এশিয়ায় গৃহশিক্ষকের পেছনে ব্যয় শত কোটি ডলার

সন্তানদের পড়ালেখার জন্য গৃহশিক্ষকের (প্রাইভেট টিউটর) ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন এশিয়ার দেশগুলোর মা-বাবারা। এটা করতে গিয়ে প্রতিবছর প্রাইভেট টিউটরের পেছনে কয়েক শ কোটি ডলার খরচ হচ্ছে। গৃহশিক্ষার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও এটা লাভজনক ব্যবসা হিসেবে ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে।


এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক গবেষণায় ওঠে এসেছে এ তথ্য। গবেষণা প্রতিবেদনটি গতকাল বুধবার প্রকাশ করা হয়েছে।
এডিবির গবেষণায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত পাঠ গ্রহণের বাইরে গৃহশিক্ষকের কাছে পাঠ নেওয়ার এই বিষয়টির নাম দেওয়া হয়েছে 'ছায়া শিক্ষা' (শ্যাডো অ্যাডুকেশন) ব্যবস্থা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়ার দেশগুলোতে ছায়া শিক্ষা এখন লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে এবং তা দ্রুতই বাড়ছে। শুধু ধনী দেশগুলোই নয়, এই ব্যবসা এখন এশিয়ার দরিদ্র দেশগুলোতেও দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। মা-বাবারা তাঁদের সন্তানদের একটি চমৎকার জীবনের সূচনা করে দিতেই গৃহশিক্ষকের দ্বারস্থ হচ্ছেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রাথমিক স্তরের ছেলেমেয়েদের ১০ জনের মধ্যে ৯ জনেরই গৃহশিক্ষক রয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ১০ জন ছাত্রের মধ্যে গৃহশিক্ষক রয়েছে ছয়জনের। প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্যান্য দেশে এই অনুপাত কিছুটা কম হলেও এশিয়ার দেশগুলোতে 'ছায়া শিক্ষার' প্রসার ক্রমেই বাড়ছে এবং তীব্র হচ্ছে। স্কুলের বাইরে এই অতিরিক্ত পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ কমানোর লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে তাদের শিক্ষাব্যবস্থাটি পর্যালোচনা করে দেখতে আহ্বান জানিয়েছে এডিবি।
মূলত পড়াশোনায় তুলনামূলক কাঁচা শিক্ষার্থীদের আরেকটু ভালো করা এবং যারা ভালো তারা যেন আরো ভালো ফল করতে পারে, সে লক্ষ্যেই মা-বাবারা সন্তানদের গৃহশিক্ষকের কাছে পাঠান। এশিয়ার অনেক মা-বাবাই বিষয়টিকে গঠনমূলক হিসেবে মনে করেন। গৃহশিক্ষকদের কাছে সন্তানদের পাঠাতে গিয়ে শিশু-কিশোরদের স্কুলের বাইরের অবসর সময়টাকেই বেছে নেন মা-বাবারা। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাইভেট টিউটরের কাছে সময় দিতে গিয়ে খেলাধুলাসহ ছেলেমেয়েদের শরীর-মন গঠনের জন্য জরুরি বিষয়গুলোর সময় কমে আসছে। দেখা গেছে, টাকাওয়ালা মা-বাবারা তাঁদের ছেলেমেয়েদের ভালো গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা করতে পারছেন। এ বিষয়টি সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি করছে বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়।
ইউনিভার্সিটি অফ হংকংস কম্পারেটিভ অ্যাডুকেশন রিসার্চ সেন্টারের সহায়তায় এডিবি এ গবেষণা চালায়। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, দক্ষিণ কোরিয়ায় গৃহশিক্ষকের পেছনে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয়, তা শিক্ষা খাতে সরকারের মোট ব্যয়ের ৮০ শতাংশের সমান। দেখা গেছে, জাপানে ২০১০ সালে গৃহশিক্ষকের পেছনে এক হাজার ২০০ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। আর ২০০৮ সালে সিঙ্গাপুরে ব্যয় হয়েছে ৬৮ কোটি ডলার। হংকংয়ে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রছাত্রীদের ৮৫ শতাংশ গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে যায়। দেশটিতে বিভিন্ন কম্পানি পত্রিকা, টেলিভিশন এমনকি রাস্তায় চলাচলরত বাসের পেছনে 'স্টার' টিউটর জাতীয় আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের আকৃষ্ট করে থাকে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, 'অন্যান্য দেশে গৃহশিক্ষকের পেছনে খরচ কিছুটা কম হলেও এসব দেশ ওই একই অবস্থার দিকে এগুচ্ছে।'
গৃহশিক্ষকের দ্বারস্থ হওয়ার প্রবণতা বাড়লেও বিশেষ করে পূর্ব এশিয়ায় এই শিক্ষাব্যবস্থার কার্যকারিতার ক্ষেত্রে মিশ্র ফলাফল লক্ষ করা গেছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, 'এই কার্যকারিতা শুধু ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ হওয়ার ক্ষমতা ও প্রতিভার ওপরই নির্ভর করে না, এটি গৃহশিক্ষকের উদ্বুদ্ধ করার ক্ষমতা ও প্রতিভার ওপরও অনেকটা নির্ভরশীল। অনেক দেশেই কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই গৃহশিক্ষক বনে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। এদের শিক্ষাদানের কিছু কিছু ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।'
প্রতিবেদনে গৃহশিক্ষাব্যবস্থার দিকটিতে সরকারকে নজর দেওয়ার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি এশিয়ার শিক্ষাব্যবস্থার একটা পর্যালোচনার দাবি জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, ''মূলধারার শিক্ষার চেয়ে 'ছায়া শিক্ষা' কেন বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, তা সরকারের খুঁজে বের করা উচিত এবং সম্পূরক শিক্ষার যদি একান্তই দরকার হয়_তবে তা কিভাবে মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়, সেটি ভেবে দেখা উচিত।'' সূত্র : এএফপি।

No comments

Powered by Blogger.