চারদিক-কী আনন্দ! সাধুর সাধবাজারে by আজাদুর রহমান
খোলা পূর্ণিমায় শিষ্যদের নিয়ে মচ্ছব করতেন লালন। ধারা মেনেই বছরে একবার মরা কালিগাঙের পাড়ে সাধুদের বাজার বসে। দুই দিনের আয়োজন তিন থেকে এবার পাঁচ দিনে ঠেকেছে। ‘সে আর আমি একখানে রই, তবুও লক্ষ যোজন ফাঁক রে, আমি এক দিনও না দেখিলাম তারে।’
স্বভাবে ভাব হলে উপায় কী! ১৮ মার্চ শুরু হচ্ছে লালন মেলা। আগেই চলে গেলাম ছেঁউড়িয়া। আখড়াবাড়ির আঙিনা, বারান্দা গলি—সবখানে খণ্ড খণ্ড মজমা চলছে। ভক্ত-অনুরাগী, আউল-বাউল সাধু-বৈষ্ণব আর ফকির-দেওয়ানাদের পদভারে ভারী হয়ে আছে তল্লাট। পাগলের মেলা যেন বসেছে সাবেক নদীয়ায়। আর আমার ভাবজগতে বেজে চলেছে—‘তিন পাগলে হলো মেলা নদে (নদীয়া) এসে।’ দেশময় ছড়িয়ে থাকলেও মন পড়ে থাকে লালনের বারামখানায়। বছরের দুটো আয়োজন ছাড়াও সুযোগ পেলেই নানা ছুতোয় বাউলেরা চলে আসেন মনতীর্থে। কত কিসিমের সাধু-বাউল যে আছেন, না দেখলে বোঝার উপায় নেই। দেখে দেখে বিকেল গড়িয়ে গেলে লালনসমাধির পাশে এসে দাঁড়াই। দূরাগত ভক্তরা আস্তানা পেতেছেন এখানে। পাতানো পাটিতে বসতে চাইলে বৃদ্ধ বাউল হেসে বলেন, ‘বসেন না ক্যান, বসেন।’ জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে আসেন কেন? খাপ খোলা প্রশ্নে তিনি তাচ্ছিল্য বোধ করে বলেন, ‘এইবার শোনেন, যেখানে বসে আছেন, ইনির নাম হলেন বিশ্ব বাউলসম্রাট। সম্রাট বোজেন, সম্রাট একটা কত বড় র্যাঙ্ক! বোজেন? বিশ্ব বাউল মানে বাতাসের সন্ধানকারী। আপনারা বহু জ্ঞানীগুণী এখানে আছেন। সাঁইজি কিন্তু নিরক্ষর ছিলেন, তাই বলে মুরুক্ষু নন। এ জন্যি এই লক্ক লক্ক মানুষ সমবেত হয়।’
প্রসঙ্গ পাল্টে বাউলদের বর্তমান হালচাল নিয়ে কথা তুললাম। ফের বলতে শুরু করলেন, ‘এখনকার বাউলেরা তো গানের বাউল, সাধনার কিচ্চু জানে না। এরা দেকবেন মোবাইলে কতা কয়। ব্যাকগুলান তো আর বাউল না! বাউলের সাঁজ নিয়ে ঘুরতিয়াছে। যাঁরা পুরোনো বাউল, তাঁরা তো তফাতে থাকেন। শতকরা অ্যাডা-দুডার বেশি পাইবেন না।’
আমি কৌতূহলী হয়ে উঠলাম—কোনো ঠিকানা কি জানা আছে আপনার?
