চারদিক-উত্তরের পথে পথে by মোকারম হোসেন
অনেকটা অন্ধকারের মধ্যেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। ভোরের আলোর জন্য অপেক্ষা করার সময় নেই। রাতেই ব্যাটারিচালিত রিকশাকে বলে রাখা হয়েছে। সাতজনের ছোটখাটো দলটি ছুটে চলল রেলস্টেশনের দিকে। দিনের কর্মব্যস্ত চেনা শহরটি এখন অচেনা। স্টেশনটি বেশ পরিপাটি, ছিমছাম। যথাসময়ে ছাড়ল ট্রেন।
আন্তনগর ট্রেন হলেও গতি মন্থর। আবদুলপুর গিয়ে ট্রেনের গতিমুখ পরিবর্তিত হলো। শুরু হলো মূল যাত্রা। ডা. আকতারুল আলমের নিয়ে আসা নাশতা সবাই বেশ আয়েশ করে খেলাম। দুই পাশের মায়াবী দৃশ্য দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল জানালার ফ্রেম থেকে। বিরান মাঠে পৌষের সোনারোদ খেলা করে। কোথাও কোথাও চলছে নাড়া পোড়ানোর আয়োজন। এসব দেখতে দেখতে আমরা পেরিয়ে যাচ্ছি গ্রামের পর গ্রাম, হাটবাজার, লোকালয়, খাল-বিল-নদী।
এই ভ্রমণের মূল পরিকল্পক খন্দকার যুবায়ের হাসান অনেকটা আকস্মিকভাবেই ওপরের বাংকারে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারলেন বলে মনে হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেনে যাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকল। এই বাড়তি সংখ্যাটি কিছুক্ষণের মধ্যে ভয়াবহ রূপ নিল। ট্রেন নয়, যেন জনসমুদ্র! তার পরের দৃশ্য আরও অস্বাভাবিক। কারণ, সামনেই হিলি সীমান্ত। ট্রেন যাচ্ছিল একেবারে সীমান্তের নো-ম্যানস-ল্যান্ড ঘেঁষে। হাত বাড়ালেই ভারত। এমন মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় থাকে দুই দেশের চোরাকারবারিরা। একটি নির্দিষ্ট এলাকায় প্রবেশমাত্রই ট্রেনটি জাদুমন্ত্রের মতো গতি কমিয়ে দিল। আর অমনি ভারতীয় মালপত্র নিয়ে ছুটে এল অসংখ্য নারী-পুরুষ। ছুড়ে দিল ট্রেনে থাকা চরদের হাতে। নিজের চোখে যা দেখলাম, তা বর্ণনাতীত। যারা এ পথের নিয়মিত যাত্রী, দৃশ্যটি তাঁদের পরিচিত হলেও আমি কিছুটা ধাক্কাই খেলাম। এই আত্মঘাতী কাজটির সঙ্গে রেলের লোক থেকে শুরু করে বর্ডার গার্ডের লোক পর্যন্ত সবাই জড়িত বলেই মনে হলো। দিনাজপুরের ফুলবাড়ী স্টেশন হয়ে আমরা অবশেষে সৈয়দপুরে পৌঁছালাম। জেলা শহর না হলেও বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর। দুপুরের খাবারটা সেখানেই সারলাম। আগে থেকেই একটি মাইক্রোবাস ভাড়া করা হয়েছিল। সেই গাড়িটি আমাদের তেঁতুলিয়ায় নিয়ে যাবে। ছুটে চলছে গাড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যেই শান্ত শহর নীলফামারী অতিক্রম করলাম আমরা। কিছুক্ষণের জন্য নীলসাগর থামলাম। পাড়বাঁধানো বিশাল এক দিঘি। যারা কখনো সাগর দেখেনি, তাদের জন্য সাগর! চারপাশ বেশ সুরক্ষিত। আকতার ভাই দোকান দেখেই চা পানের উদ্দেশ্যে বসে পড়লেন। দিঘিটি ঘুরে দেখার কোনো ইচ্ছেই তাঁর নেই। আমরা পাড় ধরে হাঁটতে শুরু করি। পরিকল্পিতভাবে অনেক গাছ লাগানো হয়েছে। পর্যটকদের অধিকাংশই স্থানীয়। হঠাৎ করে দিঘির আরেক প্রান্তে টলটলে