খোলা হাওয়া-বিরোধী দলের সংসদে যাওয়া by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
সোমবার ১৪ মার্চ সন্ধ্যায় বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ সংবাদ সম্মেলন করে জানালেন, ১৫ মার্চ থেকে বিএনপি এবং তার জোটগত মিত্ররা সংসদে যাবে। সোমবারই বিএনপির সংসদীয় দলের সভায় এই সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়। বাংলাদেশের সংকটবিদ্ধ গণতন্ত্রের জন্য বিরোধী দলের সংসদে ফেরার সিদ্ধান্তটি নিশ্চয় একটি সুসংবাদ। সংবাদপত্রগুলো থেকে
পরদিন জানা গেল, বিরোধীদলীয় নেত্রী তাঁর সাংসদদের অনুরোধ মেনে নিয়েই এই ইতিবাচক সিদ্ধান্তটি নেন। আমাদের দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলের নেত্রীরা তাঁদের দলের সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের অনুরোধ-উপদেশ খুব একটা আমলে নিয়েছেন—এ রকম উদাহরণ যেখানে বিরল, সেখানে সাংসদেরা সংসদে গিয়ে, বিএনপির এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও সাংসদ মওদুদ আহমদের ভাষায়, ‘জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো তুলে ধরার’ প্রত্যয় ব্যক্ত করতেই বেগম খালেদা জিয়া সংসদে না যাওয়ার তাঁর এত দিনের ধনুভাঙা পণ ভেঙে গণতন্ত্রের প্রতি আস্থার যে প্রকাশ ঘটালেন, সে জন্য তাঁকেও অভিনন্দন। দলের সাংসদেরা সংসদে ফিরতে চাইছেন, বিএনপির নেত্রীও রাজি হয়েছেন, তাতে নিশ্চয় প্রমাণিত হলো, দলটির ভেতর গণতন্ত্রের চর্চা নেই বলে নিন্দুকেরা এত দিন যা বলছে, তা সঠিক নয়। দলের ভেতর এ রকম গণতন্ত্র থাকলে দেশের সব গণতান্ত্রিক কাঠামোতে তার প্রতিফলন পড়তে বাধ্য। এবং এর ফলে অন্য বড় দল আওয়ামী লীগের ওপরও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চায় মনোযোগী হওয়ার জন্য চাপ পড়বে। ফলে আওয়ামী লীগের নেতাকেও তাঁর সাংসদদের উপদেশ-অনুরোধ শুনতে হবে। এবং এভাবে গণতন্ত্রচর্চা বাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে দলটি যখন বিরোধী দলে থাকবে এবং দেশ ও জাতির প্রয়োজনে সংসদ বর্জন করতে থাকবে এবং দীর্ঘদিন অনুপস্থিতির পর যখন তাঁর সাংসদদের খেয়াল হবে, ‘দেশ ও জনস্বার্থের পরিপন্থী বিভিন্ন ইস্যু এবং বিরোধী দলকে হেয়প্রতিপন্ন করা কোনো বিষয় বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেওয়া’ উচিত নয়, তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী তথা দলনেত্রীকে তাঁরা অনুরোধ জানালে তিনিও সম্মত হবেন। আজকে বিএনপির ভেতর গণতন্ত্রচর্চার এমন উদ্দীপনাময় উদাহরণ ভবিষ্যতেও আরেকটি দলকে গণতন্ত্রচর্চায় উজ্জীবিত করবে। এভাবেই তো গণতন্ত্র এগিয়ে যায়!
২.
