কল্পকথার গল্প-ওপরের নির্দেশ-খাসা আছি, আছি বেশ by আলী হাবিব

ঈশ্বর কোথায় থাকেন? নাস্তিকদের কথা আলাদা। বিশ্বাসীদের ধারণা, ঈশ্বর থাকেন ঊর্ধ্বালোকে। সেখান থেকে তিনি এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড শাসন করেন। তাঁর ইচ্ছাতেই গাছের পাতা নড়ে। নদীতে জোয়ার-ভাটা হয়। পুরাণে এক মহাপ্রলয়ের কথা আছে। সেই মহাপ্রলয় শেষে এই পৃথিবী ছিল অন্ধকারময়।


তখন বিরাট মহাপুরুষ পরমব্রহ্ম নিজ তেজে সেই অন্ধকার দূর করার জন্য পানি সৃষ্টি করলেন। সেই পানিতে নিক্ষিপ্ত হলো সৃষ্টির বীজ। এরপর নানা ঘটনা। একটি অংশ আকাশ হলো। আরেক অংশ হলো ভূমণ্ডল। পুরাণে ভগবানের ২১ অবতারের কথা উল্লেখ আছে। ২১ বার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করিয়েছিলেন। সবই হয়েছে তাঁর ইচ্ছায়। বেদ চার ভাগ হয়েছে। রাম বনবাসে গেছেন। প্রচার হয়েছে অহিংসা। ভগবান কিংবা ঈশ্বর, যিনি বসে আছেন ওপরে, তাঁর ইচ্ছাতেই সবকিছু হচ্ছে। তিনি যা ইচ্ছা করছেন। তাঁর নির্দেশের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
গ্রিক পুরাণেও এমন গল্প খুঁজে পাওয়া যায়। গ্রিক পুরাণের সেই গল্পেও এক মহাপ্রলয়ের কথা আছে। সেখানে আবার মানুষের নানা রূপের কথা খুঁজে পাওয়া যায়। গ্রিক পুরাণে বলা হয়েছে, মানুষ আজকের দিনে যে রূপে আছে, এটা হচ্ছে তার পঞ্চম রূপ। সে যাকগে, গল্পটা বলে নেওয়া যাক। গল্পে বলা হচ্ছে, কোনো এক সময় পৃথিবীর মানুষ এমন পাপী হয়ে উঠল যে, জিউস শেষ পর্যন্ত ঠিক করলেন, মানুষকে ধ্বংস করে দেবেন। তিনি স্থির করলেন, সীমাহীন পৃথিবীর ওপরভাগে ঝড় এবং ঝঞ্ঝাকে মিশাবেন। মানুষের জন্য আনবেন চরম সমাপ্তি। তিনি প্লাবন পাঠালেন। সমুদ্রের দেবতাকে অনুরোধ করলেন তাঁকে সাহায্য করতে। দুজনে মিলে আকাশ থেকে ঝরালেন মুষলধারে বৃষ্টি। পৃথিবীর সব নদীর জলধারা খুলে দিলেন। ডুবিয়ে দিলেন গোটা পৃথিবীর মাটি। পানিতে ডুবে গেল পৃথিবী। উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গও ডুবে গেল। কেবল সুউচ্চ পার্নাসাস পর্বতের শিখর কোনোমতে এই পানি থেকে রক্ষা পেল। ৯ দিন ৯ রাত ধরে বৃষ্টি চলল। পার্নাসাসের চূড়ায় আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পারল দুটি মানুষ_একজন পুরুষ, একজন নারী_ডিউক্যালিয়ন ও পাইরা। ডিউক্যালিয়ন ছিলেন প্রমিথিউসের পুত্র। পাইরা এপিমিথিউস ও প্যান্ডোরার কন্যা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী