কালের পুরাণ-আবার তারেক যুগ! আবার হারিছ প্রশাসন! by সোহরাব হাসান
ঘটনাটি কাকতাল কি না, জানি না। সারা দেশের মানুষ পনেরোই আগস্ট শোক দিবস হিসেবে পালন করলেও বিএনপি সাড়ম্বরে দেশনেত্রীর জন্মদিন পালন করে। আবার সাতই মার্চকে আমরা সবাই জানি রমনা রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ দিবস হিসেবে। যেখান থেকে পাকিস্তানিদের চূড়ান্ত কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
২০০৯ সাল থেকে বিএনপি এটিকে তারেক রহমানের কারাবরণ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। কারণ, সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ৭ মার্চ বিএনপির তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করে দুর্নীতির দায়ে। এরপর আইনি লড়াইয়ে তিনি উচ্চ আদালতে জামিন নিয়ে ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার উদ্দেশ্যে লন্ডনে চলে যান। এখনো তিনি সপরিবারে সেখানে অবস্থান করছেন। বিএনপি ৩ সেপ্টেম্বর তাঁর মুক্তি দিবস পালন করে আসছে।
অপ্রয়োজনীয় বহু দিবস পালনের দেশে একজন রাজনৈতিক নেতার কারাবরণ বা মুক্তি দিবস পালনে দোষের কিছু নেই। কিন্তু সেদিন মহানগর নাট্যমঞ্চে বেগম খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে দলের প্রবীণ নেতারা যেভাবে তারেক-বন্দনার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামলেন, তা দেখে যেকোনো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক লজ্জিত হবেন। পাকিস্তান আমলের বাম ও আধা বাম রাজনীতিতে হাতেখড়ি নেওয়া প্রবীণ নেতারা সমস্বরে বলে উঠলেন, তারেক ছাড়া দল নেই, তারেক ছাড়া দেশ নেই। এখন লন্ডন থেকে নাকি তারেক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, ভবিষ্যতে দেশে ফিরে জাতির নেতৃত্ব দেবেন। তাঁদের কেউ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন, দলের ভবিষ্যৎ মহাসচিব হবেন বলে আশা করছেন; কিন্তু অকপটে স্বীকার করে নিলেন, তাঁরা যত বড় নেতাই হোন, দলের নেতৃত্ব দিতে অক্ষম। দেশের নেতৃত্ব দিতে অক্ষম। সে জন্য দেশ চালানোর জন্য লন্ডন থেকে তারেক রহমানকে নিয়ে আসতে হবে এবং এর আগে বর্তমান সরকারের পতন ঘটাতে হবে।
এই প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন। কেউ পছন্দ করুক বা না করুক, তারেক রহমান একজন রাজনীতিক। তিনি দুর্নীতি করলে তাঁর শাস্তি হবে। আদালতে বিচার হবে এবং সেই বিচারের জন্য সরকার তাঁকে গ্রেপ্তারও করতে পারে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাঁর ওপর যে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছে, সেটি ছিল অত্যন্ত নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ। রাজনীতিক তো বটেই, একজন সাধারণ নাগরিককেও রাষ্ট্র বিচারের আগে এভাবে শাস্তি দিতে পারে না। আমাদের সরকারগুলো, তা সেনা-সমর্থিত বা নির্বাচিত হোক—আইনের শাসনে বিশ্বাস করে না, বিশ্বাস করে গায়ের জোরে, জবরদস্তিতে। তাদের উদ্দেশ্য দুর্নীতি ও অপরাধের বিচার নয়, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গয়রহ সবার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা ঠুকে, জেলে পুরে, জোরপূর্বক জবানবন্দি আদায় করে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানটিই হাস্যকর করে ফেলেছিল, যার খেসারত পুরো জাতিকে দিতে হয়েছে। এখনো হচ্ছে।
