোগবিলাসে অর্থবিত্তের কী সঞ্চয় আর কী অপচয়! এত সহজে যখন এত অর্জন সম্ভব, তখন কী দরকার পূর্ব উচ্চারিত রাষ্ট্রিক, সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধ নিয়ে মাথা ঘামানো।
বরং যে ব্যবস্থায় শ্রেণীস্বার্থের অভাবিত সুরক্ষা সম্ভব, সেটাই সচল রাখা দরকার। বাংলাদেশে সামরিক, বেসামরিক শাসনব্যবস্থায় এ ধারাই চলেছে। চলেছে সামরিক-বেসামরিক ধনবাদের সঙ্গে রাজনীতির মালাবদলের মাধ্যমে। মুনাফাবাজি ও বিত্তের সঙ্গে দুর্নীতির, দুর্নীতির সঙ্গে রাজনীতির স্থায়ী বন্ধন তৈরি হয়ে গেছে। এ বন্ধন সহজে ছিন্ন হওয়ার নয়।
বাংলাদেশে তাই আনুমানিক প্রায় চার-পাঁচ শতাংশ উচ্চবর্গীয় মানুষ বেশ ভালো আছেন। হয়তো আরো ১০-১৫ শতাংশ মানুষ মোটামুটি ভালো। এভাবে ভালো থাকার সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেয়ে নিম্নআয়ে পৌঁছে গেছে। শ্রেণীস্বার্থের সিন্ডিকেট না ভেঙে ফেলা অবধি- এই সাধারণ অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখবে না। এটাই বর্তমান বাংলাদেশের সমাজ-বাস্তবতা।
অবাঞ্ছিত এ বাস্তবতার পরিবর্তন ঘটাতে দরকার সমাজ পরিবর্তন। দরকার বৈষম্যহীন সমাজ। একমাত্র জনস্বার্থের শাসনব্যবস্থাই আনতে পারে বাঞ্ছিত পরিবর্তন। সে শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন কিভাবে সম্ভব? পদ্ধতি বিচারে মতভেদ অনেক। কারো মতে বিপ্লব, কারো মতে সংসদীয় নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি। দেশের সমাজবাস্তবতাই বলে দিতে পারে, কোন্টা সঠিক পথ।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক
No comments