প্রমিথিউস বুদ্ধি করে তৈরি করেছিলেন একটি বড় আকৃতির কাঠের বাঙ্। সেই বাঙ্রে মধ্যে সব খাদ্য ও রসদ ভরে তিনি পুত্র ও পুত্রবধূকে সেখানে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। এই মহাপ্লাবন যিনি সৃষ্টি করেছিলেন, সেই জিউস অবশ্য ক্ষিপ্ত হননি। ক্ষিপ্ত না হওয়ার কারণও ছিল। ডিউক্যালিয়ন ও পাইরা দুজনেই ছিলেন ধর্মপরায়ণ। পানি নেমে যাওয়ার পর তাঁরা দুজন যখন বাঙ্ থেকে নেমে এলেন স্থলভূমিতে, তখন কোথাও প্রাণের চিহ্ন নেই। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। তাঁদের দেখে জিউসের মায়া হলো। তিনি বন্যার পানি শুষে নিলেন। নদীগুলো দূরে চলে গেল। জেগে উঠল কঠিন ডাঙা। মৃত পৃথিবীতে নেমে ডিউক্যালিয়ন ও পাইরা দেখতে পেলেন এক মন্দির। সেখানে গিয়ে তাঁরা প্রার্থনা করলেন ভয়াবহ নির্জনতার মধ্যে সাহায্যের আশায়। প্লাবন থেকে রক্ষা পাওয়ায় তাঁরা দেবতাদের ধন্যবাদ জানালেন। তখনই ভেসে এল অলৌকিক কিছু শব্দ। এটাকে ওপরের নির্দেশ বললেও বলা যেতে পারে। প্রাচীন আমলের ওপরের নির্দেশ। কী সেই নির্দেশ? তাঁরা শুনতে পেলেন, 'তোমাদের মস্তক আবৃত করো এবং পেছনে ছুড়ে মারো তোমাদের মায়ের হাঁড়।' আদেশ শুনে তো ভয় পেয়ে যাওয়ারই কথা। এমন নির্জনে এভাবে ইথার থেকে যদি আদেশ ভেসে আসে, তাহলে ভয় পাওয়াটাই তো স্বাভাবিক। যাহোক, বুকে সাহস সঞ্চয় করে ভাবতে বসলেন ডিউক্যালিয়ন ও পাইরা। ডিউক্যালিয়ন যেন একটা পথ খুঁজে পেলেন। তিনি স্ত্রীকে বোঝালেন, 'পৃথিবী হচ্ছে সবার মা। তার হাড় হচ্ছে পাথর।' সামনে যে পাথর আছে, সেই পাথর পেছনে ছুড়ে মারতে হবে। তাঁরা পাথর ছুড়তে লাগলেন। এক-একটা পাথর ছুড়ে মারেন তাঁরা। সেই পাথর থেকে সৃষ্টি হয় একেকটি মানুষ। গ্রিক পুরাণে এদেরই বলা হচ্ছে প্রস্তর মানব। মহাপ্লাবনের পর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে নতুন পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য এমন মানুষ প্রয়োজন ছিল তখন। ওপরের নির্দেশে সেই মানুষ সৃষ্টি হয়েছিল।
ওপরের নির্দেশের আরো উদাহরণ আছে। ঈশ্বর শুরুতে স্বর্গ ও মর্ত্য সৃষ্টি করলেন। মর্ত্যে ছিল পানি ও অন্ধকার। এই দেখে ঈশ্বর বললেন, 'আলো হোক'। পৃথিবী আলোকিত হলো। ঈশ্বর অন্ধকার থেকে আলোকে আলাদা করলেন। এই যে ঈশ্বর বললেন 'আলো হোক', এটাও তো ওপরেরই নির্দেশ। তাঁর নির্দেশেই আলোকিত হয়ে উঠল পৃথিবী। সেই আমলে ওপরের নির্দেশে আলো হতো, ভালো হতো। কিন্তু তারপর?
ওপরের নির্দেশ কেমন হতে পারে, কেমন ভয়াবহ ওপরের নির্দেশের রূপ, সেটা তো আমরা অনেক দিন ধরেই প্রত্যক্ষ করে আসছি। ওপরের নির্দেশ নামের গায়েবি হুকুমের অনেক ব্যবহার আমরা দেখেছি। ওপরের নির্দেশে এককালে বাড়ি থেকে অনেককে তুলে নিয়ে যাওয়া হতো। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও ওপরের নির্দেশে অনেককে তুলে নিয়ে গিয়ে অনেক নাটক করা হয়েছে। কিন্তু ওপরের সেই অদৃশ্য নির্দেশদাতারা বরাবর থেকে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাঁরা ওপর থেকে নির্দেশ দিয়ে চুপ করে থাকেন। সেই নির্দেশ পালন করার বান্দা যাঁরা, তাঁরা ওপরের নির্দেশ পালন করেন। যেমন, সম্প্রতি ওপরের নির্দেশে নাজেহাল হতে হয়েছে একজনকে। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত সেই খবরের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। খবরে বলা হচ্ছে, 'স্কুলের সভাপতি নির্বাচিত হওয়াই যেন তাঁর অপরাধ। ক্ষমতাসীন প্রতিপক্ষকে হারিয়ে কলেজ শিক্ষক জিয়াউদ্দিন শাহীন সভাপতি হয়েছিলেন। এ কারণে ক্ষুব্ধ প্রতিপক্ষ পুলিশ দিয়ে তাঁকে চরম অসম্মান করে। চোর-ডাকাতের মতো বেঁধে শুক্রবার রাতে থানায় আনা হয় তাঁকে। আটকের ১৬ ঘণ্টা পর গতকাল শনিবার আওয়ামী লীগের এক নেতাকে বাদী সাজিয়ে একটি চাঁদাবাজির মামলাও দেওয়া হয় তাঁর বিরুদ্ধে। পুলিশ বলছে, সবই করা হয়েছে ওপরের নির্দেশে। ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার এ ঘটনাটি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।' গত শুক্রবার রাতে নান্দাইল থানা পুলিশ কোনো অভিযোগ ছাড়াই কলেজ শিক্ষক শাহীনকে শত শত লোকের সামনে কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় নিয়ে আসে বলে প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। এ সময় পুলিশ তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে বলে খবরে প্রকাশ। নান্দাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, 'ওপরের নির্দেশে' তাঁকে আটক করা হয়েছে। ওপর থেকে যে 'ওপরওয়ালা' এহেন নির্দেশ দিলেন, তিনি কিন্তু থেকে গেলেন আড়ালে। ওপরওয়ালাদের এটাই সুবিধা। নির্দেশ দিয়ে তাঁরা বেশ পর্দার আড়ালে থেকে যেতে পারেন।
'কেমন আছেন'_ এমন প্রশ্নের জবাবে পটুয়া কামরুল হাসান নাকি বলতেন, 'ভালো থাকার হুকুম আছে'। এই হুকুম বা নির্দেশ তিনি কিভাবে কোত্থেকে পেলেন, সে বিষয়টি কোনোদিন কারো কাছে খোলাসা করে বলেননি। হুকুম কিংবা নির্দেশ কোত্থেকে আসে, কেমন করে আসে, সে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া না গেলেও নির্দেশ বা হুকুম আজও আসে। ওপরের নির্দেশ! সেই নির্দেশ মেনে চলতে হয় হুকুমবরদারদের। কিন্তু ভালো থাকতেন তিনি। হুকুমটা নিশ্চয়ই মেনে চলতেন। আমাদের সমাজে এমন হুকুমবরদারের অভাব নেই। স্বৈরাচার থেকে তত্ত্বাবধায়ক আমলের রুদ্ধ সময় পেরিয়ে এসেছি আমরা। গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে এসেও 'ওপরের নির্দেশ' থেকে মুক্তি মিলছে না কেন? নাকি 'ওপরের নির্দেশ' মেনেই ভালো থাকতে হবে আমাদের? তাহলে আসুন, সমস্বরে সবাই বলি, খাসা আছি, আছি বেশ_ ওপরের নির্দেশ! এটাই হোক এই সময়ে ভালো থাকার একমাত্র মন্ত্র।

লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.