তারেক রহমান দেশের বাইরে যাওয়ার আগে রাজনীতি ত্যাগের ঘোষণা দিলেও এখন রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন। শুনেছি, বিএনপির উচ্চপর্যায়ের কোনো সিদ্ধান্ত হয় না তাঁর অনুমোদন ছাড়া। এমনকি যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের ঝগড়া মেটাতেও নেতারা লন্ডনে ছুটে যান ‘বড় ভাই’য়ের আশীর্বাদ নিতে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে রাজনৈতিক দলগুলো যখন ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী ও বারিধারায় অফিস খুলতে শুরু করে, তখন মানুষ সমালোচনা করে বলত, নেতারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। দূরে চলে গেছেন। আমাদের নেতারা জেনে গেছেন, ক্ষমতার চাবিকাঠি কোথায়। এ কারণে কষ্ট করে জনগণের সঙ্গে মেশার চেয়ে তাঁরা বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে বেশি উৎসাহী। শূন্য দশকে এসে রাজনীতি কেবল ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী ও বারিধারায় সীমিত নেই। কোনো দলের সিদ্ধান্ত আসে লন্ডন থেকে, কোনো দলের বিবৃতি আসে ভার্জিনিয়া থেকে।
রাজনীতিকেরা জনগণকে বরাবর ধাপ্পা দিয়ে এলেও জনগণ তাঁদের আগমনকে স্বাগত জানিয়েছে। বিশেষ করে, তরুণদের প্রতি তাঁরা একটু বেশি আস্থাশীল। ১৯৯৩ সালে তারেক রহমান যখন বাবার জন্মস্থান গাবতলীতে সাধারণ সদস্যপদ গ্রহণের মাধ্যমে বিএনপির রাজনীতিতে আসেন, কেউ বিরোধিতা করেননি। দলের বাইরেও অনেকে তাঁর শুভকামনা করেছেন। রাজনীতিতে এসে তিনি খানিকটা চমকও সৃষ্টি করেছিলেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে দল গোছানো, প্রার্থী মনোনয়নে তরুণদের অগ্রাধিকার দেওয়া এবং তাঁর নির্বাচনী কর্মকৌশল বিএনপিকে আশাতীত সাফল্য এনে দিয়েছিল।
কিন্তু নির্বাচনের পরই দৃশ্যপট পাল্টে যায়। বিএনপির চেয়ারপারসনের অফিস ‘হাওয়া ভবন’কে তিনি বিকল্প ক্ষমতাকেন্দ্রে পরিণত করেন। বিএনপির ইউনিয়ন, উপজেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের সম্মেলন করার নামে তিনি দলের সব প্রবীণ নেতাকে তাঁর পেছনে কাতারবন্দী করেন। রাতারাতি সাবেক রাষ্ট্রপতির ছেলে হয়ে যান যুবরাজ, মহা ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তিনি যা বলেন, তা-ই আইন; তিনি যা ইচ্ছে করেন, তা-ই হয়ে যায়। সরকারে ও দলে যাঁরা তাঁর অনুগত ছিলেন, পদপদবি যা-ই হোক না কেন, তাঁরাই সর্বক্ষমতার অধিকারী। ফলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নবীনদের দাপটে জ্যেষ্ঠরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। যুবরাজ ভাবলেন, বিএনপিই দেশের শেষ সরকার (এখন আওয়ামী লীগের নেতাদেরও কেউ কেউ সে রকম ভাবতে শুরু করেছেন)। তাঁর কাজকর্ম সেটাই প্রতিফলিত হয়েছে বারবার।
আমাদের মনে আছে, বিএনপির মহাবিজয়ের পর খালেদা জিয়ার ১০০ দিনের কর্মসূচি বাস্তবায়নের আগেই দলের কর্মীরা বিরোধী দল ও সংখ্যালঘু নিধন কর্মসূচি ‘সফল’ করেছিলেন। মনে আছে, আওয়ামী লীগ একবার হাওয়া ভবন ঘেরাও কর্মসূচি নিলে পুলিশ ভবনটির চারপাশে অবরোধ করে, যাতে কোনো জনমানুষ সেখানে প্রবেশ করতে না পারে। জনগণের নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেকোনো ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু সেই কর্মসূচিকে ঘিরে যখন পুরো ঢাকা শহর উত্তেজনায় টানটান, তখন ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোকে নিয়ে যুবরাজ পুলিশ চৌহদ্দির ভেতরে ক্রিকেট খেলছিলেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে এরূপ মশকরা এর আগে বা পরে আর কোনো নেতা করেননি। গিনেস বুক সব অবিশ্বাস্য ও রেকর্ড সৃষ্টিকারী ঘটনা লিপিবদ্ধ করে রাখে। আমাদের জানা নেই, তারেক রহমানের সেই ক্রিকেট খেলাটি তারা লিখে রেখেছিল কি না।
