সময়ের কথা-হরতাল ও রাজনীতির নতুন চমক by অজয় দাশগুপ্ত
সবকিছু ভালোভাবে যে চলছে না, তাতেও দ্বিমত করার উপায় নেই। মধ্যবিত্ত-শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সরকারের প্রচুর সমালোচনা শোনা যায় এবং তা প্রকাশ্য। সংবাদপত্রে মূল সুর হয়ে উঠছে সরকারের নানা কাজের সমালোচনা। এমনকি সরকারের ভেতর থেকেও প্রকাশ পাচ্ছে ক্ষোভ।
পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়নি ঠিকই, কিন্তু একটু দূরে যাদের নজর তারা মন্দ সংকেত নিশ্চয়ই পাচ্ছেন। বিএনপি কেন তা উপেক্ষা
করে ধর্মান্ধ শক্তির পালে হাওয়া দিচ্ছে, বিশেষ করে ২০০৫ সালের তিক্ত অভিজ্ঞতার পরও?
বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নিয়ে কয়েকদিন ধরেই জোর আলোচনা চলছে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ১ জুলাই এক মন্তব্যে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীকে 'মহাশক্তিধর রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তুলে ধরায় অনেকেই বিস্মিত হয়েছিল। ভারতের কয়েকজন সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনায় তার আরেকটি মন্তব্য ছিল, 'বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা রয়েছে।' যে কোনো মুহূর্তে পটপরিবর্তনের আশঙ্কাও ব্যক্ত হয়েছিল তার এই একান্ত বৈঠকে। তবে 'গোপন কথাটি' গোপন রাখা হয়নি, আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে তুলে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মতো পটপরিবর্তন হবে নাকি ২০০৭ সালের মতো ওয়ান-ইলেভেন_ এ নিয়েও সংশয় চলতে থাকে। তারপর ভোজবাজির মতো ওয়েবসাইট থেকে উঠে গেল এ মন্তব্য। ঢাকায় এলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণা। ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর মনমোহন সিং বহুল প্রতীক্ষিত সফরে বাংলাদেশে আসছেন, সে ঘোষণাও এলো। শনিবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে 'জাতীয় বাজেট ২০১১-২০১২ : বাংলাদেশের বৈদেশিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব' শীর্ষক এক সেমিনারে অংশ নেওয়ার সুযোগ ঘটেছিল। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো খোন্দকার মোয়াজ্জেম চলতি বছরের বাজেট পর্যালোচনা করে যখন বক্তব্য রাখছিলেন, মিলনায়তন ছিল মন্ত্রমুদ্ধ। উপাচার্য ড. শরীফ এনামুল হক এ সময় উপস্থিত ছিলেন। সিনিয়র ও তরুণ শিক্ষকরাও এতে অংশ নেন। প্রশ্নোত্তর পর্বে সবচেয়ে প্রশ্ন আসে ভারত ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে। তরুণদের বক্তব্যে ছিল ভারতকে নিয়ে শঙ্কা-সংশয়। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ভারত-বাংলাদেশের মতোই। ভারত থেকে বাংলাদেশ যা আমদানি করে, সেখানে রফতানি হয় তার তুলনায় কণামাত্র। চীনের ক্ষেত্রেও একই চিত্র_ তারা বাংলাদেশের কাছে বেচে বেশি, কেনে কম। কিন্তু শ্রোতাদের বেশিরভাগ প্রশ্ন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে কেন্দ্র করেই। আগামীতে দুই দেশের মধ্যে যেসব চুক্তি-সমঝোতা হওয়ার কথা, সেসবও আলোচনায় এসেছে। শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বাংলাদেশের অনেক মানুষকেই বিষয়টি আলোড়িত করছে এবং করবে। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এবং এর দায় তাদের ওপরই বর্তাবে। পথ চলতে হবে জনমতকে বিবেচনায় রেখেই।
