মায়াবাদে বিশ্বাস ও কুসংস্কার by ডা. ওয়াহিদ নবী

৭ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গায় ঘটা মর্মান্তিক ঘটনাটি পড়ে মর্মাহত হলাম। বেশি দুঃখ পেলাম এ জন্য যে মাত্র কয়েক দিন আগে কয়েকজন আত্মীয়সহ বালিয়াডাঙ্গা গিয়েছিলাম সেখানকার বিখ্যাত আমগাছটি দেখতে। ইটের রং ভালো করার জন্য নরবলি! এই একবিংশ শতাব্দীতে! অবিশ্বাস্য।


কিন্তু ঘটেছে বলেই তো 'কালের কণ্ঠ' গুরুত্বসহ ঘটনাটি প্রকাশ করেছে। খবরটি পড়ে মনে হলো, অনেকেই মনে করেছেন আসলে এটি নরবলি নয়; এর উদ্দেশ্য অন্য কিছু ছিল। মায়াবাদে বিশ্বাসের প্রভাব আমাদের জীবনে ব্যাপক হারে পরিলক্ষিত। আমাদের বিশ্বাসে ও কর্মে মায়াবাদের ভিত্তি এতই সুদৃঢ় যে মায়াবাদকে আমাদের জীবনের অঙ্গ হিসেবে মনে করলেও অতিশয়োক্তি করা হবে না। প্রথমেই উল্লেখ করা যাক মায়াবাদ বলতে আমরা কী বুঝি। ইংরেজিতে মায়াবাদকে 'ম্যাজিক্যাল একটিভিটিজ' বলে বর্ণনা করা হয়। সহজ বাংলায় আমরা এ ধরনের কাজকে 'জাদুবিদ্যা' বলি। এ ধরনের কাজের সঙ্গে এর ফলাফলের কোনো বাস্তবসম্মত সম্পর্ক নেই। আসলে এগুলো বুজরুকি ছাড়া আর কিছুই নয়। একজন জাদুকর বুজরুকির মাধ্যমে সরল মানুষদের বোকা বানিয়ে দুই পয়সা উপার্জন করে। এসব জাদুকরের চেয়েও যারা বুদ্ধিমান তারা বাবা, ভগবান, সাধু পীর ইত্যাদি সেজে বুজরুকির মাধ্যমে পয়সা উপার্জন তো করেই, সামাজিক নেতৃত্বও অর্জন করে। কিন্তু এই মায়াবাদ যখন একটা জাতিকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে ফেলে, তখন তা সত্যিই হয়ে ওঠে দুঃখজনক।
কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। আমার এক আত্মীয়ের ছেলে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। বাবা পেশায় আইনজীবী। মা একটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। পরীক্ষার বেশ কয়েক দিন আগে থেকে ছেলের মা বেশি বেশি নামাজ পড়তে শুরু করলেন। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে শুরু করলেন যাতে ছেলের পরীক্ষার ফল ভালো হয়। ফকির খাওয়ানোও শুরু হলো। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই যে ছেলের মেধা ও পরিশ্রমের ওপর তার পরীক্ষার ফলাফল নির্ভর করবে। মা-বাবার ফকির খাওয়ানোর ওপর পরীক্ষার ফলাফল নির্ভর করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা পরিষ্কার, যেসব কাজ করে ছেলের ফলাফল ভালো করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তার সঙ্গে ফলাফলের কোনো সম্পর্কই নেই। মা-বাবার এসব কাজ বরং ছেলের লেখাপড়ার ক্ষতি করতে পারে। ছেলে মনে করতে পারে যে মা-বাবার প্রার্থনায়ই তো আমার পরীক্ষার ফল ভালো হবে। তাই খেটেখুটে এত পড়াশোনা করার কী দরকার?