আমরা যারা গণতন্ত্রকে কার্যকর দেখতে চাই, সংসদকে সক্রিয় দেখতে চাই এবং সব হানাহানি ও কথা-সন্ত্রাসের অবসান চাই, তারা বিরোধী দলের সংসদে ফেরার সিদ্ধান্তে পুলকিত। আমাদের পুলক বাড়িয়ে দিয়েছে বিএনপির প্রথম সারির কয়েকজন নেতার বক্তব্য। ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেছেন, ‘আমাদের সংসদে যোগ দেওয়া দরকার। সংসদকে কার্যকর করার ব্যাপারে বিরোধী দল হিসেবে আমাদের চেষ্টা করতে হবে।’ দেরিতে হলেও কী চমৎকার তাঁর এই উপলব্ধি! চিফ হুইপ জয়নাল আবদিন ফারুক বলেছেন, ‘দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে’ সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ‘সরকার জাতীয় ইস্যুতে বিরোধী দলকে কথা বলতে দিলে বিএনপি সংসদে থেকে দায়িত্ব পালন করতে চায়’ বলেও তিনি জনিয়েছেন। বিএনপির সভায় মোট ২৪ জন সাংসদ বক্তব্য দেন এবং তাঁদের অধিকাংশই সংসদে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ‘অধিকাংশ’দের বাইরে যে ‘অল্পাংশ’ সাংসদ না যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন, তাঁদের কথাগুলো অবশ্য কোনো কাগজ লেখেনি। লিখলে আমরা খুশি হতাম। তাঁদের নিশ্চয় কিছু যুক্তি ছিল। তার পরও গণতান্ত্রিক চেতনায় ‘অধিকাংশের’ মত যে জয়যুক্ত হলো, তাতে আমাদের মতো গণতন্ত্রমনারা আশ্বস্ত হলো। আমরা আশা করব, এখন থেকে সংসদ প্রাণবন্ত হবে, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বস্তুনিষ্ঠ বিতর্ক হবে এবং সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা হবে। যে দলটির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র এত শক্তিশালী, সে দল নিশ্চয় গণতন্ত্রের সব শর্ত মেনে সংসদে অংশগ্রহণ করবে। চিফ হুইপ তো নিজেই বলেছেন, ‘জাতীয় সংসদ আজ অকার্যকর। সরকারি দলের সাংসদেরাও সংসদে যোগদানের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।’ সে তো হারাবেনই। সরকারি দলের ভেতর তো গণতন্ত্রচর্চা বিএনপির মতো এতটা স্বাস্থ্যবান নয় যে দলনেত্রী সাংসদদের উপদেশ-অনুরোধ সব রাখবেন। অন্তত এখন পর্যন্ত। তবে বিএনপির এই উদাহরণ সৃষ্টির পর সরকারি দলে কী পরিবর্তন হয়, সেটি এখন আমরা দেখব।
সংসদীয় গণতন্ত্র বলে, বিরোধী দল সরকারেরই একটি অংশ। বিরোধী দলের একটি ছায়া সরকার থাকে। সেটি, বলতে গেলে একটি বিকল্প সরকারেরই চরিত্র গ্রহণ করে। সংসদীয় গণতন্ত্রের একধরনের অলিখিত বোঝাপড়া থাকে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে। সংসদই হয় সব আলোচনা-সমালোচনা-বিতর্ক-বিবাদের জায়গা। উন্নত গণতন্ত্রে রাস্তায় আন্দোলনের প্রয়োজন হয় না। রাস্তায় আন্দোলন দেশের জন্য ক্ষতিকর। রাস্তা গরম থাকে অনুন্নত গণতন্ত্রে। অনুন্নত গণতন্ত্রে কথায় কথায় ধর্মঘট হয়, হরতাল হয়। কারণ অনুন্নত গণতন্ত্রে ক্ষমতার আসনটি সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বস্তু। এটি শুধু ক্ষমতা দেয় না, দেয় অর্থ-বিত্ত এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং বংশানুক্রমে ক্ষমতা ভোগ ও প্রয়োগের সুযোগ। ফলে অনুন্নত গণতন্ত্রে যা কিছু হয়, তা ওই আসনকেন্দ্রিক। ব্যক্তি নয়, দল নয়, দেশ নয়—কেউ কিছু নয়, কোনো বিবেচনাই প্রধান নয়, বিবেচনা শুধু ওই একটি—ক্ষমতা তথা ক্ষমতার আসন। ফলে দেশ গোল্লায় যায়, মানুষের জীবনের স্বস্তি উবে যায়, অর্থনীতি-শিক্ষা-শিল্প-স্বাস্থ্য-সংস্কৃতি সব রসাতলে যায়; শুধু উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয় ক্ষমতার আসনের মহিমা, তার কারিশমা। আমরা যেন প্রকৃতিগতভাবেই, হয়তো বংশগতভাবেই অনুন্নত গণতন্ত্রের ক্রুদ্ধ এবং লাঠি হাতে ছুটে চলা পথযোদ্ধা—সামনে যা পাই ভাঙি। একবারও ভাবি না, কেন। ৪ এপ্রিল একটি হরতাল আসছে। শুনছি, বিএনপি থেকে বলা হচ্ছে, বিশ্বকাপ ক্রিকেটের পর হরতাল শুধু নয়, প্রয়োজনে লাগাতার হরতাল দেওয়া হবে। জাপানের জন্য বিপর্যয় বয়ে এনেছে ভূমিকম্প-সুনামি-পারমাণবিক বিস্ফোরণ; আমাদের জন্য আনবে ধর্মঘট-হরতাল-লাগাতার হরতাল। একটা দেশ শান্তিতে থাকবে, সেটি প্রকৃতিও চায় না।