মনমোহন সিং 'বাংলাদেশে যে কোনো মুহূর্তে পটপরিবর্তনের' শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার প্রত্যক্ষ সহযোগী জামায়াতে ইসলামীর শক্তির চিত্র দিয়েছেন। এটা হতে পারে যে, তিনি 'গোটা ধর্মান্ধ শক্তিকে' বোঝাতেই জামায়াতে ইসলামীর নাম ব্যবহার করেছেন। এই শক্তির সঙ্গে বিএনপির স্ট্র্যাটেজিক সখ্যও সুবিদিত। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাকিস্তান ও সৌদি আরবে পালিয়ে থাকা গোলাম আযমকে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে ফিরে আসার অনুমতি দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে সরকার গঠনের পর জামায়াতে ইসলামী গোলাম আযমকে দলের আমির ঘোষণা করার 'অসম সাহসী' পদক্ষেপ নেন। ২০০১ সালে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করে এবং জামায়াতে ইসলামীর দুই শীর্ষ নেতাকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করে। এরপর একের পর এক চমক_ শায়খ আবদুর রহমান, বাংলাভাই ও মুফতি হান্নানের উত্থান এবং বাংলাদেশ নামক দেশটি যে কোনো সময়ে 'পাকা ফলের মতো' মৌলবাদীদের খপ্পরে পড়বে বলে উল্লেখযোগ্য মানুষের মনে ধারণা সৃষ্টি। খালেদা জিয়ার সরকার এ শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করছে, এমন ধারণা মোটেই অমূলক ছিল না। আবার এটাও ঠিক যে, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলার প্রায় পাঁচশ' স্থানে একই দিনে একযোগে বোমা হামলা এবং ঝালকাঠি, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নেত্রকোনাসহ কয়েকটি এলাকায় ইসলামী জঙ্গিদের আত্মঘাতী বোমা-গ্রেনেড হামলা পরিচালনার পর খালেদা জিয়ার সরকারই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এসব ধর্মান্ধ শক্তির রাজনৈতিক অভিলাষ রয়েছে এবং তা গোপন রাখা হয় না। বিএনপি সরকার তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করবে, সেটা হয়তো অনেকেই ভাবতে পারেনি। এর ফলে বিএনপির সঙ্গে তাদের দূরত্ব কিছুটা বেড়ে থাকবে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী এবং অন্য ইসলামী দলগুলোর ভরাডুবি ঘটে। নির্বাচনে এদের সঙ্গে বিএনপি জোট বেঁধেছিল। বিএনপির অনেক সমর্থক মনে করেছিল, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী এবং শায়খ আবদুর রহমান-বাংলাভাইদের সঙ্গে জোট বাঁধার খেসারত দিতে হয়েছে নির্বাচনে। অনেকের ধারণা হয়েছিল, বিএনপি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেবে এবং ধর্মান্ধ শক্তির সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে উদ্যোগী হবে। একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন শীর্ষ নেতার বিচারের উদ্যোগের পর বিএনপি নেতারা তাদের মুক্তির দাবিতে খুব একটা মুখ না খোলায় কিছু আশাবাদেরও সঞ্চার হয়। কিন্তু 'বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে উৎসাহ জোগানো হচ্ছিল, যাতে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো বর্তমান সরকারের ধর্মীয় বিষয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামে' [প্রথম আলো, ৯ জুলাই, ২০১১]। এ সংক্রান্ত খবরে আরও বলা হয়, ফতোয়া, নারীনীতি, শিক্ষানীতিসহ একাধিক ধর্মীয় বিষয়ে আলেম সমাজ আন্দোলনে না নামায় খালেদা জিয়া উষ্মা প্রকাশ করেন।
অবশেষে তারা আন্দোলনে নেমেছে এবং খালেদা জিয়ার প্রত্যাশামতো ১০ ও ১১ জুলাই এক টানা ৩০ ঘণ্টার হরতাল আহ্বান করেছে। এ হরতালের প্রতি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করেছে। এর আগে ৬ ও ৭ জুলাই বিএনপি ও জামায়াত টানা ৪৮ ঘণ্টা হরতাল আহ্বান করেছিল। এ দুটি দল ১২ ও ১৩ জুনও ৩০ ঘণ্টার হরতাল আহ্বান করেছিল। বাংলাদেশে এখন হরতাল আহ্বানকারীদের যেমন জোশ থাকে, হরতাল পালন করায় জনসাধারণের তরফে তেমনটি দেখা যায় না। এ কারণেই হরতাল এক ধরনের 'ছুটিতে' পরিণত হয়েছে। 