ভিকারুননিসা নূন-মর্যাদার প্রতিষ্ঠানটি নিষ্কলঙ্ক হোক by আখতার জাহান

মনে প্রশ্ন জাগে, নামি-দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিরই যখন এই হাল তখন দেশের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা কী? বিষয়টি আমাকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। বাংলাদেশের মানুষ গড়ার কারিগর নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কি এভাবেই ধ্বংস হয়ে যাবে শুধু এক শ্রেণীর অসাধু, স্বার্থপর, নীতিজ্ঞানবর্জিত মানুষের খামখেয়ালিপনায়? উপর্যুক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় এনে সরকারের অবিলম্বে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক


শিক্ষকতা আমার নেশা এবং পেশা। গত ১ জানুয়ারি স্বাভাবিক নিয়মে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী অধ্যাপক পদ থেকে অবসর গ্রহণ করি। বর্তমানে ভালো বই পড়ে, গান শুনে, সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা করে জীবনের বাকি সময়টুকু পার করার চেষ্টা করছি, যা আগে সময়ের অভাবে পেরে উঠিনি। তার মধ্যেও নিরন্তর মনে পড়ে আমার সদ্য ছেড়ে আসা প্রতিষ্ঠানটির কথা, প্রতিনিয়ত অভাববোধ করি আমার প্রিয় সহকর্মী আর সন্তানতুল্য স্নেহের শিক্ষার্থীদের সাহচর্য। বেশ কিছুদিন ধরে কানাঘুষা ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক দ্বারা ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনাটি আমার নজরে আসে।
ভিকারুননিসার শিক্ষক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে বরাবরই গর্ববোধ করতাম। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহজ, সুন্দর, অনাবিল ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের পরিবেশ বিরাজ করত। এক সময়ে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মনোনীত হতেন শিক্ষানুরাগী, মানসিকভাবে স্বশিক্ষিত ব্যক্তিরা। বিগত সরকারের আমলে এই নিয়ম পরিবর্তন করে স্থানীয় সাংসদদের সভাপতি করার প্রথা চালু হয়, যা একটি ভুল পদক্ষেপ। একজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি ও একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মানসিক গঠন এক নয়। তারা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থটাকেই বড় করে দেখেন। প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়নের পরিবর্তে ভর্তি-বাণিজ্য, নিয়োগ-বাণিজ্য ও আরও অন্যান্য বাণিজ্য করে বিনা পুঁজিতে প্রচুর অর্থ উপার্জন করাই অন্যতম উদ্দেশ্য হয়।
সম্প্রতি ভিকারুননিসায় যা ঘটছে তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ভিকারুননিসার অবক্ষয় শুরু হয়েছিল আরও আগেই, তৎকালীন পর্ষদ সভাপতি ও অধ্যক্ষের যোগসাজশে প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যক্তিমালিকানাধীন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নামে স্কুলের জমি দখল ও শিক্ষকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে ৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত মুনাফার আশ্বাস দিয়ে সোনালী ব্যাংক (ভিকারুননিসা শাখা) থেকে অন্য ব্যাংকে স্থানান্তর করার মাধ্যমে। বিগত সরকারের আমলে পরবর্তী অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের প্রচেষ্টায় জমি উদ্ধার হলেও অর্থ আদায় হয়নি। পরবর্তীকালে এই অর্থ আদায়ের জন্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ২০০৪ সালে নিম্ন আদালতে একটি মামলা করা হয়। বিলম্বে হলেও ১৩.১০.২০০৮ তারিখে নিম্ন আদালতে মামলার রায় প্রতিষ্ঠানের পক্ষে গিয়ে আদালত ওই সাবেক সভাপতিকে সর্বমোট ৮ কোটি ৯ লাখ ৪৬ হাজার ২৪ টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু এই রায় প্রদান সত্ত্বেও পরবর্তীকালে যখন টাকা পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন এ বিষয়ে সাবেক অধ্যক্ষ ও শিক্ষকরা নিজ উদ্যোগে বর্তমান সরকারপ্রধানের শরণাপন্ন হয়ে তার সহযোগিতা কামনা করেন। সরকারপ্রধান অত্যন্ত সহানুভূতি ও গুরুত্ব সহকারে বিষয়টি বিবেচনায় এনে আশু সমাধানের লক্ষ্যে পুনর্তদন্তের নির্দেশ দেন। যতদূর জানা যায়, তদন্ত রিপোর্টটিও আদালতের রায়ের সঙ্গে একমত পোষণ করে। আশা করা গিয়েছিল বর্তমান সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠানটি তার ন্যায্য প্রাপ্য অর্থ ফেরত পাবে। যদিও এটি আদায় করার নৈতিক দায়িত্ব ছিল বর্তমান পর্ষদ ও অধ্যক্ষের; কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বারবার বলা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত তাদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
