পরাজয়ের ধ্বংসস্তূপ by সৈয়দ তালাত হুসেইন

মোহালিতে অনুষ্ঠিত ভারত-পাকিস্তান সেমিফাইনাল ম্যাচটি থেকে আমরা দুটি দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করেছি। প্রথমটি হলো, পাকিস্তান ও ভারতের সাধারণ মানুষের মতামতের বিচিত্র ধরন। আর দ্বিতীয়টি হলো, পরাজয়ের পর আমাদের জাতীয় আত্মসন্তুষ্টির চেহারা।


এ ম্যাচে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের শান্তি প্রতিষ্ঠার কতটা ইচ্ছা রয়েছে, তার বাস্তব চেহারাটা দেখা গেছে। ভারতের প্রচারমাধ্যমের সামনে সুযোগ ছিল ভদ্রতা ও নম্রতা প্রদর্শন করে পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বের দুয়ার উন্মুক্ত করার। কিন্তু তা না করে যা করা হয়েছে, তা জাতীয় পর্যায়ে এক ধরনের তিরস্কার ছাড়া আর কিছুই নয় এবং সেটা চলেছে কয়েক দিন ধরেই।
স্বাগতিক দেশটি পাকিস্তান দলের ব্যাপারে স্পেশাল কেয়ার নিয়েছে। কিন্তু প্রচারমাধ্যমের একটি বড় অংশ পাকিস্তান দল এবং দলের অধিনায়ককে নিয়ে এতটাই শোরগোল করেছে, যেন অন্য একটি জগৎ থেকে আসা দখলদার সেনাবাহিনী সে দেশে ঢুকে পড়েছে। বিতর্কের নামে তারা পাকিস্তান দলকে বেসামালভাবে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে। সেমিফাইনাল যতই আগাতে থাকে, বিষয়টি ততই সভ্যতার মাপকাঠির বাইরে চলে যেতে থাকে। এটি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের মনস্তাত্তি্বক যুদ্ধ ছাড়া আর কিছুই নয়। কিছু নির্দিষ্ট তথ্য ও কিছু বিতর্ক সৃষ্টিকারী উদাহরণ জড়ো করে দলটির বিরুদ্ধে কুৎসা চলতে থাকে। কপিল দেব বললেন, 'পাকিস্তানিদের কত কম প্রশংসা প্রাপ্য।' ভারত যখন একটু চাপের মুখে, রবি শাস্ত্রী দুই দলের তুলনা করতে গিয়ে সব যুক্তি হারিয়ে ফেললেন এবং তুলনা করলেন পাকিস্তানকে একটি নড়বড়ে রিকশা এবং ভারতকে একটি বিএমডাবি্লউ গাড়ির সঙ্গে।
স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর আক্রমণ ছিল রীতিমতো বিষাক্ত। বেশ কয়েকটি টেলিভিশন শোতে ভারতের চলচ্চিত্র অভিনেতা ও সংগীতশিল্পীদের পাকিস্তানকে নিয়ে উপহাস করা অনেকটা নিয়মে দাঁড়িয়ে যেতে দেখা গেছে। আমরা জানি, প্রচারমাধ্যমের কর্মকাণ্ড সব কিছু কেড়ে নিতে পারে। যেকোনো বিষয়কে প্রচারমাধ্যম বিপথে নিয়ে যেতে পারে। প্রপাগান্ডা সৃষ্টি করতে পারে। আমরা পাকিস্তানে সব সময় তা ঘটতে দেখেছি, সে বিবেচনায় পাকিস্তানকে নিয়ে ভারতের কিছু প্রচারণা ও লেখা সহনশীল বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এবারের সুযোগটি ছিল ব্যাপক এবং সুনির্দিষ্ট। ক্ষণিকের জন্য হলেও তারা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর ব্যাপারে সব ধরনের সহনশীলতা, এমনকি ভারসাম্য পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছিল। এর চেয়েও বিপজ্জনক বিষয় ছিল, ভারতের সমাজের উদার অংশ যাঁরা সাধারণত নিজেদের দেশে অ্যান্টি-পাকিস্তান হিস্টিরিয়াকে এড়িয়ে চলেন, তাঁরাও আর প্রতিবেশীদের নিয়ে আলোচনায় ঘৃণা লুকিয়ে রাখতে পারেননি। ম্যাচ শুরুর আগে শহীদ আফ্রিদি এ নির্যাতনের কথা উল্লেখ করেছেন যে এমন আর কোনো দেশকে নিয়ে হয়নি।
ব্যাপারটি এমন ছিল, যেন মোহালির ম্যাচ পুরো ভারতকে আবর্জনা হিসেবে দেখার টিকিট করে দিয়েছে। ক্রিকেট যেন পুরো জাতিকে একত্র করেছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর জন্য। পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা তৈরির যে কথা বলা হয়, তা মোহালির এ ম্যাচের অভিজ্ঞতার সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না। যখন একটি ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরির এবং তা সীমানার বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় এল, তখন ভারত থেকে যে মেইলগুলো রিসিভ করা গেল তা ঘৃণা ছাড়া আর কিছু নয়।
দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি হলো, আমাদের পরাজয়ের পর আমরা বিষয়টিকে কিভাবে দেখলাম সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের করুণ পারফরম্যান্সের পর একটি মিথ্যা বীরত্বের গল্প সামনে নিয়ে আসা হলো। এ প্রচারণার মূলে রয়েছে আমরা যেন কোনো প্রশ্ন না করি, কোনো সমালোচনা না শুনি এবং কোনো অভিযোগ না করি; কারণ আমরা আমাদের দলকে ভালোবাসি। এ মন্ত্র মূলত এসেছে কিছু বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে, যেগুলোর সঙ্গে কিছু খেলোয়াড়ের বড় বড় চুক্তি রয়েছে। ম্যাচের পর এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু সমস্যা দেখা দেয়। পোস্টারে যাঁদের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, তাঁরা গ্রাহকদের কাছে খাটো হয়ে গেছেন। ক্রিকেটারদের জন্য তাই অব্যাহতভাবে বীরত্ব ও তাঁদের পূজা করা অপরিহার্য। আর সেটা হতে পারে যদি বলা যায় যে মোহালির ম্যাচ ছিল পাকিস্তান ক্রিকেটের জন্য চমৎকার।
লেখক : ডন নিউজের সিনিয়র সাংবাদিক।
দ্য ডন থেকে ইষৎ সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর : মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.