এ রকম ঘনায়মান (এবং ঘনীভূত) সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির সংসদে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তে আমরা পুলকিত হয়েছি। ব্যারিস্টার সরকার যে বলেছেন, ‘সংসদকে কার্যকর করার ব্যাপারে’ দলটির চেষ্টা করতে হবে, তাতে নিশ্চয় সংসদ এমনভাবে পরিচালিত হবে, যাতে সরকারও বাধ্য হয় বিরোধী দলের যৌক্তিক দাবিগুলো শুনতে। সরকার অবশ্য গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করছে না। বিরোধী দল সংসদে এসে তার ভূমিকা পালন করুক—এ ব্যাপারে সরকার কতটা আন্তরিক, এই প্রশ্ন রয়েই যায়। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের আগে নিজে থেকেই বলেছিলেন, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হবেন। তা হয়নি। তা ছাড়া শুরুতে বিরোধী দল সংসদের সামনের সারিতে দুটি আসন চেয়েছিল। তাদের তা দেওয়া হয়নি। দুটি মাত্র আসন। দিলে এমন কী ক্ষতি হতো?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ একটি নিশানা পেয়ে যাই ওই ‘আসন’ শব্দটি থেকে। বটে, আসন! কে ছেড়ে দেবেন, তাঁর বহু সাধের আসন অন্য কাউকে, তাঁর দাবিটা জোরালো হলেও? ওই যে অনুন্নত গণতন্ত্রের কথা বলা হলো, যেখানে আসনকেন্দ্রিকতাই রাজনীতির নিয়ামক, সেখানে ছলে-বলে-কৌশলে যেকোনো উপায়েই আসন প্রাপ্তি এবং টিকিয়ে রাখাই তো আসল। এই যে বিএনপি মধ্যবর্তী নির্বাচন চাইছে, তা যতটা না চলমান নানা সংকট নিরসনের জন্য (এসব সংকট, যেমন—বিদ্যুৎ, গ্যাস, যানজট-সন্ত্রাসজনিত নানা সংকট জোট সরকারের আমলেও ছিল, ক্ষেত্রবিশেষে বেশিই ছিল এবং এখন জোটটি ক্ষমতায় গেলে এসব ক্ষেত্রে যে উন্নতি করবে, সে রকম ট্র্যাক রেকর্ড তো তার নেই) তার থেকে বেশি ওই মহা আসনের জন্য। সংসদে যাওয়ার ক্ষেত্রে আসল ইস্যু হচ্ছে আপাতত সংসদ সদস্যদের আসনগুলো টিকিয়ে রাখা।
একটি জাতীয় দৈনিকে পাঠকদের জন্য একটি জরিপের প্রশ্ন ছিল: বিএনপি কি এখন সংসদে যাচ্ছে ৯০ দিন একাদিক্রমে সংসদে অনুপস্থিতিজনিত কারণে আসন না হারানোর জন্য? প্রায় ৮৪ ভাগ পাঠক বলেছেন, হ্যাঁ, এই কারণে। তাহলে যে দলটি বলছে, দেশের স্বার্থে নানা ইস্যু নিয়ে কথা বলার জন্য সংসদে যাওয়ার এটাই উপযুক্ত সময়? হ্যাঁ, উপযুক্ত সময় এখনই, যেহেতু ৯০ দিনের গ্যাঁড়াকলে এখনই পড়তে হচ্ছে। ওটি অক্টোবরে হলে অক্টোবরই হতো উপযুক্ত সময়।
তাহলে কি এবারও ওই এক দিন-দুই দিন হাজিরা দিয়ে ওয়াকআউট হবে এবং এই দুই দিনেই ‘বিরোধী দল হিসেবে দায়িত্ব পালন করা’ হয়ে যাবে? হয়তো। কারণ চিফ হুইপ বলেছেন, ‘সরকারি দলের আচরণের ওপর নির্ভর করবে তাদের সংসদে থাকা।’ সরকারি দলের আচরণের পরিবর্তন হবে বলে আশা করাটা বৃথা। এটি ১৫ মার্চ যেমন থাকবে, ২৪ জুন তেমন থাকবে, ৯ অক্টোবরও তেমনই থাকবে। যে গণতন্ত্র দলকে এবং ব্যক্তিকে প্রধান করে, দেশকে নয়, সেই রাজনীতির তারাও ভাগীদার। ফলে সরকারের আচরণ উন্নত গণতন্ত্রের সরকারগুলোর মতো হবে; অর্থাৎ মনে যা থাকুক, আচরণে অন্তত সুশীল—সে সম্ভাবনা কম।
তাহলে কী হবে?