একজন মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে ওঠে তখনই, যখন সে তার পরিবার, পারিপাশর্ি্বক অবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আদর্শিক অনুকূল পরিবেশ পায়। এর একটি জায়গাও যদি কোনোরকম হেরফের হয়, তাহলে তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং এর দায় অনেকটাই পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপরই বর্তায়। সে ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে (বিশেষ করে মেয়েদের) পুরুষ শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি নির্বাচন করতে হয় অনেক চিন্তা-ভাবনা করে। শিক্ষক দ্বারা শিক্ষার্থী নির্যাতনের কথা আজকাল প্রায়ই শোনা যায়। সত্যিকার অর্থে এই কাজ যারা করে থাকেন, তাদের শিক্ষক হওয়ার কোনো যোগ্যতাই নেই। দেখা গেছে, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন অনেক শিক্ষার্থীর জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছে। বিষয়টি খুবই আশঙ্কাজনক।
সম্প্রতি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী নির্যাতনে অভিযুক্ত যেসব শিক্ষকের নাম পত্রপত্রিকায় উঠে এসেছে, তাদের নিয়োগদান হয়েছে গত সেপ্টেম্বরে। বর্তমান পর্ষদ ও অধ্যক্ষ (নবনিযুক্ত এবং পর্ষদ কর্তৃক মনোনীত) দ্বারা। জানা যায়, শিক্ষার্থী নির্যাতনের বিষয়টি আগেই কর্তৃপক্ষের গোচরে আনা হয়েছিল; কিন্তু তারা তেমন কোনো গুরুত্ব না দিয়ে হালকাভাবে নিয়ে উল্টো সতর্ককারী শিক্ষকদের তিরস্কৃত করে। একজন মানুষের আচার-আচরণ, ব্যবহার তাকে চিনতে সহায়তা করে। কিন্তু প্রশ্ন, সতর্ক করার পরও কেন পরিচালনা পর্ষদ নীরব ছিল? কেন অধ্যক্ষ বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে তদন্ত বা নিবিড় পর্যবেক্ষণে না এনে হালকাভাবে নিয়েছিলেন? অনেক সময় ঘরের কথা ঘরের ভেতরেই সীমাবদ্ধ রাখা ভালো, শান্তির জন্য অনেক আপসই করতে হয়; কিন্তু তারও একটা মাত্রা থাকে। মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে ঘরের কথা আর ঘরে থাকে না। যে দায়িত্ব পরিচালনা পর্ষদ, অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের ছিল সে দায়িত্ব কেন শিক্ষার্থীদের নিতে হলো? অভিযোগ প্রমাণিত হলে শুধু সাময়িক বরখাস্ত বা অন্য শাখায় বদলি করে দায় এড়িয়ে গেলে চলবে না, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থাও করতে হবে এবং সেটা করতে হবে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেই।
জানা যায়, ঘটনাটি ঘটার পর প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক দ্বারা গঠিত শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে একটি সভার আহ্বান করা হয়েছিল; কিন্তু পর্ষদের এক মহিলা সদস্য (যার কন্যা বহু আগেই এ প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে চলে গেছে) তা বন্ধ করে দেন। আমার প্রশ্ন, তিনি নিজে একজন নারী হয়েও কেন নির্যাতিত শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়াননি?
উল্লেখ্য, এই পর্ষদের আমলেই কয়েক বছর আগে তাদেরই লালিত একশ্রেণীর তথাকথিত অভিভাবক নামধারী একদল সন্ত্রাসী নিতান্ত তুচ্ছ একটি মনগড়া বিষয় নিয়ে আন্দোলনের নামে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে অধ্যক্ষের দরজায় লাথি মারে, শিক্ষকরা এর প্রতিবাদ করায় তারা শিক্ষকদের চুলের মুঠি ধরে বের করে নিজেরাই অধ্যক্ষ ও শিক্ষক নিয়োগদানের হুমকি দিয়েছিল। সব দাবি আদায়ের একটি যৌক্তিকতা ও সৌন্দর্য থাকে। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের দরজায় লাথি মারার অর্থ প্রতিষ্ঠানের গায়ে লাথি মারা, শিক্ষকদের সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করা মানে তাদের সন্তানকে যারা মানুষ করার দায়িত্ব নিয়েছেন তাদের অসম্মান করা। তখনও এই পর্ষদ নীরব, নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করেছিল। শিক্ষকদের চাপের মুখে পরবর্তীকালে বিষয়টি তদন্তের ব্যবস্থা করা হয়; কিন্তু তদন্ত না করেই তারা চলে যান। বাকিরা দায়সারা গোছের তদন্ত করে বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। পটপরিবর্তনের পরে তারাই আবার নবনিযুক্ত অধ্যক্ষকে মিষ্টি ও ফুলের তোড়া নিয়ে সংবর্ধিত করে। এই ঘটনাটি প্রতিষ্ঠানটির নিয়ম-শৃঙ্খলার অবনতির অনেক চিত্রের একটি চিত্রমাত্র। তথাকথিত অভিভাবকের মুখে আগেরবারের প্রতিবাদের ভাষা ছিল_ 'আমাদের দাবি মানতে হবে. অধ্যক্ষকে সরে যেতে হবে।' এবার শিক্ষার্থীদের মুখে শুনেছি_ 'আমাদের এক দাবি, অধ্যক্ষ তুই করে যাবি।' অধ্যক্ষকে নিয়ে এ ধরনের ধৃষ্টতাপূর্ণ অশালীন বুলি ছাত্রীদের মুখে কারা জোগাল? এটা কি রাজনীতির মাঠ না শিক্ষা প্রতিষ্ঠান? এর পেছনে উদ্দেশ্য কী? কারা তাদের উস্কে দিচ্ছে, খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
মনে প্রশ্ন জাগে, নামি-দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিরই যখন এই হাল তখন দেশের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা কী? বিষয়টি আমাকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। বাংলাদেশের মানুষ গড়ার কারিগর নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কি এভাবেই ধ্বংস হয়ে যাবে শুধু এক শ্রেণীর অসাধু, স্বার্থপর, নীতিজ্ঞানবর্জিত মানুষের খামখেয়ালিপনায়? উপর্যুক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় এনে সরকারের অবিলম্বে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক।

আখতার জাহান :সাবেক সহকারী অধ্যাপক ভিকারুননিসা নূন কলেজ

No comments

Powered by Blogger.