বিএনপির নেতারা বলতে চাইছেন, বর্তমান সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং বিদেশি শক্তি নাকি এক জোট হয়ে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। কী চক্রান্ত করছে? তাঁকে দেশে ফিরতে দিচ্ছে না। আমরা জানি, তারেক রহমানের দেশে ফিরতে আইনগত কোনো বাধা নেই। তবে বাধা আছে ১১টি মামলা। বাধা আছে তাঁর ঘনিষ্ঠজনের অপকর্ম। বাধা আছে, হাওয়া ভবনের পাঁচ বছরের অপশাসন-দুঃশাসন। বাধা হয়ে আছেন দলের কোনো কোনো জ্যেষ্ঠ নেতা, যাঁদের এই যুবরাজ অপমান করেছেন, তাঁর অনুগত ব্যক্তিরা লাঞ্ছিত করেছে।
কারও বিরুদ্ধে আদালতে মামলা থাকা মানে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত নয়। বিএনপির বহু নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির মামলা আছে। তাঁরা দেশে থেকে মামলা মোকাবিলা করতে পারলে তারেক রহমান কেন পারবেন না? বিএনপি দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও আন্দোলন করছে। সেই আন্দোলনে তাঁদের সিপাহশালার থাকবেন না?
বর্তমান সরকার ওয়াদা ভঙ্গকারী একটি সরকার। জনগণের কাছে যেসব ওয়াদা দিয়ে তারা ক্ষমতায় এসেছে, তার প্রায় কোনোটাই পূরণ করেনি অথবা করতে পারেনি। কিন্তু তার বিকল্প আরেকটি নৈরাজ্য যুগ নয়, আরেকটি জঙ্গিবাদী আমল নয়, বোমা ও গ্রেনেডের আঘাতে মানুষের রক্তাক্ত লাশ রাজপথে পড়ে থাকা নয়। দুই দশক ধরে দেশে দ্বিদলীয় শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। বিএনপির পর আওয়ামী লীগ; আওয়ামী লীগের পর বিএনপি। মানুষ তা-ও হয়তো মেনে নিতে রাজি আছে। কিন্তু সেই বিএনপি কাদের পৃষ্ঠপোষকতা করবে? জঙ্গিবাদের? বোমা-গ্রেনেড হামলার? অস্ত্র চোরাচালানি ও অর্থ পাচারকারীদের? যে হাওয়া ভবন জঙ্গিবাদকে উসকে দিয়েছে, দুর্নীতিকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে বহির্বিশ্বে ১ নম্বর দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে, সেই নেতৃত্ব ফিরে আসতে পারে না। জনগণ আসতে দেবে না।
বিএনপির নেতাদের অভিযোগ, বর্তমান সরকার পূর্ববর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছে। তাতে তাঁদের খুশি হওয়ারই কথা। কেননা তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতিবাজদের বিচার করেনি। এই সরকারও করছে না। ইতিমধ্যে ২৬ মাস পার হয়ে গেছে, আর কয়েকটি মাস পার হলেই হরতাল-অবরোধ এবং সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হয়ে যাবে। তখন সরকার আরও তালগোল পাকিয়ে ফেলবে। দুর্নীতির বিচারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হবে রাজপথে বিরোধী দলকে সামাল দেওয়া। তখন সব মামলাই রাজনৈতিক মোড়ক পাবে। বিএনপির নেতারা সেই সুদিনের অপেক্ষায় আছেন। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা ১১টি মামলার মধ্যে মাত্র একটির চার্জশিট হয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ এবং বিএনপির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণাকারী সরকারের এই সাফল্য!
আমরা কোন দেশে বাস করছি? একবার আমরা দুর্নীতির দায়ে যাঁদের মসনদ থেকে তাড়াই, তাঁদেরই আবার সাদরে বরণ করে আনি। একবার জয়নাল হাজারী-শামীম ওসমানেরা দুঃশাসনের প্রতীক হন, আরেকবার যুবরাজ-হারিছ চৌধুরীরা দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় নামেন। রাজনীতির নামে সবকিছুই জায়েজ করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকার অনেক খারাপ করেছে। যেসব খাতের প্রতি নিবিড় নজরদারি দরকার, সেসব খাত উপেক্ষা করে তারা নামফলক স্থাপন ও জমি অধিগ্রহণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। জনগণ তেতে আছে। এর প্রতিকার কি তারেক যুগের পুনরাবির্ভাব? আবার হাওয়া ভবন? আবার বিকল্প ক্ষমতাকেন্দ্র? আবার জঙ্গিবাদের তোষণ? আবার ট্রাকভর্তি অস্ত্রের চালান? আবার বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচি বানচাল করতে ক্রিকেট খেলা?