কী আবার হবে। ‘সরকার কথা বলতে দিচ্ছে না, তাই বেরিয়ে এসেছি’ বলে আরেকটি সংবাদ সম্মেলন হবে। এবং খুব শিগগিরই। এবং তারপর আবারও আরেক দফা ৯০ দিনের দিন গণনা। তত দিনে বেতন-ভাতা, ভিআইপি স্ট্যাটাস সবই চলবে, আগের মতোই।
তার পরও অন্তত একবার দলের সাংসদেরা একটা বিষয়ে যে একমত হলেন এবং সেটি মেনে নেওয়া হলো, এই গণতন্ত্রচর্চার জন্য দলটিকে অভিনন্দন। ৯০ দিনের হিসাবটা সামনে এসে দাঁড়ালেও সেটি অগ্রাহ্য করব। অভিনন্দনে কার্পণ্য করাটা খুবই অনুচিত।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
২.
আমরা যারা গণতন্ত্রকে কার্যকর দেখতে চাই, সংসদকে সক্রিয় দেখতে চাই এবং সব হানাহানি ও কথা-সন্ত্রাসের অবসান চাই, তারা বিরোধী দলের সংসদে ফেরার সিদ্ধান্তে পুলকিত। আমাদের পুলক বাড়িয়ে দিয়েছে বিএনপির প্রথম সারির কয়েকজন নেতার বক্তব্য। ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেছেন, ‘আমাদের সংসদে যোগ দেওয়া দরকার। সংসদকে কার্যকর করার ব্যাপারে বিরোধী দল হিসেবে আমাদের চেষ্টা করতে হবে।’ দেরিতে হলেও কী চমৎকার তাঁর এই উপলব্ধি! চিফ হুইপ জয়নাল আবদিন ফারুক বলেছেন, ‘দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে’ সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ‘সরকার জাতীয় ইস্যুতে বিরোধী দলকে কথা বলতে দিলে বিএনপি সংসদে থেকে দায়িত্ব পালন করতে চায়’ বলেও তিনি জনিয়েছেন। বিএনপির সভায় মোট ২৪ জন সাংসদ বক্তব্য দেন এবং তাঁদের অধিকাংশই সংসদে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ‘অধিকাংশ’দের বাইরে যে ‘অল্পাংশ’ সাংসদ না যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন, তাঁদের কথাগুলো অবশ্য কোনো কাগজ লেখেনি। লিখলে আমরা খুশি হতাম। তাঁদের নিশ্চয় কিছু যুক্তি ছিল। তার পরও গণতান্ত্রিক চেতনায় ‘অধিকাংশের’ মত যে জয়যুক্ত হলো, তাতে আমাদের মতো গণতন্ত্রমনারা আশ্বস্ত হলো। আমরা আশা করব, এখন থেকে সংসদ প্রাণবন্ত হবে, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বস্তুনিষ্ঠ বিতর্ক হবে এবং সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা হবে। যে দলটির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র এত শক্তিশালী, সে দল নিশ্চয় গণতন্ত্রের সব শর্ত মেনে সংসদে অংশগ্রহণ করবে। চিফ হুইপ তো নিজেই বলেছেন, ‘জাতীয় সংসদ আজ অকার্যকর। সরকারি দলের সাংসদেরাও সংসদে যোগদানের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।’ সে তো হারাবেনই। সরকারি দলের ভেতর তো গণতন্ত্রচর্চা বিএনপির মতো এতটা স্বাস্থ্যবান নয় যে দলনেত্রী সাংসদদের উপদেশ-অনুরোধ সব রাখবেন। অন্তত এখন পর্যন্ত। তবে বিএনপির এই উদাহরণ সৃষ্টির পর সরকারি দলে কী পরিবর্তন হয়, সেটি এখন আমরা দেখব।
