দুর্নীতি দমন-দুদক আইন নিয়ে কিছু নাগরিক ভাবনা by মাহবুবুর রহমান
বাংলাদেশের দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র আমাকে সাংঘাতিকভাবে উদ্বিগ্ন করে, উৎকণ্ঠিত রাখে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ দুর্নীতি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) বাংলাদেশকে মাত্র কয়েক বছর আগে পৌনঃপুনিকভাবে পাঁচবার বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল।
হালেও সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়নি, বরং এর ভয়াবহতা শাখা-প্রশাখায় বিস্তারিত হয়েছে।
ভাবলে অবাক হই, এই জাতিই অস্ত্র হাতে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিল, রক্ত ঝরিয়েছিল। কঠিন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এক সাগর রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। এত ত্যাগ, এত বিসর্জনের বাংলাদেশ মাত্র ৪০ বছরে এ কী দশা! কী শোনার ছিল, কী শুনছি? কী দেখার ছিল, কী দেখছি? মুক্তিযুদ্ধের মহান গৌরব ধুলায় লুণ্ঠিত।
কিন্তু এ বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তাঁতি সব পেশাজীবী-শ্রমজীবী মানুষ, আপামর জনগণ দুর্নীতির সঙ্গে কতটুকু জড়িত? তারা তো মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে। উদয়াস্ত পরিশ্রম করছে। তাদের প্রশ্ন, হিমালয়প্রমাণ এত বড় দুর্নীতির, কলঙ্কের তারা কেন অংশীদার হবে? তারা কেন সহ্য করবে, এত বড় জাতীয় গ্লানি, এত বড় অপমান। তারা তো দুনম্বরি করে না। তারা অস্ত্র ব্যবসা করে না। নারী ও শিশু রপ্তানি করে না। মানি লন্ডারিং করে না। শেয়ারবাজারে ধস নামিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে না। লাইসেন্স জাল করে না। দেশের সম্পদ পাচার করে না। বহুজাতিক কোম্পানিদের সঙ্গে অসম চুক্তি করে মহামূল্যবান তেল, গ্যাস, কয়লা বিদেশিদের হাতে তুলে দেয় না।
দারিদ্র্যই এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জাতীয় সমস্যা। এটি জাতীয় সংকট, মহামানবিক দুর্যোগ। তাই দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধায় অন্ন জোগাড়, রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থাই জাতির জন্য আজ সবচেয়ে বড় কাজ। বেকার কোটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থান করাই এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও বাংলাদেশের ৫০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। মানুষের মৌলিক পাঁচটি চাহিদার (অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাসস্থান) একটিরও ন্যূনতম সমাধান দিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে, স্বাবলম্বী ও উন্নয়নশীল হতে আমাদের চলার পথে বাধার বিন্ধ্যাচল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুর্নীতি। এটি একটি মারাত্মক ব্যাধি, সমাজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে জাতীয় জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে সংক্রামক রোগের মতো বিস্তারিত। দারিদ্র্য বিমোচন ও জাতীয় উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে সুশাসন। আর সুশাসন তখনই সম্ভব, যখন শাসনযন্ত্রে বিশ্বস্ততা ও সততা সম্বন্ধে জনগণ আস্থাবান হবে, শ্রদ্ধাশীল হবে। গণতন্ত্রের দুই প্রধান নিয়ামক শক্তি স্বচ্ছতা আর জবাবদিহি। দুর্নীতির অবাধ বিস্তার সমাজের স্বচ্ছতা আর জবাবদিহির দৈন্যই নগ্নভাবে প্রকাশ করে। প্রকাশ করে, আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর, আমাদের শাসনযন্ত্রের অসারতা ও দীনতা। ব্যক্তিগত সুবিধা লাভের