'টানা ছয় দিন ছুটি পেয়ে' লাখ লাখ মানুষ 'ঈদের আমেজে' ঢাকার বাইরে চলে গেছে। বিএনপি নেতারাও মানুষের এ মেজাজ জানে। এ কারণে তারাও ছুটির দিনের সঙ্গে মিলিয়ে হরতালের তারিখ নির্ধারণ করছে। হরতালে যে জনসাধারণ রাজপথে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ মিছিলে আদৌ শামিল হবে না, সে বুঝও তাদের রয়েছে। কিন্তু ১০ ও ১১ জুলাইয়ের হরতালকে কেন্দ্র করে বিএনপির সঙ্গে ধর্মান্ধ শক্তির সখ্য যে নতুন মাত্রা পেয়েছে, সেটাই রাজনীতিতে সর্বশেষ চমক। বিএনপি নেতৃত্ব মৌলবাদীদের খপ্পরে পড়ে গিয়েছে, এমন সরলীকরণ করা হয়তো ঠিক হবে না। খালেদা জিয়া এমন হিসাবও করে থাকতে পারেন যে, মৌলবাদী শক্তি মাঠে নেমে সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গি জিগির তুলে সরকারকে চাপে ফেলতে পারলে ভোটের সময়ে বিএনপির ঘরেই তার ফসল আসবে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে নির্বাচনী প্রচারণায় খালেদা জিয়া বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মসজিদে আজানের ধ্বনি শোনা যাবে না। ঘণ্টা ও উলুধ্বনি এবং সিঁদুর-তিলক নিয়েও করা হয়েছে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ। এতে দেশের তিন কোটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীর মধ্যে যে ক্ষোভ ও যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়, সেটা ভাবার অবকাশ আদৌ দেখা যায় না। দশকের পর দশক ধরে রাজনীতি ও সমাজ জীবনে ধর্মান্ধ রাজনৈতিক গোষ্ঠী যে বিষ ফোঁড়ার মতো হয়ে আছে, সেটাও নেই বিবেচনায়। গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার কথা বলে। একই সঙ্গে জড়িত রয়েছে মানবাধিকারের ইস্যু। বেশিরভাগ লোক এক জোট হয়েও এমন কিছু করতে পারে না, যাতে সংখ্যালঘুদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়। বিএনপি নেতৃত্ব কি এ বিষয়টি উপেক্ষা করেই চলবেন?
সাধারণ নির্বাচন এখনও আড়াই বছর দূরে। কোনো দল নির্বাচনী আমেজ চাইলেই সৃষ্টি করা যায় না। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি আর্থ-সামাজিক ইস্যুগুলো নিয়ে জনসাধারণের সঙ্গে মতবিনিময়ের এটাই চমৎকার সময় হতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, তেল-গ্যাস অনুসন্ধান-আহরণের পন্থা, খাদ্য ও জ্বালানি তেলে সরকারি ভর্তুকি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ও বেসরকারি খাতের অবস্থান এবং এ ধরনের আরও ইস্যু নিয়ে চলতে পারে তর্ক-বিতর্ক। রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরেও সমাজে এমন অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা এতে ভূমিকা রাখতে পারে। এ পথে না চলে কেন ইতিহাসের চাকা ফের উল্টোমুখী করার চেষ্টা? বিএনপি নেতৃত্ব নিশ্চয়ই মাত্র ছয় বছরে ২০০৫ সালের তিক্ত অভিজ্ঞতা ভুলে যায়নি। শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলাভাইয়ের দল এবং জামায়াতে ইসলামী সে সময়ে তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। কিন্তু তারা এমন হিংসার পথে চলছিল যাতে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প ছিল না। পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে কিংবা উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর বার্ষিক সম্মেলনে ভয়ঙ্কর বোমা-গ্রেনেড হামলা চালিয়ে এই শক্তি নিজেদের প্রকৃত উদ্দেশ্য তুলে ধরেছে। তারা নিজেদের শুধরে নিয়েছে, এমন ধারণার কারণ নেই। বিএনপি নেতৃত্বও নিশ্চয়ই সেটা জানে। তারপরও কেন আগুন নিয়ে খেলা?
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার যে প্রতিশ্রুতি ও প্রত্যাশা নিয়ে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি চমকের সরকার গঠন করেছিল তার সবটা পূরণ হয়নি। মন্ত্রী এবং সরকারদলীয় এমপিদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ তেমন নেই। কিন্তু সবকিছু ভালোভাবে যে চলছে না, তাতেও দ্বিমত করার উপায় নেই। মধ্যবিত্ত-শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সরকারের প্রচুর সমালোচনা শোনা যায় এবং তা প্রকাশ্য। সংবাদপত্রে মূল সুর হয়ে উঠছে সরকারের নানা কাজের সমালোচনা। এমনকি সরকারের ভেতর থেকেও প্রকাশ পাচ্ছে ক্ষোভ। পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়নি ঠিকই, কিন্তু একটু দূরে যাদের নজর তারা মন্দ সংকেত নিশ্চয়ই পাচ্ছেন। বিএনপি কেন তা উপেক্ষা করে ধর্মান্ধ শক্তির পালে হাওয়া দিচ্ছে, বিশেষ করে ২০০৫ সালের তিক্ত অভিজ্ঞতার পরও?