সংসদীয় গণতন্ত্র বলে, বিরোধী দল সরকারেরই একটি অংশ। বিরোধী দলের একটি ছায়া সরকার থাকে। সেটি, বলতে গেলে একটি বিকল্প সরকারেরই চরিত্র গ্রহণ করে। সংসদীয় গণতন্ত্রের একধরনের অলিখিত বোঝাপড়া থাকে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে। সংসদই হয় সব আলোচনা-সমালোচনা-বিতর্ক-বিবাদের জায়গা। উন্নত গণতন্ত্রে রাস্তায় আন্দোলনের প্রয়োজন হয় না। রাস্তায় আন্দোলন দেশের জন্য ক্ষতিকর। রাস্তা গরম থাকে অনুন্নত গণতন্ত্রে। অনুন্নত গণতন্ত্রে কথায় কথায় ধর্মঘট হয়, হরতাল হয়। কারণ অনুন্নত গণতন্ত্রে ক্ষমতার আসনটি সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বস্তু। এটি শুধু ক্ষমতা দেয় না, দেয় অর্থ-বিত্ত এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং বংশানুক্রমে ক্ষমতা ভোগ ও প্রয়োগের সুযোগ। ফলে অনুন্নত গণতন্ত্রে যা কিছু হয়, তা ওই আসনকেন্দ্রিক। ব্যক্তি নয়, দল নয়, দেশ নয়—কেউ কিছু নয়, কোনো বিবেচনাই প্রধান নয়, বিবেচনা শুধু ওই একটি—ক্ষমতা তথা ক্ষমতার আসন। ফলে দেশ গোল্লায় যায়, মানুষের জীবনের স্বস্তি উবে যায়, অর্থনীতি-শিক্ষা-শিল্প-স্বাস্থ্য-সংস্কৃতি সব রসাতলে যায়; শুধু উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয় ক্ষমতার আসনের মহিমা, তার কারিশমা। আমরা যেন প্রকৃতিগতভাবেই, হয়তো বংশগতভাবেই অনুন্নত গণতন্ত্রের ক্রুদ্ধ এবং লাঠি হাতে ছুটে চলা পথযোদ্ধা—সামনে যা পাই ভাঙি। একবারও ভাবি না, কেন। ৪ এপ্রিল একটি হরতাল আসছে। শুনছি, বিএনপি থেকে বলা হচ্ছে, বিশ্বকাপ ক্রিকেটের পর হরতাল শুধু নয়, প্রয়োজনে লাগাতার হরতাল দেওয়া হবে। জাপানের জন্য বিপর্যয় বয়ে এনেছে ভূমিকম্প-সুনামি-পারমাণবিক বিস্ফোরণ; আমাদের জন্য আনবে ধর্মঘট-হরতাল-লাগাতার হরতাল। একটা দেশ শান্তিতে থাকবে, সেটি প্রকৃতিও চায় না।
এ রকম ঘনায়মান (এবং ঘনীভূত) সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির সংসদে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তে আমরা পুলকিত হয়েছি। ব্যারিস্টার সরকার যে বলেছেন, ‘সংসদকে কার্যকর করার ব্যাপারে’ দলটির চেষ্টা করতে হবে, তাতে নিশ্চয় সংসদ এমনভাবে পরিচালিত হবে, যাতে সরকারও বাধ্য হয় বিরোধী দলের যৌক্তিক দাবিগুলো শুনতে। সরকার অবশ্য গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করছে না। বিরোধী দল সংসদে এসে তার ভূমিকা পালন করুক—এ ব্যাপারে সরকার কতটা আন্তরিক, এই প্রশ্ন রয়েই যায়। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের আগে নিজে থেকেই বলেছিলেন, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হবেন। তা হয়নি। তা ছাড়া শুরুতে বিরোধী দল সংসদের সামনের সারিতে দুটি আসন চেয়েছিল। তাদের তা দেওয়া হয়নি। দুটি মাত্র আসন। দিলে এমন কী ক্ষতি হতো?