জিয়াউর রহমানের রাজনীতি সৎ ছিল না। ক্ষমতার ভিত পাকাপোক্ত করতে তিনি অনেক রাজনীতিককে অসৎ বানিয়েছেন। কিন্তু ব্যক্তি জিয়াউর রহমানের যে পরিচ্ছন্ন ইমেজ ছিল, সততা ও মিতব্যয়িতার জন্য দলমতনির্বিশেষে সবার প্রশংসা পেয়েছিলেন, তাঁর সেই ইমেজকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছেন তাঁর ছেলে তারেক রহমান। আওয়ামী লীগ গত ৩০ বছরে জিয়ার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে যত না ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে বেশি করেছেন তাঁর ছেলে। বিএনপির নেতারা যখন তারেক রহমানের নেতৃত্ব বরণ করতে উদ্গ্রীব, তখন আরও কয়েকটি নাম চোখের সামনে ভেসে ওঠে—হারিছ চৌধুরী, গিয়াস আল মামুন। দেশে-বিদেশে তাঁর আরও কতিপয় বন্ধু। বিএনপির নেতারা তারেক রহমানের মুক্তি চাইলেও রহস্যজনক কারণে তাঁদের মুক্তি চাইছেন না। হারিছ চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা বলছেন না। তিনি তো খালেদা জিয়ার এক নম্বর রাজনৈতিক সচিব ছিলেন। প্রশাসনের সবকিছু হতো তাঁর অঙ্গুলি নির্দেশে। কেউ কেউ তাঁকে মি. টেন পার্সেন্ট হিসেবেও চিনতেন। হারিছ চৌধুরী না এলে ভবিষ্যতে তারেক রহমান প্রশাসন চালাবেন কীভাবে? গিয়াস আল মামুন মুক্তি না পেলে তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যই বা কে দেখবেন?
এ কারণেই বিএনপির নেতাদের কাছে অনুরোধ থাকবে, তারেক রহমানের মুক্তি ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দাবির সঙ্গে যেন এই দুটি নামও তাঁরা যুক্ত করেন। বিশ্বস্ত সিপাহি ছাড়া তো সিপাহশালার চলতে পারেন না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
অপ্রয়োজনীয় বহু দিবস পালনের দেশে একজন রাজনৈতিক নেতার কারাবরণ বা মুক্তি দিবস পালনে দোষের কিছু নেই। কিন্তু সেদিন মহানগর নাট্যমঞ্চে বেগম খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে দলের প্রবীণ নেতারা যেভাবে তারেক-বন্দনার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামলেন, তা দেখে যেকোনো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক লজ্জিত হবেন। পাকিস্তান আমলের বাম ও আধা বাম রাজনীতিতে হাতেখড়ি নেওয়া প্রবীণ নেতারা সমস্বরে বলে উঠলেন, তারেক ছাড়া দল নেই, তারেক ছাড়া দেশ নেই। এখন লন্ডন থেকে নাকি তারেক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, ভবিষ্যতে দেশে ফিরে জাতির নেতৃত্ব দেবেন। তাঁদের কেউ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন, দলের ভবিষ্যৎ মহাসচিব হবেন বলে আশা করছেন; কিন্তু অকপটে স্বীকার করে নিলেন, তাঁরা যত বড় নেতাই হোন, দলের নেতৃত্ব দিতে অক্ষম। দেশের নেতৃত্ব দিতে অক্ষম। সে জন্য দেশ চালানোর জন্য লন্ডন থেকে তারেক রহমানকে নিয়ে আসতে হবে এবং এর আগে বর্তমান সরকারের পতন ঘটাতে হবে।
এই প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন। কেউ পছন্দ করুক বা না করুক, তারেক রহমান একজন রাজনীতিক। তিনি দুর্নীতি করলে তাঁর শাস্তি হবে। আদালতে বিচার হবে এবং সেই বিচারের জন্য সরকার তাঁকে গ্রেপ্তারও করতে পারে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাঁর ওপর যে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছে, সেটি ছিল অত্যন্ত নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ। রাজনীতিক তো বটেই, একজন সাধারণ নাগরিককেও রাষ্ট্র বিচারের আগে এভাবে শাস্তি দিতে পারে না। আমাদের সরকারগুলো, তা সেনা-সমর্থিত বা নির্বাচিত হোক—আইনের শাসনে বিশ্বাস করে না, বিশ্বাস করে গায়ের জোরে, জবরদস্তিতে। তাদের উদ্দেশ্য দুর্নীতি ও অপরাধের বিচার নয়, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গয়রহ সবার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা ঠুকে, জেলে পুরে, জোরপূর্বক জবানবন্দি আদায় করে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানটিই হাস্যকর করে ফেলেছিল, যার খেসারত পুরো জাতিকে দিতে হয়েছে। এখনো হচ্ছে।