জন্য সরকারি অবস্থানের অপব্যবহারই দুর্নীতি। দুর্নীতির মধ্যে স্বভাবতই জড়িত শাসনযন্ত্রের উঁচু মহলের নীতিনির্ধারকেরা। জড়িত জ্যেষ্ঠ আমলা, বড় বড় মুনাফাখোর, অসাধু ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি, কর প্রতারক ও ব্যাংক ঋণ খেলাফিরা। সমাজের যে যত বিত্তবান, তার বিত্তের সঙ্গে সঙ্গে তত বেশি অপরাধ জড়িয়ে আছে। ধনাঢ্য ব্যক্তির কাপবোর্ডেই মানুষের কঙ্কাল লুকানো থাকে। দুর্নীতি অন্যায়-অপরাধ-অনৈতিকতারই অপর নাম। মাছের পচন যেমন শুরু হয় মাথা থেকে, দুর্নীতির বাসও তেমনি অতি উঁচু মহলে। পানি যেমন ওপর থেকে নিচে গড়ায়, দুর্নীতিও তেমনি সব সময় অধোগামী।
জাতীয় সংসদ একটি মহান প্রতিষ্ঠান। জাতির সবচেয়ে পবিত্র স্থান, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাদপীঠ। জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, জাতির সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। জাতির কল্যাণে নীতিমালা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করাই জাতীয় সংসদের দায়িত্ব। যাঁরা জনপ্রতিনিধি, তাঁদের স্কন্ধেই এই মহান দায়িত্ব বর্তায়। কিন্তু এই দায়িত্ব পালনে আমরা কতটুকু আন্তরিক প্রয়াস নিয়েছি, সংসদকে কার্যকর করার জন্য কতটুকু একনিষ্ঠ থেকেছি? গণতন্ত্রকে সত্যিকার প্রতিষ্ঠানিক রূপ দিতে, তার শেকড়কে গভীরে প্রোথিত করতে কতটুকু সফল হয়েছি? জাতীয় জীবনে ও প্রশাসনে কতটুকু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পেরেছি? আমরা কখনো আমলাদের দিকে, কখনো বা অসাধু ব্যবসায়ীদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছি। কিন্তু কখনো ভালো করে দেখিনি যে এক অঙ্গুলি দ্বারা অন্যকে যখন নির্দেশ করছি, তখন আমার হাতেরই অপর অঙ্গুলিগুলো আমার নিজের দিকেই নির্দেশ করছে। আমরা সংসদেরা নির্বাচন-পরবর্তীকালে প্রথম যে কাজটি করি তা হলো, এক মিথ্যা স্বাক্ষরিত পত্রে নির্বাচনী ব্যয়ের ঘোষণা দেওয়া। আমাদের যানবাহনের সুবিধার্থে সরকারপ্রদত্ত শুল্কমুক্ত মোটরগাড়ির পারমিট লোভের বশবর্তী হয়ে কিছু টাকার বিনিময়ে সরকারের লক্ষ-কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে হস্তান্তর করি।
ওয়ান-ইলেভেনের পর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নতুন অধ্যাদেশ জারি করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সারা দেশে কঠোর অভিযান পরিচালনা করে। এই নিয়ে কিছু ভুলভ্রান্তি থাকলেও সাঁড়াশি অভিযানে জড়সড় হয়ে পড়েছিল মহাপরাক্রান্ত বড় দুর্নীতিবাজেরা। সারা দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক জাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের জারি করা অধ্যাদেশটি স্বীকৃতি না দিয়ে তা বাতিল করে দেয়। এর পর থেকে মন্থর হয়ে পড়ে, স্থিমিত হয়ে যায় দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এতে অত্যন্ত হতাশ হয়ে পড়েন। ওই সময় কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সরকারের এহেন কর্মকাণ্ডের প্রকাশ্য সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘দুদক এখন দন্তহীন এক ব্যাঘ্র। এর থাবার নখরগুলো ছেঁটে ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে আরও দুর্বল ও ক্ষমতাহীন করার চেষ্টা হচ্ছে।’ টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘দুর্নীতি প্রতিরোধের নামে কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলা হলেও নতুন নতুন আইন পাস করে এর ক্ষমতা আরও খর্ব করা হচ্ছে।’ হালে আইন করা হচ্ছে, সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া দুর্নীতির অভিযোগে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না। এ ছাড়া দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা নিজেদের পদমর্যাদার চেয়ে উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের অভিযোগ অনুসন্ধানের সময় জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন না। নতুন আইনে আরও সংযোজিত থাকছে, মিথ্যা অভিযোগের জন্য অভিযোগকারীকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান। পাশাপাশি কমিশনের যেকোনো কাজের জবাবদিহি থাকছে রাষ্ট্রপতির কাছে।
উল্লেখ্য, নির্বাচিত সরকারের দুই বছরেও দুর্নীতি মোটেই কমেনি। অভিযান জোরদার হওয়ার পরিবর্তে দুর্নীতির তদন্ত কার্যক্রম আশঙ্কাজনকভাবে ঝিমিয়ে পড়েছে। দুর্নীতি-অভিযোগসংক্রান্ত মামলার সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে কমে এসেছে। দুর্নীতির দায়ে দায়ের করা মামলাগুলো সবই রাজনৈতিক মামলা বলে (শুধু সরকারি দলের) খারিজ করা হচ্ছে। মামলাগুলো ন্যায়বিচারের স্বার্থে বিচারালয়ে নিষ্পত্তির প্রয়োজন ছিল। আইনি বিষয়কে আইনি-প্রক্রিয়ায় চলতে দেওয়া উচিত ছিল। বিচার বিভাগকে এভাবে রাজনৈতিকীকরণ, দলীয়করণ নিশ্চয়ই বিচারের নামে প্রহসন। এটা অনৈতিক, এটা অন্যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিকই বলেছিলেন, ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’। পরিতাপের বিষয়, সরকারের প্রাক-নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ ছিল, দেশ থেকে সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতি উচ্ছেদ করা হবে। প্রস্তাবিত আইন তাঁর পরিপন্থী। দুর্নীতি রোধে আমাদের নির্দিষ্ট প্রস্তাব হচ্ছে:
১. দুর্নীতি দমন কমিশনকে সত্যিকারভাবে শক্তিশালী ও কার্যকর হতে হবে। গজদন্তের পরিবর্তে আমরা ব্যাঘ্র দন্ত চাই। চাই ব্যাঘ্রের শক্তিশালী থাবা। দুর্নীতি দমন কমিশনকে আমরা দেখতে চাই স্বয়ংসম্পূর্ণ, সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান হিসেবে। দেখতে চাই, এটি হবে প্রশাসনিকভাবে সুসংগঠিত, পেশাগতভাবে সুদক্ষ, নেতৃত্বের মাপকাঠিতে অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ, সুদৃঢ় এবং সুকঠোর।
২. সব মন্ত্রী, সাংসদ, নির্বাচন প্রাক ও নির্বাচনোত্তর এবং প্রতিবছর তাঁদের স্থাবর ও অস্থাবর সব সম্পদের পূর্ণ বিবরণ দাখিল করবেন এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় উপস্থাপন করবেন। এ বিষয়টি জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক মনিটরিংয়ের আওতায় থাকবে।
৩. প্রশাসনে জড়িত সব সিনিয়র আমলার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের হিসাব দিতে হবে এবং তা প্রতিবছর বাধ্যতামূলকভাবে হালনাগাদ করতে হবে। বিষয়টি জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক মনিটরিংয়ের আওতায় থাকবে।
৪. ব্যাংক ঋণখেলাপি, কর প্রতারকদের শক্ত হাতে আইনের আওতায় আনতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় তাদের নামের তালিকা নিয়মিত পৌনঃপুনিকভাবে প্রকাশ করতে হবে। জনগণের কাছে তাদের নগ্নভাবে উন্মোচিত করতে হবে।
৫. এনজিও ও সুশীল সমাজের সংগঠনগুলোকেও সরকারের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
৬. বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত ও স্বাধীন রাখতে হবে।
৭. তথ্যের অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের কাছে তথ্যপ্রাপ্তি আবশ্যকীয়ভাবে জটিলতামুক্ত, অবাধ ও সহজলভ্য করতে হবে।