তিনি পদ বলতে লাগলেন, ‘হাতের কাছে হয় না খবর, কি দেখতে যাও দিল্লি লাহোর। কারিকর পাড়াতে যান, সেইখানে দুর্লভ শাহকে পাইবেন। বাঁইচে আছে কি না আল্লাহ মালিকই জানেন।’
১১১ বছর বয়সী ফকির দুর্লভ নির্জনে বাস করেন। পিচের রাস্তা অত দূর যায়নি। হেয়ারিং ছেড়ে আড়া-জঙ্গল পেরিয়ে তবে পিড়ালিগাঁথা মাটির ঘর। প্রতিবেশীদের বাড়িতে আলো জ্বলছে। দুর্লভ বিদ্যুৎ কিনতে পারেননি, তাই প্রয়োজন ছাড়া কুপি জ্বলে না তাঁর ঘরে। তলতা বাঁশে বোনা হাওয়ার বেড়া। লাগোয়া চৌকিতে গুটি হয়ে বসে আছেন তিনি। তেলচিটে বালিশ সরিয়ে বসতেই সহজ আলাপন—‘স্ত্রীর জ্ঞানেই তো আমি জ্ঞানী। আদিমূলের বিষয়ে সেই বেশি বলে দিত। ভোলাইশাহ ও প্যারীনেছা তখনো বেঁচে ছিলেন। আমরা তাঁদের দুজনকে খুব সেবা কত্তাম। হুঁকো সাজিয়ে দিতাম। আখড়াবাড়িতে তখন পানের বরজ ছ্যালো।’
কাছে রাখবেন বলে স্ত্রীকে ঘরের পাশেই কবর দিয়েছেন দুর্লভ। শুরুতে তিনি ইসলামপুরের পীর খোদা মওলানা সাহেবের মুরিদ ছিলেন। ১০ জন মুরিদের মতো ভালোই চলছিল সবকিছু। মওলানা সাহেব মারা গেলে কোকিলশাহের সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁর কাছেই দীক্ষা নেন তিনি। গুরুকে আলাদা বস্তু মনে করেন তিনি। ‘আমার নালিশটা তো আমি উকিলের মাধ্যমেই দিই। গুরুই তো উকিল হয়া আমার নালিশ জানাবেন। গুরুচরণ পেলেই রাসুলের চরণ পাওয়া যাবে।’ বলেন দুর্লভ শাহ। কথা শেষ করেন না। দম নিয়ে আবার অগোছালোভাবে বলতে থাকেন, ‘নিঃশ্বাস ধরে রাখতে হবে। মনের সঙ্গে লড়াই করতে হবে। সামান্য একটা চাতক পাখি এত দাবি করতাছে, দিদার করছে; ম্যাঘের জল ছাড়া কিচ্চু খায় না, আর আমি কী মানুষ হলাম বাপ, দিদার করতে পারলাম না। শরীরের ভেতরে শক্তি ধরে রাখতে হবে। এটাই সাধনা। শক্তি বাড়াইয়া গ্যালে তো জ্ঞান বাড়াইয়া যায়। জ্ঞান বাড়লে কামের ঘরে অটোমেটিক তালা পড়ে যাবে। সবই জ্ঞানী কথা লালন দিয়ে গেছেন।’ বলতে বলতে তালি বাজিয়ে গান ধরলেন তিনি—
‘বাকির কথা গেলো কাগজে
কোন দিন যেন আসবে সমন।’
তিনি থামলেন না, ‘আমার ভিতরের খোদাকে দিয়ে গুরুর খোদাকে ধরতে হবে; তবেই তো পাওয়া যাবে অপার খোদাকে। সবার কী হবে তাতে আমার কী? আপনঘরের খুঁটি ঠিক রাখতে হবে। ভার নিয়া তুমি কী করছ—তাই আল্লায় দ্যাখবে।’
দুর্লভ থামেন না। ওদিকে সন্ধ্যা গভীর হয়ে আসে। যাওয়া দরকার। দুর্লভের হাতে জ্বলে থাকা কুপি থেকে ছড়ানো আলো খুব বেশি দূর গেল না। তাতে কী, চাঁদের ফালা বলে দিচ্ছে পূর্ণিমার দেরি নেই। কদিন আর! জ্যোৎস্নায় ভেসে যাবে লালনবাড়ি।
প্রসঙ্গ পাল্টে বাউলদের বর্তমান হালচাল নিয়ে কথা তুললাম। ফের বলতে শুরু করলেন, ‘এখনকার বাউলেরা তো গানের বাউল, সাধনার কিচ্চু জানে না। এরা দেকবেন মোবাইলে কতা কয়। ব্যাকগুলান তো আর বাউল না! বাউলের সাঁজ নিয়ে ঘুরতিয়াছে। যাঁরা পুরোনো বাউল, তাঁরা তো তফাতে থাকেন। শতকরা অ্যাডা-দুডার বেশি পাইবেন না।’
আমি কৌতূহলী হয়ে উঠলাম—কোনো ঠিকানা কি জানা আছে আপনার?