তারেক রহমান দেশের বাইরে যাওয়ার আগে রাজনীতি ত্যাগের ঘোষণা দিলেও এখন রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন। শুনেছি, বিএনপির উচ্চপর্যায়ের কোনো সিদ্ধান্ত হয় না তাঁর অনুমোদন ছাড়া। এমনকি যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের ঝগড়া মেটাতেও নেতারা লন্ডনে ছুটে যান ‘বড় ভাই’য়ের আশীর্বাদ নিতে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে রাজনৈতিক দলগুলো যখন ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী ও বারিধারায় অফিস খুলতে শুরু করে, তখন মানুষ সমালোচনা করে বলত, নেতারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। দূরে চলে গেছেন। আমাদের নেতারা জেনে গেছেন, ক্ষমতার চাবিকাঠি কোথায়। এ কারণে কষ্ট করে জনগণের সঙ্গে মেশার চেয়ে তাঁরা বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে বেশি উৎসাহী। শূন্য দশকে এসে রাজনীতি কেবল ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী ও বারিধারায় সীমিত নেই। কোনো দলের সিদ্ধান্ত আসে লন্ডন থেকে, কোনো দলের বিবৃতি আসে ভার্জিনিয়া থেকে।
রাজনীতিকেরা জনগণকে বরাবর ধাপ্পা দিয়ে এলেও জনগণ তাঁদের আগমনকে স্বাগত জানিয়েছে। বিশেষ করে, তরুণদের প্রতি তাঁরা একটু বেশি আস্থাশীল। ১৯৯৩ সালে তারেক রহমান যখন বাবার জন্মস্থান গাবতলীতে সাধারণ সদস্যপদ গ্রহণের মাধ্যমে বিএনপির রাজনীতিতে আসেন, কেউ বিরোধিতা করেননি। দলের বাইরেও অনেকে তাঁর শুভকামনা করেছেন। রাজনীতিতে এসে তিনি খানিকটা চমকও সৃষ্টি করেছিলেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে দল গোছানো, প্রার্থী মনোনয়নে তরুণদের অগ্রাধিকার দেওয়া এবং তাঁর নির্বাচনী কর্মকৌশল বিএনপিকে আশাতীত সাফল্য এনে দিয়েছিল।
কিন্তু নির্বাচনের পরই দৃশ্যপট পাল্টে যায়। বিএনপির চেয়ারপারসনের অফিস ‘হাওয়া ভবন’কে তিনি বিকল্প ক্ষমতাকেন্দ্রে পরিণত করেন। বিএনপির ইউনিয়ন, উপজেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের সম্মেলন করার নামে তিনি দলের সব প্রবীণ নেতাকে তাঁর পেছনে কাতারবন্দী করেন। রাতারাতি সাবেক রাষ্ট্রপতির ছেলে হয়ে যান যুবরাজ, মহা ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তিনি যা বলেন, তা-ই আইন; তিনি যা ইচ্ছে করেন, তা-ই হয়ে যায়। সরকারে ও দলে যাঁরা তাঁর অনুগত ছিলেন, পদপদবি যা-ই হোক না কেন, তাঁরাই সর্বক্ষমতার অধিকারী। ফলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নবীনদের দাপটে জ্যেষ্ঠরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। যুবরাজ ভাবলেন, বিএনপিই দেশের শেষ সরকার (এখন আওয়ামী লীগের নেতাদেরও কেউ কেউ সে রকম ভাবতে শুরু করেছেন)। তাঁর কাজকর্ম সেটাই প্রতিফলিত হয়েছে বারবার।