৮. সংবিধান বর্ণিত ন্যায়পালের শূন্যপদে একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয়, প্রশ্নাতীতভাবে সৎ, নির্ভীক ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে অতিসত্বর নিয়োগ দিতে হবে।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহবুবুর রহমান (অব.): সাবেক সেনাপ্রধান ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা।
ভাবলে অবাক হই, এই জাতিই অস্ত্র হাতে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিল, রক্ত ঝরিয়েছিল। কঠিন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এক সাগর রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। এত ত্যাগ, এত বিসর্জনের বাংলাদেশ মাত্র ৪০ বছরে এ কী দশা! কী শোনার ছিল, কী শুনছি? কী দেখার ছিল, কী দেখছি? মুক্তিযুদ্ধের মহান গৌরব ধুলায় লুণ্ঠিত।
কিন্তু এ বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তাঁতি সব পেশাজীবী-শ্রমজীবী মানুষ, আপামর জনগণ দুর্নীতির সঙ্গে কতটুকু জড়িত? তারা তো মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে। উদয়াস্ত পরিশ্রম করছে। তাদের প্রশ্ন, হিমালয়প্রমাণ এত বড় দুর্নীতির, কলঙ্কের তারা কেন অংশীদার হবে? তারা কেন সহ্য করবে, এত বড় জাতীয় গ্লানি, এত বড় অপমান। তারা তো দুনম্বরি করে না। তারা অস্ত্র ব্যবসা করে না। নারী ও শিশু রপ্তানি করে না। মানি লন্ডারিং করে না। শেয়ারবাজারে ধস নামিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে না। লাইসেন্স জাল করে না। দেশের সম্পদ পাচার করে না। বহুজাতিক কোম্পানিদের সঙ্গে অসম চুক্তি করে মহামূল্যবান তেল, গ্যাস, কয়লা বিদেশিদের হাতে তুলে দেয় না।
দারিদ্র্যই এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জাতীয় সমস্যা। এটি জাতীয় সংকট, মহামানবিক দুর্যোগ। তাই দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধায় অন্ন জোগাড়, রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থাই জাতির জন্য আজ সবচেয়ে বড় কাজ। বেকার কোটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থান করাই এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও বাংলাদেশের ৫০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। মানুষের মৌলিক পাঁচটি চাহিদার (অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাসস্থান) একটিরও ন্যূনতম সমাধান দিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে, স্বাবলম্বী ও উন্নয়নশীল হতে আমাদের চলার পথে বাধার বিন্ধ্যাচল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুর্নীতি। এটি একটি মারাত্মক ব্যাধি, সমাজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে জাতীয় জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে সংক্রামক রোগের মতো বিস্তারিত। দারিদ্র্য বিমোচন ও জাতীয় উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে সুশাসন। আর সুশাসন তখনই সম্ভব, যখন শাসনযন্ত্রে বিশ্বস্ততা ও সততা সম্বন্ধে জনগণ আস্থাবান হবে, শ্রদ্ধাশীল হবে। গণতন্ত্রের দুই প্রধান নিয়ামক শক্তি স্বচ্ছতা আর জবাবদিহি। দুর্নীতির অবাধ বিস্তার সমাজের স্বচ্ছতা আর জবাবদিহির দৈন্যই নগ্নভাবে প্রকাশ করে। প্রকাশ করে, আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর, আমাদের শাসনযন্ত্রের অসারতা ও দীনতা। ব্যক্তিগত সুবিধা লাভের জন্য সরকারি অবস্থানের অপব্যবহারই দুর্নীতি। দুর্নীতির মধ্যে স্বভাবতই জড়িত শাসনযন্ত্রের উঁচু মহলের নীতিনির্ধারকেরা। জড়িত জ্যেষ্ঠ আমলা, বড় বড় মুনাফাখোর, অসাধু ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি, কর প্রতারক ও ব্যাংক ঋণ খেলাফিরা। সমাজের যে যত বিত্তবান, তার বিত্তের সঙ্গে সঙ্গে তত বেশি অপরাধ জড়িয়ে আছে। ধনাঢ্য ব্যক্তির কাপবোর্ডেই মানুষের কঙ্কাল লুকানো থাকে। দুর্নীতি অন্যায়-অপরাধ-অনৈতিকতারই অপর নাম। মাছের পচন যেমন শুরু হয় মাথা থেকে, দুর্নীতির বাসও তেমনি অতি উঁচু মহলে। পানি যেমন ওপর থেকে নিচে গড়ায়, দুর্নীতিও তেমনি সব সময় অধোগামী।