তিনি পদ বলতে লাগলেন, ‘হাতের কাছে হয় না খবর, কি দেখতে যাও দিল্লি লাহোর। কারিকর পাড়াতে যান, সেইখানে দুর্লভ শাহকে পাইবেন। বাঁইচে আছে কি না আল্লাহ মালিকই জানেন।’
১১১ বছর বয়সী ফকির দুর্লভ নির্জনে বাস করেন। পিচের রাস্তা অত দূর যায়নি। হেয়ারিং ছেড়ে আড়া-জঙ্গল পেরিয়ে তবে পিড়ালিগাঁথা মাটির ঘর। প্রতিবেশীদের বাড়িতে আলো জ্বলছে। দুর্লভ বিদ্যুৎ কিনতে পারেননি, তাই প্রয়োজন ছাড়া কুপি জ্বলে না তাঁর ঘরে। তলতা বাঁশে বোনা হাওয়ার বেড়া। লাগোয়া চৌকিতে গুটি হয়ে বসে আছেন তিনি। তেলচিটে বালিশ সরিয়ে বসতেই সহজ আলাপন—‘স্ত্রীর জ্ঞানেই তো আমি জ্ঞানী। আদিমূলের বিষয়ে সেই বেশি বলে দিত। ভোলাইশাহ ও প্যারীনেছা তখনো বেঁচে ছিলেন। আমরা তাঁদের দুজনকে খুব সেবা কত্তাম। হুঁকো সাজিয়ে দিতাম। আখড়াবাড়িতে তখন পানের বরজ ছ্যালো।’
কাছে রাখবেন বলে স্ত্রীকে ঘরের পাশেই কবর দিয়েছেন দুর্লভ। শুরুতে তিনি ইসলামপুরের পীর খোদা মওলানা সাহেবের মুরিদ ছিলেন। ১০ জন মুরিদের মতো ভালোই চলছিল সবকিছু। মওলানা সাহেব মারা গেলে কোকিলশাহের সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁর কাছেই দীক্ষা নেন তিনি। গুরুকে আলাদা বস্তু মনে করেন তিনি। ‘আমার নালিশটা তো আমি উকিলের মাধ্যমেই দিই। গুরুই তো উকিল হয়া আমার নালিশ জানাবেন। গুরুচরণ পেলেই রাসুলের চরণ পাওয়া যাবে।’ বলেন দুর্লভ শাহ। কথা শেষ করেন না। দম নিয়ে আবার অগোছালোভাবে বলতে থাকেন, ‘নিঃশ্বাস ধরে রাখতে হবে। মনের সঙ্গে লড়াই করতে হবে। সামান্য একটা চাতক পাখি এত দাবি করতাছে, দিদার করছে; ম্যাঘের জল ছাড়া কিচ্চু খায় না, আর আমি কী মানুষ হলাম বাপ, দিদার করতে পারলাম না। শরীরের ভেতরে শক্তি ধরে রাখতে হবে। এটাই সাধনা। শক্তি বাড়াইয়া গ্যালে তো জ্ঞান বাড়াইয়া যায়। জ্ঞান বাড়লে কামের ঘরে অটোমেটিক তালা পড়ে যাবে। সবই জ্ঞানী কথা লালন দিয়ে গেছেন।’ বলতে বলতে তালি বাজিয়ে গান ধরলেন তিনি—
‘বাকির কথা গেলো কাগজে
কোন দিন যেন আসবে সমন।’
তিনি থামলেন না, ‘আমার ভিতরের খোদাকে দিয়ে গুরুর খোদাকে ধরতে হবে; তবেই তো পাওয়া যাবে অপার খোদাকে। সবার কী হবে তাতে আমার কী? আপনঘরের খুঁটি ঠিক রাখতে হবে। ভার নিয়া তুমি কী করছ—তাই আল্লায় দ্যাখবে।’
দুর্লভ থামেন না। ওদিকে সন্ধ্যা গভীর হয়ে আসে। যাওয়া দরকার। দুর্লভের হাতে জ্বলে থাকা কুপি থেকে ছড়ানো আলো খুব বেশি দূর গেল না। তাতে কী, চাঁদের ফালা বলে দিচ্ছে পূর্ণিমার দেরি নেই। কদিন আর! জ্যোৎস্নায় ভেসে যাবে লালনবাড়ি।
No comments