পিতাকে না দেখা সন্তানের শ্রদ্ধাঞ্জলি by রুদ্র মাসুদ

বুকে বিপ্লবের মন্ত্র, পকেটে চট্টগ্রাম বন্দরের চাকরির নিয়োগপত্র আর ঘরে তরুণী স্ত্রী, দেড় বছরের সন্তান এবং স্ত্রীর গর্ভে অনাগত সন্তান কোনটি বেছে নেবেন তিনি। সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় জনগণের অংশীদারিত্বের জন্য জাসদের গোপন সংগঠন গণবাহিনীর আহ্বানেই সাড়া দিলেন মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার নজীর আহম্মদ।


কিন্তু বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথিত আদর্শ বুকে আলগে রাখতে গিয়ে ১৯৭৫-এর ১০ জুলাই রক্ষীবাহিনীর গুলিতে নিহত হন নোয়াখালীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রিয় এ মানুষটি।
মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার নজীরের সেই অনাগত সন্তান আমি। ২০১০ সালের ১০ জুলাই সকালে আমার মুঠোফোনে হঠাৎ করে একটি ফোন আসে। অপর প্রান্ত থেকে নারী কণ্ঠে বলছেন, 'রুদ্র আমি ঢাকা থেকে শিরিন আক্তার... শিরিন ফুপু... তোমার শিরিন ফুফু...। কয়েকবার বলার পর বিশ্বাস হচ্ছিল এখনও আমাদের কেউ খবর রাখে! আসলেই কেউ আমাদের খবর রাখেনি তো এত বছর তাই বিশ্বাস হচ্ছিল না। অপর প্রান্ত থেকে জাসদ নেত্রী শিরিন আক্তার বললেন, দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আমাদের কী করার আছে। আমরা তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি...।
জন্মের আগেই বাবাকে হারিয়েছি। বেড়ে ওঠার প্রতিটি পদে পদে মানুষের কাছে শুনেছি মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী নানা কীর্তি। যে রাজনীতি বাবাকে দেখার সুযোগ থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছে সেই রাজনীতি কখনও টানতে পারেনি আমাদের দুই ভাইকে। তবে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আচরণ এবং নেতাকর্মীদের প্রতি দায়বোধ কষ্ট দেয়। ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে শেখ হাসিনা কিংবা ১/১১'র-পরবর্তী সময়ে রিমান্ডে নির্যাতনে অসুস্থ তারেক রহমানকে পিজি হাসপাতালে দেখতে গিয়ে খালেদা জিয়া যে অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়েছেন তা দেখে কিছুটা বিস্ময় জাগে মনের ভেতর। কারণ নিজেদের স্বজন নিয়ে তাদের যেই কান্না, ১৫ কোটি মানুষের জন্য তাদের এমন কাঁদতে দেখা যায় না।
কষ্ট লাগে যে পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধা নজীরকে ঘায়েল করতে পারেনি অস্ত্র দিয়ে, সেই নজীর আহম্মদ মারা গেলেন স্বাধীন দেশের মাটিতে। হয়তো রক্ষীবাহিনীর যে সদস্য তাকে গুলি করেছে তিনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ঝাণ্ডা ওড়াতে গিয়ে আমার বাবার নির্মম মৃত্যু হলো সেই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের বেহাল দশা দেখেও অনেক কষ্ট। আশা করি, আমাদের নেতৃবৃন্দ জনগণের সামনে তত্ত্ব তুলে ধরার ক্ষেত্রে তা শুধু এক্সপেরিমেন্টের জন্য নয়, কল্যাণের দিকটি বিবেচনায় রাখবেন আগামী সময়ে।
বাবার মৃত্যু দিনে তাই বাবাকে না দেখা সন্তানের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
 

No comments

Powered by Blogger.