আমাদের মনে আছে, বিএনপির মহাবিজয়ের পর খালেদা জিয়ার ১০০ দিনের কর্মসূচি বাস্তবায়নের আগেই দলের কর্মীরা বিরোধী দল ও সংখ্যালঘু নিধন কর্মসূচি ‘সফল’ করেছিলেন। মনে আছে, আওয়ামী লীগ একবার হাওয়া ভবন ঘেরাও কর্মসূচি নিলে পুলিশ ভবনটির চারপাশে অবরোধ করে, যাতে কোনো জনমানুষ সেখানে প্রবেশ করতে না পারে। জনগণের নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেকোনো ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু সেই কর্মসূচিকে ঘিরে যখন পুরো ঢাকা শহর উত্তেজনায় টানটান, তখন ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোকে নিয়ে যুবরাজ পুলিশ চৌহদ্দির ভেতরে ক্রিকেট খেলছিলেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে এরূপ মশকরা এর আগে বা পরে আর কোনো নেতা করেননি। গিনেস বুক সব অবিশ্বাস্য ও রেকর্ড সৃষ্টিকারী ঘটনা লিপিবদ্ধ করে রাখে। আমাদের জানা নেই, তারেক রহমানের সেই ক্রিকেট খেলাটি তারা লিখে রেখেছিল কি না।
বিএনপির নেতারা বলতে চাইছেন, বর্তমান সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং বিদেশি শক্তি নাকি এক জোট হয়ে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। কী চক্রান্ত করছে? তাঁকে দেশে ফিরতে দিচ্ছে না। আমরা জানি, তারেক রহমানের দেশে ফিরতে আইনগত কোনো বাধা নেই। তবে বাধা আছে ১১টি মামলা। বাধা আছে তাঁর ঘনিষ্ঠজনের অপকর্ম। বাধা আছে, হাওয়া ভবনের পাঁচ বছরের অপশাসন-দুঃশাসন। বাধা হয়ে আছেন দলের কোনো কোনো জ্যেষ্ঠ নেতা, যাঁদের এই যুবরাজ অপমান করেছেন, তাঁর অনুগত ব্যক্তিরা লাঞ্ছিত করেছে।
কারও বিরুদ্ধে আদালতে মামলা থাকা মানে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত নয়। বিএনপির বহু নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির মামলা আছে। তাঁরা দেশে থেকে মামলা মোকাবিলা করতে পারলে তারেক রহমান কেন পারবেন না? বিএনপি দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও আন্দোলন করছে। সেই আন্দোলনে তাঁদের সিপাহশালার থাকবেন না?
বর্তমান সরকার ওয়াদা ভঙ্গকারী একটি সরকার। জনগণের কাছে যেসব ওয়াদা দিয়ে তারা ক্ষমতায় এসেছে, তার প্রায় কোনোটাই পূরণ করেনি অথবা করতে পারেনি। কিন্তু তার বিকল্প আরেকটি নৈরাজ্য যুগ নয়, আরেকটি জঙ্গিবাদী আমল নয়, বোমা ও গ্রেনেডের আঘাতে মানুষের রক্তাক্ত লাশ রাজপথে পড়ে থাকা নয়। দুই দশক ধরে দেশে দ্বিদলীয় শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। বিএনপির পর আওয়ামী লীগ; আওয়ামী লীগের পর বিএনপি। মানুষ তা-ও হয়তো মেনে নিতে রাজি আছে। কিন্তু সেই বিএনপি কাদের পৃষ্ঠপোষকতা করবে? জঙ্গিবাদের? বোমা-গ্রেনেড হামলার? অস্ত্র চোরাচালানি ও অর্থ পাচারকারীদের? যে হাওয়া ভবন জঙ্গিবাদকে উসকে দিয়েছে, দুর্নীতিকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে বহির্বিশ্বে ১ নম্বর দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে, সেই নেতৃত্ব ফিরে আসতে পারে না। জনগণ আসতে দেবে না।
বিএনপির নেতাদের অভিযোগ, বর্তমান সরকার পূর্ববর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছে। তাতে তাঁদের খুশি হওয়ারই কথা। কেননা তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতিবাজদের বিচার করেনি। এই সরকারও করছে না। ইতিমধ্যে ২৬ মাস পার হয়ে গেছে, আর কয়েকটি মাস পার হলেই হরতাল-অবরোধ এবং সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হয়ে যাবে। তখন সরকার আরও তালগোল পাকিয়ে ফেলবে। দুর্নীতির বিচারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হবে রাজপথে বিরোধী দলকে সামাল দেওয়া। তখন সব মামলাই রাজনৈতিক মোড়ক পাবে। বিএনপির নেতারা সেই সুদিনের অপেক্ষায় আছেন। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা ১১টি মামলার মধ্যে মাত্র একটির চার্জশিট হয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ এবং বিএনপির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণাকারী সরকারের এই সাফল্য!