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
করে ধর্মান্ধ শক্তির পালে হাওয়া দিচ্ছে, বিশেষ করে ২০০৫ সালের তিক্ত অভিজ্ঞতার পরও?
বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নিয়ে কয়েকদিন ধরেই জোর আলোচনা চলছে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ১ জুলাই এক মন্তব্যে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীকে 'মহাশক্তিধর রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তুলে ধরায় অনেকেই বিস্মিত হয়েছিল। ভারতের কয়েকজন সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনায় তার আরেকটি মন্তব্য ছিল, 'বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা রয়েছে।' যে কোনো মুহূর্তে পটপরিবর্তনের আশঙ্কাও ব্যক্ত হয়েছিল তার এই একান্ত বৈঠকে। তবে 'গোপন কথাটি' গোপন রাখা হয়নি, আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে তুলে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মতো পটপরিবর্তন হবে নাকি ২০০৭ সালের মতো ওয়ান-ইলেভেন_ এ নিয়েও সংশয় চলতে থাকে। তারপর ভোজবাজির মতো ওয়েবসাইট থেকে উঠে গেল এ মন্তব্য। ঢাকায় এলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণা। ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর মনমোহন সিং বহুল প্রতীক্ষিত সফরে বাংলাদেশে আসছেন, সে ঘোষণাও এলো। শনিবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে 'জাতীয় বাজেট ২০১১-২০১২ : বাংলাদেশের বৈদেশিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব' শীর্ষক এক সেমিনারে অংশ নেওয়ার সুযোগ ঘটেছিল। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো খোন্দকার মোয়াজ্জেম চলতি বছরের বাজেট পর্যালোচনা করে যখন বক্তব্য রাখছিলেন, মিলনায়তন ছিল মন্ত্রমুদ্ধ। উপাচার্য ড. শরীফ এনামুল হক এ সময় উপস্থিত ছিলেন। সিনিয়র ও তরুণ শিক্ষকরাও এতে অংশ নেন। প্রশ্নোত্তর পর্বে সবচেয়ে প্রশ্ন আসে ভারত ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে। তরুণদের বক্তব্যে ছিল ভারতকে নিয়ে শঙ্কা-সংশয়। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ভারত-বাংলাদেশের মতোই। ভারত থেকে বাংলাদেশ যা আমদানি করে, সেখানে রফতানি হয় তার তুলনায় কণামাত্র। চীনের ক্ষেত্রেও একই চিত্র_ তারা বাংলাদেশের কাছে বেচে বেশি, কেনে কম। কিন্তু শ্রোতাদের বেশিরভাগ প্রশ্ন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে কেন্দ্র করেই। আগামীতে দুই দেশের মধ্যে যেসব চুক্তি-সমঝোতা হওয়ার কথা, সেসবও আলোচনায় এসেছে। শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বাংলাদেশের অনেক মানুষকেই বিষয়টি আলোড়িত করছে এবং করবে। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এবং এর দায় তাদের ওপরই বর্তাবে। পথ চলতে হবে জনমতকে বিবেচনায় রেখেই।
মনমোহন সিং 'বাংলাদেশে যে কোনো মুহূর্তে পটপরিবর্তনের' শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার প্রত্যক্ষ সহযোগী জামায়াতে ইসলামীর শক্তির চিত্র দিয়েছেন। এটা হতে পারে যে, তিনি 'গোটা ধর্মান্ধ শক্তিকে' বোঝাতেই জামায়াতে ইসলামীর নাম ব্যবহার করেছেন। এই শক্তির সঙ্গে বিএনপির স্ট্র্যাটেজিক সখ্যও সুবিদিত। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাকিস্তান ও সৌদি আরবে পালিয়ে থাকা গোলাম আযমকে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে ফিরে আসার অনুমতি দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে সরকার গঠনের পর জামায়াতে ইসলামী গোলাম আযমকে দলের আমির ঘোষণা করার 'অসম সাহসী' পদক্ষেপ নেন। ২০০১ সালে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করে এবং জামায়াতে ইসলামীর দুই শীর্ষ নেতাকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করে। এরপর একের পর এক চমক_ শায়খ আবদুর রহমান, বাংলাভাই ও মুফতি হান্নানের উত্থান এবং বাংলাদেশ নামক দেশটি যে কোনো সময়ে 'পাকা ফলের মতো' মৌলবাদীদের খপ্পরে পড়বে বলে উল্লেখযোগ্য মানুষের মনে ধারণা সৃষ্টি। খালেদা জিয়ার সরকার এ শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করছে, এমন ধারণা মোটেই অমূলক ছিল না। আবার এটাও ঠিক যে, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলার প্রায় পাঁচশ' স্থানে একই দিনে একযোগে বোমা হামলা এবং ঝালকাঠি, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নেত্রকোনাসহ কয়েকটি এলাকায় ইসলামী জঙ্গিদের আত্মঘাতী বোমা-গ্রেনেড হামলা পরিচালনার পর খালেদা জিয়ার সরকারই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এসব ধর্মান্ধ শক্তির রাজনৈতিক অভিলাষ রয়েছে এবং তা গোপন রাখা হয় না। বিএনপি সরকার তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করবে, সেটা হয়তো অনেকেই ভাবতে পারেনি। এর ফলে বিএনপির সঙ্গে তাদের দূরত্ব কিছুটা বেড়ে থাকবে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী এবং অন্য ইসলামী দলগুলোর ভরাডুবি ঘটে। নির্বাচনে এদের সঙ্গে বিএনপি জোট বেঁধেছিল। বিএনপির অনেক সমর্থক মনে করেছিল, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী এবং শায়খ আবদুর রহমান-বাংলাভাইদের সঙ্গে জোট বাঁধার খেসারত দিতে হয়েছে নির্বাচনে। অনেকের ধারণা হয়েছিল, বিএনপি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেবে এবং ধর্মান্ধ শক্তির সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে উদ্যোগী হবে। একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন শীর্ষ নেতার বিচারের উদ্যোগের পর বিএনপি নেতারা তাদের মুক্তির দাবিতে খুব একটা মুখ না খোলায় কিছু আশাবাদেরও সঞ্চার হয়। কিন্তু 'বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে উৎসাহ জোগানো হচ্ছিল, যাতে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো বর্তমান সরকারের ধর্মীয় বিষয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামে' [প্রথম আলো, ৯ জুলাই, ২০১১]। এ সংক্রান্ত খবরে আরও বলা হয়, ফতোয়া, নারীনীতি, শিক্ষানীতিসহ একাধিক ধর্মীয় বিষয়ে আলেম সমাজ আন্দোলনে না নামায় খালেদা জিয়া উষ্মা প্রকাশ করেন।
অবশেষে তারা আন্দোলনে নেমেছে এবং খালেদা জিয়ার প্রত্যাশামতো ১০ ও ১১ জুলাই এক টানা ৩০ ঘণ্টার হরতাল আহ্বান করেছে। এ হরতালের প্রতি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করেছে। এর আগে ৬ ও ৭ জুলাই বিএনপি ও জামায়াত টানা ৪৮ ঘণ্টা হরতাল আহ্বান করেছিল। এ দুটি দল ১২ ও ১৩ জুনও ৩০ ঘণ্টার হরতাল আহ্বান করেছিল। বাংলাদেশে এখন হরতাল আহ্বানকারীদের যেমন জোশ থাকে, হরতাল পালন করায় জনসাধারণের তরফে তেমনটি দেখা যায় না। এ কারণেই হরতাল এক ধরনের 'ছুটিতে' পরিণত হয়েছে। 'টানা ছয় দিন ছুটি পেয়ে' লাখ লাখ মানুষ 'ঈদের আমেজে' ঢাকার বাইরে চলে গেছে। বিএনপি নেতারাও মানুষের এ মেজাজ জানে। এ কারণে তারাও ছুটির দিনের সঙ্গে মিলিয়ে হরতালের তারিখ নির্ধারণ করছে। হরতালে যে জনসাধারণ রাজপথে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ মিছিলে আদৌ শামিল হবে না, সে বুঝও তাদের রয়েছে। কিন্তু ১০ ও ১১ জুলাইয়ের হরতালকে কেন্দ্র করে বিএনপির সঙ্গে ধর্মান্ধ শক্তির সখ্য যে নতুন মাত্রা পেয়েছে, সেটাই রাজনীতিতে সর্বশেষ চমক। বিএনপি নেতৃত্ব মৌলবাদীদের খপ্পরে পড়ে গিয়েছে, এমন সরলীকরণ করা হয়তো ঠিক হবে না। খালেদা জিয়া এমন হিসাবও করে থাকতে পারেন যে, মৌলবাদী শক্তি মাঠে নেমে সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গি জিগির তুলে