জাতীয় সংসদ একটি মহান প্রতিষ্ঠান। জাতির সবচেয়ে পবিত্র স্থান, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাদপীঠ। জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, জাতির সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। জাতির কল্যাণে নীতিমালা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করাই জাতীয় সংসদের দায়িত্ব। যাঁরা জনপ্রতিনিধি, তাঁদের স্কন্ধেই এই মহান দায়িত্ব বর্তায়। কিন্তু এই দায়িত্ব পালনে আমরা কতটুকু আন্তরিক প্রয়াস নিয়েছি, সংসদকে কার্যকর করার জন্য কতটুকু একনিষ্ঠ থেকেছি? গণতন্ত্রকে সত্যিকার প্রতিষ্ঠানিক রূপ দিতে, তার শেকড়কে গভীরে প্রোথিত করতে কতটুকু সফল হয়েছি? জাতীয় জীবনে ও প্রশাসনে কতটুকু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পেরেছি? আমরা কখনো আমলাদের দিকে, কখনো বা অসাধু ব্যবসায়ীদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছি। কিন্তু কখনো ভালো করে দেখিনি যে এক অঙ্গুলি দ্বারা অন্যকে যখন নির্দেশ করছি, তখন আমার হাতেরই অপর অঙ্গুলিগুলো আমার নিজের দিকেই নির্দেশ করছে। আমরা সংসদেরা নির্বাচন-পরবর্তীকালে প্রথম যে কাজটি করি তা হলো, এক মিথ্যা স্বাক্ষরিত পত্রে নির্বাচনী ব্যয়ের ঘোষণা দেওয়া। আমাদের যানবাহনের সুবিধার্থে সরকারপ্রদত্ত শুল্কমুক্ত মোটরগাড়ির পারমিট লোভের বশবর্তী হয়ে কিছু টাকার বিনিময়ে সরকারের লক্ষ-কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে হস্তান্তর করি।
ওয়ান-ইলেভেনের পর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নতুন অধ্যাদেশ জারি করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সারা দেশে কঠোর অভিযান পরিচালনা করে। এই নিয়ে কিছু ভুলভ্রান্তি থাকলেও সাঁড়াশি অভিযানে জড়সড় হয়ে পড়েছিল মহাপরাক্রান্ত বড় দুর্নীতিবাজেরা। সারা দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক জাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের জারি করা অধ্যাদেশটি স্বীকৃতি না দিয়ে তা বাতিল করে দেয়। এর পর থেকে মন্থর হয়ে পড়ে, স্থিমিত হয়ে যায় দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এতে অত্যন্ত হতাশ হয়ে পড়েন। ওই সময় কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সরকারের এহেন কর্মকাণ্ডের প্রকাশ্য সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘দুদক এখন দন্তহীন এক ব্যাঘ্র। এর থাবার নখরগুলো ছেঁটে ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে আরও দুর্বল ও ক্ষমতাহীন করার চেষ্টা হচ্ছে।’ টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘দুর্নীতি প্রতিরোধের নামে কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলা হলেও নতুন নতুন আইন পাস করে এর ক্ষমতা আরও খর্ব করা হচ্ছে।’ হালে আইন করা হচ্ছে, সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া দুর্নীতির অভিযোগে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না। এ ছাড়া দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা নিজেদের পদমর্যাদার চেয়ে উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের অভিযোগ অনুসন্ধানের সময় জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন না। নতুন আইনে আরও সংযোজিত থাকছে, মিথ্যা অভিযোগের জন্য অভিযোগকারীকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান। পাশাপাশি কমিশনের যেকোনো কাজের জবাবদিহি থাকছে রাষ্ট্রপতির কাছে।
উল্লেখ্য, নির্বাচিত সরকারের দুই বছরেও দুর্নীতি মোটেই কমেনি। অভিযান জোরদার হওয়ার পরিবর্তে দুর্নীতির তদন্ত কার্যক্রম আশঙ্কাজনকভাবে ঝিমিয়ে পড়েছে। দুর্নীতি-অভিযোগসংক্রান্ত মামলার সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে কমে এসেছে। দুর্নীতির দায়ে দায়ের করা মামলাগুলো সবই রাজনৈতিক মামলা বলে (শুধু সরকারি দলের) খারিজ করা হচ্ছে। মামলাগুলো ন্যায়বিচারের স্বার্থে বিচারালয়ে নিষ্পত্তির প্রয়োজন ছিল। আইনি বিষয়কে আইনি-প্রক্রিয়ায় চলতে দেওয়া উচিত ছিল। বিচার বিভাগকে এভাবে রাজনৈতিকীকরণ, দলীয়করণ নিশ্চয়ই বিচারের নামে প্রহসন। এটা অনৈতিক, এটা অন্যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিকই বলেছিলেন, ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’। পরিতাপের বিষয়, সরকারের প্রাক-নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ ছিল, দেশ থেকে সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতি উচ্ছেদ করা হবে। প্রস্তাবিত আইন তাঁর পরিপন্থী। দুর্নীতি রোধে আমাদের নির্দিষ্ট প্রস্তাব হচ্ছে:
১. দুর্নীতি দমন কমিশনকে সত্যিকারভাবে শক্তিশালী ও কার্যকর হতে হবে। গজদন্তের পরিবর্তে আমরা ব্যাঘ্র দন্ত চাই। চাই ব্যাঘ্রের শক্তিশালী থাবা। দুর্নীতি দমন কমিশনকে আমরা দেখতে চাই স্বয়ংসম্পূর্ণ, সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান হিসেবে। দেখতে চাই, এটি হবে প্রশাসনিকভাবে সুসংগঠিত, পেশাগতভাবে সুদক্ষ, নেতৃত্বের মাপকাঠিতে অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ, সুদৃঢ় এবং সুকঠোর।
২. সব মন্ত্রী, সাংসদ, নির্বাচন প্রাক ও নির্বাচনোত্তর এবং প্রতিবছর তাঁদের স্থাবর ও অস্থাবর সব সম্পদের পূর্ণ বিবরণ দাখিল করবেন এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় উপস্থাপন করবেন। এ বিষয়টি জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক মনিটরিংয়ের আওতায় থাকবে।
৩. প্রশাসনে জড়িত সব সিনিয়র আমলার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের হিসাব দিতে হবে এবং তা প্রতিবছর বাধ্যতামূলকভাবে হালনাগাদ করতে হবে। বিষয়টি জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক মনিটরিংয়ের আওতায় থাকবে।
৪. ব্যাংক ঋণখেলাপি, কর প্রতারকদের শক্ত হাতে আইনের আওতায় আনতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় তাদের নামের তালিকা নিয়মিত পৌনঃপুনিকভাবে প্রকাশ করতে হবে। জনগণের কাছে তাদের নগ্নভাবে উন্মোচিত করতে হবে।
৫. এনজিও ও সুশীল সমাজের সংগঠনগুলোকেও সরকারের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
৬. বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত ও স্বাধীন রাখতে হবে।
৭. তথ্যের অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের কাছে তথ্যপ্রাপ্তি আবশ্যকীয়ভাবে জটিলতামুক্ত, অবাধ ও সহজলভ্য করতে হবে।
৮. সংবিধান বর্ণিত ন্যায়পালের শূন্যপদে একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয়, প্রশ্নাতীতভাবে সৎ, নির্ভীক ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে অতিসত্বর নিয়োগ দিতে হবে।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহবুবুর রহমান (অব.): সাবেক সেনাপ্রধান ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা।
No comments