আমরা কোন দেশে বাস করছি? একবার আমরা দুর্নীতির দায়ে যাঁদের মসনদ থেকে তাড়াই, তাঁদেরই আবার সাদরে বরণ করে আনি। একবার জয়নাল হাজারী-শামীম ওসমানেরা দুঃশাসনের প্রতীক হন, আরেকবার যুবরাজ-হারিছ চৌধুরীরা দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় নামেন। রাজনীতির নামে সবকিছুই জায়েজ করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকার অনেক খারাপ করেছে। যেসব খাতের প্রতি নিবিড় নজরদারি দরকার, সেসব খাত উপেক্ষা করে তারা নামফলক স্থাপন ও জমি অধিগ্রহণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। জনগণ তেতে আছে। এর প্রতিকার কি তারেক যুগের পুনরাবির্ভাব? আবার হাওয়া ভবন? আবার বিকল্প ক্ষমতাকেন্দ্র? আবার জঙ্গিবাদের তোষণ? আবার ট্রাকভর্তি অস্ত্রের চালান? আবার বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচি বানচাল করতে ক্রিকেট খেলা?
জিয়াউর রহমানের রাজনীতি সৎ ছিল না। ক্ষমতার ভিত পাকাপোক্ত করতে তিনি অনেক রাজনীতিককে অসৎ বানিয়েছেন। কিন্তু ব্যক্তি জিয়াউর রহমানের যে পরিচ্ছন্ন ইমেজ ছিল, সততা ও মিতব্যয়িতার জন্য দলমতনির্বিশেষে সবার প্রশংসা পেয়েছিলেন, তাঁর সেই ইমেজকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছেন তাঁর ছেলে তারেক রহমান। আওয়ামী লীগ গত ৩০ বছরে জিয়ার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে যত না ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে বেশি করেছেন তাঁর ছেলে। বিএনপির নেতারা যখন তারেক রহমানের নেতৃত্ব বরণ করতে উদ্গ্রীব, তখন আরও কয়েকটি নাম চোখের সামনে ভেসে ওঠে—হারিছ চৌধুরী, গিয়াস আল মামুন। দেশে-বিদেশে তাঁর আরও কতিপয় বন্ধু। বিএনপির নেতারা তারেক রহমানের মুক্তি চাইলেও রহস্যজনক কারণে তাঁদের মুক্তি চাইছেন না। হারিছ চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা বলছেন না। তিনি তো খালেদা জিয়ার এক নম্বর রাজনৈতিক সচিব ছিলেন। প্রশাসনের সবকিছু হতো তাঁর অঙ্গুলি নির্দেশে। কেউ কেউ তাঁকে মি. টেন পার্সেন্ট হিসেবেও চিনতেন। হারিছ চৌধুরী না এলে ভবিষ্যতে তারেক রহমান প্রশাসন চালাবেন কীভাবে? গিয়াস আল মামুন মুক্তি না পেলে তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যই বা কে দেখবেন?
এ কারণেই বিএনপির নেতাদের কাছে অনুরোধ থাকবে, তারেক রহমানের মুক্তি ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দাবির সঙ্গে যেন এই দুটি নামও তাঁরা যুক্ত করেন। বিশ্বস্ত সিপাহি ছাড়া তো সিপাহশালার চলতে পারেন না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments