জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-আদিবাসী নারীর অধিকার সুরক্ষা by ইলিরা দেওয়ান

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শত বছর পূর্ণ হলো চলতি বছরের ৮ মার্চ। এবার নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে সম-অধিকার: প্রশস্ত করে নারীর শোভনীয় কাজের দুয়ার’। এই শত বছরের দীর্ঘ নারী আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ও ত্যাগের পরও নারীর অর্জন ও বঞ্চনার হিসাব মেলাতে গিয়ে এখনো নানা গরমিল প্রকটভাবে ফুটে ওঠে।


বাংলাদেশের নারীদের জন্য এবারের নারী দিবস বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সমকালীন বাংলাদেশে নারী আন্দোলনে অনন্য ভূমিকা পালনকারী কবি বেগম সুফিয়া কামালের জন্মশতবার্ষিকীর পাশাপাশি এবার আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রাক্কালে এ দেশের নারীদের বহু প্রতীক্ষিত ও কাঙ্ক্ষিত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা, ২০১১-এর খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে। এ নীতিমালায় উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ও পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। যদিও নীতিমালার কোনো অনুচ্ছেদেই উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সম-অধিকারের কথা বলা হয়নি। শুধু উত্তরাধিকার থেকে প্রাপ্ত সম্পত্তির ওপর নারীর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা হয়েছে।
এ নীতিমালা নিয়ে আদিবাসী নারীদের আশঙ্কার জায়গা রয়েছে। ১৯৯৭ সালের নীতিমালায় আদিবাসী নারীদের বিষয়টি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত ছিল। এ জন্য এ নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রস্তাবনার সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, বিশেষত নারী আন্দোলনের নেত্রীরা বিভিন্ন সময় সভা-সেমিনারে তাঁদের এ ভুল স্বীকার করেছেন এবং ভবিষ্যতে নীতিমালা সংস্কারের সময় আদিবাসী নারীদের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় আনা হবে বলে তাঁরা আদিবাসী নারীদের আশ্বস্ত করেছিলেন। এ নীতিমালাটিকে সময়োপযোগী করার জন্য কৃষিশ্রমিক, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রতিবন্ধী নারী এবং হতদরিদ্র ও আদিবাসী নারীদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করা সংক্রান্ত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নীতিমালায় আদিবাসী নারীর অধিকারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হলেও কীভাবে আদিবাসী নারীর অধিকার সংরক্ষণ করা হবে, তা স্পষ্ট নয়। তাই বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের এ বিশাল অর্জনে আদিবাসী নারী অধিকারের বিষয়টিকে যদি হালকাভাবে নেওয়া হয়, তাহলে আদিবাসী নারীরা আবারও হতাশায় পড়বে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নারী উন্নয়নসংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সকল সনদ, ঘোষণা ও সিদ্ধান্তগুলো সরকার অনুসমর্থন করেছে এবং সেসব লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে তাঁর সরকার কাজ করে যাচ্ছে। আমরাও চাই ১৯৭২ সালে অনুস্বাক্ষর করা আইএলও কনভেনশন (১০৭) বাংলাদেশ সরকার যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করুক এবং ১৯৮৯ সালের আইএলওর অধিকতর প্রগতিশীল কনভেনশন আদিবাসী ও ট্রাইবাল জাতিগোষ্ঠী কনভেনশন ১৬৯ নং-এ বাংলাদেশ সরকার অনুসমর্থন করে এ দেশের আদিবাসীদের স্বার্থ সংরক্ষণে আরও সচেষ্ট হোক।
নারী উন্নয়ন নীতিমালায় কতগুলো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য চিহ্নিত করা আছে। তার মধ্যে নারীর রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা, নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীর সুস্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করা, গণমাধ্যমে নারীর ইতিবাচক ভাবমূর্তি উপস্থাপন, মেধাবী এবং প্রতিভাময়ী নারীর সৃজনশীল ক্ষমতা বিকাশে সহায়তা প্রদানের কথা উল্লেখযোগ্য। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চায় প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্র সীমিত আকারে দেখা দিলেও তা সরকারের উদাসীনতার কারণে বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। চুক্তি অনুযায়ী তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে তিনজন করে মোট নয়জন নারী প্রতিনিধির বিধান রাখা হলেও আজ দুই দশকের অধিক কাল ধরে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ায় এ প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীনদের দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে আছে। ফলে চুক্তির পর নারীরা এখানে প্রতিনিধিত্বের কোনো সুযোগ পায়নি। বর্তমানে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদে একজন বাঙালি নারী প্রতিনিধি আছেন, যাঁর ক্ষেত্রে নারী প্রতিনিধিত্বের চেয়ে ‘দলীয়’ পরিচয়টা প্রাধান্য পায়।
সর্বক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে নারীর মেধা ও যোগ্যতাকে যেমন মূল্যায়ন করতে হবে, তেমনি নারীর সৃজনশীল বিচরণের ক্ষেত্রকেও প্রসারিত করতে হবে। সংসদে আদিবাসী নারীর জন্য আসন সংরক্ষণ করে জাতীয় সংসদের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে আদিবাসী নারীদের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ করে দিতে হবে। এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের গত পৌর নির্বাচনের দিকে তাকালে দেখা যায়, তিন পার্বত্য জেলা সদরের কোনো পৌরসভায় আদিবাসী নারীরা জয়ী হতে পারেনি। খাগড়াছড়ি সদর পৌর এলাকার ভোটার পরিসংখ্যান থেকে এর কারণ স্পষ্ট পাওয়া হবে বলে মনে হয়। এখানে মোট ভোটারসংখ্যা ৩০ হাজারের মতো। তার মধ্যে পাহাড়ি ভোটার মাত্র ১০ হাজারের কাছাকাছি। আদিবাসী-অধ্যুষিত এলাকা হলেও আজ তারাই নিজ এলাকায় সংখ্যালঘু। কাজেই আদিবাসী নারীদের অংশীদারি ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হলে জাতীয় সংসদের আসন থেকে শুরু করে পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদগুলোতেও আদিবাসী নারীর আসন সংরক্ষণ করা জরুরি।
নারী উন্নয়ন নীতিমালা দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। এ নীতিমালার দ্রুত বাস্তবায়ন যেমন চাই, তেমনি চাই এর সুবাতাস যেন আদিবাসী নারীদের দ্বারে দ্বারে পৌঁছায়। সে দায়িত্বও সরকারকে নিতে হবে। আদিবাসী নারীরা চান, অধিকারের কথা বলতে গিয়ে যেন আর কল্পনা চাকমাদের অপহূত হতে না হয়। ভূমি বেদখলের প্রতিবাদ করতে গিয়ে জুমঘরে যেন আর কোনো পনেমালা ত্রিপুরাকে প্রাণ হারাতে না হয়। অতিরিক্ত ‘নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করতে গিয়ে যেন বুদ্ধপুদি চাকমাদের বুকে আর কোনো গুলি না লাগে। পাশের জুমখেত থেকে খাদ্যশস্য ও কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে আর যেন কোনো পাহাড়ি নারীকে শ্লীলতাহানির শিকার হতে না হয়, এ বিষয়ে রাষ্ট্রকে নিশ্চয়তা দিতে হবে। তবেই পাহাড় কি সমতলে আদিবাসী নারীরা জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়নের সুফল ভোগ করতে পারবে।
ইলিরা দেওয়ান: মানবাধিকারকর্মী।
ilira.dewan@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.