বিদ্যুৎ এখন আমাদের জীবনে বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। যেখানেই গিয়েছি, যার সঙ্গেই কথা বলেছি_বিদ্যুৎ নিয়ে অনুযোগের কথা এসে যায়। আমার এক আত্মীয় এমনই অনুযোগ করছিলেন। তিনি বললেন, অন্যান্য অসুবিধা না হয় সহ্য করা যায়; কিন্তু ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার যে ক্ষতি হচ্ছে তা অপূরণীয়। সবাই তাঁর কথার সঙ্গে একমত প্রকাশ করলেন (আমি একটা জেলা শহরে লণ্ঠনের আলোয় লেখাপড়া করেছি)_যেমন হয়, এরপর অনেক বিষয়ে আলোচনা হলো। একপর্যায়ে কোরবানির কথা উঠল। আমার আত্মীয় বললেন, তিনি গরু কোরবানি দিয়েছেন। গরুর দাম ছিল ১৭ হাজার টাকা। আমি হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসলাম, 'আইপিএসের দাম কত?' একজন বললেন, ১৫ হাজার টাকার মতো। আমি অবুঝের মতো বলে বসলাম, 'আইপিএস কিনলেই তো ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্ষতি হতো না।' আমার আত্মীয় বললেন, '১৫ হাজার টাকা তো অনেক টাকা।' আমার সাহস হলো না তাঁকে এ প্রসঙ্গে অন্য একটা বিষয় মনে করিয়ে দিতে। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ভালো ব্যবস্থা করলে ওই ছেলেমেয়ে মানুষের জন্য ভবিষ্যতে ভালো কাজ করবে এবং আল্লাহ এতে বেশি খুশি হবেন। সুচিন্তিত একটি কাজ করলে যে সেটা অনেকের জন্য বেশি মঙ্গলজনক হবে_এটা আমরা ভাবতে পারি না আমাদের চিন্তাধারার ওপর মায়াবাদের অশুভ প্রভাবের জন্য।
বাংলাদেশে মনোরোগ বিভাগে কাজ করার সময় লক্ষ করেছিলাম, মানসিক রোগীদের জিনে ধরেছে বলে মনে করা হয়। আমার ছাত্রছাত্রীদের সাহায্যে একটি গবেষণা করি। আমরা দেখি যে ৮০ শতাংশ রোগীকে আগে পীর-ফকিরের কাছে নিয়ে যায় তাদের অভিভাবকরা। সেখানে ভালো না হওয়ায় তাদের মনোরোগ বিভাগের বহির্বিভাগে নিয়ে আসা হয়েছিল। জিনের আছর-জাতীয় মায়াবাদে বিশ্বাসের জন্য মানসিক রোগীদের আধুনিক চিকিৎসা পেতে শুধু দেরি হয় তা-ই নয়, তাদের ওপর অমানুষিক অত্যাচারও চালানো হয়। কাঁটাসহ লাঠি দিয়ে তাদের পেটানো হয়। পানির ভেতর মাথা ডুবিয়ে রাখা হয়। জোর করে মাটিতে চেপে ধরে রেখে পড়া শুকনো মরিচের গুঁড়ো নাকে দেওয়া হয়। এমন অনেক অত্যাচার রোগীর মা-বাবা খুশি মনে দেখেন। কারণ তাঁরা মনে করেন যে অত্যাচারটা জিনের ওপর করা হচ্ছে। এ জাতীয় বিশ্বাস শিক্ষিত-অশিক্ষিত, শহর ও গ্রামবাসীদের মধ্যে একই সংখ্যায় বিরাজমান। রোগীর অভিভাবকদের মধ্যে প্রায় সবাই বলেন যে জিনে বিশ্বাসের উৎস হচ্ছে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। কিন্তু এক হাজার অভিভাবকের সঙ্গে আমরা কথা বলেছিলাম, যাঁদের মধ্যে নিজে ধর্মগ্রন্থ পড়েছেন মাত্র ৩৭ জন। রোগীর আত্মীয়রা বলেন যে তাঁরা জিনের আছর ও মানসিক রোগের উপসর্গের মধ্যে কী পার্থক্য তা বলতে পারেন না।
জাতি হিসেবে আমাদের অনেক চিন্তাধারা এখনো একবিংশ শতাব্দীতে পেঁৗছায়নি। নিজ স্বার্থের কারণে অনেকে এ জাতীয় পশ্চাৎমুখী চিন্তাধারা জিইয়ে রাখতে বিশেষভাবে সক্রিয়। মায়াবাদে বিশ্বাস অনেক কুসংস্কারের জন্ম দেয়। ঠাকুরগাঁওয়ের ইটখোলায় যে অমানুষিক ঘটনা ঘটেছে, তা অবিশ্বাস্য মনে হলেও অসম্ভব নয়। আধুনিক শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। কুসংস্কারের শিকড় অনেক গভীরে গ্রথিত। কাজেই সজাগ মানুষদের প্রয়োজন কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে সমাজ থেকে এসব কুসংস্কার দূর করা।

লেখক : লন্ডন প্রবাসী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.