সরকারকে চাপে ফেলতে পারলে ভোটের সময়ে বিএনপির ঘরেই তার ফসল আসবে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে নির্বাচনী প্রচারণায় খালেদা জিয়া বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মসজিদে আজানের ধ্বনি শোনা যাবে না। ঘণ্টা ও উলুধ্বনি এবং সিঁদুর-তিলক নিয়েও করা হয়েছে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ। এতে দেশের তিন কোটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীর মধ্যে যে ক্ষোভ ও যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়, সেটা ভাবার অবকাশ আদৌ দেখা যায় না। দশকের পর দশক ধরে রাজনীতি ও সমাজ জীবনে ধর্মান্ধ রাজনৈতিক গোষ্ঠী যে বিষ ফোঁড়ার মতো হয়ে আছে, সেটাও নেই বিবেচনায়। গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার কথা বলে। একই সঙ্গে জড়িত রয়েছে মানবাধিকারের ইস্যু। বেশিরভাগ লোক এক জোট হয়েও এমন কিছু করতে পারে না, যাতে সংখ্যালঘুদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়। বিএনপি নেতৃত্ব কি এ বিষয়টি উপেক্ষা করেই চলবেন?
সাধারণ নির্বাচন এখনও আড়াই বছর দূরে। কোনো দল নির্বাচনী আমেজ চাইলেই সৃষ্টি করা যায় না। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি আর্থ-সামাজিক ইস্যুগুলো নিয়ে জনসাধারণের সঙ্গে মতবিনিময়ের এটাই চমৎকার সময় হতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, তেল-গ্যাস অনুসন্ধান-আহরণের পন্থা, খাদ্য ও জ্বালানি তেলে সরকারি ভর্তুকি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ও বেসরকারি খাতের অবস্থান এবং এ ধরনের আরও ইস্যু নিয়ে চলতে পারে তর্ক-বিতর্ক। রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরেও সমাজে এমন অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা এতে ভূমিকা রাখতে পারে। এ পথে না চলে কেন ইতিহাসের চাকা ফের উল্টোমুখী করার চেষ্টা? বিএনপি নেতৃত্ব নিশ্চয়ই মাত্র ছয় বছরে ২০০৫ সালের তিক্ত অভিজ্ঞতা ভুলে যায়নি। শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলাভাইয়ের দল এবং জামায়াতে ইসলামী সে সময়ে তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। কিন্তু তারা এমন হিংসার পথে চলছিল যাতে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প ছিল না। পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে কিংবা উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর বার্ষিক সম্মেলনে ভয়ঙ্কর বোমা-গ্রেনেড হামলা চালিয়ে এই শক্তি নিজেদের প্রকৃত উদ্দেশ্য তুলে ধরেছে। তারা নিজেদের শুধরে নিয়েছে, এমন ধারণার কারণ নেই। বিএনপি নেতৃত্বও নিশ্চয়ই সেটা জানে। তারপরও কেন আগুন নিয়ে খেলা?
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার যে প্রতিশ্রুতি ও প্রত্যাশা নিয়ে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি চমকের সরকার গঠন করেছিল তার সবটা পূরণ হয়নি। মন্ত্রী এবং সরকারদলীয় এমপিদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ তেমন নেই। কিন্তু সবকিছু ভালোভাবে যে চলছে না, তাতেও দ্বিমত করার উপায় নেই। মধ্যবিত্ত-শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সরকারের প্রচুর সমালোচনা শোনা যায় এবং তা প্রকাশ্য। সংবাদপত্রে মূল সুর হয়ে উঠছে সরকারের নানা কাজের সমালোচনা। এমনকি সরকারের ভেতর থেকেও প্রকাশ পাচ্ছে ক্ষোভ। পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়নি ঠিকই, কিন্তু একটু দূরে যাদের নজর তারা মন্দ সংকেত নিশ্চয়ই পাচ্ছেন। বিএনপি কেন তা উপেক্ষা করে ধর্মান্ধ শক্তির পালে হাওয়া দিচ্ছে, বিশেষ করে ২০০৫ সালের তিক্ত অভিজ্ঞতার পরও?
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
No comments