নীল জলের বুকে কালো একটি রেখার নড়াচড়া দেখে পুলকিত হয়ে উঠি। প্রিয় ও পান্থ চেঁচিয়ে বলল, পাখি! পাখি! ইশারা করে ওদের চুপ থাকতে বললাম। বিরক্ত হলে ওরা উড়ে যেতে পারে। অতিথি পাখির একটা ঝাঁক নেমেছে এখানে। চুপি চুপি খুব কাছে গিয়ে ছবি তুললাম। দিঘির শান্ত জলে রাজসিক ভঙ্গিতে চরে বেড়াচ্ছে ওরা। আমরা দিঘির চারপাশ একচক্কর ঘুরে বেরিয়ে এলাম। তারপর আবার ছুটে চলা। পেরিয়ে যাচ্ছি একের পর এক অচেনা গ্রাম, জনপদ, সবুজের সমারোহ। মাঝেমধ্যে রংবেরঙের সেচপাইপগুলো মাথা তুলে আছে শস্যের মাঠে। কিছুক্ষণ পর শুরু হলো গান। বেড়াতে গেলে বয়সের ব্যবধান থাকে না। যুবায়ের ভাইয়ের সঙ্গে সবাই সুর মেলাল। কিন্তু আমাদের এই বেসুরো সংগীতায়োজন আকতার ভাইয়ের আরামের ঘুম নষ্ট করায় তিনি কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়ে শিল্পীদের ওপর অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। বিকেলের রংমাখা পঞ্চগড় শহর পেছনে ফেলে আমরা ক্রমাগত সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে যাই। এদিকে এখন আর আগের মতো ভাঙাচোরা পথ নয়, একেবারে মসৃণ ঝকঝকে পথ। তেঁতুলিয়া ঢোকার মুখে শান্ত গোবরা নদী আমাদের স্বাগত জানাল। তখন সন্ধ্যার আয়োজনে ব্যস্ত প্রকৃতি।
তেঁতুলিয়ায় পৌঁছালাম সন্ধ্যার পরে। একটি দোতলা ছিমছাম বাগানবাড়ি। সেখানেই আমাদের থাকার আয়োজন। এখানে শীত মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে। বাড়িটি যুবায়ের হাসানের এক আত্মীয়ের। সেই সুবাদে সব ব্যবস্থাই পাকাপোক্ত। আটটার মধ্যে রাতের খাবার শেষ। এদিকে এটাই নিয়ম। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তো ঘুম আসবে না। টিভিও নেই। অগত্যা ঘুমানোর চেষ্টা ছাড়া উপায় কী?
সকালে একটু তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে উঠতে হলো। জানা গেল যে আমাদের ভ্রমণসূচি আংশিক পরিবর্তন করা হয়েছে। দুপুরের মধ্যেই দিনাজপুরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়তে হবে। সেখানে যুবায়ের ভাইদের একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা। এই জরুরি এলানটা পাওয়া গেল আকতার ভাইয়ের কাছ থেকে। তিনি অতি প্রত্যুষে উঠেই নাশতার জন্য বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। প্রিয়কেও তাঁর আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেল। বয়সে ছোট হলেও প্রিয় খাবারের ক্ষেত্রে তাঁর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী! হাতে সময় বেশি নেই। তেঁতুলিয়ায় কয়েক ঘণ্টার জন্য ঝটিকা সফর। এদিকে এখন অনেকগুলো চা-বাগান। কেউ কেউ কমলাবাগানও করেছেন। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো কিছুটা হলেও এটা আমাদের চাহিদা মেটাবে। তেঁতুলিয়া বাজার পেরিয়ে এলে বাঁ পাশে ভারত সীমান্ত। কাঁটাতারের বেড়া, ওয়াচ টাওয়ার। ডাহুক নদী আর আজিজনগর গ্রাম হয়ে আমরা চলে গেলাম একেবারে বাংলাবান্ধা সীমান্তে। ওপাশে মহানন্দা নদী। বাংলাদেশের এই ছোট্ট অংশটুকু তিন পাশ থেকে ঘিরে রেখেছে ভারত। এদিকটায় ঘরবাড়ি খুব একটা নেই। আগের তুলনায় রাস্তা অনেক ভালো। মাঝখানে একটি খুঁটি কিংবা কাঁটাতারের বেড়া। দুই পাশের মানুষ পরিচয়ে বাঙালি। ভাষা ও সংস্কৃতি, বর্ণ, গন্ধ, চেহারা একই। দুই পাশের গাছপালা, মাটির রংও অভিন্ন। তবু তারা আলাদা পরিচয়ে বেঁচে থাকে। ভূগোল মানুষকে আলাদা করে দেয়।
এই ভ্রমণের মূল পরিকল্পক খন্দকার যুবায়ের হাসান অনেকটা আকস্মিকভাবেই ওপরের বাংকারে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারলেন বলে মনে হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেনে যাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকল। এই বাড়তি সংখ্যাটি কিছুক্ষণের মধ্যে ভয়াবহ রূপ নিল। ট্রেন নয়, যেন জনসমুদ্র! তার পরের দৃশ্য আরও অস্বাভাবিক। কারণ, সামনেই হিলি সীমান্ত। ট্রেন যাচ্ছিল একেবারে সীমান্তের নো-ম্যানস-ল্যান্ড ঘেঁষে। হাত বাড়ালেই ভারত। এমন মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় থাকে দুই দেশের চোরাকারবারিরা। একটি নির্দিষ্ট এলাকায় প্রবেশমাত্রই ট্রেনটি জাদুমন্ত্রের মতো গতি কমিয়ে দিল। আর অমনি ভারতীয় মালপত্র নিয়ে ছুটে এল অসংখ্য নারী-পুরুষ। ছুড়ে দিল ট্রেনে থাকা চরদের হাতে। নিজের চোখে যা দেখলাম, তা বর্ণনাতীত। যারা এ পথের নিয়মিত যাত্রী, দৃশ্যটি তাঁদের পরিচিত হলেও আমি কিছুটা ধাক্কাই খেলাম। এই আত্মঘাতী কাজটির সঙ্গে রেলের লোক থেকে শুরু করে বর্ডার গার্ডের লোক পর্যন্ত সবাই জড়িত বলেই মনে হলো। দিনাজপুরের ফুলবাড়ী স্টেশন হয়ে আমরা অবশেষে সৈয়দপুরে পৌঁছালাম। জেলা শহর না হলেও বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর। দুপুরের খাবারটা সেখানেই সারলাম। আগে থেকেই একটি মাইক্রোবাস ভাড়া করা হয়েছিল। সেই গাড়িটি আমাদের তেঁতুলিয়ায় নিয়ে যাবে। ছুটে চলছে গাড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যেই শান্ত শহর নীলফামারী অতিক্রম করলাম আমরা। কিছুক্ষণের জন্য নীলসাগর থামলাম। পাড়বাঁধানো বিশাল এক দিঘি। যারা কখনো সাগর দেখেনি, তাদের জন্য সাগর! চারপাশ বেশ সুরক্ষিত। আকতার ভাই দোকান দেখেই চা পানের উদ্দেশ্যে বসে পড়লেন। দিঘিটি ঘুরে দেখার কোনো ইচ্ছেই তাঁর নেই। আমরা পাড় ধরে হাঁটতে শুরু করি। পরিকল্পিতভাবে অনেক গাছ লাগানো হয়েছে। পর্যটকদের অধিকাংশই স্থানীয়। হঠাৎ করে দিঘির আরেক প্রান্তে টলটলে নীল জলের বুকে কালো একটি রেখার নড়াচড়া দেখে পুলকিত হয়ে উঠি। প্রিয় ও পান্থ চেঁচিয়ে বলল, পাখি! পাখি! ইশারা করে ওদের চুপ থাকতে বললাম। বিরক্ত হলে ওরা উড়ে যেতে পারে। অতিথি পাখির একটা ঝাঁক নেমেছে এখানে। চুপি চুপি খুব কাছে গিয়ে ছবি তুললাম। দিঘির শান্ত জলে রাজসিক ভঙ্গিতে চরে বেড়াচ্ছে ওরা। আমরা দিঘির চারপাশ একচক্কর ঘুরে বেরিয়ে এলাম। তারপর আবার ছুটে চলা। পেরিয়ে যাচ্ছি একের পর এক