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ একটি নিশানা পেয়ে যাই ওই ‘আসন’ শব্দটি থেকে। বটে, আসন! কে ছেড়ে দেবেন, তাঁর বহু সাধের আসন অন্য কাউকে, তাঁর দাবিটা জোরালো হলেও? ওই যে অনুন্নত গণতন্ত্রের কথা বলা হলো, যেখানে আসনকেন্দ্রিকতাই রাজনীতির নিয়ামক, সেখানে ছলে-বলে-কৌশলে যেকোনো উপায়েই আসন প্রাপ্তি এবং টিকিয়ে রাখাই তো আসল। এই যে বিএনপি মধ্যবর্তী নির্বাচন চাইছে, তা যতটা না চলমান নানা সংকট নিরসনের জন্য (এসব সংকট, যেমন—বিদ্যুৎ, গ্যাস, যানজট-সন্ত্রাসজনিত নানা সংকট জোট সরকারের আমলেও ছিল, ক্ষেত্রবিশেষে বেশিই ছিল এবং এখন জোটটি ক্ষমতায় গেলে এসব ক্ষেত্রে যে উন্নতি করবে, সে রকম ট্র্যাক রেকর্ড তো তার নেই) তার থেকে বেশি ওই মহা আসনের জন্য। সংসদে যাওয়ার ক্ষেত্রে আসল ইস্যু হচ্ছে আপাতত সংসদ সদস্যদের আসনগুলো টিকিয়ে রাখা।
একটি জাতীয় দৈনিকে পাঠকদের জন্য একটি জরিপের প্রশ্ন ছিল: বিএনপি কি এখন সংসদে যাচ্ছে ৯০ দিন একাদিক্রমে সংসদে অনুপস্থিতিজনিত কারণে আসন না হারানোর জন্য? প্রায় ৮৪ ভাগ পাঠক বলেছেন, হ্যাঁ, এই কারণে। তাহলে যে দলটি বলছে, দেশের স্বার্থে নানা ইস্যু নিয়ে কথা বলার জন্য সংসদে যাওয়ার এটাই উপযুক্ত সময়? হ্যাঁ, উপযুক্ত সময় এখনই, যেহেতু ৯০ দিনের গ্যাঁড়াকলে এখনই পড়তে হচ্ছে। ওটি অক্টোবরে হলে অক্টোবরই হতো উপযুক্ত সময়।
তাহলে কি এবারও ওই এক দিন-দুই দিন হাজিরা দিয়ে ওয়াকআউট হবে এবং এই দুই দিনেই ‘বিরোধী দল হিসেবে দায়িত্ব পালন করা’ হয়ে যাবে? হয়তো। কারণ চিফ হুইপ বলেছেন, ‘সরকারি দলের আচরণের ওপর নির্ভর করবে তাদের সংসদে থাকা।’ সরকারি দলের আচরণের পরিবর্তন হবে বলে আশা করাটা বৃথা। এটি ১৫ মার্চ যেমন থাকবে, ২৪ জুন তেমন থাকবে, ৯ অক্টোবরও তেমনই থাকবে। যে গণতন্ত্র দলকে এবং ব্যক্তিকে প্রধান করে, দেশকে নয়, সেই রাজনীতির তারাও ভাগীদার। ফলে সরকারের আচরণ উন্নত গণতন্ত্রের সরকারগুলোর মতো হবে; অর্থাৎ মনে যা থাকুক, আচরণে অন্তত সুশীল—সে সম্ভাবনা কম।
তাহলে কী হবে?
কী আবার হবে। ‘সরকার কথা বলতে দিচ্ছে না, তাই বেরিয়ে এসেছি’ বলে আরেকটি সংবাদ সম্মেলন হবে। এবং খুব শিগগিরই। এবং তারপর আবারও আরেক দফা ৯০ দিনের দিন গণনা। তত দিনে বেতন-ভাতা, ভিআইপি স্ট্যাটাস সবই চলবে, আগের মতোই।
তার পরও অন্তত একবার দলের সাংসদেরা একটা বিষয়ে যে একমত হলেন এবং সেটি মেনে নেওয়া হলো, এই গণতন্ত্রচর্চার জন্য দলটিকে অভিনন্দন। ৯০ দিনের হিসাবটা সামনে এসে দাঁড়ালেও সেটি অগ্রাহ্য করব। অভিনন্দনে কার্পণ্য করাটা খুবই অনুচিত।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments