গন্তব্য ঢাকা-‘মন পইড়া থাহে মাঠে আর নদীতে’ by শর্মিলা সিনড্রেলা

আজ প্রায় ২২ বছর হতে চলল ঢাকায় এসেছেন তিনি। পড়াশোনা বাদ দিয়ে যখন সংসারের দিকে মন দিতে ইচ্ছে করল, তখন ছেলেটির বয়স কেবল ১৩ কি ১৪। মাথায় এত সব চিন্তা ছিল না। ধীরে ধীরে সময়ের বাস্তবতা বদলে দিয়েছে সবকিছু। এখন তো সময়গুলো হয়ে পড়েছে একঘেয়ে। পছন্দ না হলেও দিনের পর দিন একই কাজ করে চলা।


আর পরিবার-পরিজন ছেড়ে দূর পরবাসে থাকা। সময়ের বিবর্তনে ছেলেটি এখন লোকটি। যাঁকে নিয়ে কথা, তাঁর নাম আবদুল জলিল। রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা বাংলামোটরকে নিজের কর্মস্থল হিসেবে বেছে নিয়েছেন তিনি। বাংলামোটর থেকে মগবাজারের দিকে যেতেই ওভারব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে শীতের মিষ্টি রোদে বা গ্রীষ্মের দাবদাহে, এমনকি বর্ষার বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচিয়ে সপ্তাহের সাতটি দিনই তিনি বিক্রি করে চলেন ফল।
জিরোন্ডা গ্রামটির প্রতি তাঁর ভালোবাসা অবিচল। আবদুল জলিলের সবচেয়ে বেশি পছন্দ গ্রামের পশ্চিম দিকটি। মনে হলেই কোনো এক সকাল অথবা বিকেলে নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন তিনি। তারপর উন্মত্ত পদ্মা পেরিয়ে দৃষ্টিনন্দন খেতের দিকে চলা। জলিল বলেন, ‘ফল ফসলের মাঠ দ্যাখতে আমার খুব ভালো লাগে। তাই মনে হলেই যাইতাম।’ হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার এই গ্রামটির স্মৃতিময় দিনগুলো যেন কিছুতেই ভুলতে পারেন না আবদুল জলিল।
‘থাহি ঢাকায়, কিন্তু মন তো পইড়া থাহে সেই মাঠে আর নদীতে। একবার হয়েছে কি, নৌকা আর বন্ধুবান্ধব গুলারে লইয়া বের হইছি নদীত ঘুরতে। হঠাৎ শুরু হয়েছে ঝড়বৃষ্টি। কী করি, অনেক কষ্টে শেষে বাড়ি ফিরছি। আমার বন্ধু মাসুদ, বাচ্চু আর জহির ছিল আমার সাথে। সবাই অনেক কষ্ট করছে। মা-বাবা তো চিন্তায় শেষ।’ বলতেই থাকেন আবদুল জলিল। একের পর এক গল্প, ভালোলাগার অনুভূতি অথবা স্ত্রী-সন্তান, মাকে ভালোবাসার স্মৃতি। ‘বাড়িত গেলে বাচ্চারা এত খুশি হয়! তিন ছেলে ও এক মেয়ে আমার। যাবার সময় প্রতিবারই ওদের লাইগ্যা কিছু লইয়া যাই। ওরা ছোট মানুষ তো, খুব খুশি হয়। এক মাস বা ২০ দিন পরপর বাড়িত যাই।’
আবদুল জলিলের বড় ছেলে ১২ বছরের মোরশেদ ঢাকায়ই থাকে বাবার সঙ্গে। কেন যেন পড়াশোনা ছেড়ে হঠাৎ দুষ্টুমি করা শুরু করেছিল, তাই তাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছেন আবদুল জলিল। বাংলামোটরেরই যেদিকে তিনি দাঁড়ান তার উল্টো দিকে একই কাজ করে মোরশেদ। ‘মোরশেদ পড়াশোনা করতে পারল না। অরে পড়ানোর ইচ্ছা ছিল। তয় আর দুই ছেলে করিম আর মুজিবুর পড়ছে। অগোরে অনেক পড়াইতে চাই। ছোট মেয়ে স্মৃতিকেও পড়াইতে চাই।’
ছেলেকে নিয়েই মগবাজারের এক মেসে থাকেন আবদুল জলিল। ভাড়া দেন মাসে এক হাজার টাকা। আর খাবার? সেটাতেই কষ্ট হয় বেশি। রোজই খেতে হয় হোটেলে। বেলা তিনটা বা সাড়ে তিনটার দিকে ছেলে তার দোকান কাউকে দেখতে বলে খেতে যায়। খাওয়া শেষে বাবার দোকানে দাঁড়িয়ে বাবাকে খেতে পাঠায়। আর খাওয়া-দাওয়া শেষে আবার কাজে নেমে পড়ে দুজনে। রোজই হয়তো মাছ বা মাংস দিয়ে ভোজনটা সারা হয়। কিন্তু কিছু যেন কম থেকে যায়। তাই তো খেতে বসলেই মনে হয় বাড়ির কথা। স্ত্রী নূরজাহানের হাতের রান্নাটার কথা মনে হতেই জিবে জল আসে। কিন্তু জীবনের তাগিদে আবার সেই হোটেলের খাবারই গলাধঃকরণ করতে হয়।
এই দোকানটি নিয়ে রোজই সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকেন আবদুল জলিল। প্রত্যেকেরই কিছু স্বপ্ন থাকে, তাঁরও স্বপ্ন আছে। তিনি চান ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে বড় হোক। আর অনেক তো ঢাকায় থাকা হলো, আর নয়। এবার যদি একটু জমি-জায়গা করতে পারেন তবে চলে যেতে চান গ্রামে আর তারপর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার। আর এ জন্যই তো দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি দিনভর। বসার ব্যবস্থা করতে গেলে যদি এখান থেকে উঠিয়ে দেয়। তাই টুল নেন না। আবার ছাতা নিলে যদি পথচারীদের চলার অসুবিধা হয়, তাই ছাতা নেন না গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহেও। অবিরত ফল কাটতে কাটতে এবং পানি নাড়তে নাড়তে হাত হয়ে উঠেছে সাদা। তবু নেই কোনো ব্যবস্থা। তিনি বলেন, ‘হাতে কিছু পরলে কাজ করবার অসুবিধা হবে, তাই লই না। আবার রোজই নষ্ট হইব। অনেক খরচ হইয়া যাইব।’
গরম পড়তে শুরু করেছে। সূর্যটাও বেশ তেজি হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। একের পর এক পথচারী আসছে আর নিয়ে যাচ্ছে গাজর বা শসা। হয়তো এটা খেয়ে তাদের প্রাণও জুড়াচ্ছে। কিন্তু কেউই হয়তো খেয়াল করছে না যে লোকটি দাঁড়িয়ে আছে, মাথায় নেই কোনো ছায়া আর হাত দুটো অবিরত হয়ে উঠছে আরও ভারাক্রান্ত। মনে পড়ে আবদুল জলিলের একটি কথা, ‘যাবার ইচ্ছে থাকলেই তো পারি না। আমার টাকা দিয়েই সংসার চলে, তাই কাজ করতে ঢাকায়ই থাকা।’

No comments

Powered by Blogger.