অচেনা গ্রাম, জনপদ, সবুজের সমারোহ। মাঝেমধ্যে রংবেরঙের সেচপাইপগুলো মাথা তুলে আছে শস্যের মাঠে। কিছুক্ষণ পর শুরু হলো গান। বেড়াতে গেলে বয়সের ব্যবধান থাকে না। যুবায়ের ভাইয়ের সঙ্গে সবাই সুর মেলাল। কিন্তু আমাদের এই বেসুরো সংগীতায়োজন আকতার ভাইয়ের আরামের ঘুম নষ্ট করায় তিনি কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়ে শিল্পীদের ওপর অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। বিকেলের রংমাখা পঞ্চগড় শহর পেছনে ফেলে আমরা ক্রমাগত সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে যাই। এদিকে এখন আর আগের মতো ভাঙাচোরা পথ নয়, একেবারে মসৃণ ঝকঝকে পথ। তেঁতুলিয়া ঢোকার মুখে শান্ত গোবরা নদী আমাদের স্বাগত জানাল। তখন সন্ধ্যার আয়োজনে ব্যস্ত প্রকৃতি।
তেঁতুলিয়ায় পৌঁছালাম সন্ধ্যার পরে। একটি দোতলা ছিমছাম বাগানবাড়ি। সেখানেই আমাদের থাকার আয়োজন। এখানে শীত মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে। বাড়িটি যুবায়ের হাসানের এক আত্মীয়ের। সেই সুবাদে সব ব্যবস্থাই পাকাপোক্ত। আটটার মধ্যে রাতের খাবার শেষ। এদিকে এটাই নিয়ম। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তো ঘুম আসবে না। টিভিও নেই। অগত্যা ঘুমানোর চেষ্টা ছাড়া উপায় কী?
সকালে একটু তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে উঠতে হলো। জানা গেল যে আমাদের ভ্রমণসূচি আংশিক পরিবর্তন করা হয়েছে। দুপুরের মধ্যেই দিনাজপুরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়তে হবে। সেখানে যুবায়ের ভাইদের একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা। এই জরুরি এলানটা পাওয়া গেল আকতার ভাইয়ের কাছ থেকে। তিনি অতি প্রত্যুষে উঠেই নাশতার জন্য বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। প্রিয়কেও তাঁর আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেল। বয়সে ছোট হলেও প্রিয় খাবারের ক্ষেত্রে তাঁর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী! হাতে সময় বেশি নেই। তেঁতুলিয়ায় কয়েক ঘণ্টার জন্য ঝটিকা সফর। এদিকে এখন অনেকগুলো চা-বাগান। কেউ কেউ কমলাবাগানও করেছেন। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো কিছুটা হলেও এটা আমাদের চাহিদা মেটাবে। তেঁতুলিয়া বাজার পেরিয়ে এলে বাঁ পাশে ভারত সীমান্ত। কাঁটাতারের বেড়া, ওয়াচ টাওয়ার। ডাহুক নদী আর আজিজনগর গ্রাম হয়ে আমরা চলে গেলাম একেবারে বাংলাবান্ধা সীমান্তে। ওপাশে মহানন্দা নদী। বাংলাদেশের এই ছোট্ট অংশটুকু তিন পাশ থেকে ঘিরে রেখেছে ভারত। এদিকটায় ঘরবাড়ি খুব একটা নেই। আগের তুলনায় রাস্তা অনেক ভালো। মাঝখানে একটি খুঁটি কিংবা কাঁটাতারের বেড়া। দুই পাশের মানুষ পরিচয়ে বাঙালি। ভাষা ও সংস্কৃতি, বর্ণ, গন্ধ, চেহারা একই। দুই পাশের গাছপালা, মাটির রংও অভিন্ন। তবু তারা আলাদা পরিচয়ে বেঁচে থাকে। ভূগোল মানুষকে আলাদা করে দেয়।
No comments