চারদিক-ভুল করা যাবে না বাংলা বানান by ইয়াসমীন রীমা

দিনটি ছিল রোববার। ১৩ মার্চ। বসন্তের সকাল। কোকিল না ডাকলেও মৃদুমন্দ হিমেল হাওয়া প্রকৃতিতে দিচ্ছিল দোলা। সূর্য আলো বিকরণে ছিল অকৃপণ। রোদের রুপালি গুঁড়ো ভাসিয়ে দিচ্ছিল রাস্তা-ঘাট-আঙিনা-জনপদ। ঘড়ির কাঁটায় নির্ধারিত সময়ে কুমিল্লা নগর মিলনায়তনের সম্মেলনকক্ষে ভিড়তে শুরু করল প্রতিযোগীরা, স্কুল-কলেজের


ছাত্রছাত্রীরা। কুমিল্লা শহরের স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা ছাড়াও এসেছে উপজেলাগুলোর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। শুদ্ধ বাংলা বানান প্রতিযোগিতা। এমন একটি ব্যতিক্রমধর্মী স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে তাদের যেমন উৎসাহ জেগেছে, তেমনই লেগেছে কৌতূহলোদ্দীপ্ত খেয়াল।
পৃথিবীতে অসংখ্য ভাষা রয়েছে। এর মধ্যে কিছুটা অদ্ভুত ভাষা (উপভাষা) রয়েছে ছয় হাজারের মতো। এর মধ্যে প্রতি ১৫ দিনে একটি ভাষা হারিয়ে যায়। এ সংকট বা সমস্যা প্রতিটি দেশে বাস্তবতার নিরিখে নানাভাবে পুনরাবৃত্তি ঘটে চলছে। প্রধান ভাষা যেমন ইংরেজির ওজন বা চাপের কাছে উপভাষাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। সারা বিশ্বে তরুণ প্রজন্ম একুশ শতকের সংস্কৃতির প্রতি বেশি আকৃষ্ট। এর মাধ্যমে নিজেদের বিকশিত করে তোলার প্রয়াসী তারা। উপভাষা হারিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটা অন্যতম প্রধান কারণ। কোনো ভাষা হারিয়ে যাওয়া নতুন কিছু নয়। এই উপমহাদেশেই একসময়ের শক্তিশালী কোনো কোনো ভাষার অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। যে ভাষার ভেতর বৈচিত্র্য ও প্রাণশক্তি যত বেশি, সে ভাষার স্থায়িত্ব অনেক বেশি। ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন এবং পড়াশোনা করেন তাঁদের কাছে বিষয়টি হয়তো নতুন কিছু নয়। তবে সাধারণভাবে তা যেমন কৌতূহলোদ্দীপক তেমন ভাবনারও। দেশে প্রথমবারের মতো শুদ্ধ বাংলা বানান প্রতিযোগিতা কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত হলো। বানান নিয়ে যে প্রতিযোগিতা, তার ফলাফল হলো বহুমাত্রিক। বুড়িচং এরশাদ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ও দৈনিক আমাদের কুমিল্লা পত্রিকার সম্পাদক ড. আলী হোসেন চৌধুরী ব্যতিক্রমধর্মী এ প্রয়াসটি দীর্ঘদিন নিজের মধ্যে লালন করে রেখেছিলেন। শুধু সময়-সুযোগের অপ্রতুলতায় প্রতিযোগিতাটি ঘটতে পারেনি তখন। তিনি বলেন, ‘রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মাতৃভাষা এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এ মাতৃভাষার আন্দোলন থেকে একটি দেশের জন্ম। সেই বাংলাদেশ শেখাল বিশ্বকে মাতৃভাষাকে ভালোবাসতে। সেই দেশে বানান নিয়ে এত দুর্বলতা কেন থাকবে? পৃথিবীতে অনেক ভাষাভাষীর দেশ আছে। তবে শ্রুতিমধুরতার দিক থেকে বাংলা ভাষার মতো আর ভাষা কই? কিন্তু এই ভাষা প্রয়োগে বানান ভুল করাটা যেমন দৃষ্টিকটু, তেমনই গ্লানিকর ও লজ্জার। আমার দীর্ঘদিনের অধ্যাপনার জীবনে দেখেছি, অনেক ছাত্রছাত্রী তাদের পরীক্ষার খাতায় অসংখ্য শব্দ ভুল বানানে লেখে। অতি সাধারণ শব্দ দিব্যি ভুল বানানে লিখে চলছে। যেমন, “ভুল” বানানটি অনেকেই লেখে “ভূল”। “সহযোগিতা”কে লেখে “সহযোগীতা”। “দুর্ঘটনা”কে “দূর্ঘটনা”। কুমিল্লা থেকে আমার এই প্রয়াসটি স্বল্প পরিসরে চালু করে দিলাম। বিস্তারিতভাবে ছড়িয়ে পড়ুক দেশজুড়ে। বাংলা বানানের প্রতি শিক্ষার্থীরা সতর্ক ও সচেতন হয়ে উঠুক এই আমার প্রত্যাশা।’
অনুষ্ঠানটি ছিল দুটি পর্বে। সকালে ছিল প্রতিযোগীদের বানান লেখার পরীক্ষা। এতে কুমিল্লা শহর ও উপজেলা থেকে আসা দুই শতাধিক স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী উপস্থিত হয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন দৈনিক আমাদের কুমিল্লা পত্রিকার সম্পাদক ও অধ্যক্ষ ড. আলী হোসেন চৌধুরী। এ ধরনের উল্লেখযোগ্য প্রয়াসকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য দেন সোনার বাংলা কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজা সৌরভ, বুড়িচং কালিকাপুর অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু কলেজের বাংলার প্রভাষক সুরেখা বেগম ও কুমিল্লা হাইস্কুলের শিক্ষক উত্তম নাথ।
বিকেলে ছিল পুরস্কার বিতরণী পর্ব। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আদর্শ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো. আবদুর রউফ। রোটারি ক্লাবের সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত পুরস্কার বিতরণীতে বিশেষ অতিথি ছিলেন অধ্যক্ষ আমীর আলী চৌধুরী, শান্তিরঞ্জন ভৌমিক। বক্তব্য দেন উপাধ্যক্ষ এহতেশাম হায়দার চৌধুরী ও রোটারি ক্লাবের পক্ষ থেকে সাবেক সভাপতি দিলনাশি মোহসেন। উপস্থাপনা করেন সাংবাদিক সৈয়দ নুরুর রহমান। প্রতিযোগিতায় ‘ক’ গ্রুপে প্রথম হয় ফয়জুননেসা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী আদিবা তাহসিন, দ্বিতীয় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী আমেনা আক্তার সেতু ও রোজ গার্ডেন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র মুহাম্মদ ইসমাইল হাসান। ‘খ’ গ্রুপে প্রথম হয় কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্র আসমা মালিহা, দ্বিতীয় শৈলরানী দেবী বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী সম্পা রানী রায় ও আওয়ার লেডি অব ফাতিমা গার্লস হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী তাহসীন নুজুস।
‘গ’ গ্রুপে প্রথম হয় বুড়িচং কালিকাপুর অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী নাজনীন আক্তার সুমা, দ্বিতীয় সোনার বাংলা কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র তারিকুর রহমান ও তৃতীয় সোনার বাংলা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র মো. নাহিদ হাসান। ব্যতিক্রমধর্মী এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া বুড়িচং কালিকাপুর আবদুল মতিন খসরু কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী দীপা এ প্রসঙ্গে বলে, ‘চারিদিকে প্রযুক্তির এত এত উপকরণ হাতের নাগালে থাকতেও এমন একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পেরে, সত্যি আমি আনন্দিত।’
‘দেশ-মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার অবাধ টান। তাই এখন থেকে একে অপরকে দিতে হবে জানান, ভুল করা যাবে না আর বাংলা বানান’—এই স্লোগান ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।

No comments

Powered by Blogger.